বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৪

বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ

বিশ্বমানব হবি যদি
কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ

শেখ উল্লাস ॥  বাঙালি জাতি অনেকটাই  আবেগ প্রবণ। আবেগ খারাপ কিছু নয় যদি বেগের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। লক্ষ্যহীন বেগই উন্মাদনায় পর্যবসিত হয় যেমনটি হয়েছিল এবারের বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে। ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি এদেশে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে একথা যে কেউ ধরে নিতে পারেন যে, এদেশের সবাই বুঝি বিশ্বমানব হয়ে গেছে। ব্যাপারটা কী আসলে তাই? প্রকৃত অর্থেই কি আমরা বিশ্বমানব হয়ে গেছি? নাকি কোন কিছু না বুঝেই প্রিয় দলের সমর্থনে উত্তাল হয়ে যাচ্ছি? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বেশ কিছু নিরীক্ষার প্রয়োজন।
যখন গণমাধ্যমে বিশ্বকাপ নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না, তখন আমাদের ফুটবল খেলার মান এশিয়ার মধ্যে আরব-কোরিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল। বর্তমানে দৃশ্যপট পাল্টেছে। টিভির পর্দা ছাড়া বাংলাদেশের মাঠে-ময়দানে ফুটবল খেলা এখন নেই বললেই চলে।  সম্প্রতি জাতীয় ফুটবল লীগের যে ক'টি খেলা বিটিভিতে দেখানো হয়েছিল তাতে ষ্টেডিয়ামে দর্শকশূন্যতা প্রকট আকারে ধরা পড়ে। জাতীয় লীগে মাঠের অবস্থা যখন এমন দর্শকশূন্য, তখন দেশের বিভাগীয়-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের মাঠগুলোর অবস্থা আর কি হতে পারে? বিশ্ব ফুটবলের মানদণ্ডে এখন বাংলাদেশের স্থান অনেক নেমে গেছে। তাই দেশের ফুটবলে আগ্রহ হারিয়ে নতুন প্রজন্ম আজ বিশ্বফুটবল তারকাদের নিয়ে পাণ্ডিত্য জাহির করছে। এই অবস্থায় দেশীয় ও জাতীয় ফুটবল সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের আরও বেশি উদাসীন হয়ে পড়ার শংকা রয়েছে। এদিকে ফুটবলের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও চলছে সার্বিক মানের চরম দূরাবস্থা। এ সুযোগে সাধারণ মানুষসহ নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় ঢুকে গেছে বিদেশি ক্রীড়াঙ্গণ। এ উদাসীনতার জন্য কে বা কারা দায়ী? তথ্য প্রযুক্তির আগ্রাসন? নাকি ক্রীড়া আয়োজকগোষ্ঠী, যারা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন? এসব প্রশ্ন আজ দেশের সর্বমহলের। নীরিক্ষায় দেখা যায়, একটি দেশের সার্বিক উন্নতির মানদণ্ড নির্ভর করে সে দেশের খেলাধুলা শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের উপর। হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধশালী এদেশ একসময় নিজস্ব খেলাধুলায় এগিয়ে ছিল। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনেও এদেশের অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয় ও প্রতিযোগিতা মুখর।  সেসময় খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠতো। এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যুবাদের মধ্য থেকে তৈরি হতো নতুন কুশলী খেলোয়াড়, যারা নিজ এলাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনে নেতৃত্ব দেয়ার মতো গুণাবলী অর্জন করতো। আজ তা অনুপস্থিত। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে ৯০'র পর এদেশে এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে  রাজনীতিজীবীদের মতো ক্রীড়া-সংগঠকদের অনেকের মাঝেই বাণিজ্যিক মনোবৃত্তিটা প্রবলভাবে জেগে উঠেছে। দেশের খেলাধুলার মানোন্নয়নের  চেয়ে নিজের প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়িক ফায়দা অর্জনেই তারা মনোযোগী হন বেশি। এসব কারণে সাধারণ মানুষও ক্রীড়াঙ্গন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পরিণতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতি-সমাজ ও  ক্রীড়াঙ্গণ।
এদেশে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেও খেলাধুলার মান যেমন ছিল, বিশেষ করে ফুটবল নিয়ে সাধারণ মানুষের যে আকর্ষণ ছিল তা আজ খুঁজে পাওয়া যায়না। বরং নতুন করে ভীনদেশী ফুটবল নিয়ে মাতামাতি প্রবল হয়েছে। এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ  বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে এদেশে যে মাতামাতি হয়েছে তা ছিল লজ্জাজনক ও  আইন-বিরোধী ব্যাপার। কেননা, ১৯৭২ সালের পতাকা আইনে বলা আছে যে, নিজ দেশের পতাকা ছাড়া অন্য কোন দেশের পতাকা সংশ্ল্লিষ্ট দূতাবাস ছাড়া  নিজ ভবনে কিংবা অন্য কোথাও ওড়ানো দেশোদ্রোহিতার সামিল। ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে উল্লাস করার মতো প্রকাশ ও পতাকা নির্ভর আনন্দ- করার সুযোগ বর্তমান প্রজন্ম পাচ্ছে না বলেই কী বিদেশি পতাকা নিয়ে এমনটি হচ্ছে? নাকি পতাকা আইনের বিষয়টি নতুন প্রজন্মকে জানানোই হয়নি! এভাবে চলতে দিলে দেশাত্মবোধ, আত্ম-উন্নয়ন এবং সচেতনতাবোধ জাগ্রত হবে কী?  এর উত্তর পেতে সংস্কারক ও ক্রীড়ানুরাগীদের সচেতনতা এখন  সময়ের দাবী।
সম্প্রতি স্থানীয় ও আঞ্চলিক ক্রীড়াঙ্গনে প্রতিযোগিতার সূত্র ধরে  সংঘাত এখন নিয়মিত ব্যাপার। তাই, সহিংসতা রোধে গ্রাম-মফস্বলের স্কুল-কলেজের মাঠে খেলাধুলা নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি টাঙ্গিয়ে রাখতে হচ্ছে। ক্রীড়াঙ্গনে এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের খেলার মান আরও নিম্নমুখী হবে। শুধু রাজধানী-কেন্দ্রিক  ক্লাবগুলোতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থ বরাদ্দ দিয়ে দেশের খেলাধুলার সার্বিক মানোন্নয় অসম্ভব। এ কথাটাও সংগঠকদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। এজন্য ক্রীড়াঙ্গণ নিয়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও  কার্যকর করা জরুরি। সম্প্রতি সরকারী দলের আশাবাদ, স্থানীয় সরকার যত শক্তিশালী হবে, জনগণও তত বেশি সেবা পাবে। কিন্তু সেই স্থানীয় সরকারে সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত নেতৃত্বের প্রকট অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন তাদের একাংশ। বিশেষ করে গণমুখী ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণকামী নির্বাচিত ব্যক্তিরা জনগণের কাছাকাছি আসছেন না। এর ফলে মাঠপর্যায়ে কাঙ্খিত সেবা পৌঁছানো গতিশীলতা হারাচ্ছে। স্থানীয় সরকারে সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত সংগঠকদের অভিসিক্ত করে গ্রাম মফস্বলের ক্রীড়াঙ্গণসহ শিক্ষার প্রতি অনুরাগী করে তুলতে হবে। কারণ, শিক্ষা ও ক্রীড়াঙ্গণে টিকে থাকার জন্য যে ধরনের   মেধা ও কসরত করতে হয় তা তাকে কাঙ্খিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার প্রেরণা যোগায়। একজন ভালো খেলোয়ার  জাতীয় সম্পদ। সম্প্রতি বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে এদেশের মানুষের মধ্যে ফুটবলের প্রতি যে উন্মাদনা দেখা গেছে তাকে ইতিবাচক কাজে লাগানো খুব জরুরি। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে ক্রীড়াঙ্গনের মাধ্যমে   না চিনিয়ে দিলে বিশ্ব অঙ্গনে কর্তৃত্ব্ব করার সুযোগ আসবে না। আত্মজাগরণ তৈরি করার ক্ষেত্রে স্বশিক্ষিত দেশপ্রেমিক সংগঠক আজ বড় প্রয়োজন।
নিজেকে না জানলে, না চিনলে, নিজেকে জয় করতে না পারলে কখনোই অপরকে জয় করা যায় না। বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে এক বাঙালি সাধক বলেছিলেন-   
 'মানুষ হ মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ, বিশ্বমানব হবি যদি তুই, কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ'-

৭১'এর স্বাধীনতাযুদ্ধে এই সাধকের বাণী অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছে প্রেরণাদায়ক ছিল। সময় এসেছে, সাধকের এই সত্যকে আবার নতুন করে উপলব্ধি করে প্রকৃত বাঙালিবোধকে জাগ্রত করার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন