বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য পূরণে দরকার সার্বিক অঙ্গনে সচেতনতা

মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য পূরণে দরকার সার্বিক অঙ্গনে সচেতনতা


শাহ্ ফুয়াদ ॥ জাতি গত শনিবার ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকী পালন করলো। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে জন্ম নিয়েছিল একটি নতুন দেশ-স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম একাত্তর’ এর প্রশ্ন - ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ এর সঠিক জবাব এখনো কেউ দিতে পারছে না। এর কারণ অবশ্যই জাতিকে খুঁজে বের করতে হবে। ৪৬ বছর একটি জাতির জন্য নিশ্চয়ই কম সময় নয়। 
বিজয় দিবসের দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সোহরায়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও লাখো শহীদের ত্যাগের মহিমায় নিজেদের গড়ে তুলতে তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এক মূহুর্তের জন্যও এটা ভোলা যাবে না, আমরা বিজয়ী জাতি, বীরের জাতি। আমরা মাথা নত করে চলি না। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা’।
এদিকে দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বাংলা একাডেমির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধের আদর্শিক লক্ষ্য পূরণ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমির নজরুল মঞ্চে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শিক লক্ষ্য ছিল, তা এখন পর্যন্ত পূরণ করা যায়নি। তিনি বলেছেন, ‘একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা যে বিজয় লাভ করেছিলাম, তা শুধু মাটি ও পতাকার জন্য ছিল না। আমাদের যে আদর্শিক লক্ষ্য ছিল, তা শুধু মাটি ও পতাকার বিজয় ছিল না। আমাদের যে আদর্শিক লক্ষ্য ছিল, তা আমরা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি। আমাদের কর্তব্য হবে, আগামী দিনগুলোয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক লক্ষ্যগুলো পূরণ করা। এটা যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আমরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখি, তা সম্পূর্ণ হবে।  
এর আগে রাজধানীতে ‘৭ই মার্চ মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক বাংলার ঘরে ঘরে, ৭ই মার্চ সম্পদ আজ বিশ্বমানবের তরে’ শ্লোগানে আয়োজিত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি; কিন্তু পরাধীনতা ও সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হইনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেও মুক্ত হইনি। অসম্পূর্ণ যে কাজগুলো আছে, তা আমাদের পূর্ণ করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন পূরণ করবে। এটা তোমাদের দায়িত্ব। নতুন প্রজন্মকে দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার শপথ করতে হবে।’   

এবার দেশ ও জাতি আনন্দের সঙ্গে পালন করেছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ৪৬ বছর। রাষ্ট্র, সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালনের ধুমধামের কোন ঘাটতি হচ্ছে না। কিন্তু বিবেকবান সকলের মুখে একটি কথা এখনো ঘুরে-ফিরে আসে তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক লক্ষ্য আজও পূরণ হয়নি। এই ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব এই জাতির সকলকেই নিতে হবে। শুধুমাত্র সরকার বা রাষ্ট্রকে দোষ দিলে হবে না, কারণ, এদেশের প্রতিটি নাগরিকই সরকার ও রাষ্ট্রের অংশ। প্রতিটি নাগরিক সচেতন হলে তাদের সরকারও সচেতন হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে কেবল আদর্শিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাই। যে অপার সম্ভাবনার দুয়ার আজ তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর, তারই প্রেক্ষাপটে বিবেকবান জাতি সেই আদর্শিক রাজনীতিই আশা করছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের কাছ থেকে। 

দেশ ও দশের প্রতি দায়বদ্ধতা

সময়ের সাফকথা....
দেশ ও দশের প্রতি দায়বদ্ধতা

সংলাপ ॥ দেশ ও দশের প্রতি কতোটা দায়বদ্ধ থাকার কথা রাজনীতিকদের, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে কোন স্তরে উন্নীত করা রাজনীতিকদের কর্তব্য। সে প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা, বিতর্ক এবং বিতন্ডা আছে। ইতিবাচক কোনও ফল টের পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে  ‘দায়বদ্ধতা’ বা ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’র মতো শব্দ অধিকাংশ রাজনীতিকদের কাছেই এ যুগে এখন কেতাবি কথা। বাস্তবে ওই ‘কেতাবিআনা’র প্রয়োগকে অপ্রয়োজনীয় বা অসম্ভব বলেই হেসে উড়িয়ে দেন এখনকার সিংহভাগ রাজনীতিক।
দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং সে ব্যর্থতা ঢেকে রাখার নিরন্তর অপপ্রয়াস ইতোমধ্যেই শোরগোল আরম্ভ হয়েছে। সমালোচনার মুখে পড়ে প্রশাসন থমকে দাঁড়ালেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অদম্য।
মোকাবিলার পথ খোঁজা সর্বাগ্রে জরুরি। কিন্তু প্রশাসন খুঁজে চাপা দেয়ার উপায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক কারণেই জটিলতর হচ্ছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি যে একটুও উন্নীত হচ্ছে না, সে কথা শীর্ষ মহলের বোঝার সময় এসেছে। এখনও  ভুলগুলো বুঝতে না পারলে প্রশাসন, এখনও সংশোধনের কথা না ভাবলে  বিপদ আরও বাড়বে।
মানুষের বেঁচে থাকার প্রাথমিক এবং ন্যূনতম প্রয়োজনের মধ্যে স্বাস্থ্য হলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য। সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে এই পরিষেবাটুকু পৌঁছে দেয়া যে কোনও সরকারের প্রধান কাজ। সেজন্যই মানুষ ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক একটি ভোট সরকার গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তাদের উচিত মানুষের চাহিদাগুলোকে যথাসাধ্য মেটানো। ক্ষমতায় আসার পর সরকার প্রত্যেকটি মানুষের সুখ সুবিধার প্রতি নজর দেবে, এটাই কাম্য। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে যে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছেন, তার কিছু কিছু প্রমাণ দেশবাসীর কাছেই অবশ্য মিলেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সমস্যার সুরাহা করার ক্ষেত্রে তাঁর আন্তরিকতা অনেকটাই নজরে পড়েছে। সবক্ষেত্রেই যে তিনি পুরোপুরি সফল হতে পেরেছেন তা নয়, তবে তাঁর শুভ ইচ্ছাটুকু সাধারণ মানুষের নজরে পড়ছে।

শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে সলতে পাকানোর কাজটুকু শুরু হয়েছিল। স্বপ্ন দেখানোর কাজ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে খোলনলচে বদলে দিয়ে আরও উন্নততর পরিষেবা দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। চেষ্টা করছেন চিকিৎসা পরিষেবার উন্নতির পাশাপাশি সেখানকার পরিসর বৃদ্ধি, আধুনিক যন্ত্রপাতি এনে চিকিৎসা করানো, ভবন নির্মাণ, বেডের সংখ্যা বাড়ানো ইত্যাদির। আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে, সে তুলনায় হাসপাতালের সংখ্যা খুবই কম। যেটুকু আছে, সেখানেও সবাইকে চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ থাকে না। হাসপাতালের বাইরে কত মানুষ যে যন্ত্রণায় কাতরায়, হয়তো বা তারা ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। আবার দেখা যায়, হাসপাতালগুলোর একই বেডে একাধিক রোগী শুয়ে থাকেন। এই অবস্থায় রোগীর পক্ষে সুস্থ হয়ে ওঠা কতটা অনুকূল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এই উদ্যোগ সব হাসপাতালের ক্ষেত্রেই নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে থানার হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে। রোগীর চাপ সামাল দিতে যে পরিকাঠামো দরকার, তা অবশ্য রাতারাতি গড়ে উঠবে না। কিন্তু এদিকে নজর দিলে দিনে দিনে হাল ফিরবেই। মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই করছে। এতো আমাদের দীর্ঘদিনের লড়াই। মন্বন্তরে মরিনা আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি। সুতরাং লড়াইটা আমাদের মজ্জাগত। তা বলে কেউ চিকিৎসা পাবে না তা তো হতে পারে না। সরকারকে দেখতে হবে বিনা চিকিৎসায় যাতে কেউ মারা না যায়। অনেক আর্থিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বর্তমান সরকার যে পদক্ষেপটুকু নিয়েছে, তার প্রশংসা করেও আক্ষেপটুকু স্বীকার করতেই হয়। বলতেই হয়, প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্প হলো। এই আক্ষেপ দূর করতে পারে কেবলমাত্র সরকারই। উন্নত পরিষেবা একটি জাতিকে সুস্থ এবং পরিশ্রমী করে তুলতে পারে। 

’৭২-এর সংবিধান বিরোধী কারা?

’৭২-এর সংবিধান বিরোধীকারা?

সংলাপ ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের এক বছর পার হওয়ার আগেই একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন জাতীয় সংসদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। সেজন্য দিনটি সংবিধান দিবস হিসেবে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশে ওই সংবিধানটিতে (যা ’৭২-এর সংবিধান হিসেবে পরিচিত) ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের চলার প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা। বিশেষ করে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশটির উঠে দাঁড়ানোর মতো নীতি ও আদর্শ যেমন - গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে করা হয় রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি। স্বাধীনতাবিরোধী দেশী-বিদেশী অপশক্তি এবং তাদের দোসররা যেহেতু তখন গর্তের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল এবং দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে কোনো কথা বলার শক্তি সামর্থ্য তাদের ছিল না সেহেতু ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কথাও তখন শোনা যায়নি। দেশের মানুষ যে স্বপ্ন নিয়ে এদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল সর্বাত্মকভাবে, যাবতীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছিল নয় মাস স্বপ্নের একটি দেশ গড়ে উঠার প্রত্যাশায় - ’৭২-এর সংবিধানের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল অকুন্ঠ।
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান এবং তারই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন পর পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা বিরোধীরা গর্ত থেকে বের হয়ে আসতে থাকে এবং এদেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে লিপ্ত হয় চক্রান্তে-ষড়যন্ত্রে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে এদেশকে আবারো পাকিস্তান বানাবার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে ধুয়ে মুছে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন নিশ্চিহ্ন করতে এবং বাঙালি জাতিকে দারিদ্র্য, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ধর্মান্ধ করে তুলতে ’৭২-এর সংবিধানকে মুছে দেয়ার চাইতে মোক্ষম কোন উপায় তাদের কাছে বুঝি আর একটিও ছিল না! এক্ষেত্রে এই ৭২’-এর সংবিধানের বিরোধীরা যথেষ্ট সফলই হয়েছে বলা যায়। সামরিক শাসন,স্বৈরাচারি শাসন ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করে রাখতে ধর্মের নামে যাবতীয় অধর্মের কাজ  করেছে ’৭২-এর সংবিধান বিরোধীরা। ২০০৯ এর জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সংসদ নেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ’৭২-এর সংবিধান আজ পর্যন্ত দেশে কায়েম থাকলে স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরে এসে দেশের অবস্থা অন্যরকম হতো। দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো।

কিন্তু সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনসহ স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ’৭২-এর সংবিধানের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন। অবশ্য তাদের কাছ থেকে উল্টোটা আশা করাও বৃথা। কারণ, ’৭২-এর সংবিধান বলবৎ থাকলে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে এদের অস্তিত্ব ও বিকাশতো দূরের কথা, উদ্ভবই হতো না। যেমন থাকে না আলোর উপস্থিতিতে অন্ধকারের অস্তিত্ব। ’৭২-এর সংবিধান তাই ওদের কাছে আতংক। এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা ওদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের যবনিকা। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানের নাম যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কেননা, ঐতিহাসিক ৬ দফা আর ১১ দফার মৌল চেতনার আলোয় ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধান যাতে প্রতিফলন ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদদের স্বপ্ন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণ আকাক্সক্ষার। তাই ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার এই দুর্লভ সুযোগে একথা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলার সময় এসেছে যে, ’৭২-এর সংবিধান মানে মুক্তিযুদ্ধ - মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর বিরোধিতা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা (যা ওরা করেও ছিল একাত্তরে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে)। ’৭২-এর সংবিধানের বিরোধিতা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আজকের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকারকে অবশ্যই এই কঠিন সত্যকে বিবেচনায় নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে রাষ্ট্রদ্রোহীদের এবং যে কোন  মূল্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে  হবে ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক ’৭২-এর সংবিধানকে। 

মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের নিয়ে বাণিজ্য - রাজনীতি কবে অবসান হবে!!


সংলাপ ॥ স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছরের চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় স্বপ্নের শোষণমুক্ত সমাজ বা দেশ প্রতিষ্ঠিত না হলেও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য কখনোই বন্ধ ছিল না। রাজধানী ঢাকার সর্বশেষ দৃশ্যপটঃ গুরুত্বপূর্ণ ছোট-বড় সকল সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে খেতাব অর্জনকারী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নামে, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন নেতৃত্ব ও সংগঠকদের নামে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তিবর্গের নাম ও কীর্তিকে স্মরণীয় করে রাখা একটি জাতীয় দায়িত্ব স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদর ও তাদের আদর্শের ধারক-বাহকরা ছাড়া এ কথা অস্বীকার করতে পারে না কেউই। কিন্তু বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের অনেক নামফলকে যেভাবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নাম প্রায় সমান আকারের টাইপে ফলাও করে লেখা হয়েছে তাতে স্পষ্টই বোঝা গেছে সংশ্লিষ্ট মেয়র তার নামকে জনসমক্ষে তুলে ধরার একটি মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগানোর যথাসাধ্য চেষ্টা-তদ্বির করেছেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক তৈরি ও সড়কের নামকরণের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ কতটুকু  বাস্তবায়ন হবে এ আশংকা রয়েই গেল। অবশ্য যেসব ফলকে কেবল বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যক্তিত্বের নামের পাশাপাশি তাদের কর্ম ও অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোতে নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুই রয়েছে।
সূফী সাধক আনোয়ারুল হক এর একটি স্মরণীয় বাণী হচ্ছে - ‘যে ব্যক্তি চিন্তা ও কর্মে এক নয় তার ইবাদত শুদ্ধ নয়।’ আর হাজার বছর আগেকার এক সাধক-ইমাম জাফর সাদিক ইবাদতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে সুসম্পন্ন করার নাম ইবাদত।’ ৪৬ বছর বয়সী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকালের আশা-আকাংক্ষা ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়েও আজ দেখা যাচ্ছে, যারা স্বাধীন দেশের সকল সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা ভোগ করেছে তাদের অনেকেই চিন্তা ও কর্মের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না, পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আজও স্বপ্নেই থেকে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কর্ম ও অবদানের ফসল হিসেবে যে সাফল্য তার সুফল ভোগ করছে অতি নগণ্য সংখ্যক মানুষ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের যে মেয়রের সময় সড়কগুলোর নামকরণ মুক্তিযুদ্ধের নামে করা হলো তিনিও একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জানবাজ গেরিলা হিসেবে ঢাকায় অনেক দুঃসাহসী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি তার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে যে ভূমিকা পালন করেছেন তাতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ব্যক্তিবর্গ ও দলই বেশি উপকৃত হয়েছে, ভূলুন্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। রাজাকারদের তালিকা না করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে গিয়েই সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। কেননা, ’৭১-এর নয় মাসে কয়েক লক্ষ রাজাকার-আলবদর-মুসলিম লীগ-শান্তি কমিটির লোক ছাড়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিবাহিনীর লোক ও সৈনিকদেরকে যুগিয়েছিল খাদ্য আশ্রয়সহ যাবতীয় সহযোগিতা। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয় একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধ-বিশ্বের সকল মুক্তিকামী জনতার কাছে যার আবেদন চিরভাস্বর হয়ে আছে। আর এ যুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটিতে ছিল সমগ্র মুক্তিকামী বাঙালির সকল বিজয় ও আশা-ভরসার প্রাণস্পন্দন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এর আবেদনকে সংকীর্ণ করে তোলার পেছনে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে আজও বিদ্যমান। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার আড়ালে তৎকালীন সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মোনাফেক ও ভন্ড রাজনীতিকদের যোগসাজশে বিলি করা হয়েছিল হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট যার সুবিধা নিয়ে সুযোগ-সন্ধানী কথিত শিক্ষিত শ্রেণী এমনকি অনেক রাজাকারও সরকারি চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে এবং এ শ্রেণীটিই পরবর্তী ৪৬ বছর ধরে দেশের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নিয়ন্তা সাজতে গিয়ে আবহমান বাংলা বাঙালির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে করেছে কলুষিত। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে আবারো পাকিস্তানী ভাবধারার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ (যার সর্বশেষ পরিণতি জঙ্গিবাদ) বানানোর এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর ক্ষমতা ভোগকারী জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কেউই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি ও বাণিজ্য করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। জিয়া সারা দেশে ‘ইয়ুথ কমপ্লেক্স’ গঠন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ-এর কার্যক্রমকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করে এদেশের ছাত্র, যুব সমাজ ও মুক্তিবাহিনীর বেকার সৈনিকদের পদস্খলন ঘটানোর পেছনে মারাত্মক ভূমিকা পালন করে গেছেন। জেনারেল এরশাদ, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’-এ ঘোষণা দিয়ে আরও বড় রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতা মেয়াদ নয় বছর পর্যন্ত বাড়াতে সমর্থ হয়েছিলেন।
তারপর ১৯৯১ সালে এদেশের জনগণ তথা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের অবসান ঘটেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহনের পর মৃত্যুর পরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। যে দেশে ’৭১-এর বীর সেনানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, অন্যদিকে রাজাকার, আলবদর চক্র বিভিন্ন ছলচাতুরি ও দেশি-বিদেশী অশুভ শক্তির সহযোগিতায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সেখানে শুধুমাত্র মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থায় তুষ্ট থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে  ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তুমি দিতে এলে ফুল’?-এই গানের কথাগুলোই মনে পড়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে বলেই স্বপ্নের সোনার বাংলা আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধুমাত্র নগণ্য সংখ্যক লোকের হাতে দেশের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে গেছে। দারিদ্র্য অশিক্ষা-কুশিক্ষা, শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন-নির্যাতনের’ নির্মম শিকার হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। তবু আশার কথা, বহু পরে হলেও দেশবাসী আজ যুদ্ধাপরাধীদের চিনতে পেরেছে, তাদের বিচারের দাবি জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং এত বিজয়ের ঘটনা যে বাঙালি জাতির পাঁচ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা তা সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক একটি অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এখন সবার আগে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতিকদের রাজনীতি ও বাণিজ্যের অবসান ঘটানো। তবেই সুগম হতে পারে স্বপ্নের দেশ গড়ার, মুক্তি পাবে এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দাবিদার সকল রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব এ বিষয়টি যত শীঘ্রই উপলব্ধি করতে পারবে ততোই মঙ্গল। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে আর সুযোগ দেয়ার অবকাশ নেই। তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে। এখন পর্যন্ত কপটতাই তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম।