বুধবার, ২৮ মে, ২০১৪

মানুষ কি সৃষ্টির সেরা জীব?

মানুষকি সৃষ্টির সেরা জীব?

সিদ্ধার্থ ॥ আমরা শুনে এসেছি মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মাখলুকাত। কিন্তু আসলেই কি তাই? জীব জগতের অন্যান্য প্রাণীরা কি স্বীকার করে যে মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব? মানুষ যে সৃষ্টির সেরা এটা তো কেবল মানুষেরই ঘোষণা! নিজেকে যে বড় বলে বড় কি সে হয়?
দৈহিক শক্তির দিক থেকে মানুষ যে জীবজগতে শ্রেষ্ঠ নয় এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। তাহলে কি বুদ্ধিমত্তায় মানুষ সেরা জীব? আধুনিক প্রাণী বিজ্ঞানীদের মতে অনেক প্রাণী রয়েছে যাদের বুদ্ধি মানুষের চেয়ে বেশি। অনেক প্রাণীরই রয়েছে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার এমন অসাধারণ ক্ষমতা যার সাথে মানুষের কোন তুলনাই চলে না। প্রত্যেক প্রাণীরই কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে। কুকুর এর ঘ্রাণশক্তি, বাজপাখির দৃষ্টিশক্তি, হরিণের শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। বাদুর শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে পথ চলতে পারে। মানুষ দৃশ্যমান আলো ছাড়া চোখে দেখে না কিন্তু নিশাচর প্রাণীরা অন্ধকারেও চোখে দেখে। অতি ছোট প্রাণী পিঁপড়ার অধ্যবসায় ও জীবন প্রণালী সব সময়ই মানুষকে কৌতূহলী করেছে।  পিঁপড়ার জীবাণুর ভয় নেই, তারা যে মাটিতে বাস করে তা ব্যাকটেরিয়াতে পরিপূর্ণ। কিন্তু কিছু পিঁপড়া মানুষের মতোই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকে। তারা নিজেদের দেহ গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত জীবাণুনাশক পদার্থ দিয়ে দেহকে জীবাণুমুক্ত রাখে এমনকি তারা তাদের বাসস্থানও পরিচ্ছন্ন রাখে যাতে ছত্রাক আক্রমণ করতে না পারে।
পশুগণের কোন নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম নেই। কিন্তু মানুষের কি আছে?  মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী ধর্ম কিংবা আদর্শের দোহাই দিয়ে স্বজাতিকে হত্যা করে না। পশুগণ শান্তশিষ্টভাবে বনে বাস করে। তাদের জীবনে কোন বিশৃঙ্খলা নেই। তাদের মধ্যে লোভ-লালসা, সঞ্চয় প্রবণতাও নেই। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ তারা করে না। মানুষ অপরাধ প্রবণ প্রাণী। সুযোগ পেলেই অপরাধ করে। তাই মানুষকে শাসনে রাখার জন্য আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন খাদ্যের চেয়ে বেশি উৎপাদিত হচ্ছে মানুষ হত্যার সরঞ্জাম। পুলিশ, দাঙ্গা পুলিশ, সেনা, উকিল, বিচারপতি আরো কত কি যে মানুষ তৈরি করেছে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তার হিসেব নেই। মানুষ নিজের বাড়ি-ঘর আর দেশ অন্য মানুষের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কিংবা দখল করার জন্য সেনাবাহিনী তৈরি করেছে। ট্যাঙ্ক, আণবিক বোমা, যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করেছে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা স্বজাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ রাখে।
মানুষ ভিন্ন অন্য কোন প্রাণী স্বজাতির অন্য কোন প্রাণীকে ভয় করে না। কেবল মানুষই মানুষকে ভয় পায়। মানুষ প্রকাশ্যে মানুষকে খুন করে, অন্যরা তাকিয়ে দেখে। মানুষ মানুষের সম্পদ লুট করে, মানুষ মানুষকে ধর্ষণ করে, অপহরণ করে। মানুষের মতো এত অসহায়, ভীত ও সন্ত্রস্ত প্রাণী আর একটিও নেই।
মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা নিজেদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। কেউ দামি জামা কাপড় পড়ে। দামি গাড়ী হাকায়। নাইট ক্লাবে যায়। অন্যের টাকা আত্মসাৎ করে সম্পত্তি সঞ্চয় করে। অন্যান্য পশুগণ সকলেই সমান, কারোই জামা-কাপড় নেই। নেই সঞ্চয় প্রবণতা।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা গেছে, মা-কুকুর তার বাচ্চাকে দুগ্ধপান করাচ্ছে, তখন পাশে থাকা তৃষ্ণার্ত একটি ছাগলছানা দৌড়ে এসে কুকুরের দুধ পান করছে। মা-কুকুরটি বিজাতীয় বলে ছাগলছানাটিকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে না কিংবা তার বাচ্চটিও ছাগলছানার তৃষ্ণা নিবারণে বাধা দিচ্ছে না। সম্প্রতি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক প্রমাণ করেছেন, শিম্পাঞ্জিরা বিরোধ নিষ্পত্তিতে একজন মধ্যস্ততাকারী নির্বাচন করে এবং ৬৯টি বিরোধের মধ্যে ৬০টির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতায় সমস্যার সমাধানও হয়। মানুষ পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে শিম্পাঞ্জি থেকে অনেক পিছিয়ে।
বিজ্ঞানীদের মতে শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষের জ্ঞানের ফ্রাগমেন্ট হচ্ছে ৩টি। হাঁস-মুরগি, ছাগল-ভেড়ার জ্ঞানের ফ্রাগমেন্টও ৩টি। ওরা যতটুকু চিন্তা করতে পারে, আমরা ওদের চেয়ে একটুও বেশি চিন্তা করতে পারি না। পার্থক্য এখানেই যে, আমাদের মধ্যে জ্ঞানীদের আবির্ভাব ঘটেছে, ওদের মধ্যে কোনো জ্ঞানী আসেনি। আমরা জ্ঞানীদের জ্ঞান ধারণ করতে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োগ করতে পারি। এই জ্ঞানীগণ যদি না আসতেন, তাহলে আজও আমরা শিম্পাঞ্জি এবং বানরের মতো বনে-জঙ্গলে উলঙ্গ হয়ে বাস করতাম। একটি সাপ ডিমের খোলস থেকে বের হয়েই খেতে পারে, ফণা তুলতে পারে, দৌড়াতে পারে। একদিনের মুরগির বাচ্চার মধ্যে ভয়-ভীতির অনুভূতি থাকে। মানুষের বাচ্চা একদিন তো দূরের কথা ৬ মাসেও তার মধ্যে ভয় সৃষ্টি হয় না। প্রায় প্রতিটি প্রাণী জন্মের পর কয়েক দিনের মধ্যেই নিজের খাদ্য নিজে যোগাড় করে খেতে পারে কিন্তু মানুষকে এজন্য অপেক্ষা করতে হয় ২৫ বছর।
মানুষ বোকামি করলে ‘কাকের মতো বোকা’ বলা হয়। কিন্তু বিজ্ঞান বলে, কাক খুবই বুদ্ধিমান। কাক তাদের নিজেদের সুবিধামত ডাল-লতাপাতা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি ও ব্যবহার করতে পারে, যে সব জায়গায় খাবার পাওয়া যায় সেসব জায়গা মনে রাখতে পারে। শক্ত খাদ্য কাক রাস্তায় ফেলে রাখে। গাড়ি আসলে খাদ্য ভেঙ্গে যায়, ফলে তারা সেগুলো খেতে পারে। শুধু তাই নয়, একটি কাক যে ঝাঁকের সদস্য, সে সেই ঝাঁকের অন্য কাকদের সাথে সমাজবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন কাজ করে। একটি কাকের মৃত্যু হলে সামাজবদ্ধ কাকদের মধ্যে তীব্র আবেগের সৃষ্টি হয় যা মানুষের মধ্যেও হয় না।
অনেকেরই ধারণা কুরআনে বলা হয়েছে, মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। কিন্তু এ ধারণা সঠিক না। কুরআনের কোথাও বলা হয়নি যে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বরং কুরআন মতে অধিকাংশ মানুষই মূর্খ - ৬:১১১; অকৃতজ্ঞ - ২:২৪৩, ৭:১৭, ১২:৩৮, ১৬:৮৩, ২৫:৫০, ২৭:৭৩, ৪০:৬১; নাফরমান - ৭:১০২, ৫:৫৯; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী -৯:৮, অবিশ্বাসকারী - ২:১০০, ১৩:১, ১২:১০৩, ২৬:৮, ২৬:৬৭, ২৬:১০৩, ২৬:১২১, ২৬:১৩৯, ২৬:১৫৮, ২৬:১৭৪, ২৬:১৯০, ৩৬:৭, ৪০:৫৯; অস্বীকারকারী - ১৭:৮৯; মিথ্যাবাদী -২৬:২২৩; মুশরিক - ৩০:৪২; বিপথগামী - ৩৭:৭১; অবুঝ - ২৯:৬৩, ৩৪:৩৬, ৩৯:৪৯, ৪০:৫৭, ৪৪:৩৯, ৪৫:২৬, ৪৯:৪; পাপাচারী - ৩:১১০, ৫৭:১৬; ৫৭:২৬, ৫৭:২৭। কুরআন মতে অধিকাংশ মানুষই সত্য ধর্মে নিস্পৃহ (৪৩:৭৮); অন্ধ ও বধির (৫:৭১); অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই (৫:১০৩); অধিকাংশ মানুষই উপলব্ধি করে না (৭:১৮৭); অধিকাংশ মানুষই সত্যকে অপছন্দ করে (২৩:৭০); অধিকাংশ মানুষ শুধু আন্দাজ-অনুমানের উপর চলে (১০:৩৬), অধিকাংশ মানুষ চতুস্পদ জন্তুর মতো বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট (২৫:৪৪)।

কুরআন মতে - “যারা সৎকর্ম করে তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ (সুরা বাইয়িনা:৭)”। মানুষ মাত্রই সৃষ্টির সেরা জীব নয় তবে মানুষের মধ্যে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে নিজেকে তৈরি করার সম্ভাবনা রয়েছে, পশুর মধ্যে সেই সম্ভাবনা নেই, পার্থক্য কেবল এইটুকুই। 

বিচ্ছিন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করাই ধর্মের লক্ষ্য

সময়ের সাফকথা ....
বিচ্ছিন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করাই ধর্মের লক্ষ্য

সাদিকুল হক ॥ মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন - ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের একজন নর ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর আমি তোমাদের অনেক সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।’ (৪৯ : ১৩)। কুরআন মতে, বিশ্বের সব মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। মানবজাতি আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার সন্তান। কালের প্রবাহে বংশবৃদ্ধির কারণে মানুষ বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হয়েছে। নবী করীম (সা.)-এঁর কন্ঠে ঘোষিত হয়েছে শান্তিধর্মের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত - “হে মানবজাতি! তোমাদের রব একজন, তোমাদের আদি পিতা একজন এবং তোমরা সকলেই আদমের সন্তান।” সকল মানুষ একই উপাদানে, একই লক্ষ্যে সৃষ্ট। বিশ্বের সকল জাতি-সম্প্রদায় ও  বর্ণের মানুষ আল্লাহ্‌ তায়ালার বৃহৎ পরিবারভুক্ত। তাই মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষই সমান মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার পাবার যোগ্য। আল্লাহ্‌ তায়ালার নিকট সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা প্রিয় যেই ব্যক্তি তার বৃহৎ পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক রাখে ও সদাচরণ করে। দ্বীনের নবী (সা.) ঘাষণা দিয়েছেন - ‘আদম সন্তানেরা সবাই সমান। তাকওয়া ব্যতীত তাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই।’ মানুষে মানুষে পার্থক্য হয়, কে কি গুণ অর্জন করতে পেরেছে, কার মধ্যে মনুষ্যত্ব কতটা বিকশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে। জাতি-বর্ণ-ভাষা মানুষের মর্যাদার মানদণ্ড নয়। রসুল (সা.) ঘোষণা করেছিলেন - ‘আজ থেকে বংশগত কৌলীন্য বিলুপ্ত হলো। সে-ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে স্বীয় কর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। আরবদের ওপর অনারবদের, সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই’। এ ঘোষণার মাধ্যমে তিনি (সা.) জাতি, বর্ণ এবং বংশগত কৌলীন্য ভেঙ্গে বিশ্বনবী হলেন। বিশ্বনবী আবদ্ধ থাকতে পারেন না রক্ত, বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠী, ভাষা কিংবা রাষ্ট্রের প্রাচীরে। বিশ্বনবী আরবীয়, ভারতীয়, কিংবা মিসরীয়দের নবী নন, তিনি সমগ্র মানব জাতির নবী। যারা তাঁকে গোষ্ঠী, বর্ণ, দেশ ও জাতির ঊর্ধ্বে পথপ্রদর্শক হিসেবে মানে তারাই মুসলিম। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র, ভৌগোলিক সীমারেখা বা বংশ পূজারীরা কখনও আল্লাহর পূজারী  হতে পারে না।
কুরআন মতে আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষের রব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানব জাতির পালনকর্তা তিনি। তাঁর পালনকর্মে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। কোন দেশ, সম্প্রদায় বা জাতি দাবি করতে পারে না যে, আল্লাহ তায়ালা কেবল তাদের। তিনি সমানভাবে সকলের, সমগ্র সৃষ্টি জগতের। আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজনীন তাই তাঁর নবী-রসুলগণও বিশ্বজনীন। নবী-রসুলগণের আগমন ঘটেছে বিভেদ তৈরির জন্য নয়, বিভেদের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য, বিচ্ছিন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি গোত্রের কাছে সমসাময়িক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে স্থানীয় ভাষায় পথপ্রদর্শকরূপে মনোনীত ব্যক্তিকে পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন ঐশী বাণী। সুরা ইব্রাহিমের ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে - ‘আর আমি প্রত্যেক রসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’  এসব প্রত্যাদেশে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। সময়ের প্রয়োজনে প্রকাশভঙ্গিতে কিছু তারতম্য আছে মাত্র। আল্লাহ বলেছেন - ‘তোমাদের জন্য সেই বিধানই দেয়া হয়েছে, যা নূহকে দেয়া হয়েছিল এবং যা তোমাকে প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, তাই প্রত্যাদেশ করা হয়েছিল ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসাকে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করো, এবং তাতে কোন দ্বিমত সৃষ্টি  করো না’ (৪২ : ১৩)। সুরা আলে ইমরানের ৮৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে - ‘বলো আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহতে আর যা আমাদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছে, আর যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহিম, আর ইসমাইল আর ইসহাক আর ইয়াকুব আর গোত্রদের কাছে; আর যা দেয়া হয়েছিল মুসাকে আর ঈসাকে আর পয়গম্বরদের তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে, তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য আমরা করি না।’ পৃথিবীর সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি এই হচ্ছে কুরআনিক সিদ্ধান্ত। কুরআন কোন সাম্প্রদায়িক বিধান নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসৃতব্য বিধান।
কুরআন মতে, সকল নবী রসুল একই ধর্ম প্রচার করেছেন। ১ লক্ষ ২৪ হাজার বার্তাবাহক তাঁদের সময়ের প্রতিনিধি। যখন কেউ কুরআন মেনে মুসলিম হয়, তখন সে আল্লাহ ও নবীর (সা.) -এঁর প্রকৃতি অনুসরণ করে বিশ্বমানব হবার চেষ্টায় রত থাকে। তার আর কোন দেশ থাকে না, গোষ্ঠী থাকে না, জাতি থাকে না। বিশ্বমানব না হয়ে কেউ সত্যিকারের মুসলিম হতে পারে না।
কুরআন সমগ্র মানব জাতিকে শান্তিতে বসবাসের পথনির্দেশ দিয়েছে। কোন সমপ্রদায় বা ব্যক্তি মানুষের উপর অন্যায় আচরণ ও জুলুমকে ইসলাম সমর্থন করে না। মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই এক আল্ল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ্‌ তায়ালা ইচ্ছা করলে সবাইকে একই ধর্মের অনুসারী বানাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নিজেই যেহেতু মানুষকে বিভিন্ন ধর্ম মতে বিভক্ত করেছেন তাই আমাদের কোন ধর্মের অনুসারীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা মোটেও ঠিক নয়। আমরা যদি সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করি এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালোবাসতে পারি তবেই পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হতে পারে।


ভয়কে করবো জয়

ভয়কে করবো জয়

দিগন্ত ॥ অধিকাংশ মানুষের জীবনে ভয় হচ্ছে ভবিষ্যতের কাল্পনিক বিপদ। মানুষ ভয়ের সাম্রাজ্যে বসবাস করে সর্বদাই। কখনও সম্পত্তি নাশের ভয়, কখনও অপমানের ভয়, কখনও আপন জনের সাথে বিচ্ছেদের ভয় জীবনের সকল সুখ কেড়ে নেয়।
ভয়ের জননী ভবিষ্যতের নেতিবাচক কল্পনা। আমরা যখন বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে চাই, যখন সমস্যাকে মোকাবেলা করার বদলে কাল্পনিক সমস্যায় ডুবে থাকি তখন সৃষ্টি হয় ভয়। ভয় নিয়ে মানুষের জন্ম হয় না। পরিবেশ থেকে নিজের মধ্যে ধারণ ও লালনের মাধ্যমে ভয়ের উৎপত্তি হয়। মা শিশুকে তেলাপোকার ভয়, ভূতের ভয় শিখায়। বড় হয়ে শিশু বুঝতে পারে ভূত বলে কিছু নেই কিন' শিশুকালে স্থাপিত ও লালিত ভূতের ভয় সে ছাড়তে পারে না। একইভাবে মা-বাবা এবং শিক্ষকরা শিশুদের মধ্যে পরীক্ষার ভয় তৈরি করে। অন্যদিকে - অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, সামাজিক চাপ, রাজনৈতিক অসি'রতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি থেকেও ভয়ের সৃষ্টি হয়। নিঃসঙ্গতা এবং বহুকাল পুষে রাখা অসন্তোষও ভয় সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
রোগ ভয়, বার্ধক্যের ভয়, প্রিয়জন বিচ্ছেদের ভয়, নিরাপত্তার ভয়, ব্যর্থতার ভয়, দারিদ্রের ভয়, একাকীত্বের ভয়, সম্মান ও সম্পত্তি হারানোর ভয়, মৃত্যুভয়, চুরি হওয়ার ভয়, না পাওয়ার ভয়, ব্যাথা পাওয়ার ভয়, ঝড়-তুফানের ভয়, বাবার শাসনের ভয়, মায়ের অশ্রুর ভয়, যানজটের ভয় ইত্যাদি কোন না কোন সাধারণ ভয়ে প্রায় সকলেই আক্রান্ত। অনেকের মধ্যে লোক ভয়, সমালোচনার ভয় ইত্যাদি সামাজিক ভয় কাজ করে। সামাজিক ভয়ে ভীত ব্যক্তি একা একা থাকতে ভালোবাসে। বিয়ে, সেমিনার, বনভোজন ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা অংশগ্রহণ করতে চায় না। মসজিদ, মন্দির বা উপাসনালয়ে যেতেও ভয় পায় তারা। মিটিং মিছিলের ধারে কাছেও তারা যেতে চায় না। সামাজিক ভয় যার মধ্যে প্রকট হয় সে একা ঘর থেকে বের হতেই ভয় পায়।
ভয় জীবনের সব সুখ কেড়ে নেয়। মনোবিজ্ঞানীরা ভয়কে আধুনিক প্লেগ হিসেবে গণ্য করেন। ভয় মস্তিষ্ক থেকে ছড়িয়ে পড়ে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, পাকস্থলীসহ শরীরের সকল প্রধান অঙ্গসমূহে। ভয়ে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, হৃদরোগ, বাত, পাকস'লীর পরিপাক জটিলতা, থাইরয়েড সর্দিকাশি আর ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পায়। ভয়ে সৃষ্টি হয় বিষণ্নতা। ভয় এবং আনন্দ একসাথে থাকতে পারে না।
যত প্রকার ভয় আছে তার মধ্যে ব্যর্থতার ভয় সবচেয়ে ক্ষতিকর। ব্যর্থতার ভয়ে অনেকে কাজ শুরুই করতে পারে না। অনেকে পারদর্শী হয়েও সফল হতে পারে না কারণ ভয় বাঁধা হয়ে সফলতার পথ রুদ্ধ করে দেয়। অনেকে ভাবেন ব্যর্থ হলে লোকজন তাকে নিয়ে উপহাস করবে, সে সকলের সামনে ছোট হয়ে যাবে। এ সব কারণে অনেকে কাজ শুরু করার আগেই হার মেনে নেন। ব্যর্থতার ভয়ে কাজ শুরু করার আগেই মানুষ হেরে যায়। অথচ ব্যর্থতা ব্যতীত সাফল্য আসে না জীবনে। জীবন চলার পথ কুসুমাবৃত নয়, ব্যর্থতাকে অতিক্রম করেই যেতে হয় সফলতার দরজায়। ব্যর্থতার ভয় বরং ব্যর্থতাকে অনিবার্য করে। ব্যর্থতার ভয়কে জয় করার জন্য চাই আত্মবিশ্বাস। নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমিও পারব। যখন আমরা এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করি যে, আমি তাকে পরাজিত করব তখন শত্রুও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সে পরাজিত হবে, তখন নিজের শক্তি ও শত্রুর শক্তি উভয়ই বিজয় লাভে সহায়ক হয়। বিজয়ের বিশ্বাস থেকেই মানুষ বিজয় লাভ করে। আমরা যদি ভাবতে থাকি যে হেরে যাব তাহলে নিজেই নিজের মধ্যে শত্রুকে আশ্রয় দেই এবং পরিণামে আমাদের পরাজয় হয়। ব্যর্থতা আসলে সফলতার একটি স্তর মাত্র। প্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্যর্থতার স্তর অতিক্রম করে সফলতা অর্জন করতে হয়। এমন কেউ নেই যার জীবনে ব্যর্থতা আসে না। ব্যর্থতার সম্ভাবনা আছে বলেই আমরা সফলতার মর্ম উপলব্ধি করতে পারি। জীবনে ব্যর্থতা আসতেই পারে এই বাস্তব সত্যটিকে মেনে নিলে ব্যর্থতার ভয় থাকবে না।
‘ছেলেটাকে যদি ভাল স্কুলে ভর্তি করতে না পারি কি হবে? যেভাবে বাড়িভাড়া, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তাতে চলব কি করে? যদি চাকরি হারাই তাহলে কি হবে? যদি কঠিন কোন রোগে আক্রান্ত হই তাহলে কি হবে?’- ইত্যাদি ভয় এমনভাবে জীবনকে জড়িয়ে রাখে যে ভয়ের অস্তিত্ব সবার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়। কিন্তু আমরা সবাই জানি ভয় পেলেই ভবিষ্যতে দুঃখের নিবারণ হয় না! ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা নিয়ে চিন্তা করে আমরা আমাদের বর্তমানের সুন্দর সময়গুলোকে কষ্টে ভরে দেই। আমরা ভবিষ্যত নিয়ে যত বেশি উদ্বিগ্ন হবো বর্তমানকে কাজে লাগাতে ও উপভোগ করতে ততই ব্যর্থ হবো। সময়কে নিয়ন্ত্রণের শক্তি আমাদের নেই। ভবিষ্যতে কি হবে তা আমরা কেউ জানি না। আমরা বর্তমানে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে থাকি ভবিষ্যৎ নিজেই নিজেকে নির্মাণ করবে। বর্তমানের কর্মতৎপরতায় ভয় থাকে না। যে বিপদকে আমরা ভয় করি বাস্তবে সে বিপদে পতিত হলে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য আমরা প্রচেষ্টা করি। কর্মে একনিষ্ঠ থাকলে ভয় থাকে না তবে সাবধানতা থাকে। সাবধানতা আর ভয় এক নয়। যেমন, আগুনকে আমরা ভয় পাই না কিন্তু আগুনের ব্যবহারে আমরা সাবধান থাকি। ঠিক একইভাবে পথ চলতে, গাড়ি চালাতে আমাদের সাবধান থাকতে হয়। সাবধানতা আমাদেরকে যে কোন প্রকারের বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক ও সজাগ রাখে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
অভিজ্ঞতা অজানা বিষয়ের ভীতির প্রতিষেধক। সাধারণ ভয়ের ক্ষেত্রে ভয়ের বস্তুটি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরী করে তা দূর করা সম্ভব। ভয় উদ্দীপকটির ব্যাপারে সংবেদনশীলতা কমালে ভয় অবশ্যই কমবে। যার মধ্যে ভূতের ভয় আছে সে যদি যুক্তিসঙ্গতভাবে বুঝতে পারে যে ভূত বলে কিছু নেই তাহলে ভূতের ভয় প্রবল হবে না। জনতার সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুর দিকে অনেকেই একটি ভীতিতে আক্রান্ত হন, কিন্তু বার বার এই পরিসি'তি মোকাবেলা করার মাধ্যমে ভীতি কেটে যায়।
ভয়কে জয় করার উপায় হলো ভয়ের মোকাবেলা করা। যে ব্যক্তি যে কাজ করতে ভয় পায় সাহস নিয়ে সে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লে ভয় পালাবার পথ খুঁজবে। এমনও হতে পারে যে, ভয় কেটে যাওয়ার পর ঐ কাজটিই হয়ে ওঠবে আনন্দের উৎস। যে ব্যক্তি নৌকা ভ্রমনে ভয় পায়, সাহস করে নৌকা ভ্রমন শুরু করলে তাতেই সে পেতে পারে অপার আনন্দ।
ভয় থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজের মধ্যে ভয়কে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভয়ের উৎপত্তি ও উৎস খুঁজে বের করতে হবে। জলের জীব ডাঙ্গায় বাঁচে না। গভীর সমুদ্রের অতিকায় প্রাণীকেও যদি কোনভাবে ডাঙ্গায় তুলা যায় তবে তার মৃত্যু হয়। ঠিক তেমনি ভয় পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের আলো সহ্য করতে পারে না। ভয় হচ্ছে অন্ধকারের সৃষ্টি, আলোয় এলেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তাই ভয়কে পর্যবেক্ষণের আলোতে স্পষ্ট করে তুলতে হবে। জানতে হবে ভয়ের উৎপত্তি ও চূড়ান্ত পরিণতি। অজানা যখন জানা হয়ে যায়, তখন আর ভয় থাকে না। অন্ধকারে রজ্জুকে সর্প ভেবে আমরা ভয় পেতে পারি কিন্তু রজ্জুতে টর্চের আলো ফেললে ভয় কেটে যায়।
যে ভয় পায় স্বয়ং সে-ই ভয়কে শক্তি দেয়। ভয়ের নিজস্ব কোন শক্তিও নেই, অস্তিত্বও নেই। ভয়কে অস্তিত্বমান করে ব্যক্তি স্বয়ং তার কল্পনা দিয়ে। সুতরাং যে কল্পনা ভয়ের সৃষ্টি করে সে কল্পনা না করলে ভয় শক্তিহীন হবেই। আমরা যদি ভয়কে কল্পনার জগতে আধিপত্য বিস্তার করতে দেই তাহলে আমাদের অজান্তেই ভয় লালিত পালিত হয়ে আরো শক্তিশালী হবে এবং ভয় থেকে মুক্তি অসম্ভব হয়ে ওঠবে। কল্পনার জগতে অবগাহণ করে যদি ভয়ের কারণগুলো খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে কারণের জন্য করণীয় বের করা সহজ হবে।
পাছে লোকে কিছু বলে! এই ভয় সবসময় আমাদের তাড়া করে। এক্ষেত্রে, লোকে কী বললো না বললো তা না ভেবে নিজস্ব মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেককে প্রাধান্য দেওয়াই শ্রেয়। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের মূল্য না দেই তবে অন্যরা আমাদের মূল্য দেবে না। যে কাজে নিজ বিবেকের সমর্থন আছে তাতে লোকের সমালোচনাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যারা সমালোচনা ও নিন্দা করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে তারাই একসময় প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। ভয় থেকে মুক্তির সহজ পন্থা হলো কর্ম। কর্মে ব্যস্ত থাকলে ভয় পাওয়ার সময়ই পাওয়া যাবে না। কর্মব্যস্ততার ফলে দেহ ও চিন্তা সবসময়ই থাকবে সজাগ ও সতর্ক।
          আমরা যদি কোন পরিবেশ বা পরিসি'তিকে এড়িয়ে চলি তাহলে বিবেচনা করে নির্ণয় করতে হবে এটা বাস্তবসম্মত নাকি ভয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয় থেকেই সৃষ্টি হয় পলায়নমনস্কতা। ভয়ের পরিস্থিতি থেকে আমরা যতই পালাই ততই কমবে আত্মবিশ্বাস এবং বাড়বে ভয়। এভাবে চলতে থাকলে সমস্যার বোঝা ভারী হতেই থাকবে। এক্ষেত্রে ভয়ের কাল্পনিক মোকাবেলার মহড়া ফলদায়ক। কল্পনায় ভয় কেটে যাওয়ার পর বাস্তবে ব্যাপারটা সহজ হয়।
ভয়ের শেষ স্তর মৃত্যু। অথচ মৃত্যুভয়ের চেয়ে অযৌক্তিক ভয় আর কিছু নেই। মৃত্যুকে ভয় পাই বা না পাই, মৃত্যু হবেই এটাই সত্য। মৃত্যুর সময় হলে মরতেই হবে। সময় হয়ে গেলে মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। নবী-রসুল, দরবেশ, মুনি-ঋষি এমন কেউ নেই যার মৃত্যু হয়নি। স্টালিন, কেনেডি, হিটলার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন কিন্তু তারা কেউ বেঁচে থাকতে পারেন নি। মৃত্যু জীবনের অবধারিত সত্য। সুতরাং মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মেনে জীবনকে উপভোগ করাই শ্রেয়।

ভয় আর কিছু নয়, কেবল ভবিষ্যৎ দুঃখের কল্পনা। বাস্তবের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। ভবিষ্যতের কথা কে জানে? আমরা কেউ সময়ের প্রভু নই। সময়তো চলে বিধাতার অধীনে। যারা বিধাতাকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে গ্রহণ করে তাদের ভয় পাওয়ার কোন কারণই নেই। কেবল এইটুকু যে উপলব্ধি করতে পারে তার পক্ষে ভয় থেকে মুক্ত হয়ে নির্ভীক হওয়া কঠিন নয়।

দেহ ও আত্মার সম্পর্ক

দেহ ও আত্মার সম্পর্ক

আরিফিন হক ॥ যে কোন ব্যক্তি যখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়, নিজের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে ভাবতে শুরু করে, জীবন ও জগতের বিভিন্ন রহস্য উন্মোচনের বাসনা জাগে তখন সবার আগে আত্মার ধারণা তাকে উদ্বেলিত করে। মানুষ যেমন চারপাশের জড়জগতকে পর্যবেক্ষণ করে তেমনি পর্যবেক্ষণ করে জীবজগত। মানুষ উপলব্ধি করে যে জড়ের মধ্যে বুঝতে পারার ক্ষমতা নেই। কিন্তু জীবের মধ্যে আছে বুঝতে পারার ক্ষমতা। এই বুঝতে পারার ক্ষমতাকে মানুষ নামকরণ করেছে আত্মা। বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকার কারণেই মানুষ যুক্তি, সচেতনতা, বোধ, এবং বুদ্ধির চর্চা করতে পারে। বস্তু মাত্রই আত্মার আধার। পরিবেশের প্রভাবে বস্তুর মধ্যে প্রকাশ ঘটে আত্মার। সমগ্র বস্তুজগৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত। এ কণিকাগুলোর নাম পরমাণু। পানি, কাদা মাটি বা আবর্জনা থেকে যখন আত্মার উদ্ভব হয় তখন অজৈব পদার্থের অণুগুলো নির্দিষ্টভাবে সজ্জিত হয়ে জীবনের ভিত্তিভূমি রচনা করে।
আত্মা বা বুঝতে পারার ক্ষমতা বস্তু থেকে পৃথক কিছু নয় বরং বস্তুরই ধর্ম। পানির সিক্ততা পানি থেকে পৃথক নয় বরং পানির অণুরই স্বভাব ধর্ম। সিক্ততা নামে কোন নিবস্তু পানির মধ্যে প্রবেশ করে পানির মধ্যে সিক্ততা সৃষ্টি করে না। পানির অণুর বিন্যাসের কারণেই সিক্ততার উদ্ভব ঘটে। আত্মাও তাই। দেহের স্বভাব ধর্ম হিসেবেই আত্মার উদ্ভব ঘটে। দেহ শব্দটির পৃথক কোন ব্যবহারই নেই। দেহ শব্দটি ব্যবহার করতে হলে উল্লেখ করতে হবে কার দেহ। যদি বলা হয় মানব দেহ,  তাহলে নিশ্চয়ই এমন একটা কিছু আছে যা মানব এবং দেহ। করিম একজন মানব। করিমের দেহ বলতে বুঝায় করিম ও দেহ এক নয়। করিমের বাড়ি, গাড়ীর মতোই করিমের দেহ করিম থেকে পৃথক। কিন্তু বাস্তবে বাড়ী, গাড়ী যেভাবে করিম থেকে পৃথক করিমের দেহ সেভাবে পৃথক নয়। আবার করিম ও দেহ একও নয়। করিম দেহতেই অবস্থান করে। সুতরাং বলা চলে যে, আত্মা হচ্ছে সূক্ষ্ম দেহ, আর দেহ হচ্ছে স্থুল আত্মা। আত্মা আর দেহ আসলে একই সত্তার দুটি দিক। একই সত্তার দুটি দিক সমান্তরাল রেখার মতো সহগামী। একটির সাথে অপরটি চলতে থাকে সময়ের সাথে সমান্তরালভাবে। দেহের রূপান্তরে আত্মার বিকাশ ঘটে, আত্মার উদ্ধরণে দেহেরও রূপান্তর ঘটে।
দেহের ওজন আছে এবং স্থান দখল করে। বস্তুর বৈশিষ্ট্যই তাই। দেহ যেহেতু বস্তু সেহেতু তাকে বস্তুজগতের নিয়ম মেনে চলতে হয়। দৈহিক কর্ম এবং অবস্থা বাহির থেকে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। জীবজন্তু, বৃক্ষাদি ও অন্যান্য বস্তুর মতো দেহ সকলের কাছেই দৃশ্যমান এবং বোধ্য ব্যাপার। কিন্তু বুঝতে পারার ক্ষমতা বস্তুজগতের নিয়মের অধীন নয়। কে কি বুঝে, কি বুঝে না তা তার দেহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থেকে প্রত্যক্ষীভূত হয় না। তা একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। কেবলমাত্র করিমই জানে করিম কি বুঝে আর কি বুঝে না। করিমের বুঝতে পারার ক্ষমতা তার নিজস্ব। করিমের জীবনে দুটি স্রোতধারা প্রবাহমান। আত্মা ও দেহের স্রোতধারা। দেহের স্রোতধারা সর্বজনের কাছে প্রকাশ্য কিন্তু আত্মার স্রোতধারা গোপনীয়। দেহে যে সব ঘটনা ঘটে তা বস্তু জগতের ঘটনাবলী। আর আত্মার জগতে যা ঘটে তা ভাব জগতের ঘটনাবলী। ব্যক্তি তার অপ্রকাশ্য গোপন কার্যাবলীর ইতিবৃত্ত সরাসরি জানতে পারে। করিমের কাছে করিমের কোন কিছু গোপন থাকার কথা না। বাহ্যিক জগতে কি ঘটছে এ সম্পর্কে জানার মধ্যে অনিশ্চিয়তা ও ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু করিমের অভ্যন্তরীণ জগতে কি ঘটছে তা সন্দেহাতীত ও নির্ভুলভাবে করিমের পক্ষে জানা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে করিম করিমকে জানে না কারণ সে আত্মসচেতন নয়, তার অন্তদৃষ্টি নেই। নিজের অভ্যন্তরে কি ঘটছে সে খবর করিম রাখে না।

মানুষ বাহ্য জগতকে জানতে প্রয়াসী হয়। বাহ্য জগতকে জেনে সে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চলছে জগতের সর্বত্র। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ গহীন অরণ্যকে নিজের বাসভূমিতে পরিণত করেছে। সমুদ্রের বিশালতাকে অতিক্রম করেছে, চাঁদের বুকে পা রেখেছে। মানুষ এখন জগত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে, কিন্তু নিজেকে জানে না, নিজের আত্মাকে চিনে না। মানুষ বস্তুকে জানছে, কিন্তু আত্মাকে জানতে চাইছেও না, জানছেও না। নিজের আত্মাকে জানতে পারছে না বলেই নিজের আত্মার চাহিদার কথাও জানতে পারছে না। মানুষ জানে কেবল দেহের চাহিদা তাই খাওয়া-দাওয়া আর কামনা-বাসনার দাসত্বে নিয়োজিত থাকে সর্বক্ষণ। যে কোনো মূল্যে মানুষ দেহের চাহিদাকে পূরণ করতে চায়। ফলে দেহের বস্তুগত চাহিদাগুলো তার বোধের জগতে রাজত্ব করতে থাকে। করিম শিক্ষিত হয় কিন্তু শিক্ষাকে কাজে লাগায় কেবল দেহের বাসনাসমূহ পূরণ করার কাজে। বস্তুজগতের নিয়ম অনুযায়ী করিম সবাইকে অতিক্রম করে সর্বোচ্চ আসনটি অধিকার করতে ব্যস্ত এবং প্রয়োজনে অন্য সবাইকে বঞ্চিত করে নিজে জগতের সবচেয়ে সেরা জিনিসটি ভোগ করতে উন্মত্ত। করিম তার শিক্ষাকে প্রয়োগ করে এ ক্ষেত্রে সফলতাও অর্জন করে। কিন্তু এ পথে সে যতই অগ্রগতি অর্জন করুক শান্তি সে পায় না। কারণ, আত্মা সমান্তরাল রেখার মতো দেহের সহগামী হয় না। শান্তি লাভের জন্য প্রয়োজন ভিতর ও বাহিরের সামঞ্জস্য। আত্মা ও দেহের সমান্তরাল উদ্ধরণ।