বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

শেকড়ের সন্ধানে সত্যমানুষ লালন সাঁঈজী


শেকড়ের সন্ধানে সত্যমানুষলালন সাঁঈজী


আপনি আপনার মনের জান ঠিকানা
পরের অন্তর সে যে সমুদ্দুর,
কিসে যাবে জানা।
সংলাপ ॥ উন্মুল স্বদেশ ভাসছে সময়ের স্রোতে। ভুগছে পরিচয়-সঙ্কটে। নদ-নদী বিধৌত এ বঙ্গভূমির মানচিত্র বার বার শিকার হয়েছে ভাঙ্গা-গড়ার। নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে এর পরিচয় বিভ্রান্তি। অভিন্ন আকাশ, অভিন্ন মাটি আর জলবায়ুতে হাজার বছরে বেড়ে ওঠা এই জনপদের মানুষগুলো পরস্পর ভিন্ন হয়ে পড়ে পরিচিতির প্রশ্নে। দু’শ বছরের ইংরেজ শাসন আর ১৯৪৭-এর ঐতিহাসিক প্রতারণা এই পরিচয় বিভ্রান্তিকে ঠেলে দেয় আরো অতলে। সিকি শতাব্দির লড়াই- সংগ্রাম আর কঠিন ‘ঠেকে শেখার’ বিনিময়ে ১৯৭১-এ এসে খন্ডিত বাংলার পূর্বাঞ্চলের মানুষ খুঁজে পায় আপনারে। ‘বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা-আমি বাঙালি।’ এই শাশ্বত সত্য ধরা পড়ে উপলব্ধিতে।
তবে সে উপলব্ধি ধরে রাখা যায়নি স্থায়ীভাবে। মানচিত্রের বিভক্তির মতই বাঙালি জাতি জড়িয়ে পড়ছে সর্বনাশা মানসিক বিভক্তিতে। টান পড়ছে খোদ জাতিসত্ত্বার মূলে। মানুষে-মানুষে, বাঙালি-বাঙালিতে ভেদাভেদ আজ বর্তমান। অথচ, সেই মধ্যযুগেই বাঙালি কবি চন্ডিদাস বলেছিলেন-
শোন হে মানুষ ভাই
সবার উপর মানুষ সত্য
তাহার উপর নাই।
গত শতাব্দীর গোড়ায় সাধক নজরুল ইসলাম বলেছিলেন -
ওরা হিন্দু না মুসলিম
ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী- বলো ডুবিছে মানুষ
সন্তান মোর মা’র।
একই জনপদে একই জলবায়ুতে অভিন্ন ভাষা, অভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পরিচিতিটাই বড় এবং প্রথম। সত্যকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে বুঝে বা না বুঝে প্রতিনিয়ত নিজের সাথে নিজে প্রতারণা করে চলেছি আমরা। আজ প্রয়োজন এই আত্মপ্রতারণার আঁধার থেকে বেরিয়ে আসা।
সত্যমানুষ লালন সাঁঈজী ঠিক এক্ষেত্রেই গোটা বাঙালি জাতিকে দেখিয়ে গেছেন আলোর পথ। ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের উর্দ্ধে উঠে গিয়ে গেয়েছেন শাশ্বত মানবতার জয়গান। অকুতোভয়ে উচ্চারণ করেছেন -
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।
সাঁঈজীর এই আদর্শ মানব সমাজ প্রতিষ্ঠা আজ নতুন শতকের দাবি। বাঙালি জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য তা জরুরীও বটে।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘বাউল’ মতের মূল ভাবধারা। কালক্রমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্ম-দর্শন ও সাধনার সমন্বয়ে এ ধারা আরো সমৃদ্ধ ও ব্যাপকতা লাভ করেছে। ড. আহমদ শরীফ বলেছেন “বিভিন্ন মতবাদের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাউল মত। হিন্দু-মুসলমানের মিশ্রনে হয়েছে বাউল সম্প্রদায়, তাই পরমত সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গ্রহণশীলতা, বোধের বিচিত্রতা, মনের ব্যাপকতা ও উদার সদাশয়তা এদের বৈশিষ্ট্য। বৈশিষ্ট্যে ও বৈচিত্র্যে এই বাউল মতধারার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে উনিশ শতকের বাউল সাধক লালন সাঁঈজীর সাধনা ও সৃষ্টির সম্ভারে।
বাঙালি সংস্কৃতিতে ‘লালন’ একটি অপরিহার্য নাম। একজন কুঠিবাসী সত্যমানুষ মধ্য যুগের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে যে সত্য-দর্শনের ভেদ উন্মোচন করে দিয়ে জীবনকে সুন্দর করার মহান পথ বাতলে দিয়েছেন তা বর্তমান আধুনিক যুগেও প্রত্যেক বাঙালিকে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
তথাকথিত সভ্য সমাজের শহুরে সভ্যতার কৃত্রিম বলয়ে নিজেকে নিপতিত না করে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় নির্জন গ্রামীণ পরিবেশে আর্তজনের আত্মার আত্মীয় হয়ে স্বকীয় সাংস্কৃতিক আবর্তে লালন হয়ে উঠেছেন চিরন্তন এক সত্তা ও বোধ। অসাধারণ প্রজ্ঞায় ও ধর্মতত্ত্বের দ্বারা তিনি পথভ্রষ্ট মানুষকে দিয়েছেন সৎ-সত্য পথের দীক্ষা। ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘বাউল ধর্ম সম্প্রদায় আর্য-অনার্য, হিন্দু, বৌদ্ধ ও সূফী ভাবধারার সমন্বয়ে গঠিত বাংলার একান্ত নিজস্ব একটি ধর্ম সম্প্রদায়। এই ধর্ম কোন অভিজাত সম্প্রদায়ের ধর্ম নয়। এটা জনসাধারণের ধর্ম। লৌকিক ধর্ম। আমরা জানি, ধর্ম সংস্কৃতিরই একটি অঙ্গ। সুতরাং বৃহৎ চিন্তায় আমরা বলতে পারি লালন-সংস্কৃতি বাংলার একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি বাঙালিরই সংস্কৃতি।’
সভ্যতার ক্রমবিকাশে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, প্রতিটি ধর্মকেই বাঙালি তার সংস্কৃতির সাথে মিশ্রিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে সাগরের মতো উদার হয়ে। তাই প্রতিটি ধর্ম সম্বন্ধীয় মতবাদ থেকেই বাঙালি তার জন্য প্রযোজ্য সত্যকে অনুসন্ধান করে নিজেকে করেছে সমৃদ্ধ। ধর্মীয় চেতনাগত সত্যে বাঙালি গড়ে তুলেছে ঐক্যের বন্ধন। এই চেতনিক ঐক্যে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে শান্তির ঠিকানা। যার জন্য সত্যমানুষ লালন সাঁঈজীর কাছে এসে বাঙালিকে ঋণী হতেই হয়। চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব শান্তি-ধর্ম এর দিক নির্দেশক হিসেবে তাঁকে অর্পণ করে হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার্ঘ।

অর্থনৈতিক গণতন্ত্র


অর্থনৈতিক গণতন্ত্র

সংলাপ ॥ দেশের রাজনীতিকরা স্বতঃসিদ্ধ বলে হয়তো ধরে নিয়েছেন যে, সমাজে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য থাকবেই। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চলমান অমিল বোধহয় এখান থেকেই শুরু। প্রকৃতি তার উন্মুক্ত আকাশ, বিশুদ্ধ বাতাস এবং অপরিমিত জলসম্পদ দিয়ে আমাদের সবাইকে ধনী করে রেখেছে। আমরা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রকৃতির অকৃপণ দান পাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রেণীবৈষম্য তৈরি করে চলেছি। সামাজিক ধনসম্পদের বৃহৎ অংশ কতিপয়ের গুদামে ঢুকবে আর গণমানুষের অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমের শাঁসটুকু নিংড়ানো আঁটিটি ভাগ্যে জুটবে এটাই ভবিতব্য।
অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক নেতা ফজলুল হক একটা বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, ‘দুটো বোকা লোক তালগাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ধুপ করে তাদের সামনে একটা তাল ভূমিতে পড়লো। দু’জনাই দৌড়ে তালটার মালিকানা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করল এবং প্রায় একই সঙ্গে তালটাকে ছুঁয়ে ফেলল। তারপরে শুরু হল কাইজা। এ বলে আমি ধরেছি ও বলে আমি। কাইজা চরম স্তরে পৌঁছল। পাশ দিয়ে এক ধূর্ত যাচ্ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, তোমাদের কলহের কারণটা কী? দুজনেই চিৎকার করে তালটির মালিকানা দাবি করতে থাকল। ধূর্ত লোকটি তাদের বোঝালেন, এসো তোমাদের কলহের মীমাংসা করে দিচ্ছি। তার নির্দেশমতো তালটিকে খুলে ফেলা হল। দেখা গেল ভেতরে তিনটা কোয়া। দাবিদার দুজনের মধ্যে সেটা সমান ভাগ করা সম্ভব নয়। তখন ধূর্ত লোকটি বললেন, এক কাজ কর, তোমরা দুজনাই একটা করে কোয়া নাও আর একটা আমার কাছে থাকুক। যে যখন আমার পেছনে ঘুরঘুর করবে তার জিহ্বায় একটু ঠেকিয়ে দেব। এই সূত্রেই মীমাংসা চিরকালীন রূপ পেল। সমাজের উৎপাদিত ধনসম্পদ সমভাবে বণ্টন অসম্ভব। তাই ধূর্ত পণ্ডিত, শাসক, এবং তাদের শক্তির আধার ব্যবসায়ীরা এক একটা করে ফাউ কোয়া নিয়ে সম্পদ সৃষ্টি ও সঞ্চয় করে চলেন এবং তা গুদামে ভরে রাখেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। বায়ান্ন সালের পর ভারতবর্ষের প্রয়াত পন্ডিত জওহরলাল নেহরু জেল থেকে বেরিয়ে এসে শুনলেন দুর্ভিক্ষের তাড়নায় হাজারে হাজারে দরিদ্র মানুষ, বৃদ্ধ, শিশু অনাহারে প্রাণ দিয়েছে। আর ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ মানুষের খাবার গুদামজাত করে রেখেছেন। তিনি প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন যে, এরা না মরে লুঠ করে খেতে পারল না! আমার ক্ষমতা থাকলে এই সমস্ত কালোবাজারি মজুতদারদের পাশের ল্যাম্প পোস্টে ঝুলিয়ে দিতাম। কিন্তু তিনি একজন কালোবাজারিকে বা অসাধু ব্যবসায়ীকে ল্যাম্প পোস্টে টাঙাতে পারেননি। তারপরে একবার নির্বাচনের সময় দেখা গেলো হাজার হাজার নেহরু ল্যাম্প পোস্টে ছবি হয়ে ঝুলছেন। গোটা বিশ্বের মনুষ্য সমাজে এটাই রীতি। এ দেশে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালন সাঁইজী ও বিবেকানন্দের মতো কিছু মানুষ জন্মেছিলেন। তাবত বিশ্বের ক্ষেত্রেও এই কথাটা বলা যায়। তাঁরা যুগ যুগ ধরে দরিদ্র, বুভুক্ষু, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, শিক্ষাহীন, স্বাস্থ্যহীন মানুষদের পক্ষ হয়ে কথা বলেছেন। তাঁরা এর থেকে মুক্তির জন্য নানা পথের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁরা এতছত্রে ও সর্ব অর্থে বলবান। কতিপয় রাজনীতিক ব্যবসায়ী ধর্মের নামে, সংস্কৃতির নামে, রাজনীতির নামে, দেশপ্রেমের নামে, জনসেবার নামে সে পথগুলো অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে চলার রাস্তা খুঁজে বের করে নিয়েছেন। বেহুলার বাসরঘরে একটি ছিদ্র বিষধরের প্রবেশকে নিশ্চিত করতে পারে। এ তো শতছিদ্রের কাহিনী। গোটা দুনিয়ায় লক্ষ লক্ষ শিশুর শৈশব কেড়ে নেয়া হচ্ছে। যৌবন দুঃসহ ভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। আর বার্ধক্যের মসজিদ বা মন্দির সে তো নরকবাস। পশ্চিমের উন্নত সভ্য জাতগুলো চীনের মতো এত বড় দেশকে আফিমের বিষ দিয়ে নির্জীব করে রাখতে পেরেছিল।
অবস্থার পরিবর্তন এবং এক ধরনের একটা উন্নয়ন প্রচেষ্টার চেষ্টাও যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। দুটো শিল বিপ্লবের পর উন্নয়নের ধন সৃষ্টি ও সম্পদ বৃদ্ধির জোয়ার এসেছে। পৃথিবী প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্বে ভাগ হয়ে গেছে। বিদেশীরা আমাদেরকে তৃতীয় বিশ্বের লোক বলে। কেউ জোর গলায় বলেনি বা বলছেনা, পৃথিবী একটাই, সেটা প্রকৃতিসৃষ্ট। আর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ব্যাপারটা কিছু মানুষের চতুরতা। এই যে পৃথিবীব্যাপী ধনবৈষম্য, অর্থনৈতিক দিক থেকে শ্রেণী বিভাজন, উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেটা নতুন রূপ নিয়ে চলমান। সমাজের মূল ভিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তার ওপর নির্ভর করেই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে এবং উঠছে। শেষ পর্যন্ত অর্থব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তারাই প্রকৃত অর্থে দেশের মালিক সেজে বসে আছেন। তাদের  ব্যবস্থাটাকে কায়েম রাখার জন্য ধনকুবেররা নানান ধরনের ছাতা মাথার ওপর ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এই ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক এবং স্থায়ীকরণের জন্য এক ধরনের সামাজিক পরিকাঠামো জন্ম নিচ্ছে। ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জাতিতে জাতিতে, বর্ণে বর্ণে ভেদাভেদ এবং সর্বোপরি সামরিক ক্ষমতা এই ব্যবস্থাকে প্রতিবাদী উত্তাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুগে যুগে এই প্রতিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে এবং শক্তিধররা মূল চরিত্র বজায় রেখে কিছু কিছু সমঝোতা করার চেষ্টা করে চলেছেন। ফ্রান্সের বিপ্লব গোটা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক শোষণের সুযোগ শেষ পর্যন্ত সালিশি করে হয়ত অর্জন করেছে কিন্তু অর্থনৈতিক গণতন্ত্র কোথাও স্বীকৃত হয়নি।

সরলে গরল!


সময়ের সাফ কথা....
সরলেগরল!

নজরুল ইশতিয়াক ॥ সহজ এখানে সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে দূর্বোধ্য। সরল এখানে গরলে মিশে চরিত্র হারিয়ে ফেলছে। মনে হবে দুই মন পাথরের টুকরার ভেতর থেকে একটি চালের টুকরা বের করার মত। আগে মনে করতাম যার যা বলার না তাই বলছে। এখন মনে হয় ঠিকই বলছে। যার যা বলার, সে তা-ই বলছে। আর তাই কোন মান বহন করে না এমন সব অরুচিকর বাক্যালাপে পরিবেশ অসহনীয় বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। জনগণ যাদের রাজনীতি করার অনুমতি-সম্মতি কোন কিছুই দেয়নি উপরন্তু যারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের উপর কোন ভরসা করে না, ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা থাকার জন্য তারাই প্রতিটি কথায় জনগণ জনগণ বলে চিৎকার করতে করতে ভারি করে তুলছে বাংলার আকাশ বাতাস। ক্ষমতা কিনতে যেয়ে আত্মসম্মান, মান মর্যাদা বিকানোর প্রতিযোগিতা চলছে। বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাকোয়াজ ও অপরাজনীতির সময় এটি। রাজনীতি নামক শব্দটায় প্রাণ যেন ত্রাহি ত্রাহি করছে। মিথ্যাচারের কবিতা আবৃত্তিতে পটু কাপালিক নেতা নেত্রীদের শব্দযন্ত্র তবু বন্ধ হয় না। ভয়ানক শব্দ দূষণের শহর এই ঢাকা আর মাঝরাতের ব্যাঙগুলো। তিন চার দিক থেকে ওয়াজ বয়ানের নামে অরুচিকর যান্ত্রিক দূষণ এতটাই ভয়াবহ যে স্মরণকালের সমস্ত দূষনকেও হার মানাবে। রাস্তায়, অফিস পাড়ায়, বাজারের মোড়ে মোড়ে আড্ডায় সব ধরনের আলাপ চারিতায় সীমাহীন অস্থিরতা ও বাক্য দূষণ আমাদের চরম অসুস্থতাকেই তুলে ধরছে। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি যেদিকে তাকায় সব অসুস্থ্যতাকে দেখতে পায়। 
যাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোন সততার সৌন্দর্য নেই তারাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার দেশের ভবিষ্যৎ কামনা নিয়ে। সরকারী সম্মানজনক পেশায় থেকে অবসরের পর আরো কোন লোভনীয় পদ পদবী পাওয়ার দৌঁড়ে বেহায়া নির্লজ্জতার বীভৎসতা দেখতে হচ্ছে আমাদের। ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বের হতেই পারছে না রাজনীতি। একটার পর একটা গেম প্ল্যান শান্তি সমৃদ্ধির পথ আটকে দাড়াচ্ছে ।
চরিত্রহীনরা চরিত্রবান হবার দৌড়ে পেরেশান হয়ে ধরাশায়ি হলেও ব্যাধির মাত্রা এতটাই উর্দ্ধমূখী যে হৃদয়যন্ত্রে লাজ-লজ্জা, লোক-লজ্জার ছিটে ফোঁটাও ধরা দেয় না। প্রাসঙ্গিক কারনে সিলগালা মারা কিংবা মোহর মেরে দেয়া লোক কাকে বলে এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস কিছু বাকোয়াজ হাসফাঁস হা-হুতাসের আস্ফালন না চাইলেও শুনতে হয় দেখতে হয়। নরম আড্ডায় হাস্যবাণে কম্পন উঠে- এসব বাকোয়াজ পন্ডিতদের কথা বলার অনুমতি যারা দিয়েছে তারাও ক্লীবলিঙ্গের অধিকারী। সংশোধনের অতীত সেসব পারদর্শী ব্যক্তিদের প্রতি করুণা বর্ষণ না করে পার পাওয়ার উপায় থাকে না।
আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর জেনে লাভ নেই যারা বলতেন তাদের স্মরণ জাগ্রত করতে বলতে চাই সুদের কারবারি তো বিশ্বজয়ের কাল্পনিক স্বপ্নে বিভোর এটিকে আপনারা কি বলবেন ? যুৎসই কোন উত্তর পেলে দয়া পরবশ হয়ে জানাবেন। আর তাকে কি কি কারণে কোন কোন শর্তপূরণের জন্য সেলসম্যান নিয়োজিত করা হল তা অনুধাবণে ব্যর্থতার মূল্য চরম হবার কথা। পটুয়া কামরুল হাসান স্বৈরাচার এরশাদের পোট্রেট একে বলেছিলেন বিশ্ববেহায়ার কবলে দেশ। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন সূদ-সামাজিকতার মহানায়কের বিশেষণ কি হতে পারে? অন্যদিকে পত্রিকার পাতায় ষড়যন্ত্রের নকশা আকঁতে আকঁতে যারা মসনদ দখলের নেশায় বুদ হয়ে ভয়ানক ছঁক আঁকেন, কালো পোষাকের অন্তরালে যে সত্যিই কালো নষ্ট ভ্রষ্ট আইনবাজ নপুংসক চরিত্রহীনদের পরামর্শ জাতিকে হজম করতে হচ্ছে তাদেরকেই বা কি বলা যেতে পারে। একই সাথে প্রশ্ন হিসেবে জানার আগ্রহ সূদের সাথে ষড়যন্ত্রের যোগসূত্র কোথায়?
সূত্র বলছে সব নষ্ট, সব ভ্রষ্ট, সব ঘাতকেরা মিলে-মিশে একাকার হয়। যে কয়েকদিন তাদেরকে আলাদা দেখা যায় তা দেখার ভ্রমমাত্র। যোগসূত্র খুঁজে পাবার জন্য কিয়ৎকাল অপেক্ষার সংস্কৃতি যার জোটে সেই তো মহাভাগ্যবান। মহাকালের কাছে মানুষের দুটি ভাগ। একটি হচ্ছে মহা হতভাগ্যবান আর অন্যটি মহাভাগ্যবান। ঈমান ও বেঈমানের ফারাক নিরূপনই তো জন্মের স্বার্থকতা। নিরন্তর এই পথ চলার সত্য, পর্যবেক্ষণ করে দেখার মধ্যে সত্যানুসন্ধ্যানীদের পরম আনন্দ।
বলা হচ্ছে দুটি পত্রিকার সম্পাদক সব সময় ষড়যন্ত্র করে আসছে তখন প্রশ্ন আসে সরকার ও দলের অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্রকারীদের কি চিহ্নিত করা গেছে? ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের শত্রু মোশতাকরা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় ফাঁদ পেতে বসে থাকে। ঘরের শত্রুকে চিনলে জানলে বাইরের শত্রুদের চেনা সহজ হয়। বিনয়ের সাথে বলতে চাই লর্ড ক্লাইভ যেমন সব সময় বর্তমান তেমনি মোশতাকরাও আশে পাশে ঘুরঘুর করে। বর্ণচোরা সেসব ঘাতকদের চিহ্নিত করতে পারাটা দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের জন্য বড় আশীর্বাদ।
জানতে ইচ্ছে করে সরকারের ও দলের আশেপাশে থেকে যারা দ্বৈতনাগরিকত্ব কিংবা শরণার্থী জীবন বেছে নিয়েছেন তাদের ব্যাপারে জনগণ কি মূল্যায়ণ করছেন তা প্রবাহমান বাতাসে কান পাতলে শোনা যায়। দেশে শান্তি স্থিতি গণতন্ত্রের কথা বলে বিদেশে নিরাপদ জীবন যাপনের প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন করেছেন বা করার চেষ্টা করছেন তাদের দেশপ্রেম জনগণের কাছে নিক্তি দিয়ে পরিমাপ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বদলী খেলোয়াড় হবার জন্য সব সময় অন্যের দিকে যারা তাকিয়ে থাকেন তাদের চরিত্র জানাটা খুব জরুরী দরকার ।
মানুষের রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পেরে যারা লাশ ফেলে দেয়ার পরামর্শ দেন, লেখালেখি সম্মানজনক পেশা স্বত্ত্বেও যারা রাজ সুবিধার আশায় এজেন্সী তল্পিবাহক হওয়াকেই শ্রেয় মনে করেন তাদের প্রতি দেশবাসী বড্ড করুণার চোখে তাকিয়ে থাকেন। এসব নিদারুন অসহায়ত্বকে সংজ্ঞায়িত করার ভাষা কারো জানা নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে এসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সুশীল তল্পিবাহকদেরকে জনগণ হাড়ে হাড়ে চিনে রাখছেন।
এই লেখার শেষ করবো একটি প্রশ্ন দিয়ে, মানব সম্প্রদায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত যত ব্যবসা করেছে সব ব্যবসা কি অসামাজিক ছিল? সামাজিক ব্যবসার নামে এ কোন আষাড়ে গল্প দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীকে শুনতে হচ্ছে?