সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০১৪

হেফাজতে ইসলাম খোলস পাল্টাচ্ছে



হেফাজতে ইসলাম খোলস পাল্টাচ্ছে

ফয়সাল ॥ বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে হেফাজতে ইসলামের। ভেতরের খবর হচ্ছে, সংগঠনটির ওপর চটেছেনও বিএনপির শীর্ষ নেতারা। গত ২ জুলাই রাজনীতিকদের সম্মানে খালেদা জিয়ার ইফতার মাহফিলে দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও হেফাজত নেতারা অংশ নেননি। আর এতেই ক্ষুব্ধ বিএনপি'র হাই কমাণ্ড। নিকট অতীতে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে অকুণ্ঠ সমর্থন দিলেও হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক অবস্থান ও কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারছেন না তারা। দলের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি নেতারা মনে করছেন, অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও হেফাজত এখন আর সেখানে নেই। তারা এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়কে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে।
একসময় অনেকটা অনাগ্রহ সত্ত্বেও হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক হয় বিএনপির। সেসময় রাজনৈতিক ফায়দা দেখেই এই সম্পর্ক করে দলটি। সূত্র জানায়, জোটের অন্যতম শরিক জামাতের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতের আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকায় তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ার আগ্রহ বিএনপির ছিল না। কিন্তু গত বছর হঠাৎ করে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে হেফাজতের আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে সেখান থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে বিএনপি। তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে সরকার পতন আন্দোলনে কট্টরপন্থী এ সংগঠনকে কাজে লাগাতে চায় তারা। ফলে ৬ এপ্রিল মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বর সমাবেশ এবং ৫ মে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে পূর্ণ সমর্থন দেয় বিএনপি। এ থেকে রাজনৈতিক সুবিধাও পেয়ে যায় দলটি। ওই সময়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয় হেফাজত। আর তাতে ব্যাপক বিজয়ও আসে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও বিএনপি-হেফাজত গাঁটছড়া ভালোই ছিলো। কিন্তু তারই মধ্যে আওয়ামী লীগ নির্বাচন সম্পন্ন করে এবং নতুন সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনের পর থেকেই ইউটার্ন নিতে শুরু করে হেফাজতে ইসলাম। এদিকে এরই মধ্যে সরকার পতনের ডাক দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ঈদের পরেই কঠোর আন্দোলন বলে হুমকি দিয়েছেন জনসভায়। সূত্রমতে, বিএনপি নেতাদের ধারণা ছিল, সরকার পতন এই আন্দোলনেও পাশে পাবে হেফাজতকে। কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলন দূরে থাক, তাদের বিরুদ্ধে ভাষণ-বক্তৃতা দেয়া থেকেও সরে এসেছেন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা। বরং উল্টো কথাও বলছেন। সম্প্রতি দু'টি সমাবেশে হেফাজতের আমীর আহমেদ শাফি বলেন, 'আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ আমাদের বন্ধু।'
এ সময় একটি অভিযোগও ওঠে আহমেদ শাফির ছেলেকে রেলের কোটি টাকার জমি দিয়ে হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করেছে সরকার। এতে হেফাজতের ওপর চটেছেন বিএনপি নেতারা। কেবল তাই নয়, হেফাজতের সঙ্গে বন্ধুত্ব হারিয়ে এখন নতুন তত্ত্বও দিচ্ছেন কেউ কেউ। সূত্র জানায়, হেফাজতের ওল্টা অবস্থানের কারণে শাপলা অভিযানের ১৪ মাস পর এসে বিএনপি নেতারা এখন বলছেন, বিএনপির আন্দোলন স্তিমিত করতেই বিশেষ সংস্থাকে দিয়ে সে সময়ে হেফাজতকে মাঠে নামিয়েছিল সরকার।
তা ছাড়া ওই সময় নিহতের যে পরিসংখ্যান হেফাজতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল সেটিও ছিল ষড়যন্ত্রেরই অংশ। অথচ এই নিহত লাশের সংখ্যা নিয়ে একের পর এক বিভ্রান্তিকর বক্তৃতা করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের নেতারা। 'পাখির মতো গুলি করে শত শত মানুষ মারা হয়েছে' বলে তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলেছেন। নিজেদের এই বক্তব্যের বিপরীতে এখন নিজেরাই অবস্থান নিয়েছেন বিএনপি নেতারা।
সূত্র মতে, নেতারা মনে করেন, বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত হলে হেফাজতের দু'চার জন শীর্ষ নেতাও মৃতের তালিকায় থাকতেন। মূলত, আন্দোলনরত ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের ভয় দেখাতে ব্যাপক প্রাণহানির গুজব হেফাজতকে দিয়ে সরকারই ছড়িয়েছিল বলে জানা যায়। এ বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে না পেরে হেফাজতের সুরে সুর মিলিয়েছিল বিএনপি। অথচ সে সময় খালেদা জিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে হেফাজতের সমাবেশে একাত্মতা প্রকাশ করতে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি অবশ্য অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গত ১২ মার্চ থেকে কারাভোগ করছেন। অপর প্রতিনিধি হয়েছিলেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। বিএনপির এই নেতা হেফাজত সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বেশ কিছুদিন কারাভোগ শেষে এখন দেশের বাইরে সিকিৎসাধীন আছেন। ওই ঘটনায় হেফাজতের কোনো নেতা এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হননি। এখন তারা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেরীতে হলেও এ বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে বিএনপিকে। তবে এসব ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি বিএনপির কোনো নেতা। হেফাজতের ব্যাপারে সব সময় ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে আসছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ। গত শুক্রবার তিনি বলেন, 'হেফাজতের সঙ্গে সরকারের আঁতাত হচ্ছে কি না? এবং দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও হেফাজত নেতারা কেন ম্যাডামের ইফতার মাহফিলে এলেন না, সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। তাই এ নিয়ে কোনো কথা বলবো না'।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর হেফাজতের আহ্‌বায়ক নূর হোসেন কাসেমী বলেন, ২ জুলাই খালেদা জিয়ার ইফতার মাহফিল ছিল রাজনীতিকদের সম্মানে। সেখানে হেফাজতের নেতাদের যাওয়ার কথা না। দাওয়াতের কথা স্বীকার করে ঢাকা মহানগর হেফাজতের মিডিয়া সেলের প্রধান আহনুল্লাহ ওয়াছেল বলেন, হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তাই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হেফাজতের গভীর সম্পর্ক অতীতে ছিল না। এখনো নেই। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন