বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৭

দর্শন আর উপলব্ধিতে বেরিয়ে আসছে জাতীয় সত্য

দর্শন আর উপলব্ধিতে

বেরিয়ে আসছে জাতীয় সত্য

সংলাপ ॥ ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’। অসহনীয়হলেও রাজনৈতিক মিথ্যাচারের সাথে বসবাসরত এদেশের মানুষ পেল একটি সত্য। দেরিতে হলেও পাওয়া এ সত্যকে পরমসত্যে পরিণত করার দায় বাঙালি জাতির। এখনও অনেকসত্যবের হয়েআসেনি জাতির সামনে। আশা করা যায়এভাবেই অদূর ভবিষ্যতে এক এক করে সত্য বের হয়েআসবে।
যখন-তখন রাজনীতিকদের কাছ থেকে অনেক বিবৃতি আসে দেশবাসীর সামনে।অতি চেনা বিবৃতিটি হলো ‘জনগণকে অভিনন্দন’ আর সরকারি দল তার পাল্টা বিবৃতি দিয়ে ‘অভিনন্দন’ জানায় একই জনগণকে। সবকিছুতেই রাজনীতিকরা দাবী করে থাকেন যে জনগণ রয়েছে তাদের সাথে।পরস্পর বিরোধীসব রাজনৈতিক দলই তাদের সবকিছু করে থাকে ‘জনগণের’ নামে।‘জনগণ চাচ্ছে’, ‘জনগণবলছে’, ‘জনগণ প্রত্যাখ্যান করছে’, ‘জনগণ সাথেআছে’ অর্থাৎ সবকিছুতেই ‘জনগণ’। কিন্তু সত্যটি বের হয়ে আসে না।
বছরের পর বছর, দশকের পর দশক এদেশে এভাবেই রাজনীতিকরা ‘জনগণে’র নাম করে নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দকে জায়েজ করে আসছেন।নিজেদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর নিজেদের দলীয় গোষ্ঠীস্বার্থের সংঘাত সবকিছুই চালিয়েযাচ্ছেন ‘জনগণে’র নামে এবংপরিশেষেতা চাপিয়েও দিচ্ছেন ‘জনগণে’রই উপর। এর মধ্যদিয়েপালা করে ক্ষমতায়যাচ্ছেন রাজনীতিকরা, ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আখের গুছিয়ে নেন নিজেদের। আর জনগণপড়ে থাকে সেই একই তিমিরেই।
প্রশ্ন হচ্ছে,জনগণ কি স্বার্থের হানাহানির এই রাজনীতিতে, রাজনীতিকদের সঙ্গে কখনও ছিলো? বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আজও কি জনগণ আছে? এ নিয়ে কোনো সামাজিক গবেষণা নেই।ফলে গবেষণালব্ধ কোন উদ্ধৃতি দেয়া সম্ভব নয়।কিন্তু সাধারণপর্যবেক্ষণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়রাজনীতিকদের সঙ্গে আছে ক্ষমতার হালুয়ালোভী অথবা ক্ষমতার হালুয়া প্রত্যাশী কিছু সহকর্মী - কর্মীছাড়া সাধারণ জনগণকেবাইনোকুলার দিয়েওখুঁজে পাওয়া যাবে না।
এদেশের রাজনীতিকরা দলীয় নেতা, জননেতা নয়।এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য ক্ষমতা, জনতা নয়।রাজনৈতিক দলে তাই জনগণ নেই।রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীতে জনস্বার্থ নেই। তাই জনসম্পৃক্ততাও নেই। রাজনীতিকদের দলীয়কর্মী পুষতে হয়অর্থ আর নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে।রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশকরতে হয় ট্রাক আর লোক ভাড়া করে। সমাবেশ হয়েউঠে দলীয়সমাবেশ।জনগণতাদের কোন সমাবেশ বহুকাল দেখেনি। জন দাবী নিয়ে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ডাক দিলেন জনগণকে, লাখলাখ জনতা তখনই সমবেত হলো সেখানে। গণআকাক্সক্ষা অর্থাৎ সত্যটি যখন উচ্চারিত হলো ময়দানে, দেশের কোটি কোটি জন সমর্থনের ঢেউ উঠলো সারাদেশে প্রজন্ম যোদ্ধাদের সমর্থনে। জনসমুদ্রের গর্জনে হয়ে উঠলো স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে নতুন শতাব্দীতে। মহাকালের অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে বিংশ শতাব্দী। বিদায়ী শতাব্দীতে অর্জিত বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সব সাফল্যের পথ বেয়ে পৃথিবী উপনীত হয়েছে এক নতুন যুগে-নতুন সভ্যতায়, যাকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল সভ্যতা।
বাঙালি জাতির জীবনে সবচাইতে বড় সত্য একাত্তরের বিজয়। কেবল চলমান শতকেই নয়, হাজার হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসে বোধকরি শ্রেষ্ঠ বিজয়। শ্রেষ্ঠ সাফল্য। এক অবিশ্বাস্য রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ, লাখ-লাখ মানুষের জীবন ক্ষয় আর কোটি বাঙালির অতুলনীয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল সেই বিজয়। শুধু বাঙালির ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসের পাতায়ও বাঙালির এই মুক্তিযুদ্ধ এক বিস্ময়কর সংযোজন। গোটা পৃথিবী সেদিন তাকিয়ে দেখেছিল সবিস্ময়ে - কেমন করে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত একটি শক্তিশালী ধর্মান্ধ সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়েছিল সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র মানুষের সহযোগিতায় তৎকালীন প্রজন্ম। মৃত্যু দিয়ে মৃত্যুকে ঠেকানোর পণ নিয়ে মরণ খেলায় মেতে উঠেছিল আবালবৃদ্ধ জনতা। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল অবশেষে। স্বাধীনতার বিজয় তিলক এঁটে বিশ্ব মানচিত্রে করে নিয়েছিল আপন ঠাঁই।
২০১৭ সনে উপনীত বিশ্ব যখন তথ্যপ্রযুক্তির সভ্যতার সাফল্য আরো বিস্তৃতির প্রচেষ্টায় রত তখন স্বাধীনতার এত বছরের পর স্বদেশের স্বভূমির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে জাতিকে! ফেলে আসা অতীতের চিত্রে একে একে ফুটে উঠে চোখের সামনে প্রিয় স্বদেশের পীড়াদায়ক বর্তমানে। স্বাধীনতা দিবসে উড্ডীয়মান বহু ব্যবহৃত অযত্নে রক্ষিত ফ্যাকাশে জাতীয় পতাকায় ভেসে ওঠে স্বদেশের ছবি। সাধক নজরুলের ভাষায় -
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলে আমরা তখন বসে/
স্ত্রী তালাকের ফতোয়া খুঁজি ফেকাহ্ হাদিস চষে।’
বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে সাধক নজরুল যা বলেছিলেন দুঃখ করে, আজ এতো বছর পেরিয়ে ’৭১ এর বিজয়ের পরও তা কত প্রাসঙ্গিক! কত বাস্তব! বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে ধর্মান্ধদের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব। সাথে রয়েছে সন্ত্রাস, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ। সীমাহীন লজ্জা আর দুঃসহ গ্লানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে জাতির বিবেক।

গন্তব্য কোথায়? সাধারণ মানুষতো দূরের কথা বোধকরি রাজীতিকরাও জানেন না! ক্ষমতার মন্ত্রে সমর্পিত জাতীয় নেতৃত্ব পারছে না দেশকে আদর্শিক পথে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে। কেবল আনুষ্ঠানিকতার সাজানো ছকে কি পালিত হবে জাতীয় দিবসগুলো! নেই আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা, অর্থপূর্ণ অকপট মূল্যায়ন। ‘এদেশে অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাচ্ছে, ভ্রান্ত ভ্রান্তকে উপদেশ দিচ্ছে’ এ সত্যই ক্রমশ ফুটে উঠছে প্রতিনিয়ত আরো বেশি করে। পরিকল্পিত অসত্যের ধুম্রজালে ঢেকে যাচ্ছে সামনে চলার পথ। বিভ্রান্ত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে চলার পথ। জাতির অস্তিত্ব হয়ে উঠছে হুমকির সম্মুখীন। সাধক নজরুলের ভাষায় যাকে বলা যায়, ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ। ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত।’ সঙ্গত কারণেই ষোল কোটি মানুষের সামনে উপস্থিত যুগের নতুন চ্যালেঞ্জ। ‘হয় টিকে থাক - নয় শেষ হয়ে যাও’ এই বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে। বলার অপেক্ষা রাখে না এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার কোনই বিকল্প নেই জাতির সম্মুখে। উপায় নেই সত্যকে মেনে নেয়া এবং সর্বস্তরে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া। 

সময়ের সাফ কথা.... বাংলার রাজনীতির মাটি

সময়ের সাফকথা....
বাংলার রাজনীতির মাটি

সংলাপ ॥ বাংলার মসনদ দখলের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে যে অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা অন্যায়, তার মধ্যে পরিণত বুদ্ধির অভাবই প্রকট হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন কেলেঙ্কারি নিয়ে চেপে ধরে আওয়ামি দলের কয়েকজন প্রথম সারির নেতাকে ব্ল্যাকমেল করে কিন্তু দেশবাসীর মন জয় করা যাবে না। শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিতে অন্যায়ভাবে কালি দিতে গেলে ফল হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল। সবার আগে দরকার রাজনৈতিক অঙ্গনে হাসিনার অনুকরণযোগ্য ভাবমূর্তি নির্মাণ। যখন তখন যত্র তত্র হাসিনার নামে কুরুচিকর মন্তব্য করে গণমাধ্যমের দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার যে চেষ্টা ইদানীং কেউ কেউ করছেন, তা সুস্থ মনের সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছেন না। দেশে বহু কষ্টে যতটুকু শান্তি ফিরেছে, সরকারকে বিপাকে ফেলার বাসনায় সেসব বানচাল করার সামান্য অপচেষ্টা হলেও সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেবে না।
জনকল্যাণের রাজনীতির অনেক পরিসরই এখানে বর্তমান আছে রাজনীতিকদের জন্য। সেই শূন্যস্থান দখলের একমাত্র উপায় হলো ইতিবাচক রাজনীতি। হাসিনার রাজনীতি এবং তাঁর যাবতীয় প্রচারের লক্ষ্য হল শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়ন। অতএব হাসিনার সঙ্গে টক্কর দিতে হলে অন্যান্যদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, বাংলার আরও উন্নয়ন ও সত্য প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য হওয়া। সরকার ও প্রশাসনের সঙ্গে ঢাকা সহ সমগ্র বাংলার উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া।
সরকারের প্রধান হিসাবে হাসিনা যা যা করছেন এবং করতে চান তার প্রত্যেকটিতে রাজনীতিকদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত হোক। একান্তভাবেই প্রকল্পগুলো রূপায়িত হোক দ্রুততার সাথে। যেমন পদ্মাসেতু, রেল, মেট্রোরেল ও সড়ক সম্প্রসারণ, রেল পরিবহণের আধুনিকীকরণ, বন্দরের ক্ষমতা বৃদ্ধি, নদীগুলোর দূষণমুক্তি, নদীভাঙন রোধ প্রভৃতি। শিল্প সংস্থাগুলোকে বাঁচানো, নতুন শিল্পের বিকাশ, পর্যটন প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলোকেও অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা কর্তব্য। স্বাস্থ্য পরিষেবার দৈন্যদশা কাটাতেও সকল রাজনীতিকদের  অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
দেশবাসীর বাস্তব সমস্যাগুলো চাপা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার বা রাখার বদ কৌশল কোনও ভাবেই যেন রাজনীতিকদের মনে স্থান না পায়। প্রশাসনে দুর্নীতি আর রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন নির্মূল করার যে প্রতিজ্ঞা, তা থেকে যেন হাসিনা সরকার কোনও ভাবেই বিচ্যুত না হয়। তার মুখে যথার্থভাবেই মান্যতা পেয়েছে গরিবের শক্তি এবং মধ্যবিত্তের মেধার প্রশ্নটি। তা আন্তরিক হলে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচিটি। তিনি নিজেই মনে করেন, গরিবকে শিক্ষিত করা গেলে, তাদের ঠিকমতো দেখভাল করা গেলে তারা সমাজকে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি দিতে পারবে। অতএব জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গরিবদের জন্য বইপত্র, পোশাক-আশাক এবং বৃত্তির ক্ষেত্রটি আরও বড় করতে হবে। সহজ কথায়, ক্রমশ বাড়াতে হবে শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দ ও নজরদারি। জোচ্চুরি অবশ্যই ঠেকাতে হবে; কিন্তু তা গরিবের খিদের অন্ন কেড়ে নেয়ার বিনিময়ে নয়।

অতএব, হাসিনার নেতৃত্বকে পরিকল্পনামাফিক এগুতে হবে জাতীয় অভাবগুলো দূর করার লক্ষ্যে। প্রয়োজন এই ব্যাপারে নতুন এক গণ আন্দোলন গড়ে তোলা। তাতে আপাতভাবে কতটা সরকারের লাভ কিংবা রাজনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, সেই হিসাব বড় করে দেখাটা ভুল হবে। গুরুত্ব পাক, শুধু সাধারণ মানুষের লাভালাভের প্রশ্নটি; মানুষের দুর্দশা দূর করতে কোন দলের আগ্রহ আন্তরিকতা কতটা। মানুষের পাশে থাকার প্রতিযোগিতায় জিতে আসার আগে পর্যন্ত বাংলার মাটি কিন্তু বিরোধী রাজনীতিকদের জন্য অনুর্বরই রয়ে যাবে। বাংলার রাজনীতির মাটি সবার থেকে আলাদা। এখানে অনিচ্ছাকৃত ভুলেরও কিন্তু মাফ হয় না সব সময়। 

সময়ের দাবী একই সুরে একই তালে দেশ ও জাতির জয়ধ্বনি

সময়ের দাবী
একই সুরে একই তালে দেশও জাতির জয়ধ্বনি

সংলাপ ॥ ১২ মাসে তেরো পার্বন। কথাটি বহুল প্রচলিত। বাংলার ১২ মাসে পর্যায়ক্রমে এই পালা-পার্বন আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। ঐতিহ্যের শেকড় থেকে, নাড়ির বন্ধন থেকে। বাস্তবে বাংলার হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান, বৌদ্ধ সব ধর্মাবলম্বী আপামর জনসাধারণ এই উৎসবগুলোর সাথে জড়িত। তাদের শরীরে এই মাটির সোঁদা গন্ধ, পায়ে পলি মাটির কাঁদা, কপালে চিক্চিক্ করে পরিশ্রমী ঘাম। কর্মের পূর্ণতায়, অবসরের আনন্দে, সম্প্রীতিতে, ভ্রাতৃত্বে, বন্ধুত্বতায় রাম-রহিম-জন এক হয়ে যায়। এরা বাংলার কৃষক, ক্ষেতমজুর, শ্রমিক - এদের কন্ঠে আছে জারি-সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, লালন, বাউল গানের সুর - এরা বাঙালি। অবশ্য আমাদের শহুরে তথাকথিত আধুনিক প্যান্ট-শার্ট পরা ‘বঙ্গ’ সন্তানদের কথা আলাদা। এরা সংস্কৃতিতে পরজীবী, কর্মে মধ্যসত্ত্বভোগী, পোশাকে আরাবিয়ান বা খৃষ্টান, উৎসবে জগাখিঁচুড়ী - এরাও বাঙালি। এরা কথা বলে বাংলায়, স্বপ্ন দেখে কানাডা-লন্ডন-আমেরিকার বা আরবের। এরা স্বাধীন দেশের মর্যাদা সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার চেয়ে অধিক পছন্দ করে পরদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর পরাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে। এরা পরশ্রীকাতরতায় উন্মুখ। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজে এই শ্রেণীর লোকের সংখ্যা আজ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠছে মিশ্র মানসিকতায় জাতিসত্তা। এই ভয়াবহ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন করবে কে?
খুঁজতে হবে এর সূত্র আমাদের জন্মের পূর্ববর্তীকালে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বিদেশী সংস্কৃতির অনুকরণের মধ্য দিয়ে। জন্মের পর পরই আমাদের বেড়ি পড়ানো হয় ধর্মের শিকলে, নাম রাখার মধ্যে দিয়েই যার শুরু। তুমি রমেশ, তুমি কাশেম, তুমি হ্যারিসন। তুমি হিন্দু, তুমি মুসলমান, তুমি খৃষ্টান - কিন্তু তুমি মানুষ না। তুমি বাংলা ভাষায় কথা বলবে - কিন্তু তুমি বাঙালি না। কিন্তু কাশেম বুঝলো না, সে কেন কাশেম, সে কেন মুসলমান? জন্মের পর থেকে নামের আদলে এই যে সাম্প্রদায়িকতার আবর্তে আমাদের বেড়ে ওঠা, পরবর্তীকালে কি আমরা এর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? আমরা অনেকে অনেক প্রগতিশীল কথাবার্তা বলি, এই সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার কথা বলি। আমাদের মধ্যে কেউ কি এই সাম্প্রদায়িক নামের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছি? পেরেছি কি সাম্প্রদায়িক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের উর্ধ্বে উঠতে? হতে পেরেছি কি সংস্কারমুক্ত? আমরা অনেকে অনেক বড় বিপ্লবী, প্রগতিশীল, কিন্তু তারপরেও মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান। তত্ত্বে বিপ্লব সাধন করা যতটা সহজ তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি কঠিন নিজের জীবনে, পরিবারে, সংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক অনুশাসনের পরিবর্তন সাধনের ভাঙ্গা-গড়ার খেলা খেলতে। আমাদের দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, বিপ্লবীরা কি এই দিকে দৃষ্টিপাত করবেন?
আসলে ধর্ম বলি আর দর্শন বলি তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। থাকার কোনো যুক্তিও নেই। সব মানুষ একই স্রষ্টার সৃষ্টি কিংবা সব মানুষের মূল উৎস একই। তাহলে একের সঙ্গে অপরের বিবাদের যুক্তি কোথায়? সুতরাং বিভেদ নয় ঐক্য, সংঘাত নয় সম্প্রীতিই হওয়া উচিত সব মানুষের জীবন দর্শন। এই কথাই বলা হয়েছে প্রতিটি ধর্মশাস্ত্রে এবং এটাই সব দর্শনের নিগূঢ় কথা। তাই সাধক নজরুলের ভাষায় বলি
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান্’।
বাংলার ঐতিহ্য পাঁচ হাজার বছর প্রাচীন হলেও এই ভাষার প্রাণের স্ফূরণ ঘটে চৌদ্দ শতকে। ওই সময়ের সঙ্গীতাবলীতে নিঃসৃত হয়েছিলো জগৎ ও জীবনের তত্ত্ব বিষয়ক অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব, সংঘবদ্ধ হয়েছিলো বাঙালির জাতীয় ঐক্য ও মিলনের আকাংক্ষা অর্থনৈতিক কারণে নয়, নৈতিক দিক থেকে সময়টা ছিল দুঃসময়। বাংলাদেশে তখন ধন ছিল, টোল-চতুস্পাটি ও পন্ডিত ছিলেন অজস্র। তবু সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছিল হাহাকার। এই অবস্থারই এক সার্থক চিত্র পাওয়া যায় বিদ্যাপতির এই ছত্রে :
কত বিদগ্ধজন, রস অনুমানই
অভিনব কাহুক ন পেখঁ।
বিদ্যাপতি কহে, প্রাণ জুড়াইতে
লাখে না মিলে এক।

বিদ্যাপতির এই আক্ষেপ আজকের বাংলাদেশের বেলায়ও যেন আক্ষরিক অর্থেই প্রযোজ্য। আজও চারিদিকে অজস্র পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ, আলেম-ওলামা রয়েছেন; তত্ত্বকথা শাস্ত্রকথাও আওড়ানো হচ্ছে হরহামেশা; কিন্তু এর অনেকটাই যেন শুধু গালভরা বুলি। জীবনে ও সমাজে যার কোনো প্রতিফলন নেই। আর তা নেই বলেইতো সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে হাহাকার, সবাই উচ্চারণ করছেন মূল্যবোধের কথা, সামাজিক অবক্ষয়ের কথা, অনেকটা বিদ্যাপতির আমলের মতো। আমরা পরিবর্তন চাচ্ছি আকুন্ঠ প্রাণে। কিন্তু পরিবর্তন চাচ্ছি বারবার ভুল মানুষদের কাছে। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিবাজ বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে নিতে চাচ্ছি জ্ঞানের খোরাক। তাইতো হোঁচট খাচ্ছি বারংবার। উন্নয়নের চাকা থমকে যাচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে। আমরা জানি একটি প্রদীপ যেমন রাতের অন্ধকার ঘোচাতে পারে না, তেমনি একক ব্যক্তির চেষ্টায়ও সাধিত হয় না সমাজের ব্যাপক কল্যাণ। এর জন্য প্রয়োজন সব মানুষের সমবেত প্রচেষ্টা। এটাই মানুষের পূর্ণতার সাধনা। আমরা সবাই কি এই সাধনায় লিপ্ত হতে পারি না? আমাদের সমাজের বিজ্ঞজন,    দিক নির্দেশনাকারীগণ, ধর্মজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, পণ্ডিত, রাজনীতিক এবং কল্পনার জগতে ভাসমান প্রগতিশীল বিপ্লবীরা কি এই সাধনায় লিপ্ত হতে পারে না একই সুরে দেশ ও জাতির জয়ধ্বনি করতে? 

প্রচেষ্টায় অপচেষ্টা নিয়ন্ত্রণ

প্রচেষ্টায় অপচেষ্টা নিয়ন্ত্রণ

সংলাপ ॥ বিশ্রাম কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা, নয়নের অংশ যেমন নয়নের পাতা, ঠিক তেমনি সরকারী আদালতের সাথেও আইন জিনিসটা একসাথে গাঁথা। আদালত থেকে আইন আলাদা করার কথা কল্পনাই করা যায় না। আইনের বৈশিষ্ট্যই হল, ওটা প্রয়োগে একটা বৈধ প্রতিষ্ঠানের বৈধ অধিকার এবং বৈধ পদ্ধতি থাকে। যে কেউ যে কোন জায়গায় ইচ্ছে মত যে কারো ওপর প্রয়োগ করলে সেটা কোন আইনই নয়।
অতীত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, কুরআনের ব্যাখ্যার ব্যাপারে কোন কোন সময় প্রচুর মতভেদ হবার উদাহরণ আছে। কোন কোন সময় একই ব্যাপারে সাত বা আট রকমের আইনগত বিভিন্ন মতামত দেয়া হয়েছে। এই মতামতের সবগুলোই ধর্মের অঙ্গ নয় ও বাধ্যতামূলক নয়। এগুলো সঠিক বা ভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু মতামতের এই বিভিন্নতা দেশ পরিচালনার ক্ষমতাকে জনকল্যাণের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী মতটি বাছাই করার সুযোগ দেয়।
ইসলামি চিন্তাবিদরা শুধু কুরআন থেকে মতামত দেন, শাসক পছন্দ মতো তার যে কোন মত একটা আইন হিসেবে প্রয়োগ করেন। ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের শারিয়া প্রয়োগের অধিকার নেই। ইসলামি খেলাফতের কোন বিশেষ শারিয়া ছিল না। তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী আইন করেছেন, কখনো কখনো স্পষ্টতই কুরআনের বাইরেও গেছেন। বর্তমান দুনিয়ায় ইসলামি রাষ্ট্র বানানোর ধারণা মুসলমানদের জন্যই যে কি আত্মঘাতী ভয়াবহ তা পই পই করে বিশ্বে মুসলমানদেরকে এক এক করে অনেক চিন্তাবিদ দেখিয়েছেন অনেক বার। ইসলামের নামে ক্রমাগত পাইকারী হারে অবৈধ ধর্মজীবী দ্বারা জাতির ধীশক্তিকে মৃত্যুদন্ডের ফতোয়ার বা গ্রাম্য শারিয়া-আদালতে বিচারের রায়ে নারীর জীবন ছিন্ন-ভিন্ন করার মহা কলঙ্ক এই উপমহাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে নেই। কিন্তু ইসলামি সরকার কবে হবে সে জন্য ধর্মান্ধ রাজনৈতিক ইসলাম বসে থাকতে রাজি নয়, শারিয়া প্রয়োগের ওই মৌলিক পদ্ধতিতেও সে ইতোমধ্যেই একটা ফুটো বের করে ফেলেছে। সেটা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনেও যেন তেন প্রকারে শারিয়া প্রয়োগ করে সমাজকে ‘ধীরে ধীরে ক্রমশঃ’ তথাকথিত বানানো শারিয়ায় অভ্যস্ত করা। এ জন্যই ধর্মান্ধরা শারীয়ার নামে ঐ অত্যাচার-কলঙ্কগুলোর প্রতিবাদ করে না।

কুরআনের নাম করে কুরআনের, নবীজীর নাম করে নবীজীর আর শারিয়ার নাম করে শারিয়ার মৌলিক নীতিমালা লংঘন করতে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক ইসলামের জুড়ি মেলা ভার। এক সাংঘাতিক গতিময়তার ভেতর দুই বিরুদ্ধ শক্তির আবির্ভাব হচ্ছে বিশ্বময়, মানব জাতির দ্রুত মেরুকরণ হচ্ছে আফ্রো-এশিয়ায় এবং পাশ্চাত্যে। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে। বাংলাদেশের সম্পদ লুটে নেয়ার জন্য দেশের মধ্যে বিদেশী তথাকথিত দাতাসংস্থাগুলোর যোগসাজসে একদিকে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়া হচ্ছে অপরদিকে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির জন্যে, যাতে সরকার নতজানু হয়ে তাদের হুকুম তামিল করে। আজ পর্যন্ত কোনো সরকার এর ফাঁদ থেকে বের হতে পারেনি। এই সরকার পারবে কি নিজের পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়ায়ে বিশ্বজুড়ে সত্য প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য স্থান দখল করতে?