বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

বাংলা ভাষায় স্বকীয়তা রক্ষা

সময়ের সাফ কথা....
বাংলা ভাষায়স্বকীয়তা রক্ষা
- আইরিন আক্তার

মূল কথা : বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা।
মূল কথা :বাংলা ভাষা স্বকীয়তা রক্ষার নীতিমালা চাই। বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে ইংরেজী অথবা কোন ভাষা চর্চায় কোন বিদ্বেষ নাই।
অনুরোধ : উৎসাহী না করতে পারেন আমাকে অনুৎসাহিত করবেন না।
জিজ্ঞাসা : ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের দাম আমরা দিতে পারব না তবে সম্মান জানাতে অর্থাৎ ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করতে আপত্তি কিসের?
পরামর্শ : মানুষ অপরাধ করে। আইন দিয়ে অপরাধ যেমন করে নির্মূল করা যায় না। কিন্তু লাগাম টেনে ধরা যায় তেমন করেই ভাষা গতিশীল জেনেই আমাদের ভাষার স্বকীয়তাকে উদ্দেশ্য :  লাগাম টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
উদ্দেশ্য : সমালোচনা নয়, সমঝোতা।
পদক্ষেপ : সুনাগরিক হিসেবে স্ব উদ্যোগ সচেতন হতে চাই, সচেতন করতে চাই। ভাষা রক্ষা পরের কথা আগে ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা সংস্থার সন্ধান চাই। সদস্য হতে চাই।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ শে ফেব্রুয়ারি .... ছেলে হারা শত মায়ের বেদনা আমি কি ভুলিতে পারি।
ছেলে হারা মায়ের বেদনায় আপ্লুত হয়ে গান, পুস্তক রচিত হয়, সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সর্বপ্রথমে বাংলাভাষার স্বকীয়তা রক্ষার আইন তৈরি এবং প্রয়োগ প্রয়োজন। ‘আইন তৈরি’ এই প্রসঙ্গে যদি কেউ বলে আইন দিয়ে কি হবে, ক’জন আইন মানে? প্রয়োজন জনসচেতনতা। তাদের কথায় যুক্তি আছে তবে এক্ষেত্রে আমাদের জানা প্রয়োজন বাংলাদেশে যানবাহন আইন (ট্রাফিক আইন) আছে। কেউ যদি নাও মানে তবুও সে জানে, সে অন্যায় করছে। এই জানা থেকে একদিন হয়ত তার বোধোদয় হবে। এই সূত্রে বলা যায়, একজন ব্যবসায়ী যখন নামফলক (সাইনবোর্ড) তৈরি করেন, ঔষুধ ব্যবসায়ী হলে উদাহরণ স্বরূপ ‘মহিমা মেডিসিন কর্ণার’ লিখেন। যেখানে উচিত ছিল ‘মহিমা ঔষধালয়’ বা ‘মহিমা ঔষধ বিতান’ লেখা। যদি এ ক্ষেত্রে আইন থাকত বাংলিশ, নামফলক তৈরি করা যাবে না, প্রথমে সম্পূর্ণ বাংলা তারপর ইংরেজী ব্যবহার করা যাবে তাহলে একজন ভুলকারী ভুল করলেও মনে মনে জানতেন যে তিনি ভুল করছেন। এরকম হাজারও উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একজন সচেতন ব্যক্তির চোখে ভুল পড়লে তিনি সেই ব্যবসায়িকে বললে হয়তো সংশোধন সম্ভব। কিন্তু আইন না থাকলে ওই ব্যবসায়ী কোন কিছুতেই কর্ণপাত করবেন না। নামের কোন অর্থ থাকে না বা ভুল হয় না এ দৃষ্টিতে যদি কেউ অমত করে, তাহলে বলব অন্তত নুতন প্রজন্মের স্বার্থে আমরা অর্থবহ নামফলক তৈরি করি। শিশুরা পরিবেশ থেকেও শিক্ষা নেয়।
কম্পিউটার শব্দের অর্থ গণনাকারী। কিন্তু এখানে গণনাকারী বললে কম্পিউটার বলতে যা বোঝায় তা বোঝানো যাবে না। এ ধরনের ক্ষেত্রগুলো ছাড়া ইংরেজী শব্দের ব্যবহার, বাংলা ভাষাকে হত্যা করার ঔষুধ বা রোগাক্রান্ত করার জীবাণু। গণমাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তুলনায় প্রচারিত সংবাদে যথাসম্ভব ইংরেজী শব্দের কম ব্যবহার দেখা যায়, সেটিকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করা দরকার। গণমাধ্যমে উপস্থাপনা যেটি ইংরেজীতে হয় সেটিতে ভুল করেও বাংলা বলা হয় না। তাই বাংলা উপস্থাপনায় ইংরেজী শব্দের পরিহার আবশ্যক।  প্রয়োজনে পুরো বাক্য বলা যাবে, কিন্তু শব্দ না।
উদাহরণ : ‘তুমি আমার ফ্রেন্ড’ না বলে (বিচ্ছিন্নভাবে ভিন দেশীয় শব্দ ব্যবহার না করে) পুরো বাক্য ইংরেজীতে বলা ‘ইউ আর মাই ফ্রেন্ড’। স্বাস্থ্য, ধন-সম্পদ হারালে ফিরে পাওয়া যেতে পারে কিন্তু ভাষার স্বকীয়তা হারিয়ে গেলে তা ফিরিয়ে আনা যে অতি দুষ্কর তা সহজেই অনুমেয়। সঠিক দিক নির্দেশনার জন্য সঠিক অভিভাবক প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন করে অন্যান্য ব্যাংকের অভিভাবক। তেমন করে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভাষার দিক থেকে অন্যান্য গণমাধ্যমের অভিভাবক হওয়া প্রয়োজন।
মোবাইল বিদেশী পণ্য হওয়া সত্ত্বেও এর বাংলা নামকরণ হয়েছে মুঠোফোন, তাহলে ‘পুলিশ কন্ট্রোল রুম’ লেখার আগে ‘পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ’ কেন লেখা যায় না। অবাক করার বিষয় হল এ ব্যাপারটি দেখা যায় ভাষার মেলা, প্রাণের মেলা বই মেলাতেও। দোকান নং না লিখে স্টল নং লেখা হয়েছে, এরকম আরো অনেক বিষয় রয়েছে মেলাতে তথ্যকেন্দ্রে, বাংলা একাডেমী কার্যালয়ে এগুলো বলার চেষ্টা করেছি সাড়া পাইনি। কাউকে কটাক্ষ করে নয় অনুরোধ করে সচেষ্ট হতে চাই।
ভাষা মানুষের মুখের বুলি। মানুষের রোগ হয় চিকিৎসা হয়। ভাষারও রোগ হতে পারে, উপযুক্ত চিকিৎসায় রোগ সারানো সম্ভব। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’ এর ‘ইনস্টিটিউট’ এই অংশ সরিয়ে ‘প্রতিষ্ঠান’ লিখলে এবং নিচে ‘ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট’ লিখলে বড় কোন অসুবিধা হবে না। প্রত্যেকটি ভাষাতেই ভিনদেশী শব্দ থাকে। আমাদের ভাষার রক্তাক্ত ইতিহাসের মত অন্য ভাষার এমন ইতিহাস নেই তাই আমরা অবশ্যই অন্যান্য ভাষাভাষীর চেয়ে ভিন্ন হব, সংবেদনশীল হব। ‘ভাষা গতিশীল’ চির সত্য এ কথা মেনেই ভাষার লাগাম ধরা যায়।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমী পরিচালিত প্রশিক্ষণ কোর্সে ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের ক্লাসের সময়সূচি।
এই সময়সূচিতে অনেকগুলো কর্মসূচি আছে কিন্তু শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষা শেখার, উচ্চারণের কোন কর্মসূচি নেই। মূল শিরোনামে কোর্স-এর অর্থ কার্যধারা এবং ক্লাসের অর্থ শ্রেণী। বহুল প্রচলিত ভিনদেশী শব্দ ব্যবহারে কোন ভুল না হলেও ‘কোর্স’ এবং ‘ক্লাস’ এর বাংলা শব্দ এখনও হারিয়ে যায়নি।

আলাদিনের আশ্বর্য প্রদীপের আশ্চর্য ক্ষমতার প্রতীক স্বরূপ যদি কারও ক্ষমতা থাকে - তিনি যদি মনে করেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, যে স্বাধীনতার মূল চেতনা বর্তমানে বাস্তবায়নের জন্য একটি নতুন তাজা রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহ প্রয়োজন তবে আমি দেব। এ লেখা পড়ে যদি কারও মনে হয় প্রাণ দেয়া বর্তমানে বিশ্বাসযোগ্য নয় তাদের আমি জানাতে চাই, আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি কেউ আত্মহত্যা করতে পারে, তাহলে দেশের জন্য ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া মঙ্গলজনক জেনেও কেন আমি জীবন দিতে পারব না? কেন বিশ্বাসযোগ্য হবে না? 

মা-মাতৃভাষা-মাতৃভূমি-মানুষ

আত্মপ্রতিষ্ঠার অনন্য উপাদান
মা-মাতৃভাষা-মাতৃভূমি-মানুষ

সংলাপ ॥ একটা দেশ শান্তির বাগান হিসেবে গড়ে উঠতে পারে যখন মা-মাতৃভাষা-মাতৃভূমি-মানুষ সেই দেশে বেশি সম্মান ও গুরুত্ব পাবে। মায়ের জাতকে অবহেলা করে, দাবিয়ে রেখে বা ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করে কোনো জাতি বিশ্বে সম্মানজনক স্থান দখল করতে পারেনি। মা পারেন যেমন একটা সংসারকে সুখের আঁধার ও শান্তিধাম করে গড়ে তুলতে তেমনি সুযোগ পেলে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও আমূল সংস্কার সাধন করতে পারেন মায়ের জাত। তাই মা ও মায়ের জাতকে আমাদের দেশে সর্বস্তরে সবচেয়ে বেশি অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য দিয়ে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে যাতে এ দেশ গড়ে উঠতে পারে।
মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ সম্মান না দিয়ে বিশ্বের কোনো জাতি গড়ে উঠতে পারেনি। মাতৃভাষার সমান মর্যাদা অন্য কোনো ভাষা পেতে পারে না। মাতৃভাষাকে ধারণ, লালন ও পালনের মধ্যেই নিহিত আছে দেশ ও জাতির কল্যাণ। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাঙালি জাতি হিসেবে বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে পারেনি। আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর থাকলেও তা সাময়িক। ৪৪ বছর পরেও যখন ফাল্গুন আসে তখন সাজ সাজ রব পড়ে আমরা যে বাঙালি তা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, আজও পর্যন্ত কিছু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ছাড়া আধা-ঘন্টা নিজের ভাষায় বক্তৃতা দিতে পারেন না অন্য ভাষার সাহায্য ছাড়া। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে যে জাতিকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ হয়েছি বাংলা ভাষাকে সেই একইভাবে ধারণ-লালন-পালন করতে। এ দৈন্যতায় বাঙালি জাতি ভুগছে। আরো কতদিন ভুগতে হবে তার ইয়ত্তা নেই। রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মজীবী সবার মধ্যেই একটা উপনিবেশিক দাসত্ববোধ কাজ করছে যা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে তারা দাঁড় করাচ্ছেন নিজের ভাষার সঙ্গে অন্য জাতির ভাষাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে। আজ পর্যন্ত কোনো সরকার মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে বাঙালি জাতিকে গড়ে তোলার জন্য কোনো আধুনিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। এ ব্যর্থতায় আমরা আমাদের সংস্কৃতির, আমাদের ভাষার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধ হারিয়ে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মধ্যে ধীরে ধীরে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছি তাতে অদূর ভবিষ্যতে জগাখিঁচুড়ি একটা ভাষা নিয়ে জাতিকে চলতে হবে। বিশ্বায়নের জিকির আর তথাকথিত ধর্মীয় জিকির তুলে আমরা ইংরেজী, আরবী, হিন্দী, উর্দুর মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে নতুন প্রজন্মকেই দেশ ও জাতিকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
ভূমি ও তার নিচের মূল্যবান সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। দেশের দশভাগ মানুষ ভোগ বিলাসের মধ্যে জীবনযাপন করবে আর নব্বই ভাগ মানুষ এক বেলা বা আধাপেট খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে তাতে দেশ ও জাতির অগ্রগতি ও উন্নতি স্তিমিত হয়ে পড়বে। মাটির নিচের মহামূল্যবান সম্পদেরও যথার্থ ব্যবহার কাঠামো গড়ে উঠেনি। আমরা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাহাজানির কথা বলি কিন্তু কেন এই অবক্ষয়? প্রযুক্তির জন্যে বিদেশের কাছে ধর্ণা দিতে হচ্ছে অথচ দেশীয় প্রযুক্তি ও মেধা ব্যবহার করা হচ্ছে না মাটির নিচের সম্পদকে খুঁজে বের করে দেশের কাজে লাগানোর জন্য। এর পিছনে কাজ করছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়িক, রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্র চক্র তাদের ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের জন্য। যতক্ষণ পর্যন্ত না মাটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নদী ও খনিজ সম্পদ যথাযথ ব্যবহার হবে সঠিক কাঠামোগত বিন্যাস সাধন না করে, ততোদিন এ দেশের বেকার সমস্যা কমবে না; আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনও আসবে না এবং বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম জায়গা করে নিতে পারবে না। দেশের সম্পদ বিদেশী বেনিয়াদের কাছে বিক্রি করে নয় বরং উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের সম্পদ দেশের মেধা সমন্বয়ে দেশের কাজেই লাগাতে হবে। শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে শিল্পায়নের জন্য।
দেশের মহামূল্যবান সম্পদ ‘মানুষ’কে পরিকল্পনা মাফিক গড়ে তুলতে হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য আজ পর্যন্ত কোনো সরকার এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ দৃষ্টি দেয়নি। দেশের মানুষ ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতিকদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে, দেশের জন্যে নয়।  মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে আর গাধা তৈরি করা হচ্ছে দেশে যাতে তারা বোঝা টানা ছাড়া আর কিছু করতে না পারে। রাজনীতিকরা চান না দেশের মানুষকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে। বরং দলবাজি করার প্রবণতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছেন এবং অসৎ উপায়ে উপার্জনে মদদ যোগাচ্ছেন। ফলে অর্থ+বেকারত্ব+মাদক ব্যবসা সমন্বয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি তো ঘটছেই তার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষ হয়ে যাচ্ছে পঙ্গু। শ্রমলব্ধ উপার্জন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশের মানুষ। অপরদিকে দেশের মানুষকে আরো পঙ্গু করে দিচ্ছে এ দেশের ধর্মজীবীরা। আল্লাহ্র নামের উপর দিয়ে সবকিছু পার করার অপচেষ্টা এবং বেহেশ্ত-দোযখের ভয় দেখিয়ে বস্তাপচা বাদশাহী আমলে প্রণীত মিথ্যা হাদিস, ফেকাহশাস্ত্র এবং সর্বোপরি শরিয়ার দোহাই দিয়ে অলীক কল্পনার ফানুস উড়িয়ে দেশের অশিক্ষিত মানুষকে ধর্মান্ধ করার প্রচেষ্টায় রত।
তাই তারা তথাকথিত ইসলামের নামে জিহাদ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষকে ধর্মের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ধর্মশিক্ষার নামে বেসরকারী মাদ্রাসা সৃষ্টি করে নিম্নমানের তথাকথিত ইসলামের শিক্ষা দিয়ে এক শ্রেণীর ধর্মজীবী এমন এক সম্প্রদায় গড়ে তুলছে যারা দেশ ও জাতির জন্যে বোঝা স্বরূপ। তারা কায়িক পরিশ্রম করতে পারে না আবার মেধার চর্চাও করতে পারে না। ফলে তারা সব সময় এমন এক মানসিক অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে যা কখনও এতো নিম্নমানের অবস্থা তৈরি করে যে তখন তারা যে কোনো অসামাজিক কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। আবার অনেক সময় তথাকথিত ইসলাম ধর্ম জানার সঙ্গে আরবী ভাষা জানায় তাদের অহংবোধ এতই প্রকট হয়ে ওঠে যে তখন তাদের ফতোয়াবাজিতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। এই অবস্থা দেশের মধ্যে বিরাজমান রাখতে এক
শ্রেণীর স্ব-ঘোষিত বুদ্ধিজীবী, ধর্মজীবী  এবং রাজনীতিকরা কাজ করে যাচ্ছে  স্বাধীনতার পর থেকে যাতে তাদেরকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে পরজীবী এবং নির্ভরশীল করে রাখতে। তাই মাদ্রাসা শিক্ষা ও কওমী মাদ্রাসা গড়ে ওঠার পিছনে রাজনৈতিক তথাকথিত ইসলামকে যে কাজে লাগানো হচ্ছে পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদীদের মদদে তার প্রমাণ পাওয়া যায় একশত বছরের আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকাসমূহের খবরাদির মধ্যে।

এ ক্ষেত্রে মা-মাতৃভাষা-মাটি-মানুষকে সমভাবে সমান মর্যাদা দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সার্বিক কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনায় মায়ের জাতকে যথাযথ জায়গা ছেড়ে না দিলে-মাতৃভাষার যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা না করলে-মাটির সম্পদকে ব্যবহারের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে-মানুষ সম্পদকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে গড়ে তুলে দেশ ও বিশ্বায়নের যুগে মূল্যবান সম্পদ শক্তি হিসাবে ব্যবহার না করলে এ দেশের শান্তি শুধু কথার কথা হয়ে থাকবে। দেশের মানুষকে গালভরা বুলি শোনানো যাবে, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তাদের ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন হয়ে রাজনীতিক, আমলারা ও ব্যবসায়ীমহল সম্পদশালী হতে পারবেন কিন্তু সার্বিক দেশের কোনো কল্যাণ নিয়ে আসতে পারবেন না। ৪৪ বছর ধরে যে মিথ্যাচার চলছে তা চলতেই থাকবে - গরীব গরীব হবে, ধনী ধনী হবে আর মধ্যবিত্তশ্রেণী দু’দিক দিয়ে ব্যবহৃত হয়ে এবং দুই শ্রেণীকে ব্যবহার করে দ্বি-চারীর সংখ্যা বাড়াবে যা দেশের জন্য ভয়াবহ.....।

ভাষা আন্দোলন স্মৃতি রক্ষা পরিষদ এর আহবানে

৮ ফাল্গুন প্রতীকি পদযাত্রা হলো
ভাষা আন্দোলন স্মৃতি রক্ষা পরিষদ এর আহবানে

সংলাপ ॥  বাংলাদেশ, বাংলা সন ও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে ১১-দফা প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে এবারের ৮ই ফাল্গুন, ২০শে ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি গেটের সামনে থেকে প্রতীকি পদযাত্রার আয়োজন করে ভাষা আন্দোলন স্মৃতি রক্ষা পরিষদ। ১১-দফা দাবির মধ্যে রয়েছে * জাতিসংঘের দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা ও বাংলা তারিখ অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আরও জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আহবান। * সর্বস্তরে বাংলা সন চালু করা এবং তারিখ ব্যবহারে বাংলা সন ও তারিখ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হোক। ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন ঠিক রাখার আহ্বান। * মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের বীরশ্রেষ্ঠ জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান এবং ভাষা সৈনিকদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং একই সাথে ভাষা শহীদদের বীরত্বগাঁথা পাঠ্যসূচিভুক্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান।
* বিদেশীদের বাংলা শেখার কারিকুলাম প্রস্তুত করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।  * প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা-এর জন্য অভিন্ন বাংলা সফটওয়্যার গ্রহণ করার উদ্যোগ নেয়া হোক। * ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি-বিজড়িত রশিদ বিল্ডিং, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার গেট, শহীদমিনার হয়ে আজিমপুর কবরস্থান পর্যন্ত সড়কটিকে ‘শহীদ স্মরণী/ভাষা আন্দোলন স্মৃতি সড়ক’ নামকরণ করা ও নাম ফলক লাগানো হোক। * ভাষা শহীদ ও ভাষা সৈনিকদের নামে চত্বর, তোরণ, বিভিন্ন স্থাপনা, স্থান, সড়ক নির্মাণ ও নামকরণের উদ্যোগ নেয়া হোক। নাম না জানা ভাষা শহীদদের কবর বিশেষ করে ভাষা শহীদ রফিক, ভাষা শহীদ সালাম, ভাষা শহীদ অহিউল্লাহ, ভাষা শহীদ আব্দুল আউয়াল এর কবর সনাক্ত করা হোক। * ভাষা আন্দোলন স্মৃতিজড়িত স্থানসমূহ চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ভাষা আন্দোলন স্মৃতি দিবসগুলো যথাযথভাবে পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। * শহীদ মিনারকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করার জন্য আহবান জানানো যাচ্ছে। শহীদ মিনারের পরিধি বিস্তৃতি পবিত্রতা রক্ষা ও নিরাপত্তা বিধান করা হোক। * সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য জাতীয় সংসদে পাশকৃত আইনটি যথাযথভাবে কার্যকর করা এবং আদালতের যাবতীয় কার্যকর বাংলা ভাষায় চালু করা হোক। * ১৯৬১ সালে ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের যথাযথ সম্মান জানানোর আহ্বান।

ভাষা আন্দোলনের ঠিক ৬৪ বছর পরে হলেও তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলা-সংলগ্ন কলা ভবনের গেইটে সমবেত জনতা ক্ষণিকের জন্য হলেও হারিয়ে গিয়েছিলেন ফাল্গুনের সেই দিনটিতে যেদিন ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে রক্ত দিয়ে সম্বিত ফিরে পেয়েছিল যে, তারা বাঙালি, বাংলা তাদের মায়ের ভাষা। প্রতীকি পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন ভাষা সৈনিক ও রাজধানীর সচেতন নাগরিকবৃন্দ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লী, শিলিগুড়ি ও আসামের বাঙালি সম্প্রদায়ের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। পদযাত্রার শুরু এবং সমাপনীতে পৃথক দুটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ভাষা সৈনিক অধ্যাপক ফুলে হোসেন, ভাষা সৈনিক ডাক্তার মির্জা মাজহারুল ইসলাম, ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু, ভাষা আন্দোলন যাদুঘরের পরিচালক এম আর মাহবুব, আসাম থেকে আগত অধ্যাপিকা মন্দিরা নন্দী, দিল্লীর ‘যমুনা নন্দীনি’ সাহিত্য ও পাঠচক্রের সাধারণ সম্পাদক শৈলেন সাহা, গঙ্গা নন্দিনী মহানগর কলকাতার সভাপতি বরুণ চক্রবর্তী। উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি যে স্থানটি থেকে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা কুখ্যাত নূরুল আমিন সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাঙালি জাতি তথা বিশ্বের ইতিহাসে অমর কাব্য রচনা করেছিল সে স্থানটিই হচ্ছে আজকের দিনের ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি (ইমারজেন্সি) গেইট। প্রতীকি পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা ‘বাংলা ভাষার আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’, ‘শহীদ দিবস, শহীদ দিবস, অমর হোক অমর হোক’ শ্লোগানে মুখরিত করে তুলে ঢাকা মেডিক্যালের সামনের গেইট। পদযাত্রাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে শেষ হয়। 

বর্তমান শিক্ষা কাঠামো - সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে কি?

বর্তমান শিক্ষা কাঠামো - সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করছে কি?

শেখ উল্লাস ॥ সাধকরা নিঃসন্দেহে কবি এবং এই সাধকদের বাণী শত শত বছর ধরে মানুষকে আলোর পথে চলার নির্দেশনা দেয়। প্রায় চার শ’ বছর আগের এমনই এক কবি-সাধক আব্দুল হাকিম বলেছিলেন, ‘আরবী ফারসি শাস্ত্রে নাই কোনো রাগ/ দেশি ভাষা বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ/ আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত/ যদি বা লিখয়ে আল্লা নবির ছিফত/..যে জন বঙ্গে ত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/ দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/ নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।’ 
সময় ও পারিপার্শি¦কতা পাল্টে যাওয়ার কারণে মানুষ এখন বিদেশ যাচ্ছে অনেক কারণে-বেশির ভাগই জৈবিক চাহিদা পূরণে-ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণে, খেয়ে-পরে নিরাপদে একটু ভালো থাকবে, দেশে থেকে কোনো ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হবে না-এই আশায়।
বিদেশে উন্নত জীবনের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে দুঃখিনী বাংলা মায়ের সেবায় আত্মনিয়োগ করার ব্রতে জীবন উৎসর্গ করবে-এমন মানুষের সংখ্যা এখন নিতান্তই কম। দেশ ও মানবতার এই মহান ব্রতে উৎসর্গকৃত হতে পারেনও শুধুমাত্র সাধকরাই। সাধকরা ছাড়া মানবতার জয়গান গাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ, জীবন চলার পথে তাদের ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই, নাম - যশ -আর্থিক প্রতিপত্তি-অর্জনের জন্য তাদের কোনো মোহ নেই। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, নাম-যশ-আর্থিক প্রতিপত্তি অর্জন - নারী - পুরুষের বিষয়গুলোর প্রতি যাদের কোনো মোহ আছে, তাদের মুখে মানবতার কথা শোভা পায় না। অথচ তারাই শিক্ষার নামে, ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে  মুখে বড় বড় কথা বলে, ত্যাগের চাইতে ভোগের প্রতিই তাদের আকর্ষণ বেশি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যসব জীব-জন্তুর মতই তাদের চাওয়া-পাওয়া, স্বার্থের একটু ব্যাঘাত ঘটলেই কেবল তাদের আসল চেহারা দেখা যায়। হীনমণ্যতা, অপরের সঙ্গে তুলনা ও সংশয়-সন্দেহ নামের যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে তারা অন্য প্রাণীদের মতোই বিচরণ করে এই পৃথিবীতে এবং এক সময় অন্য প্রাণীর মতোই তারা যখন পৃথিবী থেকে চলে যায়, কোনো রকমের আবেদন তারা পৃথিবীতে সৃষ্টি করে যেতে পারে না এবং মানুষও তাদের কথা স্মরণ রাখে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই তারাই আবার পার্থিব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাদের কাছে সাধারণ মানুষকে ধর্ণা দিতে হয়। সমাজ-সংসারে যাবতীয় অনাচার সৃষ্টির কারণ তারাই।
বাঙালির ভাষা আন্দোলন, শহীদ দিবসের ৬৪, বিজয় দিবসের ৪৫ বছর  বছর পার হচ্ছে, বাঙালির মুক্তির-মন্দির সোপানতলে কত লাখো প্রাণের বলিদান হয়েছে, কিন্তু মাতৃভাষার মর্যাদা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি ওই সব হীনমণ্য তথা সংকীর্ণ লোকদের জন্য।  ধর্মের নামে আরবী, শিক্ষার নামে ইংরেজি, বিনোদনের নামে হিন্দীর দাপটে বাংলা ভাষাকেও আজও চরম লাঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে - সরকারি প্রাথমিক, কিন্ডার গার্টেন বা ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষা-এই  প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করলে দেখা যায় সরকারি প্রাথমিক স্কুলে আসে দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা। এইসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে শিক্ষাদানের চাইতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে অন্য সব কাজে, যেমন-বিভিন্ন জরিপ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বিভিন্ন নির্বাচন, সপ্তাহে অন্যাবশ্যক থানা শিক্ষা অফিসারের কক্ষে হাজিরা দেয়া, অফিসারদের বা নেতাদের অভ্যর্থনার নামে শিক্ষক -শিক্ষার্থীদের ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা ইত্যাদি। মোটামুটিভাবে স্বচ্ছল ও অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা যায় কিন্ডার গার্টেনে ও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে।  ইংরেজি শিখলে ভালো চাকুরি পাওয়া যাবে, বিদেশে যাওয়া যাবে-এই আশায়। ‘যে জন বঙ্গে ত জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’- এই জাতীয় মানুষদের সংখ্যাই যেখানে বেশি সেখানে সুশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না। একদিকে ইংরেজির প্রতি মোহ ও ভুল ইংরেজি শিক্ষা, অপরদিকে বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা ও অনাগ্রহের কারণে একটি বিরাট প্রজন্ম শেকড়চ্যুত হয়ে পড়ছে। আর সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বেশি সুবিধাভোগী মানুষদের সন্তানেরা শুদ্ধ ইংরেজি শিখছে শুধুমাত্র বিদেশে পাড়ি জমানোর লক্ষ্যে। এদেশে চাকুরি করে, পেনশনসহ রাষ্ট্রীয় যা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তা বিনিয়োগ করা হচ্ছে বিদেশে।  নিজের দেশ ও গ্রাম-মফস্বলের প্রতি দায়বদ্ধতা যেন নেই কারো।
অথচ এদের অধিকাংশেরই শেকড় এই গ্রাম-মফস্বলে। দেশের সর্বোচ্চ ও সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত দশকে অনেক নতুন বিভাগ চালু হওয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়েছে। কিন্তু ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন না হওয়া এবং ইংরেজির প্রতি মোহাচ্ছন্নতা দেশ ও সমাজের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের একটি বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে একটি দাওয়াতপত্র দিতে গিয়ে দেখা যায়, বাংলায় এর নাম-ঠিকানা পরিচয় কিছুই লেখা নেই।  বাংলা ভাষা ওই বিভাগ থেকে উধাও। অনেক খোঁজাখুজি করেও যখন বাংলায় বিভাগটির নাম পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন দু’ছাত্রের কাছে এর কারণ চাইলে তারা বলে, এখানে বিশ্বের সকল ধর্ম সম্পর্কে পড়ানো হয় বলে বাংলা না লিখে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। যেন বাংলা ভাষাভাষী কোনো ধর্ম তাদের আর পড়ার দরকার নেই। সব পড়া হয়ে গেছে। পরে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কে রোজারিওকে বিষয়টি জানালে বলেন, এটা ভুল হয়েছে। লালন সাঁইজী সেই কবে কেন যে বলেছিলেন, ‘ভেদ, বিধি, পথ, শাস্ত্র কানা, আর এক কানা মন আমার, এসব দেখি কানার হাঁটবাজার!’       
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা মাদ্রাসাগুলোকে কেন্দ্র করে। অর্থনৈতিকভাবে এবং ধর্মচিন্তায় সবচেয়ে দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা আসে মাদ্রাসায়। গ্রামের দরিদ্র ও কোমলমতি শিশুদেরকে তাদের মা-বাবারা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে নানা প্রলোভনে। সেখানে শুধুমাত্র আরবী  শেখানো হচ্ছে, বাংলা ও ইংরেজি শেখানোর কোনো উদ্যোগ ও পরিবেশ নেই। এমনকি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের কাছেই মাদ্রাসা বানিয়ে মাদ্রাসাগুলোতে ছাত্র সংখ্যা বাড়ানোর ঘটনা ঘটছে। ধর্মজীবীদের ব্যবসা খুব চাঙ্গা হচ্ছে। কিন্তু এই কোমলমতি ছেলেময়েরা বড় হয়ে কী করবে, পৃথিবীতে কোন্ কাজটিকে তারা  জীবিকার উপায় হিসেবে বেছে নেবে, মানবতা তথা আল্লাহর জন্য কাজ করা তো আরও দূরের ব্যাপার! এই সব প্রশ্নের কোনো উত্তর এই ধর্মজীবীদেরকে জিজ্ঞাসা করেও পাওয়া যাচ্ছে না। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও পরবর্তীতে ব্রিটিশরাজ এদেশের সরল-সহজ মুসলমানদেরকে কর্মবিমুখ করার দূরভিসন্ধি নিয়ে খ্রীষ্টান পাদ্রীদের দিয়ে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলেন তার বড় প্রমাণ কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ-এর কক্ষে আজও সেই পাদ্রীদের নাম শোভা পাচ্ছে-অনুসন্ধিৎসুদের জন্য যা এক নিদর্শনস্বরূপ! অবশ্য কওমী মাদ্রাসাওয়ালারা বলে থাকেন, আলিয়া মাদ্রাসাগুলো খ্রিষ্টান প্রভাবিত এবং কওমী মাদ্রাসাই আসল মাদ্রাসা। কিন্তু এই উপমহাদেশে মাদ্রাসা শব্দটি চালুই করেছে ইংরেজরা-প্রথমে আলিয়া এবং পরবর্তীতে কওমী মাদ্রাসাগুলোর পেছনেও ছিল ইংরেজ সরকার। আরব দেশের নজদের ওহাবী মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠাই এসবের মূল লক্ষ্য যে নজদের আব্দুল ওহাব ছিলেন নবী মুহাম্মদ (দঃ)-এর প্রকাশ্য শত্রু। আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র (আমেরিকা), যুক্তরাজ্য, ইসরাইল রাষ্ট্র এবং তাদের বশংবদ সৌদি রাজতন্ত্র-এসব কিছুই ওহাবী ইসলাম তথা এজিদী ইসলামের ধারক-বাহক-এ সত্যটুকু সাধারণ মুসলমানরা উপলব্ধি কবে করবেন-সেটাই আজ বড় প্রশ্ন।
শিক্ষাক্ষেত্রে এইসব জগাখিচুড়ি সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করছে, সৃষ্টি করছে বৈষম্য। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অকার্যকর করে তুলেছে সরকারেরই এক শ্রেণীর নেতা ও আমলারা। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা কাঠামোকে সত্য ও সঠিক পথে নিয়ে এসে দেশে বৈষম্যহীন ও আত্মমর্যাদাশীল সমাজ গঠনের অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে কি?

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মুক্তিপাগল চেতনায়....


মুক্তিপাগল চেতনায়....

সংলাপ ॥ সারা বিশ্বে বাঙালি জাতি অত্যুজ্জ্বল তার গৌরবময় স্বাতন্ত্রে। প্রত্যেক জাতিরই আছে নির্দিষ্ট ভাষা যার পুষ্পিত শাখায় প্রস্ফুটিত হয় সে জাতির স্বকীয় চিন্তা, চেতনা, ধ্যান-ধারণা অর্থাৎ তার স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। ভাষাতেই প্রবাহিত হয় তার সত্তার সলিল ধারা। ভাষা জাতির প্রাণের সম্পদ, অচ্ছেদ্য হৃদ-স্পন্দন। কখনো কেউ সে হৃদ-স্পন্দনে যমের কালো থাবা বসাতে চাইলে কিংবা প্রাণের সম্পদ জবর দখল করে ফলাতে চায় স্ব-ইচ্ছার ফসল তখনই জাতি সোচ্চার হয়ে ওঠে প্রতিবাদে, অস্তিত্বের ভিত্তি রাখতে সুদৃঢ় হয়ে ওঠে উৎসর্গিত প্রাণ। প্রমাণ করেছে একমাত্র বাঙালি জাতি সমস্ত বিশ্বের মধ্যে। নিঃসঙ্কোচে দূরন্ত সাহসে বুকের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে সুরক্ষিত করেছে বাঙালি জাতি অমূল্য মানিক - বাংলা ভাষা।
শুধু ইতিহাসের ধূলিধূসর কালো অক্ষরে নয়, সমস্ত বাঙালির সতেজ বুকে ২১ তাই এক অমর অমলিন রক্তাক্ত পোষ্টার। ২১ আসে। ২১ যায় না। প্রতিনিয়ত ২১ আমাদের বন্ধ দরজার কড়া নেড়ে আমাদের জাগায়। ২১ তার আলিঙ্গনে আমাদেরও রাঙিয়ে তোলে নিত্য নতুন চেতনায়।
প্রতিবারের মতো এবারও ২১ আসছে সততঃ নিয়মে। কিন্তু এ যাত্রা বাঙালি জাতির চরম পরীক্ষার। মুখোশধারী বাঙালিদেরকে চিনিয়ে দিয়ে যাবে নীরব অভিমানে। রেখে যাবে এক বিরাট প্রশ্ন। প্রশ্ন হলো - তথাকথিত ধর্মীয় চেতনা, না-কি জাতীয় চেতনা, কোনটা বড়? এ দুয়ের কোন সরোবরে ম্লান করে সত্তাকে পূত সজীব রাখতে হবে? ২১ এলেই মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের যে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিক কর্মতৎপরতা তা কি একেবারেই মূল্যহীন? ‘সারিবদ্ধ বাঙালি উন্মুক্ত পায়ে ধীর লয়ে হেঁটে চলে। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে হাতে ফুল। মুখে অমর ২১-এর গান। বিভিন্ন নিবেদিত সংগঠনের বিচিত্র আলপনা পথে পথে। অসংখ্য বাঙালির সমাবেশ শহীদ মিনার চত্বরে। বক্তৃতা, সেমিনার, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখরিত চতুর্দিক।’ এমনই হয়ে থাকে, হয় প্রতি ২১-এ। আন্দোলন মুখর বাঙালি ২১-এর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েই একদিন জয় করলো কাঙ্খিত মুক্তির সোনালী সূর্য। পরাধীনতার সেই নিগুঢ়ে বাঙালি যে কুঠারাঘাত হেনেছিলো তা  ২১-এরই শাশ্বত বিদ্রোহী মুক্তিপাগল চেতনারই চরম প্রকাশ।
জাতীয় চেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনার কোনো তফাৎ নেই কিন্তু তফাৎ আছে ধর্মীয় চেতনার নামে তথাকথিত মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে। জাতীয় চেতনাকে ছাপিয়ে তথাকথিত ধর্মীয় অনুশাসন কখনোই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। করলে নিঃসন্দেহে সে জাতি সম্মুখীন হয় বিরাট বিপর্যয়ের। আজ সমগ্র বিশ্বের মানচিত্রে একবার চোখ ফিরালেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। যে জাতির মধ্যে তার জাতীয়তাবাদ প্রবলভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, সে জাতি কখনোই বিভক্ত থাকতে পারে না।
স্বকীয় জাতীয় সত্তাকে অক্ষুন্ন রাখার তাগিদেই অবধারিতভাবে বাঙালি ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। এরপরে আর জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মীয় চেতনার মাঝে বিতর্কের অবকাশ থাকে না। তথাকথিত ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে অর্থাৎ তার সামগ্রিক সত্তাকে পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও তার স্বজাতীয়তাবোধ তাকে উজ্জীবিত করবেই। পৃথিবীতে কোথাও ধর্মীয় জাততত্ত্বের বন্ধনে কোনো জাতিই সৃষ্টি হয়নি হবেও না। সবকিছুর উর্দ্ধে অর্থাৎ সর্বপ্রথম জাতীয়তা তারপর অন্য কিছু এই সহজ বোধ কি সর্বসাধারণের মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত? কেন এই কঠিন পরীক্ষায়  আমরা উতরাতে পারছি না? কাদের দায়িত্ব এই বোধ সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলা? নিঃসন্দেহে বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলের, কিন' এই বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা যে একই দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাকে আজো আবদ্ধ। অন্যকে পরিত্রাণের পথ তারা কি করে দেখাবে?
নিজেদের উৎসর্গিত করে যারা রেখে গেলেন অমূল্য মানিক বাংলাভাষা, তারা কি চিরস্মরণীয়, চিরপূজনীয় নয়?  মহান ভাষা শহীদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও চরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশে যে দ্বিধাগ্রস্থ বা উদাসীন সে কি সত্যিকার ভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ? না অন্য কিছু? অকৃতজ্ঞের মতো কি ভুলে যাওয়া যায় আজন্মের ঋণ? তাই ’২১-এর চেতনা দীপ্ত মহান দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালিকে হয়ে উঠতে হবে যথাযথ বাঙালি সর্বাগ্রে। নতুবা পরিপূর্ণ মূল্যবোধ বিকাশ কোনোদিনই সম্ভব নয়। যে কোনো সময় হানা দিতে পারে ধর্ম-পণ্যসর্বস্ব সওদাগরের সর্বগ্রাসী দল। সময় থাকতে তাই সতর্ক হতে হবে এবং সক্রিয়ভাবে তৎপর হওয়ার সময় এসেছে জাতীয় মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত এক মহান জাতি গঠনে।

বিবেকের কাছে প্রশ্ন -


সময়ের সাফ কথা....
বিবেকের কাছে প্রশ্ন -

শাহ্‌ ফুয়াদ ॥ * নিজের মাতৃভাষা বাংলা, এর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আমরা এখন কতটুকু ভালোবাসি? ধর্মের নামে আরবি, শিক্ষার নামে ইংরেজি আর বিনোদনের নামে হিন্দি-তেই কি আমরা গা ভাসিয়ে দিবো? এ দুরাবস্থা থেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির উত্তরণের উপায় কি?
* নিজের মাতৃভাষা, এর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভালো না বাসলে, এর সাথে মিশে যেতে না পারলে কখনো ধার্মিক হওয়া সম্ভব কি?    
* বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করে নিজের উন্নতি কতটুকু সম্ভব? সমাজ ও দেশের উন্নতিই বা কতটুকু সম্ভব? বিশ্বমানব হওয়ার পূর্বশর্ত-কায়মনোবাক্যে বাঙালি হওয়ার শপথ নেয়ার দিন আজ নয় কি?
* মহান ভাষা আন্দোলন ও শহীদ দিবসের অঙ্গীকার ছিল, এদেশে বাংলা ভাষা পরবাসী হবে না। অথচ আমরা জোর গলায় আজ বলতে পারছি কি বাংলা ভাষা আমাদের অহংকার? বৈদ্যুতিন মাধ্যমে হিন্দি অনুষ্ঠানের দাপটে শহরে, বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জের সর্বস্তরে দেশীয় ভাষার অনুষ্ঠানগুলো আজ অপাংক্তেয় হয়ে উঠছে কেন?
* বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে বাংলা ভাষা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সম্মানজনক ব্যবহার আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? তথাকথিত শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত মানুষদের আচার-আচরণে নিজ মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি আজ কতটুকু প্রতিষ্ঠিত?
* মাতৃভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনদানকারী একটি জাতির মাতৃভাষার প্রতি কোনো প্রকার নেতিবাচক মনোভাব দুর্ভাগ্যজনক নয় কি?
* ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিভিন্ন রকমের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না কেন?
* রাজধানী ও দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো যেভাবে ইংরেজি ভাষার বিজ্ঞাপন বোর্ড ও বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে তাতে মনে হয়, দেশের মানুষ বাংলা বোঝে না, অথবা বাংলা ভাষাভাষী লোকই এদেশে নেই। জাতীয় জীবনের এই সংকীর্ণতা দূর করতে সবাইকে এগিয়ে আসা আজ জরুরি নয় কি?
* বিশ্বায়নের যুগে বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা শেখার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু তাই বলে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ভাষার যে জগাখিচুড়ি অবস্থা এখন চলছে তা কি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য? এই অবস্থায় আত্মমর্যাদাশীল একটি প্রজন্ম গড়ে তোলা কখনও সম্ভব কি? কে দেবে এর উত্তর?   
* যারা আজ বাংলা ভাষাকে বিভিন্নভাবে অসম্মান ও উপেক্ষা করে বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে তারা কি ৭১’এর সে রাজাকার বা তাদেরই উত্তরসূরী?
* মহান ভাষা আন্দোলন ও অমর শহীদদের আদর্শ অর্থাৎ মাতৃভাষার মর্যাদা সবার ওপরে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব কি?

ধর্মান্ধ রাজনৈতিক ইসলাম পথ খুঁজছে!


ধর্মান্ধ রাজনৈতিক ইসলাম পথ খুঁজছে!

সংলাপ ॥ রাজনৈতিক অরাজকতার পরও গণতন্ত্রের চারাগাছটি এ দেশের মাটিতে ধীরে ধীরে শিকড় মেলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গণতান্ত্রিক পরিবেশ যতই বিকশিত হচ্ছে এ দেশে ধর্মান্ধ রাজনীতি বিকাশের সম্ভাবনা ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে। আজ পর্যন্ত গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার রাজনীতি এ দেশে যতটা প্রসার লাভ করেছে, সেটা সম্ভব হয়েছে শুধু এ দেশের গণতন্ত্রকে সঠিক গতিতে বিকশিত করে তোলার ব্যাপারে গণতন্ত্র চর্চায় সংকীর্ণ রাজনীতিকদের ব্যর্থতার জন্যই। তাই এটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত একটা আদর্শিক দল সরকার গঠন করবে। সে ক্ষেত্রে ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামিতে আক্রান্ত বা সম্পৃক্ত দলগুলোর রাজনীতি শুধু গলাবাজি ও তর্জন-গর্জনেই পর্যবসিত হবে।
বিগত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এ কথাটি বেশ স্পষ্ট হয়েই ফুটে ওঠে। ১৯৯১-এর জাতীয় নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে সে ব্যাপারটি সাধারণ জনগণের কাছে ততটা স্পষ্ট ছিল না। যেসব অঞ্চলে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মনগড়া ধর্মের নাম করে জনপ্রিয় অবস্থানে ছিল সেখানকার ধর্মভীরু মানুষেরা ভেবেছিল যে, সারা দেশেই বুঝি তারা একই রকমভাবে জনপ্রিয়। তাই তাদের কাছে মনে হয়েছিল যে, ধর্মান্ধরাই হয়তো সরকার গঠন করবে। জনগণের এই বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে তাই ’৯১-এর জাতীয় নির্বাচনে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কয়টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
কিন্তু ’৯৬-এর গণভোটের ফলাফল প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে বাংলার বুকে সরকার গঠন করার কোন সম্ভাবনা নেই। ২০০১-এর নির্বাচনে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক ইসলামপন্থী দলগুলো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সাথে গাটছড়া বেঁধে বিএনপিকে সমর্থন জানায়।
ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো বুঝে ফেলেছে যে, যতদিন বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসাবে টিকে থাকবে, ততদিন প্রতিক্রিয়াশীল ভোটাররা বিএনপিকেই সমর্থন দিবে, ধর্মান্ধদের কেউ সমর্থন করবে না। তাই ক্ষমতায় যেতে হলে প্রথমেই তাদেরকে যে কাজটি করতে হয়েছে তা হলো ধর্মের নামে জাপা ও বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। যাতে ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল ভোটারদের সামনে সমর্থন দেয়ার জন্য একমাত্র ধর্মান্ধ দলগুলো ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দল অবশিষ্ট না থাকে।
ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো এ কাজটি খুব সুষ্ঠুভাবে করে আসছিল। তারা বন্ধু সেজে, চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে, বিএনপির ভিতরে চর-অনুচর ঢুকিয়ে দিয়ে, তার প্রশংসা করে এবং দুর্বলতাগুলোর সুযোগ নিয়ে, তাকে খুব চালাকির সাথে প্ররোচিত করে, নানান রকম কুটিল শলা-পরামর্শ দিয়ে, বিএনপিকে এমন একটা রাজনৈতিক চোরাবালির মধ্যে ফেলে দিয়েছে যার মধ্য থেকে উঠে আসা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে।
হঠাৎ করে বিএনপির অভ্যন্তরস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ঘুম ভাঙ্গার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, বিএনপিকে এই মুহূর্তে আর পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যে পথ ধরে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে চলছিল, এখন থেকে সে পথ ধরে এগিয়ে চলা তাদের পক্ষে আর লাভজনক হচ্ছে না। কারণ জনগণের কাছে তাদের ধর্মীয় মুখোশ খুলে পড়েছে এমনকি বিএনপির কাছেও। এখন থেকে তাই তারা চেষ্টা করছে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা, যার ফলে এ দেশের বর্তমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এ দেশে ভবিষ্যতে নির্বাচন অনুষ্ঠান যাতে অসম্ভব হয়ে  পড়ে। এই রকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে তারা গোপনে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ ধরে এ দেশের মানুষকে শঙ্কিত করে শাসনযন্ত্র দখল করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই ধরনের সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য এ দেশের ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলো বহুদিন ধরে তাদের কর্মীবাহিনীর একাংশকে দেশে এবং বিদেশে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছে। দেশে একটা অরাজকতাপূর্ণ আবহাওয়া সৃষ্টি করতে পারলেই তারা তাদের সামরিক কায়দায় ও সামরিক বাহিনী পুলিশ ও বিডিআর বাহিনী এবং আমলাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা চরদের সহযোগিতায় গণতন্ত্র ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে ধর্মের নামে মিথ্যাচারের সৌদি শাসন যাতে মুহাম্মদী (সাঃ) ইসলাম এবং গণতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দেশের মানুষ শান্তি (ইসলাম) নিয়ে না থাকতে পারে।
সরকারকে আরো কঠোর হবার সময় এসেছে। সাপকে দয়া দেখালে অথবা অসাবধান থাকলে ছোবল মারবেই। স্মরণ রাখতে হবে সাপের বাচ্চা সাপই হয়।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যেভাবে হলো


কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যেভাবে হলো

সংলাপ ॥ ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কার্য শুরু করা হয় ১৯৫৬-৫৭ সালে। নকশা ও সামগ্রিক পরিকল্পনাকারী হামিদুর রহমান। নির্মাণ কার্য তদারকিতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নাগরিক গণপূর্ত বিভাগ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জটিল বৃত্তান্তটি ছড়িয়ে আছে সুদীর্ঘ, বিপদসঙ্কুল ছয়টি দশকে ব্যাপ্ত হয়ে।
স্থপতি হামিদুর রহমান বলেন, চিত্রশিল্পে ইংল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে আমার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই সে কাহিনীর সূচনা হয়। আমার জন্য ১৯৫৬ সালের হেমন্তকালের প্রারম্ভটি অত্যন্ত উত্তেজক হয়ে ওঠে। প্রয়াত শিল্পী জয়নুল আবেদিন আমাকে গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী জনাব এম এ জব্বারের সঙ্গে অবিলম্বে সাক্ষাত করার জন্য অনুরোধ করেন। সেটি ছিল ঢাকায় শীত সমাগমের এক ধোঁয়াটে কিন্তু উজ্জ্বল প্রাতঃকাল। আমি জনাব জব্বারের অফিস কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হলে ১৯৫২ সালে বাংলা-ভাষা আন্দোলনে যেসব শহীদ মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাদের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে যে জল্পনা-কল্পনা করা হচ্ছিল, আমাকে তা জানানো হলো।
১৯৫৭ সালে প্রধান প্রকৌশলীর অনুরোধ অনুসারে আমি একটি মডেল ও ৫২টি নকশার কাগজপত্র প্রস্থত করি, যার সাহায্যে ওই নির্মাণ কাজটি বুঝবার সুবিধা হতে পারে। অন্যান্য শিল্পী ও স্থপতিকেও তাদের ওই সম্পর্কে চিন্তাভাবনার সমর্থনে কাগজপত্র জমা দিতে অনুরোধ জানানো হয় এবং সে অনুসারে কাজও হয়। বিখ্যাত গ্রিস দেশীয় স্থপতি ডক্সিয়াডেস নির্বাচন কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। জনাব জব্বার, শিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং আরও কয়েকজন সরকারি আমলা ওই কমিটির সদস্য ছিলেন। আমার প্রস্থতকৃত নির্মাণ কল্পনাটিই ‘সবুজ সঙ্কেত’ লাভ করে এবং সেই মুহূর্ত থেকে মিনার সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে সব কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। সে সময়ের নগরাঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব মঈনুল ইসলামের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তার অফিসে আমার ‘মডেল’ ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে যাওয়া হয় এবং নির্মাণ কাজটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার জন্য প্রায় সার্বক্ষণিক কাজকর্ম চলতে থাকে। কয়েকদিন পর গণপূর্ত বিভাগ আমাকে একজন সহায়ক কর্মী প্রদান করে, যিনি ছিলেন তাদের প্রধান ভ্রাম্যমাণ স্থপতি জাঁ ডুলুর্যান্ড নামের এক ড্যানিশ ভদ্রলোক। আমার পরিকল্পনাটি এবং মডেলগুলো নিয়ে আমি গণপূর্ত বিভাগের ইমারতের চতুর্থ তলায় চলে যাই। ডুলুর্যান্ড আমার জন্য বড় এক প্রস্থ নীল নকশা এবং কয়েকটি কার্যকরী মডেল প্রস্তুত করে দেন।
১৯৫৭ সালের শেষভাগে আমার এ সম্পর্কিত কার্যকলাপ বেশ দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের চত্বরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৫৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনারের নির্মাণ কর্মটি শেষ করে ফেলার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। আর্থিক প্রসঙ্গ এবং অন্যান্য দফতর সম্পর্কিত কাগজপত্র আমার নির্মাণ কল্পনার সম্মানী (রয়্যালটি) বাবদ আমি মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা দাবি করেছিলাম। মিস নভেরা আহমেদের তিনটি ভাস্কর্য কর্ম সম্পাদন করার জন্য দশ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার সমগ্র কর্মীদলটির জন্য পাঁচ হাজার টাকা মাত্র প্রদান করা হয়েছিল। শহীদ মিনারের নিম্ন তলের দেয়ালে আমি ১০০০ বর্গফুটের ম্যুরাল এঁকে দিয়েছিলাম। আর নভেরা তিনটি ভাস্কর্য কাজ নির্মাণ করেছিলেন। যেগুলো মিনারের স্টুডিও (কর্মশালা) কক্ষের অন্ধকারে চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত ২১শে ফেব্রুয়ারি মিনারের অসম্পূর্ণ স্তম্ভগুলোর ছায়াতলেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সেই তারিখের পরেও আমরা কর্মরত রইলাম। কিন্তু পরিকল্পিত নির্মাণ কার্যটি সম্পূর্ণ করে আমার জন্য আমাদের সেখানে থাকতে দেয়া হলো না। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের প্রথম দিনেই আমাকে সে স্থান থেকে বের করে দেয়া হলো। এমনকি আমরা আমাদের শিল্পকর্মের সরঞ্জামাদি ও ব্যক্তিগত সামগ্রীও নিয়ে আসার সুযোগ পাইনি। স্টুডিওর দরজায় একটা বিশালায়তন তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল, আর তার পাশেই দাঁড়িয়েছিল এক সতর্ক ‘জওয়ান’। আমার ধারণা, এই প্রকল্প সম্পর্কিত কিছু কিছু দলিলপত্র এখনও নগর গণপূর্ত শাখার দফতরে ‘ইডেন’ ইমারতের স্থাপত্য বিভাগে পাওয়া যেতে পারে।
১৯৫৮ সালের শেষভাগ, ‘লিডার এক্সচেঞ্জ’ কর্মসূচির অধীনে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থিত ফাইন আর্টস একাডেমিতে আমি বিদেশি শিক্ষার্থী রূপে কাজ শুরু করি। কিন্তু আমার অন্তরে ফেলে আসা অসম্পূর্ণ মিনারটির চিন্তা এত বেশি ছিল যে, অল্প কিছু দিনের মধ্যে আমাকে স্বদেশে ফিরে আসতে হলো। তথাপি আমার অনুকূলে এক বিন্দু পরিবর্তনের আভাসও পাওয়া গেল না। সামরিক আইন তখন তার মহিমার শিখরে অবস্থান করছিল এবং কারও সাহস ছিল না যে, ‘পরিত্যক্ত’ মিনারটির বিষয়ে কোন কথা বলে। বহু বছর পার করে অবশেষে ১৯৬৩-৬৪ সালে এই নিস্তব্ধতা ভাঙে। মিনারের কাজ আবার আরম্ভ করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকার সে বছর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে ছিলেন ড. মাহমুদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলার ও আর্ট কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল শিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মতো কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি। আমার ধারণা ছিল যে, তারা আমাকে অচিরেই ডাকবেন, কিন্তু তা ঘটবার আগেই ওই কমিটি যেন রাতারাতি হাওয়ায় উবে গেল। পরবর্তীকালে ওই কমিটির একজন সদস্য আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ওই কমিটি আমাকে অনুরোধ জানাতে উদ্যোগ নিয়েছিল যেন প্রত্যেকটি স্তম্ভের জন্য আমি আরব্য ‘টোগরা’ (শিরস্ত্রাণ?) নির্মাণ করে দেই। অতঃপর শহীদ মিনারের ওপর নিস্তব্ধতার প্রগাঢ় ও দীর্ঘ এক ছায়া নেমে আসল।
১৯৭২ সালের প্রারম্ভকাল, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করল। মিনারের কাজ এবারে একেবারে সম্পূর্ণ করে ফেলতে তারা উদ্যোগী হল। শহীদ মিনার নতুন ভাবে নির্মাণ পরিকল্পনার জন্য তারা নতুন প্রতিযোগিতা আহ্বান করল এবং বিচারের জন্য কিছু বিচক্ষণ বিচারক নিয়োগ করলেন। এবার দেশের সব শিল্পী ও স্থপতি গোষ্ঠী দলবব্ধ হয়ে তাদের কর্ম-পরিকল্পনা কমিটিতে উপস্থাপন করল। এই প্রতিযোগিতা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে অগ্রিম প্রচারণা লাভ করল এবং সেসঙ্গে জনমতও কর্মকর্তারা লিপিবদ্ধ করলেন।
একদিন বঙ্গভবনের কেন্দ্রীয় বৃহত্তর কক্ষে সবক’টি উপস্থাপনা প্রদর্শিত হলো। ওই কমিটির, গণমাধ্যমের এবং জনগণের প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেল আমার দলটির উপস্থাপিত নির্মাণ কল্পনাটি তাদের সুস্পষ্ট সমর্থন লাভ করেছে। সবারই মতামত ছিল মিনারটির সেই পূর্ব পরিচিত মূল পরিকল্পনাটির জন্যই- যা ছিল আমার সৃষ্টিকর্ম। সে সঙ্গে আশা করা হলো যে, আরও কিছু সংযোজন করা হবে। আগেই আমার দলটি ঠিক এই পরিকল্পনাটিই প্রকাশ করেছিল। অতঃপর খুব ভালো, কঠিন কিছু কার্য সম্পাদন করা হলো এবং আমাদের ক্রিয়াকর্ম দেখে তারা বেশ সন'ষ্ট হলেন। এরপর আবার সেই দীর্ঘসূত্রতা, কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না এবং অবিলম্বেই ১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এসে গেল। কোনো অদৃশ্য হাত যেন শহীদ মিনারের নিম্নের দেয়াল থেকে আমার অঙ্কিত ১০০০ বর্গফুটের ম্যুরালটির ওপর সাদা চুনকাম করে দিল। এ ব্যাপার দেখে আমার ক্রোধের অন্ত রইল না। কিন্তু রহস্য উন্মোচনের সূত্র কেউ আমাকে দিতে পারল না, এমনকি নগর অঞ্চলের গণপূর্ত বিভাগটিও নয়, যদিও তারাই ছিল সমগ্র কাজটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে।