বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৪

চিন্তা নিয়ন্ত্রণ

চিন্তা নিয়ন্ত্রণ

সিদ্ধার্থ ॥ বাহ্য জগতের সাথে কি প্রকারে নিজের সংযোগ হয়? কি প্রকারে বাহ্য জগতের তথ্য নিজের ভিতরে প্রবেশ করে? আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো বাহিরের দিকে উন্মুক্ত। বাহ্য জগতের আঘাত ইন্দ্রিয়ের উপর পতিত হয় এবং বাহিরের তথ্য ভিতরে প্রবেশ করে। দেহের একটি জীবকোষ যখন স্পন্দিত হয়, তখন পাশের জীবকোষে সে স্পন্দন সঞ্চারিত করে এবং এই প্রকারে একটি কোষ থেকে আরেক কোষের মাধ্যমে তা চিন্তার কেন্দ্রে প্রবেশ করে। বাহ্যিক আঘাত যদি ক্ষীণ হয় তবে কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না এবং ইন্দ্রিয় অনুভূতি হয় না। বাহ্য জগতের নির্দিষ্ট আঘাত গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট গ্রাহক ইন্দ্রিয় রয়েছে। বায়ুর স্পন্দন কর্নে আঘাত করলে সে আঘাতকে আমরা বলি শব্দ। একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন আঘাতের মাত্রা ও গুণ অনুযায়ী আমরা তাদের নামকরণ করে থাকি।
তার দিয়ে বৈদ্যুতিক প্রবাহ স্থানান্তরে পৌঁছে তার কেটে দিলে বিদ্যুৎ প্রবাহ থেমে যায়। আবার একই বিদ্যুৎ দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্র চালিত হয়। ঠিক একইভাবে বাহ্য জগতের তথ্য যে ইন্দ্রিয় দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে ইন্দ্রিয়ের সাথে চিন্তার সংযোগ কেটে দিলে তা আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। যা প্রবেশ করে তাকেও চিন্তা-সংযোগে বিভিন্ন কার্যে ব্যবহার করা যায়। আর এক প্রকারের শক্তি আছে যা নিজের ভিতরেই উৎপন্ন হয়। ভিতরে উৎপন্ন শক্তি বাহিরের শক্তিকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করার সামর্থ রাখে। সুতরাং দেখা যায়, দুই প্রকারের শক্তি দ্বারা জীব উত্তেজিত হয় - বাহিরের শক্তি এবং ভিতরের শক্তি। বাহিরের শক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই কিন্তু ভিতরে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার একমাত্র অধিপতি নিজেই। যে পথ দিয়ে বাহিরের শক্তি ও তথ্য নিজের ভিতরে প্রবেশ করে সে পথকে সংকুচিত কিংবা প্রসারিত করার, রুদ্ধ কিংবা উন্মুক্ত করার ক্ষমতা মানুষের আছে।
প্রত্যেকেরই এমন অভিজ্ঞতা আছে যে চিন্তার বিক্ষিপ্ত অবস্থায় যা দেখি নাই কিংবা শুনি নাই, চিন্তা যোগ করে তা দেখি অথবা শুনি। চিন্তাযোগে অনুভূতি হ্রাস-বৃদ্ধি হয়ে থাকে। কি উপায়ে চিন্তার যোগ বা বিয়োগ ঘটে কিংবা সংযোগ দ্বার রুদ্ধ কিংবা উন্মুক্ত হয়, চিন্তা জগতে এমন কি আছে যা ইন্দ্রিয়কে গ্রহণ কিংবা প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত করে তা নিজেকে পর্যবেক্ষণ না করে উপলব্ধি কারার সুযোগ করার নেই। এটা উপলব্ধি করা খুব কঠিন নয় যে, ইচ্ছানুসারে বাহ্যিক প্রভাব হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। এই হ্রাস-বৃদ্ধি চিন্তা সন্নিবেশের উপর নির্ভর করে। একরূপ সন্নিবেশে উত্তেজনার প্রবাহ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়, অন্যরূপ সন্নিবেশে উত্তেজনার প্রবাহ আড়ষ্ট হয়। বাহিরের শক্তি দ্বারা যাহা ঘটে ভিতরের শক্তি দ্বারাও অনেক সময় তা সংঘটিত হয়। বাহিরের আঘাতে যেমন হস্ত-পেশী যেরূপ সংকুচিত বা প্রসারিত হয়, ভিতরের ইচ্ছায়ও হস্ত-পেশী সেরূপ সংকুচিত বা প্রসারিত হয়।
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এ শক্তি নিহিত আছে যা দ্বারা সে বহির্জগতের সাথে সংযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জগত আঘাত করলেই আঘাত পেতে হবে এমন কোন নিয়ম মানুষ মেনে চলতে বাধ্য নয়। জগতের আঘাত কে কিভাবে গ্রহণ করবে তার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ইচ্ছানুসারে বাহির ও ভিতরের প্রবেশ পথ উন্মুক্ত কিংবা অবরুদ্ধ করতে পারে। এইরূপে দেহ ও চিন্তার উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে যে ক্ষীণ শব্দ শ্রবণযোগ্য নয় তা সে শুনতে পারবে আবার যে উচ্চ স্পন্দনের শব্দ তা সে শুনতে পাবে না। ইচ্ছানুসারে সে হাত, পা, কান, চোখকে তার কর্তৃক নির্ধারিত কর্মে নিয়োজিত রাখতে পারবে।
যখন চিন্তা ইন্দ্রিয়ের বিশেষ কেন্দ্রে সংযুক্ত হয়, তখনই বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ যাবতীয় কর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। চিন্তার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে যখন তখন তা ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্রগুলোতে সংযুক্ত হয়ে যায়। এই জন্যই মানুষ যা-তা কর্ম করে এবং দুঃখ উৎপন্ন করে। চিন্তার উপর যদি নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকত তাহলে মানুষ এত চিন্তাও করত না এত কর্মও করত না। চিন্তা নিয়ন্ত্রণে থাকলে যখন তখন ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয়ানুভূতির কেন্দ্রগুলোতে সংযুক্ত হতো না, ফলে অনুভূতি ও আকাঙ্খা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকত।
চিন্তাকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী ইন্দ্রিয়ের সাথে সংযুক্ত ও বিযুক্ত করতে পারলে আমরা পূর্ণতার দিকে অনেক দূর অগ্রসর হবো। নিজের উপর এই নিয়ন্ত্রণ না আসা পর্যন্ত মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। এর আগ পর্যন্ত আমরা যন্ত্রের মতোই জড় পদার্থ। মানুষের চিন্তা অত্যন্ত চঞ্চল, এক স্থানে এক মিনিটও স্থির থাকে না। প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার বার সে স্থান পরিবর্তন করে। চিন্তা এমন এক মাতাল বানরের মতো যাকে বৃশ্চিক দংশন করেছে। তাই বিষয় থেকে বিষয়ে তার অবিরাম লাফালাফি। এই চঞ্চল চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন অবশ্যই।
নানা প্রকার পরিবেশে নানা প্রকার লোকের-সঙ্গ চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করে। তাই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথম প্রথম নির্দিষ্ট সময় একা থাকার অভ্যাস করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, পরনিন্দা, পরচর্চা, তর্ক ইত্যাদি হতে বিরত থাকতে হবে। বেশি কথা বললে, বেশি কাজ করলে চিন্তাও বেশি চঞ্চল হয়।
এক বিষয়ে থাকলে চিন্তা শান্ত হবে এবং প্রত্যেকটি বিষয় গভীরভাবে দেখার, বুঝার  ও উপলব্ধি করার সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। দৈহিক সুস্থতা একরৈখিকতার প্রথম চিহ্ন। যারা একরৈখিকতায় আরো উন্নতি চান তাদের সকল গ্রহণ বর্জন যেমন আহার, দৃষ্টি, অনুভূতি, শ্বাস ইত্যাদি সর্বদিকে সতর্ক থাকতে হবে। তবেই চিন্তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। চিন্তা যত একরৈখিক হবে ইন্দ্রিয়গুলোর অনুভূতিও ততই সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ণতর হতে থাকবে।
চিন্তা নিয়ন্ত্রণের প্রথম উপায় কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকা। দেহকে স্থির রাখা। চিন্তা কিভাবে লাফালাফি করছে তা অবলোকন করা। চিন্তা যতই লাফালাফি করুক তাতে ক্ষতি নাই। এতোদিন সে তা-ই করে আসছে আজও তা-ই করুক। 'আমি' শুধু তার লাফালাফিটা পর্যবেক্ষণ করি। এরূপ পর্যবেক্ষণ করাও সহজ নয়। প্রথম দিকে যে পর্যবেক্ষণ করছে তাকে সাথে নিয়েই চিন্তা লাফালাফি শুরু করে দেবে। বারবারই তা ঘটতে থাকবে এবং বারবারই ফিরে আসতে হবে পর্যবেক্ষণে। যতক্ষণ না জানতে পারব চিন্তা কি করছে ততক্ষণ তাকে সংযত করা যাবে না। চিন্তা যেমন খুশি বিচরণ করুক। বাজে চিন্তা উদিত হোক ক্ষতি নাই, ডুবে যাক ক্ষতি নাই। কেবল নিজেকে পৃথক করে পর্যবেক্ষণ করে যেতে হবে। প্রথম কয়েক মাস অসংখ্য বিষয়ের উদয় অস্ত হবে কিন্তু ধীরে ধীরে তা অবশ্যই কমতে থাকবে। ধৈর্যের সাথে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকলে চিন্তা অবশ্যই শান্ত হবে। কারণ চিন্তার শক্তি বিভাজিত হয়ে সিংহভাগ পর্যবেক্ষণে চলে যায়। ফলে শক্তি না পেয়ে চিন্তা শান্ত হয়।

এটা কঠিন কাজ, একদিনে এ কাজে সফলতা আসে না, এক মাসেও না। ক্রমাগত কয়েক বৎসর চর্যা করলে চিন্তার গলায় শিকল পড়ানো যায়। চিন্তার গলায় একবার শিকল পরাতে পারলে খুঁটি দিয়ে তাকে এক জায়গায় গেড়ে রাখতে হয়। ছোট্ট হস্তি শাবককে যখন প্রথম জঙ্গল থেকে ধরে আনা হয় তখন তাকে ছয় ফুট লম্বা মোটা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। হস্তিশাবক মুক্ত হওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয় কারণ শিকল ভাঙ্গার শক্তি তাঁর ছোট্ট শরীরে থাকে না। সে বারবার শিকল টানে, বারবার রক্তাক্ত হয়। এভাবে রক্তাক্ত হতে হতে এক সময় সে শিকল ভাঙ্গার চেষ্টা ছেড়ে দেয়। ফলে তার দুনিয়া শিকলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এক সময় হস্তি-শাবক বড় হয়, শিকল ছেঁড়ার শক্তি হয় তার গায়ে। চেষ্টা করলে এক মুহূর্তে সে শিকল উপড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু যখনই তার পায়ে শিকলের টান লাগে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন