মানুষ কি সৃষ্টির সেরা জীব?
সিদ্ধার্থ ॥ আমরা শুনে এসেছি মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল
মাখলুকাত। কিন্তু আসলেই কি তাই? জীব জগতের অন্যান্য প্রাণীরা কি স্বীকার করে যে মানুষই
সৃষ্টির সেরা জীব? মানুষ যে সৃষ্টির সেরা এটা তো কেবল মানুষেরই ঘোষণা! নিজেকে যে বড়
বলে বড় কি সে হয়?
দৈহিক শক্তির দিক থেকে মানুষ যে জীবজগতে শ্রেষ্ঠ নয় এ নিয়ে
বিতর্কের অবকাশ নেই। তাহলে কি বুদ্ধিমত্তায় মানুষ সেরা জীব? আধুনিক প্রাণী বিজ্ঞানীদের
মতে অনেক প্রাণী রয়েছে যাদের বুদ্ধি মানুষের চেয়ে বেশি। অনেক প্রাণীরই রয়েছে প্রতিকূল
পরিবেশে টিকে থাকার এমন অসাধারণ ক্ষমতা যার সাথে মানুষের কোন তুলনাই চলে না। প্রত্যেক
প্রাণীরই কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে। কুকুর এর ঘ্রাণশক্তি, বাজপাখির দৃষ্টিশক্তি, হরিণের
শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। বাদুর শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে পথ চলতে পারে। মানুষ
দৃশ্যমান আলো ছাড়া চোখে দেখে না কিন্তু নিশাচর প্রাণীরা অন্ধকারেও চোখে দেখে। অতি ছোট
প্রাণী পিঁপড়ার অধ্যবসায় ও জীবন প্রণালী সব সময়ই মানুষকে কৌতূহলী করেছে। পিঁপড়ার জীবাণুর ভয় নেই, তারা যে মাটিতে বাস করে
তা ব্যাকটেরিয়াতে পরিপূর্ণ। কিন্তু কিছু পিঁপড়া মানুষের মতোই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার
ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকে। তারা নিজেদের দেহ গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত জীবাণুনাশক পদার্থ
দিয়ে দেহকে জীবাণুমুক্ত রাখে এমনকি তারা তাদের বাসস্থানও পরিচ্ছন্ন রাখে যাতে ছত্রাক
আক্রমণ করতে না পারে।
পশুগণের কোন নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম নেই। কিন্তু মানুষের কি
আছে? মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী ধর্ম কিংবা
আদর্শের দোহাই দিয়ে স্বজাতিকে হত্যা করে না। পশুগণ শান্তশিষ্টভাবে বনে বাস করে। তাদের
জীবনে কোন বিশৃঙ্খলা নেই। তাদের মধ্যে লোভ-লালসা, সঞ্চয় প্রবণতাও নেই। হত্যা, খুন,
ধর্ষণ, অপহরণ তারা করে না। মানুষ অপরাধ প্রবণ প্রাণী। সুযোগ পেলেই অপরাধ করে। তাই মানুষকে
শাসনে রাখার জন্য আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন খাদ্যের চেয়ে বেশি
উৎপাদিত হচ্ছে মানুষ হত্যার সরঞ্জাম। পুলিশ, দাঙ্গা পুলিশ, সেনা, উকিল, বিচারপতি আরো
কত কি যে মানুষ তৈরি করেছে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তার হিসেব নেই। মানুষ নিজের
বাড়ি-ঘর আর দেশ অন্য মানুষের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কিংবা দখল করার জন্য সেনাবাহিনী
তৈরি করেছে। ট্যাঙ্ক, আণবিক বোমা, যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করেছে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা
স্বজাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ রাখে।
মানুষ ভিন্ন অন্য কোন প্রাণী স্বজাতির অন্য কোন প্রাণীকে
ভয় করে না। কেবল মানুষই মানুষকে ভয় পায়। মানুষ প্রকাশ্যে মানুষকে খুন করে, অন্যরা তাকিয়ে
দেখে। মানুষ মানুষের সম্পদ লুট করে, মানুষ মানুষকে ধর্ষণ করে, অপহরণ করে। মানুষের মতো
এত অসহায়, ভীত ও সন্ত্রস্ত প্রাণী আর একটিও নেই।
মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা নিজেদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি
করেছে। কেউ দামি জামা কাপড় পড়ে। দামি গাড়ী হাকায়। নাইট ক্লাবে যায়। অন্যের টাকা আত্মসাৎ
করে সম্পত্তি সঞ্চয় করে। অন্যান্য পশুগণ সকলেই সমান, কারোই জামা-কাপড় নেই। নেই সঞ্চয়
প্রবণতা।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা গেছে, মা-কুকুর তার
বাচ্চাকে দুগ্ধপান করাচ্ছে, তখন পাশে থাকা তৃষ্ণার্ত একটি ছাগলছানা দৌড়ে এসে কুকুরের
দুধ পান করছে। মা-কুকুরটি বিজাতীয় বলে ছাগলছানাটিকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে না কিংবা তার
বাচ্চটিও ছাগলছানার তৃষ্ণা নিবারণে বাধা দিচ্ছে না। সম্প্রতি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের
একদল গবেষক প্রমাণ করেছেন, শিম্পাঞ্জিরা বিরোধ নিষ্পত্তিতে একজন মধ্যস্ততাকারী নির্বাচন
করে এবং ৬৯টি বিরোধের মধ্যে ৬০টির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতায় সমস্যার সমাধানও হয়। মানুষ পারস্পরিক
বিরোধ নিষ্পত্তিতে শিম্পাঞ্জি থেকে অনেক পিছিয়ে।
বিজ্ঞানীদের মতে শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষের জ্ঞানের ফ্রাগমেন্ট
হচ্ছে ৩টি। হাঁস-মুরগি, ছাগল-ভেড়ার জ্ঞানের ফ্রাগমেন্টও ৩টি। ওরা যতটুকু চিন্তা করতে
পারে, আমরা ওদের চেয়ে একটুও বেশি চিন্তা করতে পারি না। পার্থক্য এখানেই যে, আমাদের
মধ্যে জ্ঞানীদের আবির্ভাব ঘটেছে, ওদের মধ্যে কোনো জ্ঞানী আসেনি। আমরা জ্ঞানীদের জ্ঞান
ধারণ করতে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োগ করতে পারি। এই জ্ঞানীগণ যদি না আসতেন, তাহলে আজও আমরা
শিম্পাঞ্জি এবং বানরের মতো বনে-জঙ্গলে উলঙ্গ হয়ে বাস করতাম। একটি সাপ ডিমের খোলস থেকে
বের হয়েই খেতে পারে, ফণা তুলতে পারে, দৌড়াতে পারে। একদিনের মুরগির বাচ্চার মধ্যে ভয়-ভীতির
অনুভূতি থাকে। মানুষের বাচ্চা একদিন তো দূরের কথা ৬ মাসেও তার মধ্যে ভয় সৃষ্টি হয় না।
প্রায় প্রতিটি প্রাণী জন্মের পর কয়েক দিনের মধ্যেই নিজের খাদ্য নিজে যোগাড় করে খেতে
পারে কিন্তু মানুষকে এজন্য অপেক্ষা করতে হয় ২৫ বছর।
মানুষ বোকামি করলে ‘কাকের মতো বোকা’ বলা হয়। কিন্তু বিজ্ঞান
বলে, কাক খুবই বুদ্ধিমান। কাক তাদের নিজেদের সুবিধামত ডাল-লতাপাতা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস
তৈরি ও ব্যবহার করতে পারে, যে সব জায়গায় খাবার পাওয়া যায় সেসব জায়গা মনে রাখতে পারে।
শক্ত খাদ্য কাক রাস্তায় ফেলে রাখে। গাড়ি আসলে খাদ্য ভেঙ্গে যায়, ফলে তারা সেগুলো খেতে
পারে। শুধু তাই নয়, একটি কাক যে ঝাঁকের সদস্য, সে সেই ঝাঁকের অন্য কাকদের সাথে সমাজবদ্ধ
হয়ে বিভিন্ন কাজ করে। একটি কাকের মৃত্যু হলে সামাজবদ্ধ কাকদের মধ্যে তীব্র আবেগের সৃষ্টি
হয় যা মানুষের মধ্যেও হয় না।
অনেকেরই ধারণা কুরআনে বলা হয়েছে, মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত।
কিন্তু এ ধারণা সঠিক না। কুরআনের কোথাও বলা হয়নি যে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বরং কুরআন
মতে অধিকাংশ মানুষই মূর্খ - ৬:১১১; অকৃতজ্ঞ - ২:২৪৩, ৭:১৭, ১২:৩৮, ১৬:৮৩, ২৫:৫০, ২৭:৭৩,
৪০:৬১; নাফরমান - ৭:১০২, ৫:৫৯; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী -৯:৮, অবিশ্বাসকারী - ২:১০০, ১৩:১,
১২:১০৩, ২৬:৮, ২৬:৬৭, ২৬:১০৩, ২৬:১২১, ২৬:১৩৯, ২৬:১৫৮, ২৬:১৭৪, ২৬:১৯০, ৩৬:৭, ৪০:৫৯;
অস্বীকারকারী - ১৭:৮৯; মিথ্যাবাদী -২৬:২২৩; মুশরিক - ৩০:৪২; বিপথগামী - ৩৭:৭১; অবুঝ
- ২৯:৬৩, ৩৪:৩৬, ৩৯:৪৯, ৪০:৫৭, ৪৪:৩৯, ৪৫:২৬, ৪৯:৪; পাপাচারী - ৩:১১০, ৫৭:১৬; ৫৭:২৬,
৫৭:২৭। কুরআন মতে অধিকাংশ মানুষই সত্য ধর্মে নিস্পৃহ (৪৩:৭৮); অন্ধ ও বধির (৫:৭১);
অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই (৫:১০৩); অধিকাংশ মানুষই উপলব্ধি করে না (৭:১৮৭); অধিকাংশ
মানুষই সত্যকে অপছন্দ করে (২৩:৭০); অধিকাংশ মানুষ শুধু আন্দাজ-অনুমানের উপর চলে (১০:৩৬),
অধিকাংশ মানুষ চতুস্পদ জন্তুর মতো বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট (২৫:৪৪)।
কুরআন মতে - “যারা সৎকর্ম করে তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ (সুরা
বাইয়িনা:৭)”। মানুষ মাত্রই সৃষ্টির সেরা জীব নয় তবে মানুষের মধ্যে সৃষ্টির সেরা জীব
হিসেবে নিজেকে তৈরি করার সম্ভাবনা রয়েছে, পশুর মধ্যে সেই সম্ভাবনা নেই, পার্থক্য কেবল
এইটুকুই।