বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি.... ২৩


অবিশ্বাস সন্দেহ মানুষের চিত্তলোককে আচ্ছন্ন করার চেষ্টা করে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের দ্বন্দ্বে অন্তর হয়, ছিন্নভিন্ন, অবিচলিত থাকে সংকল্প ও সাধনা, অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একদিন আসে জীবনের পরম লগ্নজয়ের গৌরব, যা শ্রীগুরুর চরম দান। দিন যায় দিন আসে। সবাই ছুটছে স্বর্ণ-মরীচিকার পিছনে। কিন্তু চিন্তা করতে হবে জীবিকার অন্বেষণের চেয়ে জীবনের অন্বেষণ অনেক মহত্তর। সুখ ও সম্পদ জীবন ধারণের সামান্য উপকরণ। অতি সংকীর্ণ তার পরিধি, ক্ষণভঙ্গুর তার দান। আর জীবনের লক্ষ্য অন্বেষণ মানুষকে দেয় শাশ্বত পরমসত্যের সন্ধান, মৃত্যুতোরণ উত্তরণের উত্তরাধিকার সকল ক্ষয়ক্ষতির ঊর্ধ্বে এক দুর্লভ অমর জীবন। দেহ একদিন যাবে মাটির ভিতরে। একে কেন্দ্র করে স্বপ্ন-নীড় রচনা করা ভোগ-সহায়ক। এই দেহের মধ্যে আমি-র অস্তিত্ব কোথায়! আত্মাতেই আমি-র অস্তিত্ব, সেই অব্যক্ত আত্মাকে করে ব্যক্ত, অনুভব করে সেই সাধনায় নিয়ন্ত্রিত হোক আমি-র গতি ও প্রকৃতি। অকপট, অক্লান্ত যার সাধনা সেই হতে পারে দিব্যজীবনের অধিকারী। প্রকৃতির সকল ঐশ্বর্য প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে; কিন্তু তারা আত্মবিস্মৃত তাই এত দুঃখ, এত নৈরাশ্য। মোহ মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে অন্ধকারের কঠিন অবরোধে, তাই রুদ্ধ গতি-শক্তির মুক্তধারা। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে মহাশক্তি ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগিয়ে তোলাইতো সাধনা। অসামান্য হয়ে উঠে জীবন। প্রয়োজন অশেষ দুঃখ বরণ, অসীম ত্যাগ ও অনন্ত ধৈর্যধারণ। অতীতের পানে ফিরে তাকানো, সামনে সত্যের আলোড়ন, নন্দনের আনন্দ সংবাদ। এই আমি-র আমিত্বগুলোকে শুধু নিয়ন্ত্রণ বা ভুলে যাওয়া, শুধু নিজকে সত্যের মাঝে বিলিয়ে দেয়া শ্রীগুরুর কৃপায়। 
সেবায় ধন্য ও পুণ্য হয় জীবন। রৌদ্রতাপে পুড়ে, বর্ষধারায় ভিজে, কঠোর পরিশ্রম করে চেতনার মাটিতে সোনার ফসল ফলানো, কোন দুঃখবরণ না করে, সে কি হয়? মহৎ কিছু পেতে হলে মূল্য দিতেই হবে, সইতে হবে অনেক দুঃখের তাপ, প্রতীক্ষার প্রহর কেটে যাবে, এরপর শুধু হাসি আর হাসি, আসবে উজ্জ্বল ফসলের কাল-পাবে অমূল্য রতন। শ্রীগুরুর উপদেশের ভিতর দিয়েই পাওয়া যায় দুর্লভের সন্ধান, লালন আর পালনের মাধ্যমে আবাদ করতে হয় সোনার ফসল-একাত্মতা। যে যতো দুঃখ সইতে পারে, সে ততো আনন্দ পাবার অধিকারী। এতো দুঃখ, এতো কান্না, যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে কেন পেতে হয় পরম জীবনকে? এ না হলে পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ ও গৌরব থাকে না; এ ছাড়া সুলভ যা মানুষ সহজে তাকে হারায়। মানুষ তাকে ধরে রাখে না। সেজন্য মূল্য জানিয়ে শ্রীগুরু তার দুর্লভ ধন ভক্তের হাতে তুলে দেন। যারা সুখে থাকে তারা পায় কি? ওরা খাঁচার পাখির মতো। ওদের গায়ে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ের ঝাপটা লাগে না, কিন্তু ওরা কি অন্তহীন আকাশের নীলিমাকে এমন অবাধ করে পায়? এতো আলো, আলোর অমৃত, অক্লান্ত বনের সবুজ ডেকে ডেকে রাত্রিশেষে বনে ফোটায় আলোর ফুল! 
দুঃখ জীবনকে মহৎ কিছু দেয়, তবে সে দুঃখ বরণ করতে ভয় কেন? একটা লক্ষ্যভিত্তিক নিয়মের অধীন হয়ে না চললে জীবন গঠন হয় না। যেদিন ভাল লাগল, সেদিন তাঁকে অর্থাৎ শ্রীগুরুকে স্মরণ করবো আর যেদিন ভালো লাগল না, সেদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবো, অলস সুখে ঝরে পড়বে মুহূর্তের অফোটা কুঁড়ি, বৃথা জল্পনায় কাটবে দিন এ সমীচীন নয় মোটেই। সামান্য সাড়ে তিনহাত শরীর, তার পুষ্টি ও পরিণতির জন্য কত খাবার, কত যত্ন ও সেবার প্রয়োজন হয়, আর যে অসীম, যার গতির শেষ নেই, অশেষ যার রহস্য, প্রচন্ড শক্তি তার পরিচয় পাবে, পূর্ণায়ত একটি পদ্মের মতো ঘটবে তার সুচারু প্রকাশ। এজন্য চাই তীব্র ত্যাগ এবং দীর্ঘ একরৈখিক সাধনা। বহু সংস্কার নিয়ে গঠিত যে জীবন একদিনে তার দিব্য রূপান্তর অসম্ভব। অস্থির জীবন, মৃত্যু যার অনিবার্য পরিণতি, অকারণে তাকে নষ্ট না করে, কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে কোনো মহৎ আদর্শের বেদীতলে তা নিঃশেষে নিবেদন করাইতো বুদ্ধিমানের কাজ। এখানে জয় ও পরাজয় দুই-ই গৌরবময়। বিফলতার মধ্যেও থাকে সার্থকতা। একাত্মতা-সিদ্ধির চূড়ায় পৌঁছান না গেলেও অগ্রগতির পথে বহু সোপান অতিক্রম করা হয়। ধৈর্যই আমি-ধর্মের উপলব্ধি। তিল তিল করে আহরণ করতে হয় অমর জীবন। কোনো দুঃখে, কোনো লোভে, কোনো বেদনায় যে বিচলিত হয় না সে-ই পায় উত্তরাধিকার। পথিক হলেই দুঃখ, কণ্টকিত হবে পথ। এরই ভিতর দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। ভয় নয়, সঙ্গে রয়েছে তাঁর অর্থাৎ একাত্মতায় শ্রীগুরুশক্তি জীবন বিকাশের বহ্নিমন্ত্র।
জীবনকে যা ধারণ করে থাকে সেখানেই আছে ধর্ম। চিন্তাজগতের সর্বাত্মক প্রকর্ষ ধর্মেরই নামান্তর। ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত রয়েছে চিন্তাজগতে। জীবনের গভীরে বিদ্যমান এর অস্তিত্ব। গুরুর যাত্রাপথই প্রকৃত ধর্মপথ যা অনুস্মরণীয়। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক বাংলার এক অনন্য ধর্মাচার্য সত্যমানুষ শ্রীগুরু। সত্যান্দোলনের তিনি প্রবর্তক। ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের তিনি যুগনায়ক। ইতিহাস তাঁকে সৃষ্টি করেনি, ইতিহাসের তিনি গ্রষ্টা। তাঁর প্রেম-সত্য-শান্তি ধর্ম থেকে বাঙালি পেয়েছে কর্ম-মানবতা-শান্তির পথে আত্মিক, আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতির দিক্-নির্দেশনা। তিনি চেয়েছেন চেতনার জগতে আত্মউপলব্ধিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক প্রতিটি মানুষ। বাঙালির মধ্যে তিনি এনে দিয়েছেন পূর্ণাঙ্গ সত্যমানুষের প্রত্যয়, তাঁর বাণীগুলো পথ দেখায় কিভাবে পাখির মতো খোলস ভেঙে বেরিয়ে এসে বাঙালি মাটির থেকে অনেক দূরে অসীম দিগন্তে উড়তে শিখতে পারে। মানবিকতার বেদীমূলে প্রতিষ্ঠিত তাঁর ধর্ম মূলতঃ সত্যের সাথে একাত্মতা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন