বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৪

বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ

বিশ্বমানব হবি যদি
কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ

শেখ উল্লাস ॥  বাঙালি জাতি অনেকটাই  আবেগ প্রবণ। আবেগ খারাপ কিছু নয় যদি বেগের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। লক্ষ্যহীন বেগই উন্মাদনায় পর্যবসিত হয় যেমনটি হয়েছিল এবারের বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে। ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি এদেশে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে একথা যে কেউ ধরে নিতে পারেন যে, এদেশের সবাই বুঝি বিশ্বমানব হয়ে গেছে। ব্যাপারটা কী আসলে তাই? প্রকৃত অর্থেই কি আমরা বিশ্বমানব হয়ে গেছি? নাকি কোন কিছু না বুঝেই প্রিয় দলের সমর্থনে উত্তাল হয়ে যাচ্ছি? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বেশ কিছু নিরীক্ষার প্রয়োজন।
যখন গণমাধ্যমে বিশ্বকাপ নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না, তখন আমাদের ফুটবল খেলার মান এশিয়ার মধ্যে আরব-কোরিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল। বর্তমানে দৃশ্যপট পাল্টেছে। টিভির পর্দা ছাড়া বাংলাদেশের মাঠে-ময়দানে ফুটবল খেলা এখন নেই বললেই চলে।  সম্প্রতি জাতীয় ফুটবল লীগের যে ক'টি খেলা বিটিভিতে দেখানো হয়েছিল তাতে ষ্টেডিয়ামে দর্শকশূন্যতা প্রকট আকারে ধরা পড়ে। জাতীয় লীগে মাঠের অবস্থা যখন এমন দর্শকশূন্য, তখন দেশের বিভাগীয়-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের মাঠগুলোর অবস্থা আর কি হতে পারে? বিশ্ব ফুটবলের মানদণ্ডে এখন বাংলাদেশের স্থান অনেক নেমে গেছে। তাই দেশের ফুটবলে আগ্রহ হারিয়ে নতুন প্রজন্ম আজ বিশ্বফুটবল তারকাদের নিয়ে পাণ্ডিত্য জাহির করছে। এই অবস্থায় দেশীয় ও জাতীয় ফুটবল সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের আরও বেশি উদাসীন হয়ে পড়ার শংকা রয়েছে। এদিকে ফুটবলের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও চলছে সার্বিক মানের চরম দূরাবস্থা। এ সুযোগে সাধারণ মানুষসহ নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় ঢুকে গেছে বিদেশি ক্রীড়াঙ্গণ। এ উদাসীনতার জন্য কে বা কারা দায়ী? তথ্য প্রযুক্তির আগ্রাসন? নাকি ক্রীড়া আয়োজকগোষ্ঠী, যারা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন? এসব প্রশ্ন আজ দেশের সর্বমহলের। নীরিক্ষায় দেখা যায়, একটি দেশের সার্বিক উন্নতির মানদণ্ড নির্ভর করে সে দেশের খেলাধুলা শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের উপর। হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধশালী এদেশ একসময় নিজস্ব খেলাধুলায় এগিয়ে ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনেও এদেশের অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয় ও প্রতিযোগিতা মুখর।  সেসময় খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠতো। এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যুবাদের মধ্য থেকে তৈরি হতো নতুন কুশলী খেলোয়াড়, যারা নিজ এলাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনে নেতৃত্ব দেয়ার মতো গুণাবলী অর্জন করতো। আজ তা অনুপস্থিত। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে ৯০'র পর এদেশে এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে  রাজনীতিজীবীদের মতো ক্রীড়া-সংগঠকদের অনেকের মাঝেই বাণিজ্যিক মনোবৃত্তিটা প্রবলভাবে জেগে উঠেছে। দেশের খেলাধুলার মানোন্নয়নের  চেয়ে নিজের প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়িক ফায়দা অর্জনেই তারা মনোযোগী হন বেশি। এসব কারণে সাধারণ মানুষও ক্রীড়াঙ্গন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পরিণতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতি-সমাজ ও  ক্রীড়াঙ্গণ।
এদেশে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেও খেলাধুলার মান যেমন ছিল, বিশেষ করে ফুটবল নিয়ে সাধারণ মানুষের যে আকর্ষণ ছিল তা আজ খুঁজে পাওয়া যায়না। বরং নতুন করে ভীনদেশী ফুটবল নিয়ে মাতামাতি প্রবল হয়েছে। এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ  বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে এদেশে যে মাতামাতি হয়েছে তা ছিল লজ্জাজনক ও  আইন-বিরোধী ব্যাপার। কেননা, ১৯৭২ সালের পতাকা আইনে বলা আছে যে, নিজ দেশের পতাকা ছাড়া অন্য কোন দেশের পতাকা সংশ্ল্লিষ্ট দূতাবাস ছাড়া  নিজ ভবনে কিংবা অন্য কোথাও ওড়ানো দেশোদ্রোহিতার সামিল। ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে উল্লাস করার মতো প্রকাশ ও পতাকা নির্ভর আনন্দ- করার সুযোগ বর্তমান প্রজন্ম পাচ্ছে না বলেই কী বিদেশি পতাকা নিয়ে এমনটি হচ্ছে? নাকি পতাকা আইনের বিষয়টি নতুন প্রজন্মকে জানানোই হয়নি! এভাবে চলতে দিলে দেশাত্মবোধ, আত্ম-উন্নয়ন এবং সচেতনতাবোধ জাগ্রত হবে কী?  এর উত্তর পেতে সংস্কারক ও ক্রীড়ানুরাগীদের সচেতনতা এখন  সময়ের দাবী।
সম্প্রতি স্থানীয় ও আঞ্চলিক ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিযোগিতার সূত্র ধরে  সংঘাত এখন নিয়মিত ব্যাপার। তাই, সহিংসতা রোধে গ্রাম-মফস্বলের স্কুল-কলেজের মাঠে খেলাধুলা নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি টাঙ্গিয়ে রাখতে হচ্ছে। ক্রীড়াঙ্গনে এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের খেলার মান আরও নিম্নমুখী হবে। শুধু রাজধানী-কেন্দ্রিক  ক্লাবগুলোতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থ বরাদ্দ দিয়ে দেশের খেলাধুলার সার্বিক মানোন্নয় অসম্ভব। এ কথাটাও সংগঠকদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। এজন্য ক্রীড়াঙ্গণ নিয়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও  কার্যকর করা জরুরি। সম্প্রতি সরকারী দলের আশাবাদ, স্থানীয় সরকার যত শক্তিশালী হবে, জনগণও তত বেশি সেবা পাবে। কিন্তু সেই স্থানীয় সরকারে সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত নেতৃত্বের প্রকট অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন তাদের একাংশ। বিশেষ করে গণমুখী ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণকামী নির্বাচিত ব্যক্তিরা জনগণের কাছাকাছি আসছেন না। এর ফলে মাঠপর্যায়ে কাঙ্খিত সেবা পৌঁছানো গতিশীলতা হারাচ্ছে। স্থানীয় সরকারে সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত সংগঠকদের অভিসিক্ত করে গ্রাম মফস্বলের ক্রীড়াঙ্গণসহ শিক্ষার প্রতি অনুরাগী করে তুলতে হবে। কারণ, শিক্ষা ও ক্রীড়াঙ্গণে টিকে থাকার জন্য যে ধরনের   মেধা ও কসরত করতে হয় তা তাকে কাঙ্খিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার প্রেরণা যোগায়। একজন ভালো খেলোয়ার  জাতীয় সম্পদ। সম্প্রতি বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে এদেশের মানুষের মধ্যে ফুটবলের প্রতি যে উন্মাদনা দেখা গেছে তাকে ইতিবাচক কাজে লাগানো খুব জরুরি। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে ক্রীড়াঙ্গনের মাধ্যমে   না চিনিয়ে দিলে বিশ্ব অঙ্গনে কর্তৃত্ব্ব করার সুযোগ আসবে না। আত্মজাগরণ তৈরি করার ক্ষেত্রে স্বশিক্ষিত দেশপ্রেমিক সংগঠক আজ বড় প্রয়োজন।
নিজেকে না জানলে, না চিনলে, নিজেকে জয় করতে না পারলে কখনোই অপরকে জয় করা যায় না। বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে এক বাঙালি সাধক বলেছিলেন-   
 'মানুষ হ মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ, বিশ্বমানব হবি যদি তুই, কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ'-

৭১'এর স্বাধীনতাযুদ্ধে এই সাধকের বাণী অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছে প্রেরণাদায়ক ছিল। সময় এসেছে, সাধকের এই সত্যকে আবার নতুন করে উপলব্ধি করে প্রকৃত বাঙালিবোধকে জাগ্রত করার।

এসো শ্রাবণ বারিধারায় করি স্নান

সময়ের সাফ কথা ....
এসো শ্রাবণ বারিধারায় করি স্নান

সংলাপ ॥ শ্রাবণ! হাক্কানী চেতনাবোধের প্রতিটি মানুষের কাছেই ভিন্নমাত্রায় উপলব্ধির মাস। বিশেষ করে মিরপুর আস্তানা শরীফের এবং বাংলাদেশ জুড়ে সমগ্র হাক্কানী খানকা শরীফের আশেকান ভক্ত এবং দরবারী দরদীদের কাছে এই মাসটির গুরুত্ব অনুভূতির। যদিও একটি দুঃখবোধ অনেকেরই অন্তরানুভূতিতে তীক্ষ্ণ হতে পারে এই ভেবে যে - যাকে নিয়ে এই শ্রাবণ, হাক্কানী চেতনার অনুষ্ঠানমালায় প্রবাহিত হতে থাকে - সেই মহান সাধকের জাগতিক অনুপস্থিতি। কিন্তু সে একেবারেই ক্ষণিক, কারণ তাঁর বিশাল জ্ঞানজগতের ধনভাণ্ডারকে হাক্কানী অনুসন্ধানীরা পর্যায়ক্রমিক অনুসন্ধিৎসু কর্ম-প্রেরণার মধ্যে নিজেকে নিবিড় করতে সচেষ্ট হলেই, তাঁর অনুপস্থিতি একেবারেই চেতনা বহির্ভূত হয়ে যায় তা প্রমাণিত। তিনি আছেন - বিস্ময়করভাবে দেখছেন, কর্ম-প্রেরণার নির্দেশ যোগাচ্ছেন, এমনই বাস্তবতায় শ্রাবণের অনুষ্ঠান হয় সকলের শান্তিময় জীবনের আকাঙ্খার এবং সত্যের পথে চলার দৃঢ়প্রত্যয় ও আর্জি পেশের মধ্য দিয়ে।
মহান সূফী সাধক আনোয়ারুল হক পর্দা নিলেন ২০ শ্রাবণ ১৪০৬ সালে, ইংরেজি ০৪ আগষ্ট ১৯৯৯ সনের বুধবার। সত্য সন্ধানের এই মহান পুঁরুষ পর্দা নেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মানব কল্যাণে তার চেতনালব্ধ ধারণকৃত জ্ঞানকে রেখে যাওয়ার জন্য ছিলেন পরিপূর্ণ সচেতন এবং সচেষ্ট। তারই অব্যাহত ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করেছেন তিনি তাঁর বাণী এবং কর্মময় জীবনাচার এর মধ্যে। যারা তাঁর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে এসেছিলেন, তারা তাদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় এই মহান সাধকের কর্মের উৎস উৎসাহ প্রেরণাকে নিজের চেতনাবোধে আত্মস্থ করে জীবন জিজ্ঞাসার অসীম চলার পথকে আনন্দময়তার সৌন্দর্য সম্ভোগের অতিন্দ্রীয় সাফল্য-আনন্দকে উপভোগ্য করে তুলতে পারছেন। এই মহান সাধক তাঁর সাধনার ফসল যে রেখে গেলেন তা মানব কল্যাণে মানুষের সামনে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে, কাজে লাগাতে বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফ এর তত্ত্বাবধানে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে প্রতি বছরই চলে বাণী অন্বেষণের অনুষ্ঠান। উদ্দেশ্য একটিই - এই বাণীর অন্তরাত্মাকে অনুভব করা এবং তাকে নিজের কর্মময়তার সাথে মিলিয়ে মানব জন্মের চেতনাকে শাণিত করে লক্ষ্যকে সামনে রেখে জীবনাচারের প্রাপ্ত-অর্পিত-সম্পর্কিত বস্তুময়তা থেকে নিজেকে বের করে সত্যানুসন্ধানকে অর্থবহ করে তোলা।
হাক্কানী ভক্ত আশেকানদের কাছে এই বাণী অন্বেষণের অনুষ্ঠানটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে বছর ধরে তাদের চিন্তাপ্রবাহের মধ্যে আবর্তিত সত্যানুসন্ধানের অনেক প্রশ্নেরই সমাধান বেরিয়ে আসে, যা তাদের জ্ঞান অন্বেষণের পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা আশেকান ভক্ত এবং শাহ্‌-সাহেবগণ শ্রাবণের অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে জ্ঞান ধারার অনন্ত বারিবরষণের শুদ্ধ স্নাত হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেন। যেহেতু জ্ঞান জগত অনন্ত-অসীম এবং তা বাহির থেকে কাউকে কখনো প্রদান করা যায় না, তাই সেই জগতের সন্ধান যারা পেয়েছেন - তাদের কর্মবৃত্ত নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করা হয় বলেই সেই পথে চলার সাহস এবং কর্মপথ তৈরির ক্ষেত্রে স্ব-স্ব চেতনায় ইতিবাচকতা সৃষ্টি করে।
যেমন - সূফী সাধক আনোয়ারুল হক যখন বলেন, 'মুর্শিদ আমি খুঁজব নাকো বন জঙ্গলে যাইয়া, আমার মাঝে আমার মুর্শিদ আছেন যে পথ চাইয়া।' তখন অনেকেই নিশ্চিত বিশ্বাস করেন এই বাণীর মধ্য দিয়ে সাধক নিশ্চিত করেছেন, মুর্শিদের জন্য বন-জঙ্গলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নেই কারো আদেশ-উপদেশ-নিষেধ শোনার কোনো প্রয়োজন, কারণ মুর্শিদ তো আমার মধ্যেই আছেন এবং আমার পথ চেয়ে আছেন। সুতরাং আর ভাবনা কি? আমি চাইলেই তো তাকে আমার মতো করে আমার প্রয়োজন মতো উপস্থিত উপস্থাপনা সংযোগ-বিয়োগ করতে পারি। এ ধরনের বিশ্বাস কিংবা ধারণার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির বিপুল অবকাশ যে আছে তা সত্যানুসন্ধানীদের পথ চলার মধ্য দিয়ে মোটামুটি ফুটে উঠে। বিশেষ করে - কে মুর্শিদ, কার (কোন ব্যক্তি বা সত্ত্বার) মুর্শিদ, কখন মুর্শিদ - কি প্রয়োজন মুর্শিদের? কোন পর্যায়ে নিজের চেতনায় মুর্শিদের অবস্থান নিশ্চিত হয়? প্রশ্নগুলো নিয়ে যখন চিন্তা জগতে উর্দ্ধ গতি প্রবাহিত হয়, তখন অনেকেরই চিন্তা জগতে প্রেম, বিশ্বাস এবং বোধ যে নড়েচড়ে উঠে একরৈখিক হয় তা উপলব্ধি করা যায়।
মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য শান্তি। কিন্তু সেই শান্তি শব্দটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নানা রং রূপ রসে আদল প্রাপ্ত হয়। নিঃসন্দেহে প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই তা আলাদা আলাদা চেহারা নিতে পারে। সঙ্গত কারণেই শান্তিকে বিশেষ সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে জটিলতা আছে এবং বেশ কঠিন। একথা অবশ্যই জাগতিক চেতনাবোধের বস্তু জগতের বস্তুময়তায় বেড়ে ওঠা জগতের নিজস্বার্থের কেন্দ্রাভিমুখী চিন্তার বেলায়ই প্রযোজ্য। কিন্তু শান্তি বিষয়টি যখন জ্ঞান জগতের ক্ষেত্রে হয় তখন শান্তি ব্যক্তির ভিন্নতা সত্ত্বেও আনন্দলোকে এককেন্দ্রিক লক্ষ্যাভিমুখী। সেখানে ব্যক্তির স্বতন্ত্র সত্তা আর একটি ভিন্ন সত্তায় আপন অস্তিত্বের বিলীনতায় বিশ্বাসী হতে বাধ্য। হাক্কানী মৌলিক চেতনাটি এখানেই। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক তাঁর প্রতিটি বাণীর মধ্যেই এই ইঙ্গিত এবং নিদর্শন রেখে গেছেন, যাতে মানুষ তার বস্তুময়তার ভোগ আকাঙ্খা লিপ্সা ঈর্ষা থেকে নিজেকে উত্তরণ ঘটিয়ে জ্ঞান জগতের পথকে বেছে নিয়ে জ্ঞানবান হয়। ব্যক্তি যত বেশি স্বার্থকেন্দ্রিক এককেন্দ্রিকতায় অবস্থান নেবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তত বেশি বাড়তে থাকবে। এর উদাহরণ আজকের আমাদের এই দেশ। এই সময়। যেখানে মানুষের চেতনাবোধ বিপরীতমুখী হয়ে শূন্যের দিকে নেমে আসছে। সমাজের প্রতিটি স্তরেই এখন আস্থাহীনতা ও বিশৃঙ্খলা ধীরে ধীরে সমস্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই গ্রাস করছে। এর প্রধান কারণই হলো - জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অনীহা, স্থবিরতা ও বন্ধ্যাত্ব। তাই কেউ মাদকের মধ্যে সুখ খুঁজছেন কেউবা অর্থবিত্তে। দুটোই নেশা। এই নেশায় যারা সমর্পিত - তাদের কাছে ধর্ম-দর্শন-কলা কিংবা জীবন চেতনাবোধ কোনো অর্থ বহন করে না।
কামনা তাড়িত অর্থ-বিত্তের ভোগাকাঙ্খার স্বীয় স্বার্থ কর্মের যে জীবন ব্যবস্থার সুখ ও শান্তির তথাকথিত জীবন ধারণা আমাদের সামনে আছে, তার প্রতি আকৃষ্ট থেকে চেতনা জগতের শান্তির আঁধার তথা বিজ্ঞানময়তা সৃষ্টি করা যায় না। কেউ যখন স্ব-উদ্যোগী হয়ে স্ব-চেতনার শাণিতবোধ কামনায় অনন্ত জ্ঞান আধারে প্রবেশ ইচ্ছুক তখনই তার জন্য প্রয়োজন একজন উন্নত চেতনাবোধের সহায়ক মানুষ, যিনি তার এই চলার পথকে সহজতর এবং কৌশলী হতে সাহায্য করতে পারেন।
এখানে কৌশল বলতে নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে মনুষ্যত্বের পথে নিরন্তর যাত্রাকেই বোঝানো হচ্ছে। এই কর্ম প্রক্রিয়া মানুষ চাইলেই ধরে রাখতে পারে না। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করতে হলে সচেতন কর্ম প্রক্রিয়ায় কৃচ্ছতার প্রশ্নটি এসে যায় সবার আগে। আর কৃচ্ছতার অন্য অর্থই হচ্ছে ত্যাগ। যা মানুষের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক ইসলাম সাফল্যজনকভাবেই আমাদের চেতনা জগতকে বস্তু ও বিষয়রাশির কামনা তাড়িত জীবনবোধ তৈরি করে মুহাম্মদী চেতনাবোধকে সুকৌশলে ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবন বোধ থেকে বহু দূরে নিক্ষেপ করতে পেরেছে। যার ফলে ত্যাগের জীবনধারা তৈরিতে আমরা একেবারেই প্রস্তুত নই। কুরআন-সুন্নাহ-ইসলাম নিয়ে দেড় হাজার বছর ধরে পরস্পরের হিংসা প্রতিহিংসার ইতিহাস সৃষ্টি করেই চলছি। প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের বেলায় একবার চিন্তা প্রবাহে আসে না কুরআন-সুন্নাহ কিংবা নবীজী অথবা ইসলামের কথা, তখন নিজের স্বার্থ, গোষ্ঠী কিংবা দল অথবা রাজনৈতিক স্বার্থই থাকে মূখ্য। একাত্তরের পাকিস্তানীদের বাঙালি হত্যাযজ্ঞ (যা তারা তখন ইসলামের নামেই চালাচ্ছিল) ধর্মের নামে আজও বাঙালি মানসে প্রজ্জ্বলিত। এখন ধর্মই হচ্ছে এই দেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় এবং কার্যকর হাতিয়ার। যারা সরাসরি সাইনবোর্ড লাগিয়ে নিয়েছে তাদের তো কথাই নেই, যারা সাইনবোর্ড লাগায়নি তারাও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এখন যথেচ্ছভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন। যার সাথে ধর্মের মূল চেতনা আত্মজিজ্ঞাসার ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। আত্মজিজ্ঞাসা এবং আত্মকর্ম বিশ্লেষণ ছাড়া যে ধার্মিক হওয়া যায় না সেই বোধ তৈরিতেই সাধকরা তাঁদের জ্ঞানভান্ডারকে উন্মুক্ত রেখে গেছেন মানব সমাজে, ব্যক্তির মানুষ হবার প্রায়শে শান্তিময় (ইসলামের) যাত্রায়। সমাজে ব্যক্তির বিশাল ভূমিকা এবং প্রভাব আছে, সেক্ষেত্রে ব্যক্তির কর্মপ্রেরণা এবং প্রকাশই তার ধার্মিকতা। কর্মপ্রেরণায় বোধ থাকলে মানুষের চেতনায় শান্তিময়তা তৈরি হতে বাধ্য। এই সত্যই তাবৎ ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে সাধককূলের কর্মময় জীবন ও বাণীর মধ্যে নিহিত আছে। সত্যকে উপলব্ধি করে ব্যক্তি স্ব-উদ্যোগী হয়ে অনুসন্ধানী পথে আরাদ্ধ আরাধনায় নিজেকে নিয়োজিত এবং নিমগ্ন করেই পথ তৈরি করতে পারে। এই পথ তৈরিতে তার প্রদর্শক অবশ্যই প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে খোঁজা ব্যতিরেকে বিকল্প কি? কিন্তু খুঁজে পেলেই তিনি পথ প্রদর্শনের জন্য প্রস্তুত থাকবেন এমন নিশ্চয়তা কোথায়? কিংবা উপস্থিতিই গ্রহণযোগ্যতা তা কি বলা যায়? কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত এই গ্রহণযোগ্যতা ব্যক্তি নিজে সৃষ্টি না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত মুর্শিদ জ্ঞান কি অতিকথন নয়? কাজেই মুর্শিদ বললেই মুর্শিদ তৈরি হয় না, তার জন্য প্রয়োজন কর্মপ্রচেষ্টা দ্বারা কর্মবৃত্ত সৃষ্টি। একটু পরিষ্কার করে বলা যায়, অভ্যাস বার বার পরিবর্তন করে জ্ঞান রাজ্যে প্রবেশের পথ করা। এই পরিবর্তনের ধারায় একটি পর্যায়ে স্বভাব তৈরি হয়। যা বর্তমান। এখান থেকেই নিজের সৃষ্ট শান্তিময়তার নয়া সাম্রাজ্যের বিস্তার। এই সাম্রাজ্যে নিজেই নিজের স্রষ্টা এবং নিয়ন্ত্রক। কিন্তু সে তো বলা কথায় তৈরি হয় না, তার জন্য প্রয়োজন নিবিষ্ট চিত্তে আরাদ্ধকে আরাধনা। আর আরাধনার জন্য চাই প্রেম। দেখা শোনা জানা দেয়া নেয়ার মধ্যে কামনা আছে, প্রেম নেই। একমাত্র ভক্তির মধ্যেই প্রেম নিহিত।
জাগতিক ভালোবাসা দ্বারা জাগতিক কর্ম হাসিল করা যায় কিন্তু জ্ঞান জগতের আরাদ্ধ চেতনায় নিবিষ্ট হওয়া যায় না। একাগ্রচিত্তে নিবিষ্ট হতে না পারলে বস্তু মোহ-মায়া থেকে নিজেকে উত্তরণ ঘটানো যায় না। নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে হলে চেতনা জগতে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হয় এবং তার জন্যই প্রয়োজন সমর্পণের। সমর্পণের ধারাবাহিক ক্রমবিকাশে জাগতিক বস্তুময়তার থেকে নিজেকে সুনির্দিষ্ট করতে সাহায্য করে। এখানেই ব্যক্তির বস্তুময় খেয়াল জগতটি ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে এক-এ বিরাজমান থাকে। যিনি করতে পারেন তখন আরাদ্ধ তার জন্য হন মুর্শিদ গুরু বা পিতা অথবা স্রষ্টা। তখনই মুর্শিদ তার অন্তরেই অবস্থান করেন, তার বন-জঙ্গলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এই অবস্থাটির নামই মূলতঃ আত্মসমর্পণ। তিনি তখন তার সৃষ্টি জগতে প্রশংসিত এবং প্রশংসা তারই জন্য এবং তিনিই প্রশংসাকারী। এখানে আমাদের সাধারণ চিন্তাবোধ যেভাবে প্রশংসাকারী এবং প্রশংসিত নিয়ে যে বাধাধরা নিয়ম এবং সীমাবদ্ধতা তৈরি করে সাধারণ নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলবার চেষ্টা করছি - তা যে বিভ্রান্তিমূলক এবং তা দ্বারা আরাধনা জগতের আলোর পরিমাপও করা যায় না। সুতরাং আরবের আহম্মদ কখন মুহাম্মদ হলেন তার চুলচেরা বিশ্লেষণ এখানে নিষ্প্রয়োজন। এখানে প্রয়োজন ব্যক্তির বিকশিত চিন্তা প্রবাহে শ্রদ্ধা ভালোবাসা, প্রেম ও ভক্তির সংযোজন।

একমাত্র প্রেম ও ভক্তির মধ্য দিয়েই মানুষ সৃষ্টি করতে পারে বা নিজে নিজেরই স্রষ্টা হতে পারে; যাকে বলে নিজেকে আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই ঘটে তার স্বাধীন সত্তার বিকাশ, যা অসীম এবং অনন্ত। তখনই আনন্দলোক চেতনায় আত্মবিলীনতা। নিঃসন্দেহে এটি সেকেণ্ডের ঘটনা কিন্তু তার প্রস্তুতি দীর্ঘতম সময় ধরে জীবনকে নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে পরিচালনা করে ভাব জগতে ঢুকতে হয়। ভাব জগত ছাড়া অনন্ত জ্ঞান জগতের সন্ধান কেউ কোনোদিন পায়নি পাবে না। কাজেই ভাব জগতের মধ্যেই আছে সেই সত্য যাকে মানুষ খুঁজে ফিরছে অনন্তকাল ধরে। প্রত্যেক সাধক বস্তুময় ব্যবহারিক জীবনকে অতি সচেতনভাবে পরিবর্তন করে তার নিজের সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাপ্রবাহকে একই পথে উর্দ্ধগমনে একই প্রবাহে প্রবাহিত করতে না পারলে মিলন বা মেরাজ সম্ভব নয়। 

চিন্তা নিয়ন্ত্রণ

চিন্তা নিয়ন্ত্রণ

সিদ্ধার্থ ॥ বাহ্য জগতের সাথে কি প্রকারে নিজের সংযোগ হয়? কি প্রকারে বাহ্য জগতের তথ্য নিজের ভিতরে প্রবেশ করে? আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো বাহিরের দিকে উন্মুক্ত। বাহ্য জগতের আঘাত ইন্দ্রিয়ের উপর পতিত হয় এবং বাহিরের তথ্য ভিতরে প্রবেশ করে। দেহের একটি জীবকোষ যখন স্পন্দিত হয়, তখন পাশের জীবকোষে সে স্পন্দন সঞ্চারিত করে এবং এই প্রকারে একটি কোষ থেকে আরেক কোষের মাধ্যমে তা চিন্তার কেন্দ্রে প্রবেশ করে। বাহ্যিক আঘাত যদি ক্ষীণ হয় তবে কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না এবং ইন্দ্রিয় অনুভূতি হয় না। বাহ্য জগতের নির্দিষ্ট আঘাত গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট গ্রাহক ইন্দ্রিয় রয়েছে। বায়ুর স্পন্দন কর্নে আঘাত করলে সে আঘাতকে আমরা বলি শব্দ। একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন আঘাতের মাত্রা ও গুণ অনুযায়ী আমরা তাদের নামকরণ করে থাকি।
তার দিয়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহ স্থানান্তরে পৌঁছে তার কেটে দিলে বিদ্যুৎ প্রবাহ থেমে যায়। আবার একই বিদ্যুৎ দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্র চালিত হয়। ঠিক একইভাবে বাহ্য জগতের তথ্য যে ইন্দ্রিয় দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে ইন্দ্রিয়ের সাথে চিন্তার সংযোগ কেটে দিলে তা আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। যা প্রবেশ করে তাকেও চিন্তা-সংযোগে বিভিন্ন কার্যে ব্যবহার করা যায়। আর এক প্রকারের শক্তি আছে যা নিজের ভিতরেই উৎপন্ন হয়। ভিতরে উৎপন্ন শক্তি বাহিরের শক্তিকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করার সামর্থ রাখে। সুতরাং দেখা যায়, দুই প্রকারের শক্তি দ্বারা জীব উত্তেজিত হয় - বাহিরের শক্তি এবং ভিতরের শক্তি। বাহিরের শক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই কিন্তু ভিতরে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার একমাত্র অধিপতি নিজেই। যে পথ দিয়ে বাহিরের শক্তি ও তথ্য নিজের ভিতরে প্রবেশ করে সে পথকে সংকুচিত কিংবা প্রসারিত করার, রুদ্ধ কিংবা উন্মুক্ত করার ক্ষমতা মানুষের আছে।
প্রত্যেকেরই এমন অভিজ্ঞতা আছে যে চিন্তার বিক্ষিপ্ত অবস্থায় যা দেখি নাই কিংবা শুনি নাই, চিন্তা যোগ করে তা দেখি অথবা শুনি। চিন্তাযোগে অনুভূতি হ্রাস-বৃদ্ধি হয়ে থাকে। কি উপায়ে চিন্তার যোগ বা বিয়োগ ঘটে কিংবা সংযোগ দ্বার রুদ্ধ কিংবা উন্মুক্ত হয়, চিন্তা জগতে এমন কি আছে যা ইন্দ্রিয়কে গ্রহণ কিংবা প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত করে তা নিজেকে পর্যবেক্ষণ না করে উপলব্ধি কারার সুযোগ করার নেই। এটা উপলব্ধি করা খুব কঠিন নয় যে, ইচ্ছানুসারে বাহ্যিক প্রভাব হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। এই হ্রাস-বৃদ্ধি চিন্তা সন্নিবেশের উপর নির্ভর করে। একরূপ সন্নিবেশে উত্তেজনার প্রবাহ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, অন্যরূপ সন্নিবেশে উত্তেজনার প্রবাহ আড়ষ্ট হয়। বাহিরের শক্তি দ্বারা যাহা ঘটে ভিতরের শক্তি দ্বারাও অনেক সময় তা সংঘটিত হয়। বাহিরের আঘাতে যেমন হস্ত-পেশী যেরূপ সংকুচিত বা প্রসারিত হয়, ভিতরের ইচ্ছায়ও হস্ত-পেশী সেরূপ সংকুচিত বা প্রসারিত হয়।
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এ শক্তি নিহিত আছে যা দ্বারা সে বহির্জগতের সাথে সংযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জগত আঘাত করলেই আঘাত পেতে হবে এমন কোন নিয়ম মানুষ মেনে চলতে বাধ্য নয়। জগতের আঘাত কে কিভাবে গ্রহণ করবে তার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ইচ্ছানুসারে বাহির ও ভিতরের প্রবেশ পথ উন্মুক্ত কিংবা অবরুদ্ধ করতে পারে। এইরূপে দেহ ও চিন্তার উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে যে ক্ষীণ শব্দ শ্রবণযোগ্য নয় তা সে শুনতে পারবে আবার যে উচ্চ স্পন্দনের শব্দ তা সে শুনতে পাবে না। ইচ্ছানুসারে সে হাত, পা, কান, চোখকে তার কর্তৃক নির্ধারিত কর্মে নিয়োজিত রাখতে পারবে।
যখন চিন্তা ইন্দ্রিয়ের বিশেষ কেন্দ্রে সংযুক্ত হয়, তখনই বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ যাবতীয় কর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। চিন্তার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে যখন তখন তা ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্রগুলোতে সংযুক্ত হয়ে যায়। এই জন্যই মানুষ যা-তা কর্ম করে এবং দুঃখ উৎপন্ন করে। চিন্তার উপর যদি নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকত তাহলে মানুষ এত চিন্তাও করত না এত কর্মও করত না। চিন্তা নিয়ন্ত্রণে থাকলে যখন তখন ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয়ানুভূতির কেন্দ্রগুলোতে সংযুক্ত হতো না, ফলে অনুভূতি ও আকাঙ্খা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকত।
চিন্তাকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী ইন্দ্রিয়ের সাথে সংযুক্ত ও বিযুক্ত করতে পারলে আমরা পূর্ণতার দিকে অনেক দূর অগ্রসর হবো। নিজের উপর এই নিয়ন্ত্রণ না আসা পর্যন্ত মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। এর আগ পর্যন্ত আমরা যন্ত্রের মতোই জড় পদার্থ। মানুষের চিন্তা অত্যন্ত চঞ্চল, এক স্থানে এক মিনিটও স্থির থাকে না। প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার বার সে স্থান পরিবর্তন করে। চিন্তা এমন এক মাতাল বানরের মতো যাকে বৃশ্চিক দংশন করেছে। তাই বিষয় থেকে বিষয়ে তার অবিরাম লাফালাফি। এই চঞ্চল চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন অবশ্যই।
নানা প্রকার পরিবেশে নানা প্রকার লোকের-সঙ্গ চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করে। তাই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথম প্রথম নির্দিষ্ট সময় একা থাকার অভ্যাস করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, পরনিন্দা, পরচর্চা, তর্ক ইত্যাদি হতে বিরত থাকতে হবে। বেশি কথা বললে, বেশি কাজ করলে চিন্তাও বেশি চঞ্চল হয়।
এক বিষয়ে থাকলে চিন্তা শান্ত হবে এবং প্রত্যেকটি বিষয় গভীরভাবে দেখার, বুঝার  ও উপলব্ধি করার সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। দৈহিক সুস্থতা একরৈখিকতার প্রথম চিহ্ন। যারা একরৈখিকতায় আরো উন্নতি চান তাদের সকল গ্রহণ বর্জন যেমন আহার, দৃষ্টি, অনুভূতি, শ্বাস ইত্যাদি সর্বদিকে সতর্ক থাকতে হবে। তবেই চিন্তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। চিন্তা যত একরৈখিক হবে ইন্দ্রিয়গুলোর অনুভূতিও ততই সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ণতর হতে থাকবে।
চিন্তা নিয়ন্ত্রণের প্রথম উপায় কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকা। দেহকে স্থির রাখা। চিন্তা কিভাবে লাফালাফি করছে তা অবলোকন করা। চিন্তা যতই লাফালাফি করুক তাতে ক্ষতি নাই। এতোদিন সে তা-ই করে আসছে আজও তা-ই করুক। 'আমি' শুধু তার লাফালাফিটা পর্যবেক্ষণ করি। এরূপ পর্যবেক্ষণ করাও সহজ নয়। প্রথম দিকে যে পর্যবেক্ষণ করছে তাকে সাথে নিয়েই চিন্তা লাফালাফি শুরু করে দেবে। বারবারই তা ঘটতে থাকবে এবং বারবারই ফিরে আসতে হবে পর্যবেক্ষণে। যতক্ষণ না জানতে পারব চিন্তা কি করছে ততক্ষণ তাকে সংযত করা যাবে না। চিন্তা যেমন খুশি বিচরণ করুক। বাজে চিন্তা উদিত হোক ক্ষতি নাই, ডুবে যাক ক্ষতি নাই। কেবল নিজেকে পৃথক করে পর্যবেক্ষণ করে যেতে হবে। প্রথম কয়েক মাস অসংখ্য বিষয়ের উদয় অস্ত হবে কিন্তু ধীরে ধীরে তা অবশ্যই কমতে থাকবে। ধৈর্যের সাথে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকলে চিন্তা অবশ্যই শান্ত হবে। কারণ চিন্তার শক্তি বিভাজিত হয়ে সিংহভাগ পর্যবেক্ষণে চলে যায়। ফলে শক্তি না পেয়ে চিন্তা শান্ত হয়।

এটা কঠিন কাজ, একদিনে এ কাজে সফলতা আসে না, এক মাসেও না। ক্রমাগত কয়েক বৎসর চর্যা করলে চিন্তার গলায় শিকল পড়ানো যায়। চিন্তার গলায় একবার শিকল পরাতে পারলে খুঁটি দিয়ে তাকে এক জায়গায় গেড়ে রাখতে হয়। ছোট্ট হস্তি শাবককে যখন প্রথম জঙ্গল থেকে ধরে আনা হয় তখন তাকে ছয় ফুট লম্বা মোটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। হস্তিশাবক মুক্ত হওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয় কারণ শিকল ভাঙ্গার শক্তি তাঁর ছোট্ট শরীরে থাকে না। সে বারবার শিকল টানে, বারবার রক্তাক্ত হয়। এভাবে রক্তাক্ত হতে হতে এক সময় সে শিকল ভাঙ্গার চেষ্টা ছেড়ে দেয়। ফলে তার দুনিয়া শিকলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এক সময় হস্তি-শাবক বড় হয়, শিকল ছেঁড়ার শক্তি হয় তার গায়ে। চেষ্টা করলে এক মুহূর্তে সে শিকল উপড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু যখনই তার পায়ে শিকলের টান লাগে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।

সংসার ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়

সংসার ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়

দিগন্ত ॥ আত্মার চেয়ে সংসারকে অগ্রাধিকার দিয়ে সংসার করা যায় না। কারণ সংসার তাকে রাক্ষসের মত গ্রাস করে। মক্ষিকা কেয়া'র রূপে আকর্ষিত হয়ে ভোগ করতে আসে কিন্তু কেয়া ফুলের আঠায় আবদ্ধ হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে কিন্তু মুক্তি পায় না। আমাদের অবস্থাও তাই। সুখ লাভের প্রত্যাশা নিয়ে আমরা সংসার শুরু করি কিন্তু যখন আত্মার চেয়ে সংসারকে অধিক গুরুত্ব দেই তখন এমনভাবে ধৃত হই যে সুখ লাভ তো হয়ই না বরং জীবন দুঃখে ভরে ওঠে। খেতে এসে আমরা নিজেরা খাদ্যে পরিণত হই, ভোগ করতে এসে নিজেই পরিণত হই ভোগ্যবস্তুতে, যেখানে সুখ পেতে এসেছিলাম সেখান থেকেই দুঃখ প্রাপ্ত হই। এই দুঃখের মূল কারণ হলো আসক্তি। আমরা ধরতে পারি কিন্তু ছাড়তে পারি না। যা ধরি তাতেই ধৃত হই। ধরতে গিয়ে ধরা পড়ি আসক্তিরই কারণে। আমরা রাজহাঁসের মতো এক ঝাঁকিতে পানি ঝড়িয়ে দিতে পারি না বরং নাইতে এসে পানিতেই ডুবে মরি। সংসারে যে ভবিষ্যৎ সুখের কল্পনা আমরা করি তার উৎস যাবতীয় ইন্দ্রিয়-সুখ। আমরা সে সব  বাহ্যবস্তুতেই আসক্ত হই যার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়সুখ  লাভ করতে পারি। কিন্তু এই আসক্তি ছাড়া আর কিছু নাই যা থেকে আমাদের দুঃখ উৎপন্ন হয়।
ইন্দ্রিয় সুখ লাভ করা খারাপ কিছু নয়। বরং তা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক। সংসার থেকে আমরা ইন্দ্রিয় সুখ লাভ
করতে পারতাম শুধু যদি আসক্তি ত্যাগ করতে পারতাম। ইচ্ছামাত্র অনাসক্ত হওয়ার সামর্থ্য যদি আমাদের থাকত, তবে ধরতে এসে ধৃত হতাম না আর আমাদের দুঃখও থাকত না। সংসার থেকে সুখ লাভ করতে কেবল সেই ব্যক্তিই সমর্থ্য হন যিনি ধরতে পারেন আবার ছাড়তেও পারেন। যে ধরার সময় একনিষ্ঠভাবে ধরতে পারে আবার ছাড়ার সময় একনিষ্ঠভাবে সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করে ছেড়ে দিতে সুখ তার জন্য। সমস্যা হলো এই যে, অধিকাংশ মানুষই দুর্বল, ধরতে পারে কিন্তু ছাড়তে পারে না। ধরার জন্য খুব শক্তির প্রয়োজন হয় না, এজন্য জৈবিক তাড়নাই যথেষ্ট। কিন্তু ছাড়ার জন্য অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়, যা অধিকাংশ মানুষ একত্রিত করতে পারে না।
সংসারে এমন মানুষও বিরল নয় যারা ধরেও না ছাড়েও না। তারা ভালোবাসতে পারে না। কোনকিছুর দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। তারা আহার, নিদ্রা, মৈথুন নিয়ে ব্যস্ত থাকে সুখ-দুঃখের অনুভূতি থাকলেও কোন গভীরতা নাই। অনেকটা জড়বস্তুর মতো। জড়বস্তু কাউকে ভালোবাসে না আবার ঘৃণাও করে না, সুখ পায় না, দুঃখও পায় না। জড়বস্তু আসক্তও হয় না নিরাসক্তও হয় না। জড়বস্তুর মত না হয়ে বরং কোন কিছুতে আসক্ত হওয়া অধিক মানবীয়। যে ব্যক্তি গভীরভাবে কাউকে ভালোবাসে না সে দুঃখ পায় না ঠিকই কিন্তু আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হয়। আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া যেমন আমাদের কাম্য নয়, তেমনি কাম্য নয় ধৃত হয়ে ছটফট করা।
আধ্যাত্মিকতা সহজ অর্থে আত্মিক উন্নতির প্রচেষ্টা। আত্মিক উন্নতি কেবল আত্মার আনন্দ লাভের জন্য নয় সংসার থেকে সুখ লাভের জন্যও প্রয়োজনীয়। যে ব্যক্তি আত্মাকে অনুভব করে সংসার তার একমাত্র বস্তু নহে। সে সংসারের সাথে সাথে আত্মাকেও চায়। সে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে কিন্তু পাশাপাশি যা আছে তাতে সে সন্তুষ্ট থাকে। সে ভোগ করে কিন্তু সীমালঙ্ঘন করে না, নিজের ভোগে মত্ত হয়ে সে অপরকে পীড়া দেয় না, তুচ্ছ বস্তুর জন্য সে হানাহানি, কাড়াকাড়ি করে না। আত্মাকে লালন করে, ভালোবাসাকে লালন করেই সে সংসার করে।
সংসার করতে হবে কিন্তু আত্মাকে উপেক্ষা করে নয়। আত্মিক উন্নয়নের প্রচেষ্টাও করতে হবে কিন্তু সংসারকে উপেক্ষা করে নয়। সংসারের দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পরিত্যাগ করে আত্মিক উন্নতির প্রচেষ্টা কেবল অন্ধকারের দিকেই পতন ঘটাবে। কারণ, প্রকৃতি মানুষকে ক্ষুধা দিয়ে দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পালনের পরিবেশে অস্তিত্বময় করেছেন। এই দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পালন করা প্রাকৃতিক। প্রকৃতিকে অস্বীকার করে আত্মিক উন্নতির প্রচেষ্টা করা যায় না। আত্মাকে জাগ্রত রেখে আসক্ত না হয়ে দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পালনের সাধনা ব্যতীত আধ্যাত্মিক সাধনা কথার মারপ্যাচ মাত্র। নিরাসক্ত হয়ে সংসারের কর্ত্তব্য পালন করলে সংসারের সংঘর্ষেই পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে।
সংসার ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক সাধনা চরম মুর্খতা। পিতা আমাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন, বিদ্যালয়ের নিয়ম এবং কর্ত্তব্য পালন সুখকর হয় না। তাই বলে বিদ্যালয় ত্যাগ করে সুখের অন্বেষণ করা চরম মূর্খতা বৈ কি! বিদ্যালয় থেকে সম্মানের সাথে মুক্ত তিনিই হতে পারেন যিনি বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে কর্তব্য পালন করেন এবং এই কর্তব্য পালনকে দুঃখ হিসেবে গ্রহণ করেন না। সংসার থেকে আত্মাকে এবং আত্মা থেকে সংসারকে পৃথক জ্ঞান করলেই বিপত্তি ঘটে। সংসার হতে আত্মাকে দূরে রাখার ফলেই আমরা ভোগে নিমগ্ন  হয়ে জীবনের পূর্ণতাভ্রষ্ট হই।
আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য সংসার ত্যাগ চূড়ান্ত স্বার্থপরতাও বটে। যারা ঠিকমত সংসারের কর্তব্য পালন করে তারা সংসার ত্যাগী সাধকদের মত স্বার্থপর হয় না। কারণ সংসারের নিয়মই হলো স্বার্থত্যাগ করা। সংসারী ব্যক্তির স্বার্থ ক্রমেই সন্তানের স্বার্থ, পরিবারের স্বার্থ, প্রতিবেশীর স্বার্থ, স্বদেশের স্বার্থ এবং সর্ব্বজনের স্বার্থে অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যাপ্ত হতে থাকে। কিন্তু যারা সংসারের দুঃখ শোক দারিদ্র্য হতে পরিত্রাণ লাভের প্রলোভনে আধ্যাত্মিক সাধনা করে তারা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়।

বৃক্ষে যে ফল থাকে সে ফল বৃক্ষ হতে রস আকর্ষণ করে পরিপক্ক হয়ে উঠে। যতই সে পরিপক্ক হতে থাকে ততই বৃক্ষের সাথে তার বৃন্তবন্ধন শিথিল হয়ে আসে। অবশেষে তার অভ্যন্তরস্থ বীজ সুপরিণত হয়ে উঠলে বৃক্ষ হতে সে সহজেই বিচ্ছিন্ন হয়ে বীজকে সার্থক করে তোলে। আমরাও সংসারবৃক্ষ হতে বিচিত্র রস আকর্ষণ করি মনে হতে পারে তাতে সংসারের সাথে আমাদের সম্বন্ধ ক্রমেই দৃঢ় হবে, কিন্তু তা নয়, আত্মার যথার্থ পরিণতি হলে বন্ধন আপনি শিথিল হয়ে আসে। ফলের সাথে আমাদের প্রভেদ এই যে, আত্মা সচেতন; রস-নির্র্বাচন ও আকর্ষণ বহুল পরিমাণে আমাদের স্বায়ত্ত। আত্মার পরিণতির প্রতি লক্ষ্য করে বিচারপূর্ব্বক সংসার হতে রস গ্রহণ ও বর্জ্জন করতে পারলেই সংসারের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং সে সঙ্গে আত্মারও।

সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০১৪

হাক্কানী কথা



হাক্কানী কথা - ৭

সংলাপ ॥ আমরা যখন স্বীকার করি নবী মোহাম্মদ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী তখন তার সাথে কি আর কারো তুলনা করতে পারি? পারি না। কিন্তু এজিদ তা করেছে। 'ইব্রাহিম (আ.)-এঁর বংশধরদের প্রতি যেরূপ শান্তি বর্ষণ করেছো, মোহাম্মদ (সা.) -এঁর বংশধরদের প্রতিও সেরূপ শন্তি বর্ষণ করো' - এটা এজিদের দোয়া। এজিদই প্রথম এই দোয়া পড়েছিল যখন ইমাম হোসেনকে হত্যার সংবাদ পেয়েছিল। যখন ইমাম হোসেনের খণ্ডিত মস্তক এজিদের দরবারে আনা হয় তখনও সভাসদদের নিয়ে ভয় ভীতিতে এই দোয়া সে পাঠ করেছিল। অথচ এখন এই দোয়া পাঠের প্রচলন হয়ে গেছে। কোন সাধক এই দোয়া পাঠ করেন না। কারণ কোন সাধকই নবী মোহাম্মদ (সা.)-এঁর সাথে অন্য কোন নবীর তুলনা করেন না।
কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন যে নবী মোহাম্মদ (সা.) নিজেও তো শান্তি আনার জন্য যুদ্ধ করেছেন, মানুষ হত্যা করেছেন। হ্যাঁ, তিনি তা করেছেন। প্রয়োজনের তাগিদে দেশবাসীকে বাঁচাবার জন্যে, হাজার হাজার মানুষকে বাঁচানোর জন্য, একজন বা কয়েকজনকে হত্যা করা যদি প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাহলে তাতে অধর্ম হয় না। কিন্তু এটা প্রমাণ করে যেতে হবে যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে, দেশের সমৃদ্ধির জন্যে, এই দেশকে একটা লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তা করা হয়েছে। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
বাংলাদেশে কিছু ধর্মবেত্তা আছে তারা ভালো করেই জানে আল্লাহর নাম নিয়ে যত কিছুই করি না কেন কিছুই হবে না। আল্লাহ ব্যস্ত আছেন তাঁর পাগলদের নিয়ে, তাই তার নাম নিয়ে অন্যরা কে কি করছে তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। দুনিয়াদারিতেও তাই। সরকার প্রধানই জানেন কোথা দিয়ে কি ঘটছে, মাঠ কর্মী বা সাধারণ মানুষ তা জানতে, বুঝতে পারে না। যে বলবে যে উচ্চ পর্যায়ে যা ঘটছে তার সবই জানে সে নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে।
হাক্কানী লাকুম দ্বীনুকুম নিয়ে চলে। তোমার ধর্ম তোমার কাছে আমার ধর্ম আমার কাছে। হাক্কানীর মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বলতে কিছু নেই। যার মধ্যে সত্য আছে, সত্যকে যে ধারণ ও লালন পালন করেন তিনিই হাক্কানী। হাক্কানী সবার ঊর্ধ্বে মানুষকে মূল্য দেয়। তাই বলে সব মানুষকে না। হাক্কানী সেই মানুষকেই মূল্য দেয় যিনি এক সত্যকে ধারণ করেছেন। সব তরিকার সারমর্ম নিয়ে তৈরি হয়েছে হাক্কানী তরিকা। হাক্কানী ওজায়িফ এসেছে ১৯৯০ সনে। প্রতিটি হাক্কানী দরবারে রবিবার ও বৃহস্পতিবার হাক্কানী ওজায়িফ পাঠ ও চর্চা করা হয়। যারা হাক্কানী ওজায়িফের পথ ধরে যেতে চায় তারা এগিয়ে যাবে। কিন্তু শুধু এই পথেই তুমি তোমার লক্ষ্য অর্জন করবে তা না। এমন কোন পথ নেই যে পথ তাকে আল্লাহর কাছে পৌঁছে দেবে না। তুমি কোন পথ ভালোবাস? তুমি কি ভালোলাগার স্তরে আছ নাকি ভালোবাসার স্তরে আছো? তুমি তোমার ভালোবাসার স্তর থেকে নিজেকে প্রেম জগতের দিকে অগ্রসর করতে চাও কি না, তোমার লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে, যে লক্ষ্য তুমি নির্ধারণ করলে সেই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে তুমি প্রেম জগতে যেতে পারবে কিনা তার উপরই নির্ভর করবে তোমার সফলতা। মোনাফেকি ও শির্‌ক ত্যাগ করতে হবে। মোনাফেকি হচ্ছে অন্তরে এক বাহিরে আরেক আর শির্‌ক হচ্ছে তুলনা করা। আমরা নিজেকে তুলনা করি অন্যের সাথে, ভুলেই যাই যে, আমরা প্রত্যেকে অনন্য মানুষ। ইসলামে নিজেকে অন্যের সাথে   তুলনা করাকে হারাম করা হয়েছে। দু'জন মানুষ কখনও এক হতে পারে না। (সমাপ্ত)।

সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে



সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে

শেখ উল্লাস ॥ দেশে বর্তমানে সুশাসন নেই- এভাবে বললে কথাটা ঢালাওভাবে বলা হবে,  সত্য হবে না। আবার, দেশে সুশাসন নিশ্চিত হয়ে গেছে-এভাবে বললেও মিথ্যাচার হবে। সুশাসন তথা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব দেশে সব সময়ই ছিল। দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম সাধারণ মানুষের জীবনকে বিষিয়ে রেখেছে সব সময়ই। এদের অনাচারের কারণেই দেশে তৈরি হয় ধর্মান্ধ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। দেশ স্বাধীনের পর সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর মুখনিঃসৃত অনেক কথাই এখন সর্বজনীন বাণীতে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একবার  বলেছিলেন, 'আমি ভিক্ষা করে নিয়ে আসি, চ্যাটার দল সব খেয়ে ফেলে'। এই চ্যাটার দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তাঁর দলে, আমলাতন্ত্রে, ব্যবসায়ী মহলে। এই চ্যাটার দল ১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে  নির্মমভাবে হত্যার পর কোনো প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেনি। বরং তাদের অনেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার সুফল ভোগ করেছে এবং দীর্ঘ সময় এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের লোকদেরকে পুনর্বাসনে সহায়তা করেছে। তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী  চক্র  সরকারি-চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে অঢেল আর্থিক সম্পদের মালিক হয়েছে। বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা বঞ্চিত হতে হতে সমাজের সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির নতুন করে জাগরণ সৃষ্টি হলেও তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেই চ্যাটার দলের কারণেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে যে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে তার সুফল সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে আজ সবচেয়ে প্রয়োজন সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করা। এই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক রাজনীতি, ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ চক্র। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, ষোলো কোটিরও বেশি মানুষের এই দেশে জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল বিরাট আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তির মালিক। অধিকাংশ রাজনীতিক ও আমলারা যদি শুধুমাত্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই রাজনীতি করেন, নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ও আরাম আয়েশের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য  চাকুরি করেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন নিজেদের অর্থ-সম্পদের পরিমাণ আরও বাড়ানোর জন্য তবে তার চাইতে দুঃখজনক আর কী'বা হতে পারে? আর বর্তমানে যে জিনিষটি অতীতের মতোই উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে তা হলো - নেতা ও আমলাকে হাত করে, ঘুষ দিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে পদোন্নতি, বদলী ও পদায়ণ নিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের এজেন্টরা। যে কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ বিঘ্ন ও বিলম্বিত হচ্ছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের লোকেরা যেভাবে জায়গা করে নিয়েছে তাতে মনে হয় যে, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রই ক্ষমতায় আছে। আর এরাই সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। পদলেহী এ গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই সরকারের বিরুদ্ধে তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে তাদের মতলব হাসিলের জন্য। দেশে সুশাসন নিশ্চিত না হওয়ার যত ফায়দা এ গোষ্ঠী ভোগ করছে, আর্থিক ও সামাজিকভাবে লাভবান হয়ে এরাই ফুলে ফেঁপে উঠছে। এক রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর হলেও তাদের হাজারো অনুসারী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশের আনাচে কানাচে। বর্তমানের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ক্ষমতাসীন দলের  নীতিনির্ধারকদের গভীর পর্যবেক্ষণ করে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার দাবি বিশ্লেষকদের। অপার সম্ভাবনার এই দেশটিকে কোনোভাবেই দুর্নীতিবাজ ও স্বাধীনতার আদর্শের বিরোধীদের অভয়ারণ্য হতে দেয়া যায় না।  এদেশের মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীনতা এনেছে। কিন্তু এর সুফল আরও ঘরে তুলতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলই যেখানে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, সেখানে দেশের এই বাস্তবতা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। নতুবা ইতিহাসের কাঠগড়ায়  জাতিকে এ ব্যর্থতার জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। পদলেহীদের হটিয়ে সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সময়ের সাফ কথা .... সেবা-ই পরম ধর্ম



সময়ের সাফ কথা ....
 সেবা-ই পরম ধর্ম

দিগন্ত ॥ সর্বজীবের প্রতি সহানুভূতিশীলতা ও উপকারের জন্য যে ভাব তার নাম সেবা। অপরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, অন্যের বিপদে সাধ্যমত সাহায্য করা, পিতা-মাতার যত্ন নেয়া, সাধু-মহৎ গুরুজন দিগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সর্বপরি প্রত্যেক মানুষ তথা সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টা বিরাজমান এই জ্ঞান করতঃ সর্বজীবে ও বিশ্ব মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার প্রচেষ্টা করার নাম মানব ধর্ম। মানব ধর্ম নতুন কোন ধর্ম নয় বরং সকল ধর্মের নির্যাস।
স্রষ্টা সৃষ্টির সঙ্গে এক হয়ে আছেন। সর্বব্যাপী, সর্বাত্মক তিনি। যা কিছু অস্তিত্ব অর্জন করেছে তা এখন, এখানেই প্রতিষ্ঠিত। জগত যা দিয়ে গঠিত মানবদেহও তা দিয়েই গঠিত। এতটুকু জানাই মানব ধর্ম পালনের জন্য যথেষ্ট। মানব ধর্ম পালন করতে হলে রাজনৈতিক দলের ন্যায় দল গঠন করতে হয় না, তীর্থে যেতে হয় না, কোন বিশেষ প্রকারের পোশাক পরিধান করতে হয় না, কোন প্রতীক ধারণ করতে হয় না, কোন আনুষ্ঠানিকতা করতে হয় না, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, পূত্র-কন্যা ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হতে হয় না। এজন্য বক্তব্য ও বিবৃতির মাধ্যমে সমাজে সামপ্রদায়িকতার বিষ বাষ্প ছড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না, শুধুমাত্র অহমিকা বর্জন করে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্দ্ধে ওঠে মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখলেই মানব ধর্ম পালিত হয়।
যারা ধর্মের নামে সমাজে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে তারা ধার্মিক নয়, সাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িক ধর্ম ব্যবসায়ীরা মানব সেবার নামে দরিদ্রতা, মূর্খতা, রোগ-শোক, বিপদ-আপদের সুযোগ নিয়ে এবং অর্থ ও চাকুরীর লোভ দেখিয়ে মানুষকে ধর্মান্তরিত করে নিজেকে ধন্য মনে করে। বাস্তবে পৃথিবীর সকল মানুষ যদি এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক হয় তবুও হিংসা ও সংঘাত বন্ধ হবে না। এখন পৃথিবীতে সংঘাত করছে একই সম্প্রদায়ের লোকেরা। যেমন, মুসলমানরাই মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষ করছে পৃথিবীর দেশে দেশে। সকল সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্দ্ধে থেকে মানুষ যতদিন মানব ধর্মের আশ্রয়ে না আসবে, ততদিন পৃথিবীতে শান্তি আসবে না।
পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছুরই মূল্য নির্ধারিত হয় মানুষের প্রয়োজনে এবং মানুষের দ্বারা। জগতের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে মানুষ। জগতের ভাঙ্গা-গড়া সবই হয়েছে মানুষের দ্বারা। এই জগত নিত্য রূপান্তরের দ্বারা যে রূপ নিচ্ছে ও ভবিষ্যতে যে রূপ নেবে এর মূলে রয়েছে মানুষ। দেশে দেশে কালে কালে মানুষ এক প্রকার সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে গড়ে তুলছে অন্য প্রকার সমাজ ব্যবস্থা মানুষেরই প্রয়োজনে। যুগে যুগে মানুষের মানবতাবোধ মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, জীবনের পথচলার সামর্থ্য দিয়েছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করতে, নানা মত ও পথ অবলম্বন করে ভেদের যে অভ্রভেদী প্রাচীর নানা আকার ও প্রকারে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠেছে তা চূর্ণ করতে প্রয়োজন মানবতাবোধের বিকাশ। কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের সুসমাচার প্রচার করে ভেদের অবসান তো ঘটানো যাবেই না বরং তা আরো শক্তিশালী হবে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে ভেদের কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের প্রচেষ্টা করাই বাস্তব সম্মত। যা বাস্তব সম্মত তাই সত্য। মানুষের উপলব্ধিতে যা ধরা পড়েছে কেবল তারই অস্তিত্ব আছে। মানুষ যা উপলব্ধি করতে পারে না তার কোন অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব মাত্রই ভাঙ্গাগড়ার অধীন। কোন কিছুই স্থায়ী নয়, চূড়ান্ত নয়। স্বয়ং সিদ্ধ সত্য হলো যা আমি'র মধ্যে সিদ্ধ। পূর্ণতা বলে কিছু নেই। আছে কেবল পূর্ণতার প্রচেষ্টা।
জীবনকে সর্বোত্তম শিল্পরূপে, সকল শিল্পের অধিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলাই মানবতার আদর্শ। এ আদর্শের ভিত্তিতেই মনুষ্য রচিত সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের প্রাচীর অতিক্রম করে মানুষ তার জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে পারে বাস্তবতা বা সত্যকে। বাস্তব যুক্তি ও বিচারের মাধ্যমে সত্যকে খুঁজে পেতে হবে। যা আছে তা নিয়েই জীবন। জীবনকে সমুন্নত করবার প্রচেষ্টাই জীবন। বেঁচে থাকার এষণাই রচনা করে জীবন বিকাশের পটভূমি।

দুঃখ মুক্তির আন্দোলন



দুঃখ মুক্তির আন্দোলন

সিদ্ধার্থ ॥ জীবন মানেই দুঃখের সমষ্টি। সারাজীবন মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের আন্দোলন করে। দুঃখ মুক্তির এই আন্দোলন থেকেই উৎপত্তি হয়েছে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখা। মানুষের সকল উদ্ভাবনই দুঃখ মুক্তির আন্দোলনের ফসল।
জন্ম থেকেই জীবকূল নানা প্রকারের দুঃখতাপে দগ্ধ হয়। শুধু যে বিচিত্র দৈহিক জরা ও যন্ত্রণা ভোগ করে তাই নয়। যুদ্ধ, মহামারী, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও জীবনকে দূর্বিষহ করে তোলে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিন কালে স্থিত অসংখ্য প্রাণীর অসংখ্য দুঃখ। প্রাচীন সাধকগণ দুঃখকে তিনভাগে ভাগ করেছেন - আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। শরীরের ভেতর থেকে উৎপন্ন রোগ জরাদি বা কাঙ্খিত বিষয়ের অপ্রাপ্তি হেতু দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক দুঃখ। শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকারের দুঃখই আধ্যাত্মিক। শারীরিক দুঃখ শরীরের নানাবিধ ত্রুটির কারণে উৎপন্ন হয়। মানসিক দুঃখ উৎপন্ন হয় - কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ভয়, ঈর্ষা, বিষাদ এবং কাঙ্খিত বিষয় না পাওয়ার ফলে। আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক দুঃখ শরীরের বাইরের কোন কারণ থেকে উৎপন্ন হয়। বাহ্যজগত থেকে যে দুঃখ উৎপন্ন হয় তা আধিভৌতিক। প্রাকৃতিক কারণে যে সব দুঃখের উৎপত্তি হয় তা আধিদৈবিক। বন্যা, খরা, মহামারী, ভূমিকম্প ইত্যাদি আধিবৈদিক দুঃখ। জন্ম থেকেই জীব এই দুঃখত্রয়ের ত্রিতাপ জ্বালায় জর্জরিত। এই ত্রিতাপ দুঃখ থেকে মুক্তির জন্যই মানুষের জীবন সংগ্রাম। দুঃখ নিবারণের তিন প্রকার উপায় আছে। যথা - লৌকিক উপায়, আনুশ্রবিক উপায় এবং তত্ত্বজ্ঞান।
দুঃখ নিবৃত্তির লৌকিক উপায় সর্বাপেক্ষা সহজ। তিন প্রকার দুঃখ নিবৃত্তির তিন প্রকার লৌকিক উপায় রয়েছে। আধ্যাত্মিক শরীর দুঃখ নিবারণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ ও পথ্য সেবন ও আধ্যাত্মিক মানস দুঃখ নিবৃত্তির জন্য সঙ্গ, পানীয়, সুস্বাদু খাদ্য সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, বস্ত্র, অলঙ্কার ইত্যাদি ভোগ্য বিষয় রয়েছে। আধিভৌতিক দুঃখ নিরাকরণের জন্য শাস্ত্রপাঠ, নিরাপদ স্থানে বাস ইত্যাদি বিবিধ সহজ উপায় আছে। অনুরূপভাবে আধিদৈবিক দুঃখ নিবৃত্তির জন্য সমসাময়িক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ অন্যান্য লৌকিক সহজ উপায় আছে। দুঃখ নিবৃত্তির লৌকিক উপায় সহজ, অধিকাংশ মানুষ সহজ পথই অনুসরণ করে কিন্তু সহজ ও লৌকিক পদ্ধতিতে কিছুক্ষণের জন্য দুঃখের নিবৃত্তি হয় মাত্র, মূল থেকে দুঃখের নিবৃত্তি হয় না।
দুঃখ নিবৃত্তির আনুশ্রবিক উপায় হলো এক এ ডুবে থাকা। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত্রি, প্রতিটি মাস এবং প্রতিটি বৎসরাদি কাল এক এ মগ্ন থাকা দুঃখত্রয়কে নিবৃত্ত করতে সমর্থ্য। এর ফল আনন্দলাভ। যে অনুভূতি দুঃখের সঙ্গে মিশ্রিত নয়, যে অনুভূতি পরবর্তীতে দুঃখের দ্বারা অভিভূত হয় না এবং যে অনুভূতি ইচ্ছামাত্র উপস্থিত হয়, সেই অনুভূতিকে আনন্দ বলে।
ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ-এ ভেদজ্ঞানকে বলে তত্ত্বজ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারাও দুঃখ থেকে নিবৃত্তি লাভ করা সম্ভব। ব্যক্ত জগৎ, অব্যক্ত প্রকৃতি এবং জ্ঞ বা স্ব-রূপ অনুধাবনের মাধ্যমে দুঃখের হাত থেকে মানবের নিবৃত্তি লাভ হতে পারে।
দুঃখ মুক্তির আন্দোলনেও দুঃখ আছে। যে উপায়ই অবলম্বন করি না কেন সহজে দুঃখের নিবৃত্তি হবে না এটা মেনে নিয়েই দুঃখ নিবৃত্তির প্রচেষ্টা করতে হয়। কেবল চাইলেই দুঃখের নিবৃত্তি হয় না। সংগ্রামের মাধ্যমেই মানুষ দুঃখকে জয় করতে পারে তাই দুঃখ জয়ে আনন্দ মেলে। দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন করতেই হবে। দুঃখের কাছে হার মানলে চলবে না। মানুষ এত দুর্বল নয় যে, দুঃখের তাপ তাকে ভস্ম করবে। যার জীবনে যে দুঃখ আসে, সে দঃখকে জয় করার শক্তিও তার কাছে থাকে। দুঃখের তাপ সহ্য করে দুঃখমুক্তির আন্দোলন যিনি করেন তিনিই তাপস। জীবনে দুঃখ এসেছে বলে নিজেকে অবজ্ঞা না করা বরং দুঃখ আসলে নিজেকে সম্মানিত বোধ করতে হবে যে আর একটা দুঃখকে অতিক্রম করার সুযোগ পাওয়া গেলে। দুঃখকে পরাজিত না করে নিজের বীরত্ব ও সম্মান উপলব্ধির অন্য কোন পথ নেই। জীবনে দুঃখ না আসলে আমরা জানতেই পারি না যে দুঃখকে মোকাবেলা করার শক্তি আমাদের আছে।
মানুষ এখন পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি করেছে তা দুঃখ তাপকে সহ্য করে, ত্যাগের দ্বারা, তপস্যা ও গবেষণা বা উপাসনার দ্বারাই সৃষ্টি করেছে। মানুষের মনুষ্যত্ব, উদারতা, মহানুভবতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে দুঃখ দ্বারা দুঃখকে জয় করার মাধ্যমে। বিষে বিষ ক্ষয় - এটাই প্রাকৃতিক বিধি।
জীবনে যদি দুঃখ না আসে তবে গর্ব করার কিছু থাকে না, অর্জন করারও কিছু থাকে না। জমি কর্ষণ করে কৃষককে ফসল উৎপাদন করতে হয় এটা কৃষকের অসম্মান নয়। বরং দুঃখকে মোকাবেলা করে ফসল উৎপাদন করতে হয় বলেই ফসলের মূল্য আছে। দুঃখের অভাবই জীবনে সবচেয়ে বড় অভাব - এই বোধ যার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে তার আর কোন দুঃখ নাই। বিধাতার কাছে দয়া নয় বরং দুঃখকে মোকাবেলা করার শক্তি, সাহস ও দৃঢ়তাই কাম্য।