উন্নয়নের
বড় প্রতিবন্ধক ধর্মান্ধতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি
সংলাপ ॥
স্বাধীনতার ৪২ বছর
পর আজও বাংলাদেশে দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা জনগণের নিত্য সঙ্গী। বাহ্যিক দৃষ্টিতে
বাংলাদেশ আজ অনেক এগিয়ে গেছে বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা যা ইতোমধ্যে
১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে তার সাথে মিলিয়ে দেখলে এবং দেশের সর্বত্র, একটি বিশেষ শ্রেণী বাদে, সর্বস্তরের জনগণের অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায় অধিকাংশ মানুষ মানবেতর
জীবন-যাপন করছে অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের বিচারে। গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, বন্দরে, রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে, চলার পথে, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর কাজ শরু এবং শেষ
হওয়ার সময়, শহরের বস্তিসহ নিম্ন আয়ের মানুষদের আবাসস্থলে
যা সচরাচর দেখা যায় তাতেই ফুঠে ওঠে দেশের প্রকৃত চিত্র। অধিকাংশ মানুষেরই হাড্ডিসার
অবস্থা, চামড়া এবং মাংস যেন এক হয়ে গেছে। অধিকাংশের
চিন্তা-চেতনাও নিদারুণভাবে পশ্চাদপদ।
তথ্যপ্রযুক্তির যেমন বিপুল বিকাশ, এত এত
টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান, ধর্মীয় বয়ান, নামাজ, রোজার
শত সহস্র ফায়দা হাসিলের কথা শোনা গেলেও গরীব মানুষের স্রোতটি দিন দিন শুধু বড়ই হতে
চলেছে। এই গরীবতাকে পুঁজি করেই স্বার্থান্বেষী রাজনীতিক ও ধর্ম-ব্যবসায়ী নামের এক শ্রেণীর
অমানুষ অসহায় গ্রামীণ জনতাকে ঠেলে দিচ্ছে জঙ্গীবাদ ও উগ্রপন্থার দিকে। আবহকাল ধরে গ্রামের
মানুষরা যেভাবে সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল তা থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
আর এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও তাদের সরলতা ও অজ্ঞতাকে পুঁজি করে বিদেশ থেকে অর্থ এসে একশ্রেণীর
শিক্ষিত ও মতলববাজরা অঢেল সম্পদের মালিক হচ্ছে। ধর্মপ্রাণ ও ধর্মভীরু মানুষের এই বাংলাদেশে
একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় - একদিকে ধর্ম আর অপরদিকে রাজনীতিক সার্টিফিকেট - এই দু’টিই
হচ্ছে বর্তমান যুগে বড় লোক হওয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আরো বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, এই দুইয়ের
সাথে দুর্নীতি, সুবিধাবাদিতা, কালোবাজারি মনোবৃত্তি, ‘গডফাদার’দের
সাথে কৌশলগত সুসম্পর্ক বজায় রেখে এক শ্রেণীর মানুষ ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে’ - গত ১০/১৫ বছরে। এ সময়ে ধনীরা হয়েছে আরো ধনী, গরীবরা
হয়েছে আরো গরীব। অথচ বিদেশে কর্মরত লাখ লাখ বাংলাদেশীর পাঠানো বিপুল অর্থ এবং পোশাক
রপ্তানী করে অর্জিত বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দেশের ও জনগণের সার্বিক কল্যাণে ব্যয়
করা গেলে এমন দূর্বিষহ অবস্থায় দেশকে পড়তে হতো না। যে মানুষ নিজের মধ্যে যা ধারণ করে
সেটিই যে তার ধর্ম একথা ঘুণাক্ষরেও কোন ধর্ম ব্যবসায়ীকে বলতে শোনা যায় না। ইসলাম ধর্মের
মূলের কথা যে, ‘শান্তি’- এ বাণী কয়জন মানুষকে বুঝিয়েছে ধর্ম-ব্যবসায়ীরা? অপরদিকে
কথিত শিক্ষিত শ্রেণীটিও যে বড় বেশি স্বার্থপর। বিশেষ করে বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায়
যেমন রাজনীতিক, আইনজীবী, শিক্ষক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ধর্মবেত্তা
ও ধর্মজীবীরা - এদের অনেকের ব্যক্তিস্বার্থপরতার মনোবৃত্তি যেভাবে আজ জাতিকে আষ্টে-পৃষ্ঠে
বেঁধে ফেলেছে তা থেকে মুক্ত হওয়া না গেলে বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তি কখনো সম্ভব
নয়। রাষ্ট্রের সম্পদ ও নগদ অর্থ লুটেরাদেরকে বিচারের আওতায় আনার যে ব্যবস্থা আজ সামাজিক
অবস্থার মধ্যে নেয়া হচ্ছে তা আশাপ্রদ হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিবাজদের বিচার কে করবে? সে প্রশ্ন
আজ বাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে যাদের আটক করে আজ জেলখানায়
সাধারণ কয়েদীদের মধ্যে রেখে বিচার করা হচ্ছে, তাদের আশীর্বাদক ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক
দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা যাদের সংগঠন অত্যন্ত শাক্তিশালী ছিল
খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের মধ্যেই। মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত
ধর্মজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ধর্মীয় সন্ত্রাসের সমর্থন করতো না এমন মানুষ খুঁজে
পাওয়াই এতদিন কঠিন ছিল। ধর্মের নামে ব্যবসাকারী ধর্মজীবী এবং সুবিধাভোগী বুদ্ধিবৃত্তিক
দুর্নীতিবাজ বুদ্ধিজীবীদেরকে বিচারের আওতায় আনাই আজকের সময়ের দাবী। এরাই দেশ ও জাতির
সবচেয়ে বড় শত্রু ।