মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ভাষা সংগ্রামীদের দাবী - বাঙালি ও বাংলা ভাষার পরিপূর্ণ মর্যাদা


ভাষা সংগ্রামীদের দাবী-
বাঙালি ও বাংলা ভাষার পরিপূর্ণমর্যাদা

শেখ উল্লাসঃ রাজধানীতে জীবিত ভাষা সংগ্রামী ও তাঁদের স্বজনদের মিলন মেলায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের পাশাপশি মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনের দাবি জানানো হয়েছে।  গত ২রা ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ধানমণ্ডির ১০ নম্বরে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব সড়কে - ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘরে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে এই দাবি জানানো হয়। জাদুঘরের সভাপতি বেগম পেয়ারী মাহবুবের সভাপতিত্বে এই মিলনমেলায় আবেগঘন আলোচনায়  অন্যান্যের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন, মরমী কবি ও শিল্পী ভাষা সংগ্রামী প্রকৌশলী সাব্বির আহমেদ চৌধুরী,  বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ঢাকা মেডিক্যাল সাবেক অধ্যক্ষ ও বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসাবিদ ভাষা সংগ্রামী ডাঃ মির্জা মাজহারুল ইলাম, ভাষা সংগ্রামী ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নওয়াজিশ আলী খান ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুব।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, যিনি কর্মজীবনে বাংলা ভাষায় প্রথম রায় প্রদান করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তিনি বলেন, বাঙালি একটি প্রাচীন জাতি। ভাষা আন্দোলন সমাজ বদলের হাতিয়ার ছিল, এই আন্দোলনের পথ ধরে দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই দেশ আজ উন্নত হচ্ছে। আগে দেখেছি যারা হকারী করতো, তারাও এখন কোটিপতি হয়েছে। বাচ্চাদের ইংরেজি মিডিয়ামে ভতি করাচ্ছে। ইংরেজির মোহে ভুল ইংরেজি শেখানো হচ্ছে। বাবুর্চির ছেলেমেয়েও এখন ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ছে, গ্রামে-গঞ্জেও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল হয়েছে। এটা কি ভাষা আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা? দেশে-বিদেশে গিয়ে ইংরেজি শিখছে, দেশের প্রতি এদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দেশকে যে ভালোবাসে না সে কি মানুষ?
ড. জসীমউদ্দিন আহমদ, তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যিনি বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারিতে আবুল বরকতের রক্তাক্ত দেহ ঢাকা মেডিক্যালের ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন, নিজের শরীর রক্তাক্ত করেছিলেন, তিনি বলেন, বাংলা একাডেমীতে একুশের বইমেলার উদ্বোধনী রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান হয়, সেখানে ভাষাসৈনিকদের বসার কোনো জায়গা দেয়া হয় না। একুশের পদক শুধুমাত্র ভাষা সংগ্রামীদেরকে দেয়ার দাবি করেন তিনি।
সাব্বির আহমদ চৌধুরী বলেন, ভাষা সৈনিকরা জাতির প্রথম সারির স্বাধীনতা সংগ্রামী। আমাদের জীবন ধন্য আমরা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম, যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এই ভাষা সৈনিকদের প্রতি জাতির কি কোনো দায়িত্ব নেই?
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, ভাষা আন্দোলন ছিল গণআন্দোলন। কিন্তু আজ নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাচ্ছে বাংলা। তাই শুধু সংবিধানেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বললে হবে না, বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। 
সভায় বলা হয়, বায়ান্নের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর পার হচ্ছে। অনেক ভাষাসংগ্রামী ইতোমধ্যেই লোকান্তরিত হয়েছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেই বার্ধক্যজনিতজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছেন। ভাষা আন্দোলন না হলে এই বাংলাদেশ হতো কি-না, বাঙালি জাতির বিশ্বের বুকে আজকের মতো বুক ফুলিয়ে টিকে থাকতো পারতো কি-না যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ভাষা শহীদ ও ভাষাসংগ্রামীদের আজও প্রকৃত স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। এমনকি দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ভাষাসংগ্রামীদের একটি নির্ভরযোগ্য, নির্ভুল ও প্রকৃত তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি বিভিন্ন সংকীর্ণতার কারণে। জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি সম্পন্ন করা অতীব জরুরি।
অনুষ্ঠানে ভাষা আন্দোলনের তথ্যসংগ্রাহক ও ইতিহাস গবেষক এম আর মাহবুব-এর সম্পাদিত সারা দেশের ১৩৬জন ভাষাসৈনিকের সংক্ষিপ্তজীবনী, ভাষা আন্দোলনে তাঁদের অংশগ্রহণের স্মৃতিচারণ, প্রকাশিত বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করে ও ভাষা সংগ্রামীদের স্বজনদের সাক্ষাৎকারসম্বলিত ‘ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি’ গ্রন্থর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। গ্রন্থটি ভাষা সংগ্রামীদের তালিকা তৈরি করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে এবং ভাষা-আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রণয়নে গ্রন্থটি একটি প্রামাণিক দলিল হিসেবে বিবেচনার যোগ্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন