শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

সময়ের সাফ কথা…. 

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা

সংলাপ ॥ বাঙালিরা সহিষ্ণুতাতে বিশ্বাস করেন, বাঙালিরা সব ধর্মতেই সত্য বিদ্যমান বলে বিশ্বাস করেন। এ কেবল কথার কথা নয়। বাংলাদেশে প্রত্যেক জনপদে ধর্মীয় বিচিত্র অনুষ্ঠান হয়, শুধু কোনও একটা ধর্মের জন্য করা হয় না। বাঙালি  নিজের ধর্মের প্রশংসা, আর অপরের ধর্মের নিন্দা করেন না। বাঙালিরা ভাল করেই জানেন, যে যতো বেশি নিজের ধর্মের প্রশংসা করে, তার ধর্ম ততো অন্তরে শুকিয়ে যায়। নিজের শ্রেণী, গোষ্ঠীর  প্রশংসা করা ঠিক না এবং নৈতিক আত্মশ্লাঘা অসহিষ্ণুতার মূল এটাও বাঙালি জাতি উপলব্ধি করেন।
পরধর্মের নিন্দা করা না। যদিও সে ধর্মে অসহিষ্ণুতা আছে বলে জানা যায়, তবুও না। বাংলাদেশে আজ সব ধর্মাবলম্বীদের একাংশ  যা করছেন, তা এর বিপরীত। অপর সকল ধর্ম, নীতি, আনুষ্ঠানিকতা তারা নির্বিচারে নস্যাৎ করছেন। ভয় ছড়াচ্ছেন অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায় সন্বন্ধে। ধর্মের হিসেব-কষা লোকদের বলা হয়ে থাকে ধর্মবণিক বা ধর্মজীবি, যে ধর্ম বেঁচে খায়। কার বেশি, কার কম, এটা ধর্মের বিষয় নয়। যে ধর্ম আচরণ করে, সে তা নিয়ে চিন্তা করে না।
ধর্ম রক্ষার জন্যও অপর ধর্মকে আঘাত করা চলে না। নিজের জীবনে ধর্ম রক্ষা। ধর্মাচরণ থেকে বিচ্যুত না হওয়া। বিধর্মীর হাত থেকে ধর্মকে রক্ষা করার কথা বলা হয়নি। নিজের জীবনে নৈতিক ধর্ম আচরণ করলে ধর্মই তাকে এবং তার সমাজকে রক্ষা করে।
হিংসা না করে কেউ থাকতে পারে না। ধর্ম আনৃশংস্য। নৃশংস – যে সবাইকে ক্ষুধার্ত দেখে নিজে চর্বচোষ্য খায়। অসাম্য সহ্য করাই নৃশংসতা। ‘ধর্ম’-র এক বৈশিষ্ট হলো, উৎকট অসাম্য সহ্য না করা। সমতাই যোগ। সমতা সব রুচি বা পন্থার বৈচিত্র, বৈশিষ্ট্য লোপ করে একই ছাঁচে কোটি কোটি লোককে দিয়ে ধর্মধ্বজী কুচকাওয়াজ করানো নয়।
ব্যক্তির ধর্মাচরণ সমাজকে রক্ষা করে। ধর্মাচরণ মানে কেবল দিবা-রাত্রি  প্রার্থনা নয়। অন্যের প্রতি আমার কী আচরণ হবে, বলে দেয় ধর্ম। ব্যক্তির সন্তোষ ও প্রসন্নতার উপায় – মৈত্রী, করুণা, নির্লিপ্তততা এবং উপেক্ষা। সমানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, মিত্রতা। দুঃখী, হীনবলের প্রতি তাচ্ছিল্য ও উদাসীনতা নয়, করুণা। অধিক সম্পন্নের প্রতি ঈর্ষা নয়, আনন্দিত চিত্তে  তার সাফল্যের উদযাপন এবং নৈতিক দৃষ্টিতে যে হীন, তার প্রতি ঔদাসীন্য। অন্য লোক কতটা দুষ্টচরিত্র তা নিয়ে উত্তেজিত না হওয়া। তার অপরাধের শাস্তির ভার প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থার। সেখানে জানালেই যথেষ্ট, শাস্তির দায়িত্ব নেয়ার অধিকার কোন ধর্মাবলম্বীর নেই।
দেশে যখন ধর্মীয় লেবাসধারীরা রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন ব্যাপক ভাবে, ধর্মজীবিরা বহুজাতিক বিশ্ববণিকদের আঁতাতে গড়ে ওঠা পরধর্মদ্বেষী রাজনীতিককুলের জিঘাংসু ‘স্বাজাত্যবোধ’-এর ঝড়ে শহর-গ্রামে বাংলাদেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ঘরে-ঘরে নির্লোভ অতিথিপরায়ণ গৃহস্থের সন্ধ্যাপ্রদীপগুলো নিবু নিবু, তখন ধর্মীয় চিন্তাবিদদের ‘ধর্ম রক্ষা’র পথ নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে, এটাই সময়ের দাবী।
মসজিদ ভেঙে মন্দির বা মন্দির ভেঙে  মসজিদ বানালে ধর্ম রক্ষা হয় না, এমনকী যদি সেই মসজিদ বা মন্দির কোনও কালে ভেঙেও তৈরি হয়ে থাকে। প্রতিদিন কাউকে ঈর্ষা না করার সংযম, কারও আঘাত না দিয়ে সত্য কথা বলা, এক আল্লাহ্ নামকীর্তনের দ্বারা সর্বজীবের কল্যাণ কামনা করলে ধর্ম রক্ষা হয়। এই রকম ধর্মকে নিজেদের জীবনচর্যায় বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রতিবেশী ভিন্নধর্মীয় সংস্কৃতি, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে সাগ্রহে সশ্রদ্ধভাবে জানবার চেষ্টা করা শ্রেয়। নিজের ধর্মের ‘পাষ-’দের অন্যায় ও ত্রুটিগুলোর প্রতিবাদ করতে হয়। নিজের জাতি, বর্ণ, শ্রেণী, বর্গকে প্রশংসা করাটা স্ব-ধর্মনিষ্ঠার লক্ষণ নয়। ‘সম্প্রদায়প্রশংসী’ যারা প্রচার করে বেড়ায় ‘আমার গোষ্ঠী সবার থেকে ভাল’ তারা  হলো নৃশংস। ধর্মের লক্ষ্য অনৃশংসতা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন