বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৪

ইসলাম কখনও শোষণের হাতিয়ার ছিল না : এরদোগান



ইসলাম কখনও শোষণের হাতিয়ার ছিল না : এরদোগান

মারিদ মাহমুদ ॥ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান বলেছেন, ‘জবরদস্তি করে, তলোয়ারের জোরে লোকজনকে ইসলাম গ্রহণ করানো কখনও ইসলামের অংশ ছিল না। ইসলাম কখনও শোষণের হাতিয়ার ছিল না। যারা স্বর্ণের জন্য আমেরিকা আর হীরার জন্য আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তারাই এখন তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে একই নোংরা ষড়যন্ত্র করছে।’ এরদোগান প্রশ্ন করেন, ‘মুসলিম বিশ্বের ধনাঢ্য মুসলমানরা কী তাদের তেলের রাজস্বের জন্য যাকাত দেন্তু ‘কেউই এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছে না।’ এরদোগান বলেন, ‘মুসলমানদের সবার আগে আত্মসমালোচনা ও নিজেদের সংশোধন করতে হবে। এরপর আমাদের আল্লাহ ছাড়া কারো দাসত্ব করা উচিত নয়।’ এরদোগানের এ বক্তব্য টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে।
এরদোগান বলেন, ‘কলম্বাস নয়, মুসলমানরাই আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন্তু। কলম্বাসের তিন্তুশ বছর আগেই মুসলমানরা আমেরিকা আবিষ্কার করেন বলে জানান তিনি। শনিবার ইস্তাম্বুলে ল্যাটিন আমেরিকার মুসলমান নেতাদের এক সম্মেলনে এরদোগান এ কথা বলেন।
কলম্বাসের একটি ডায়েরির উদ্ধৃতি দিয়ে এরদোগান বলেন, ‘ইসলাম ও লাতিন আমেরিকার পরিচয় হয়েছে বারো শতাব্দী থেকে। ১১৭৮ সালে মুসলমানরা আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন; ক্রিস্টোফার কলম্বাস নন।’ তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, ১১৭৮ সাল থেকে মুসলমান নাবিকরা আমেরিকা পৌঁছাতে থাকেন এবং কলম্বাস নিজেই কিউবা উপকূলে একটি পাহাড়ের ওপর একটি মসজিদের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তুরস্ক সেই জায়গায় একটি মসজিদ তৈরি করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান এরদোগান। তিনি বলেন, ‘মসজিদ তৈরি প্রসঙ্গে আমি কিউবার ভাইদের সঙ্গে কথা বলব এবং ওই পাহাড়ের ওপর সুন্দরভাবে একটি মসজিদ নির্মিত হতে পারে।’ আমেরিকার আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের কর্ণধার ইতিহাসবেত্তা ড. ইউসেফ মরুই ১৯৯৬ সালে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘কলম্বাস তার নিবন্ধে স্বীকার করেছেন যে ১৪৪২ সালের ২১ অক্টোবর সোমবার তার জাহাজ যখন কিউবার উত্তর-পূর্ব উপকূলের জিবারা অতিক্রম করছিল তখন একটি সুন্দর পাহাড়ের চূড়ায় তিনি একটি মসজিদ দেখতে পান।’ তবে বেশিরভাগ ইতিহাস গ্রন্থে বলা হয়ে থাকে- ১৪৯২ সালে ভারত যাওয়ার নতুন সমুদ্রপথ আবিষ্কার করতে গিয়ে কলম্বাস ভুল করে আমেরিকায় চলে যান।

যোগ্যতমরাই টিকে থাকে



সময়ের সাফকথা ....
যোগ্যতমরাই টিকে থাকে

সংলাপ ॥ নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে যোগ্যতমরই জয় হয়। পৃথিবীতে টিকে থাকে যোগ্যতমরা। কিন্তু ‘যোগ্যতা’ নির্ণয়ের মানদণ্ড ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন হয়। যোগ্যতম প্রার্থীকেই চাকুরীতে নিয়োগ দেয়া হয়। কখনোই এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না, তবে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে যোগ্যতার সংজ্ঞা যায় পাল্টে। যোগ্যতা হতে পারে শিক্ষাগত, অভিজ্ঞতা, বয়স, বুদ্ধি, দৈহিক শক্তি, দৈহিক আকার- এমনকি কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির ‘ভাগ্নে’ হওয়াও যোগ্যতার মানদণ্ড হতে পারে। কর্পোরেট বিশ্বে যোগ্যতম ব্যক্তি হলেন: একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ উদ্যোক্তা, যিনি টাকার পেছনে লেগে থাকেন এবং টাকা উপার্জনের সংক্ষিপ্ত ও নিশ্চিত উপায় বের করতে পারেন।
জীববিজ্ঞানীদের কাছে যোগ্যতা হলো প্রজননগত সাফল্য। একটি প্রাণী যদি অন্য আরেকটি প্রাণীর অর্ধেক জীবনকাল বেঁচে থাকে কিন্তু দ্বিগুণ সংখ্যক সন্তান-সন্ততি রেখে যায়, তবে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। টিকে থাকার যোগ্যতা- আকার, আকৃতি, শক্তি, শিক্ষা, বয়স, বুদ্ধি কিংবা সৃজনশীলতার উপর নির্ভর করে না- নির্ভর করে প্রজননগত সাফল্য এবং পরিবেশের সাথে অভিযোজনের উপর।
সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের যোগ্যতা কী তা তিনিই ভালো জানেন। তবে তাঁর প্রেরিত শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তার সারমর্ম হলো: সৃষ্টিকর্তা পূর্ণ, কারণ তিনি ধারণাকে ততক্ষণাৎ বাস্তবায়িত করতে পারেন। সৃষ্টিকর্তা যদি বলেন ‘হও’ তাহলে ততক্ষণাৎ তা হয়ে যায়। সুতরাং মানুষ যদি সৃষ্টিকর্তার কাছে যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব হতে চায় তাহলে তাকে তাঁর গুণে গুনান্বিত হতে হবে। অর্থাৎ, তাকে অবশ্যই ধারণাকে বাস্তবায়িত করার, কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করার কলা-কৌশল শিখতে হবে এবং তা প্রয়োগে দক্ষ হতে হবে।

অনুকরণ নয় জাতি চায় অনুসরণ



অনুকরণ নয়  জাতি চায় অনুসরণ

অনন্ত বিশ্বাস ॥ সত্য বটে- শৈশবে অন্যের হাত ধরেই জলে নামতে হয়, সাঁতারের কৌশলও শিখতে হয় কিন্তু সাঁতার কাঁটতে হয় নিজের মত করে। শিক্ষকের লিখিত আদর্শ দেখেই বর্ণমালা শিখতে হয়। কিন্তু যে লিখতে শিখে যায় সে তার মত লেখে। তাই প্রত্যেকের হাতের লেখা অনন্য হয়। শিশু বয়ঃপ্রাপ্তদের বাক্যানুকরণ করে কথা বলতে শিখে বটে কিন্তু আপন কন্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি ও বাচনভঙ্গিতে সৃষ্টি করে অনন্যতা। বয়ঃপ্রাপ্তের কার্য্য দেখে শিশু কার্য্য করতে শেখে কিন্তু নিজের কার্য্য নিজেকেই করতে হয়, নিজের মত করে। যে সৃজনশীলতার বিকাশ করার প্রচেষ্টা করে না তাকে চিরকালই অনুকরণ করতে হয়। সে কখনও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। শিক্ষণের প্রথমে অনুকরণ সকলকেই করতে হয় কিন্তু নিজস্বতা ব্যতীত অনুকরণ দুষ্ট। উপযুক্ত কাল উত্তীর্ণ হলে অনুকরণ প্রবৃত্তি বলবৎ থাকার মত বড়শি আর কিছু নেই।
অনুকরণ পদ্ধতি, অনুসরণ লক্ষ্য। অনুকরণ বাহ্যিক, অনুসরণ আদর্শিক। বাহ্যিক আচরণে অন্তর্গত আদর্শের প্রকাশ নাও থাকতে পারে। তাই অনুসরণ উত্তম, অনুকরণ অধম।
অনুকরণ অন্ধ, অনুসরণ আলোকিত। অন্ধ অনুকরণ সম্ভব কিন্তু অন্ধ অনুসরণ অসম্ভব। মহান ব্যক্তিত্বের অনুকরণে ঐ ব্যক্তি উচ্চকিত হতেও পারেন কিন্তু নিপাত যায় অনুকরণকারী।
অনুসরণ সৃজনশীল, অনুকরণ বন্ধ্যা। অনুকরণ পুরানো পথে চলে অনুসরণ নূতন পথ তৈরি করে। অনেকেই অনুকরণ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে নিজের স্বকীয়তা এবং স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা। এরপর আসে অনুশোচনা- ‘হায়! কী করলাম আমি জীবন নিয়ে’!
আদিম সভ্য জাতি অন্য কোন জাতির অনুকরণ না করেই শিক্ষিত এবং সভ্য হয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয় ও মিশরীয় সভ্যতা অনুকরণলব্ধ নয়। বুদ্ধ কারো অনুকরণ করে বোধি লাভ করেন নি, আইনস্টাইন কারো অনুকরণে আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন নি, রবীন্দ্রনাথ কারো অনুকরণে কবিতা লেখেন নি, লালন কারো অনুকরণে গান করেন নি, চার্লি চ্যাপলিন কারো অনুকরণে অভিনয় করেন নি তাই তাঁরা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। অনুসরণ উদার, অনুকরণ সংকীর্ণ। অনুকরণ নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে অনুসরণ বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে।
রামায়ণের অনুসরণ মহাভারত-অনুকরণ নয়। রাম ও যুধিষ্ঠিরে কিছু মিল আছে কিন্তু প্রভেদ অনেক। রামায়ণের লক্ষ্মণ ও মহাভারতের অর্জ্জুন, রামায়ণের রাবণ ও মহাভারতের দুর্য্যোধন, রামায়ণের বিভীষণ ও মহাভারতের বিদুর এক সত্যকেই প্রকাশ করে কিন্তু স্টাইল এক নয়।
জগতে বৈচিত্র্য আছে বলেই জগত সুন্দর। পৃথিবীর সবদেশে একটি করে তাজমহল থাকলে তাজমহল দর্শনীয় হতো না। সকল ফুল যদি সাদা হতো তাহলে সাদা ফুলের কদর থাকতো না। সবাই যদি লালনের গান গাইতো তাহলে লালন সঙ্গীতের মর্যাদা থাকতো না। সকল কবিতাই যদি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অনুকরণে লেখা হতো তাহলে কোন মানুষ আর কবিতা পড়তো না। সকল পাখীই যদি ঘু ঘু করতো তাহলে ঘুঘুকে চিনতাম কী প্রকারে?
এডিসন যদি একই পরীক্ষা বারবার করতেন তাহলে পৃথিবীতে লাল-নীল বাতি জ্বলতো না। কর্মপ্রচেষ্টা যদি নূতন পথ না পায় তাহলে নূতন আবিষ্কার হবে কী প্রকারে? অনুসরণ কঠিন, অনুকরণ সহজ। মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী! সর্বদা সহজ পছন্দ করে। মানুষ নিজেই নিজেই নিজের অনুকরণ করে- একই কর্ম, একইভাবে পুনঃপুন করণের মাধ্যমে। তাই বিজ্ঞানী কম, ব্যবহারকারী অনেক।
সত্য এক কিন্তু সত্য আবিষ্কারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পথের আবশ্যকতা অবশ্যই আছে। সব কাজ একজন করতে পারে না। তাই এসেছে শ্রমবিভাজন। সকল মানুষ যদি একই পথে সত্যের অন্বেষা করে কিংবা একই ব্যক্তি যদি সকল পথে সত্যের অন্বেষা করে তাহলে মিথ্যার চোরাবালিতেই মৃত্যু হবে মানুষের। প্রকৃতিতে যেমন নানা রঙের ফুল আছে তেমনি ভালোবাসা প্রকাশেরও রয়েছে নানা রঙের পথ। বারবার একইভাবে ভালোবাসাঞ্জলি জ্ঞাপনের মধ্যে কোন ঐশ্বর্য নেই।
অধম যখন উত্তম হওয়ার অভিপ্রায়ে উত্তমের নিকট আসে তখন সে কী প্রকারে উত্তম হবে? অনুকরণ নাকি অনুসরণের মাধ্যমে?
মায়ুকাজি ছিলেন বৌদ্ধমঠের প্রধান গুরু। ধ্যান করার সময় তিনি পায়ের কাছে তাঁর পোষা বিড়ালটিকে রাখতেন। একদিন মায়ুকাজি পর্দা নিলেন। নতুন গুরুকে এক শিষ্য জিজ্ঞেস করল, ‘বিড়ালটা কি করব?’ গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ হিসেবে নতুন গুরু বিড়ালটিকে যথাস্থানে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আশেপাশের মঠেও বিড়ালের কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল। বিড়ালটি একসময় মারা গেল। কিন্তু, মঠবাসীরা ধ্যানের সময় বিড়ালের উপসি'তিতে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়ল যে, তারা আরেকটা বিড়াল ধরে আনল। মায়ুকাজি মঠের অনুকরণে অন্যান্য মঠেও বিড়াল পোষা শুরু হয়ে গেল। তাদের বিশ্বাস ছিল মায়ুকাজির বোধিলাভ ও অসাধারণ পাঠদানের মূলে রয়েছে ‘বিড়াল’।
এক প্রজন্ম পার হয়ে যাবার পর ‘ধ্যানে বিড়ালের গুরুত্ব’ শীর্ষক গবেষণা শুরু হলো। অনেক বই প্রকাশিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ঘোষণা করল- বিড়াল নেতিবাচক এনার্জি ফিল্ডকে নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে একাগ্রতা বৃদ্ধি করে। এবং এভাবে ওই এলাকায় ১০০ বছর ধরে ধ্যানচর্চার ক্ষেত্রে বিড়াল অপরিহার্য হয়ে উঠল।
তারপর এক আলোকিত গুরু এলেন, তিনি ধ্যানচর্চার ক্লাস থেকে বিড়াল বাদ দিতে চাইলেন। সব শিক্ষার্থী ও সাধুরা প্রতিবাদ শুরু করল। কিন্তু, গুরু অনড়। জ্ঞানচর্যার মাধ্যমে অবশেষে তিনি মায়ুকাজি মঠ থেকে বিড়াল খেদিয়েই ছাড়লেন। যেহেতু তিনি আলোকিত গুরু ছিলেন, তাঁর তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীরা বিড়াল ছাড়াই উন্নতি করতে লাগল।
অন্যান্য মঠগুলো এত বিড়ালকে খাওয়ানো নিয়ে আগে থেকেই সমস্যায় ছিল। বিড়াল তাড়ানোর খবর পেয়ে তারাও মঠ থেকে ঝেটিয়ে বিড়ালগুলো বের করে দিল। পরবর্তী ২০ বছর গোটা জাপানে আগুন ঝরানো সব প্রবন্ধ লেখা হলো: বিষয়- ‘বিড়াল ব্যতীত ধ্যানের গুরুত্ব’।
কথিত আছে- পুরো অঞ্চলে ধ্যানচর্চা বিড়ালমুক্ত করতে একশ বছর লেগেছিল।

সময়ের অপচয়ই সবচেয়ে বড় অপচয়



সময়ের অপচয়ই সবচেয়ে বড় অপচয়

আব্দুল্লাহ মাযরান ॥ হংকং একটি সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে দেখল যে, যদি পাহাড়ের পাশ দিয়ে রাস্তা নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে পাঁচ সেকেন্ড সময় বেশি লাগবে আর যদি পাহাড় কেটে ভেতর দিয়ে রাস্তা নেয়া হয় তাহলে পাঁচ সেকেন্ড সময় কম লাগবে। কিন্তু পাহাড় কেটে রাস্তা করতে রাষ্ট্রের ব্যয় হবে ১০০ কোটি টাকা। পাঁচ সেকেন্ড সময় বাঁচানোর জন্য ১০০ কোটি টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে হংকং সময়ের মূল্য দেয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ১০০ কোটি কেন, পৃথিবীর সব সম্পদের বিনিময়েও ১ সেকেন্ড সময় কেনা যায় না। যে ব্যক্তি বা জাতি সময়ের মূল্য দেয় না সময়ও তাকে মূল্য দেয় না। সে চিরকালই থাকে দরিদ্র।
সময় এক অদ্ভুত প্রতারণার খেলা করে আমাদের সাথে। প্রতিদিন জীবনের হিসাবের খাতায় ৮৬৪০০ সেকেন্ড জমা করে আবার নিয়ে যায়। অব্যবহৃত একটি সেকেন্ডও জমা থাকে না- হারিয়ে যায় মহাকালের অতল গহ্বরে। সময় একবার যায় তো চিরকালের জন্যই যায়। তাই বুঝতে হবে সময়ের মূল্য।
কিন্তু সময়ের মূল্য বোঝা কী সহজ? ১মিলিসেকেন্ডের মূল্য যে কী তা বুঝতে পারে কেবল সেই প্রতিযোগী যে ১মিলিসেকেণ্ডের জন্য জিততে পারলো না অলিম্পিকে স্বর্ণপদক। যে ব্যক্তি ১সেকেন্ডের ব্যবধানে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেলো, সে বুঝতে পারে ১সেকেন্ডের মূল্য। ১মিনিটের জন্য যে ট্রেন মিস করেছে সে বুঝে ১মিনিটের মূল্য। পরবর্তী ট্রেনের জন্য যে ১ঘন্টা অপেক্ষা করেছে সে বুঝে ১ঘন্টা কত মিনিটে হয়! কষ্ট ও ক্ষতির পর মানুষের বুঝ হয়। বুঝ কেউ কাউকে দিতে পারে না- জীবন দিয়ে অর্জন করতে হয়।
সময়ের গণ্ডিতে বাঁধা আমাদের জীবন। প্রত্যেক সেকেন্ড জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিবস, মাস আর কিছু বছরের সমষ্টি হচ্ছে আমাদের জীবন। সময়ই জীবন। তাই সময়ের অপচয়ই সবচেয়ে বড় অপচয়। আমরা সময়ের অপচয় করি- ট্রাফিক জ্যামে, টিভি দেখে, মোবাইলে কথা বলে, কম্পিউটার গেমস্‌, আড্ডা ইত্যাদিতে। ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয়জীবনে সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে সময়ের অপচয় রোধ করতেই হবে।
চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছু সময়ের মূল্য দিয়ে চলে। সূর্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে উদিত হয়, অস্ত যায়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি দিন এই বলে ঘোষণা করতে থাকে যে, যদি কেউ কিছু করতে চাও তাহলে আজই তা করে নাও। যদি আজ নয় তাহলে কখন? আমি আর ফিরে আসবো না। আমি বড় নিষ্ঠুর। আমি কারো প্রতি সদয় হই না। তবে আমার সঙ্গে যে সদ্ব্যবহার করবে সে কখনও বঞ্চিত হবে না।
এখনই একমাত্র সময়। যদি এখন নয়, তাহলে কখন। তখন, কখনও আসে না জীবনে। এখনই সময় নূতন কিছু করবার। আত্মবিশ্বাস শক্তির প্রমাণ দেয়ার এখনই সময়। জড়তা, আলস্য ত্যাগ করে এগিয়ে যাবার এখনই সময়। এখনই সময় নূতন করে শপথ নেয়ার। নিজের সংকল্পকে বাস্তবায়িত করার সময় বয়ে যায়। নবরূপে উত্তরণের সময় বয়ে যায়।
‘ঘুমিয়ে আছে যারা, হয়ে আপন হারা, এখনই সময় জাগিয়া ওঠার নূতন জীবনের লাগি’।

কল্পনা ও সত্য



কল্পনা ও সত্য

আইনুল হাফিজ ॥সারভানতেস- এর ‘ডন কুইক্সোট’ স্পেন সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস। বই পড়তে পড়তে বইগুলোতে ঘটে যাওয়া অসম্ভব ঘটনাগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করেন গ্রামের এক বয়ষ্ক ভদ্রলোক। নিদ্রাহীনতা, ক্ষুধা ও অতিরিক্ত পড়াশুনায় তার মতিবিভ্রম ঘটে। কল্পনাকে তিনি গ্রহণ করতে লাগলেন সত্য হিসেবে। এক পর্যায়ে তিনি তার পুরানো বর্ম, হেলমেট পড়ে নিজেকে ঘোষণা করলেন ডন কুইক্সোট হিসেবে, বেরিয়ে পড়লেন এডভেনচারে। এডভেনচারে বেরিয়ে অতি উৎসাহী, অতি উত্তেজিত ডন কুইক্সোট কান্ড জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ভেড়ার পালকে তার মনে হলো সৈন্যবাহিনী আর দাসদের মনে হলো অত্যাচারিত ভদ্রলোক। এক ব্যক্তিকে তিনি আক্রমন করে বসলেন অন্যায়কারি দৈত্য মনে করে। এক বালককে মুক্ত করলেন যার মনিব তাকে গাছে বেধে রেখেছিল, পাওনা মজুরি চাইতে গিয়েছিল বলে। ফেরার পথে ডন কুইক্সোট ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন যারা তার কল্পনার নায়িকাকে অপমান করেছিল। ডন কুইক্সোট তার নিজস্ব কল্পনার জগত গড়ে তুলেছিলেন অতি নিষ্ঠা আর যত্নের সাথে। নিজের গ্রাম লা মনচাতে একসময় ফিরে আসেন এই নায়ক। মানসিকভাবে সুস্থ হওয়ার পর ঐসব বইয়ের সাথে তার সব সম্পর্কের অবসান ঘটে। মৃত্যুশয্যায় তিনি তার অতীত এডভেনচারের নির্বুদ্ধিতা ও পাগলামীর কথা স্বীকার করেন।
ডন কুইক্সোটের মত এমন অনেক মানুষই আছে আমাদের সমাজে যারা কল্পনার অলিক জগতে বিচরণ করেন আর বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনা ও চরিত্র তৈরি করে আক্রমন চালান শব্দের তলোয়ারে। এমন লোকেরও অভাব নেই যারা কল্পনাকে ধরে নেন সত্য।  আমাদের দেশে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও আছে যারা ধ্যানের নামে ‘কল্পনা চিকিৎসা’ শিক্ষা দেয় মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে।
কল্পনা কাকে বলে? পূর্বে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষ করা হয়েছে তার প্রতিরূপের নূতন আকার ও অবস্থা সম্বন্ধে চিন্তা করাকে বলা যায় কল্পনা। কল্পনাও এক প্রকারের চিন্তা। স্মরণের সাথে কল্পনার পার্থক্য হলো: স্মরণের ক্ষেত্রে পূর্ব-প্রত্যক্ষ বিষয়ের প্রতিরূপের সম্বন্ধ পূর্বের মতই থাকে কিন্তু কল্পনার ক্ষেত্রে এই সম্বন্ধ নূতন। কল্পনায় অতীত অভিজ্ঞতাকে নূতনভাবে সাজিয়ে নূতন ইন্দ্রিয় ছাপ গঠন করা হয়।
চোখের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষানুভূতি অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষানুভূতির চেয়ে প্রবল। তাই শ্রবণকল্পনা, স্পর্শকল্পনা, ঘ্রাণকল্পনা ও স্বাদকল্পনার চেয়ে দর্শনকল্পনা শক্তিশালী। প্রত্যক্ষণের জন্য চক্ষু আছে, শ্রবণের যেমন কর্ণ, কিন্তু কল্পনা করার জন্য কোন বিশেষ অঙ্গ নেই।
স্মৃতি এবং কল্পনার দিকে প্রথম দৃষ্টিতেই প্রতীয়মান হয় যে, স্মৃতি কল্পনার চেয়ে অধিকতর জীবন্ত। স্মৃতি যতটা স্পষ্টতর রঙে রঞ্জিত, কল্পনা ততটা নয়। কল্পনার প্রত্যক্ষণ ক্ষীণ ও নিস্তেজ। কল্পনাকে প্রয়াস ব্যতীত একইরূপে বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না কিন্তু স্মৃতিতে ডুবে থাকা যায়। স্মৃতি ও কল্পনার মধ্যে আরও স্পষ্ট পার্থক্য হলো: স্মৃতি সীমিত, কল্পনা সীমিত নয়। স্মৃতির ঘটনাক্রম ইচ্ছেমত সাজানোর সুযোগ নেই কিন্তু কল্পনার জগতে সে সুযোগ অবারিত। স্মৃতিকে পরিবর্তন করা যায় না কিন্তু কল্পনাকে যতবার ইচ্ছা পরিবর্তন, পবির্ধন করা যায়। স্মৃতিতে ঘটনার মৌলিক রূপ সংরক্ষিত থাকে। স্মৃতির ত্রুটির কারণে বিষয়বস্তু' স্বরূপ হতে বিচ্যুত হতে পারে, আগের ঘটনা পরে এবং পরের ঘটনা আগে স্মরণে আসতে পারে কিন্তু ঘটনার বিন্যাসের দিকে সচেতন দৃষ্টি দিলে প্রকৃত ঘটনা উদ্ধার করা অসম্ভব নয়। স্মৃতি কেবল বিষয়বস'কে সংরক্ষণই করে না, ঘটনা ক্রম অনুযায়ী সাজিয়েও রাখে। কোনরূপ বিচ্যুতি না ঘটিয়ে একই কল্পনার পুনরাবৃত্তি যদি করা হয় তবে তাকে কল্পনা না বলে কল্পনার স্মৃতি বলাই উত্তম। কল্পনায় ঘটনাসমূহ বিন্যাসের স্বাধীনতা অবাধ।
কল্পনা সত্য কেবল কল্পনার জগতেই। বাস্তব জগতে কল্পনা ও সত্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। সীমিত কিছুকে অসীম হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে। কল্পনা আমাদেরকে সত্য থেকে দূরেও নিয়ে যেতে পারে। নদীর এপারে বসে যদি আমরা কল্পনা করতে থাকি যে ওপার আরও অনেক বেশি সুন্দর তাহলে এ পাড়ের উপর আমাদের বিতৃষ্ণা জন্মাতে পারে। অবস্থার আরও অবনতি ঘটার সম্ভাবনা থাকে যদি কল্পনায় প্রভাবিত হয়ে নৌকা নিয়ে আমরা ওপাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করে দেই। ওপাড়ে গিয়ে যদি আমরা এপাড়ের চেয়ে খারাপ অবস্থা দেখি তাহলে হতাশাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক।
তবে, কল্পনা সত্য উপলব্ধিতেও সহায়ক হতে পারে আবার সত্যও কল্পনাকে আশ্রয় করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিকগণ কল্পনার মাধ্যমে সত্যকে আবিষ্কার করেন। চিত্রশিল্পীদের জন্য কল্পনা একান্ত আবশ্যক। যার কল্পনা শক্তি যত বেশি তার ছবি তত বেশি সৃজনশীল হয়। একজন কবি যখন কবিতা লেখেন তখন তিনি কল্পনার আলোতে সত্যকে দেখেন। শব্দের ছন্দে যখন তিনি কল্পনাকে প্রকাশ করেন তখন তা সত্য ও সুন্দর। অর্থাৎ কল্পনা আমাদেরকে সত্য-মিথ্যা দু’টো দিকেই নিয়ে যেতে পারে।
সত্যের আধার কল্পনা নয়- আত্মা। আত্মা কল্পনা করে না। আত্মায় যখন সত্য উন্মোচিত হয়, সত্যে বসবাস করে তখন কল্পনার কোন প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। প্রেমিকের চোখের সামনে যখন প্রেমাস্পদ বসে থাকে তখন প্রেমিক প্রেমাস্পদের কথা কল্পনা করে না। সত্য জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয়কে একাকার করে। তাই সত্যের কল্পনার প্রয়োজন নেই। একত্বের উপলব্ধি কল্পনা নয়- সত্য। সীমাকে অসীম রূপে কল্পনা করা আর অসীমকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করা এক নয়।
আত্মায় যখন সত্য উন্মোচিত হতে থাকে, মিথ্যার আবরণগুলো যখন উড়ে যেতে থাকে তখন কল্পনা বিশেষ শক্তি সঞ্চার করে সত্যের উন্মোচনকে তরান্বিত করতে পারে।
আত্মা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে, দেখতে পারে, সনাক্ত করতে পারে কিন্তু আত্মা নিজে থেকেই সত্যকে দেখে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না দেহের সব শক্তি এ কাজে নিয়োজিত হয়। কল্পনায় সত্যকে দেখা হবে অলীক প্রত্যক্ষণ। কিন্তু কল্পনার শক্তি দিয়ে মিথ্যার আবরণগুলো উন্মোচনের প্রচেষ্টা অলীক প্রতক্ষণ নয়, আত্মাকে সত্য দেখার জন্য সহায়তা করা।
সফলতার কল্পনা যেমন আমরা করতে পারি তেমনি করতে পারি ব্যর্থতার কল্পনা। আমরা প্রেমের কল্পনা যেমন করতে পারি তেমনি পারি ঘৃণার কল্পনা করতে। ঘৃণার কল্পনা যদিও কল্পনাই কিন্তু কীভাবে আমাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও অস্থিরতার সৃষ্টি করে তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি।
কিন্তু কল্পনা-বিলাসিতা মানুষকে অলস করে দেয়। কেবল কল্পনা দ্বারা সত্য- মিথ্যা হয় না কিংবা মিথ্যা- সত্য হয় না। সিন্দাবাদের ভূত, সাদ্দাদের বেহেশত, হনুমানের পর্বত বহন, দৈত্যের বাড়ি, পঙ্খীরাজ ঘোড়া, মধুর নহর, দশ মাথা তাল গাছ আমরা কল্পনা করতেই পারি। এমনকি এসব কল্পনায় দেখা ছবি আমরা এঁকেও দেখাতে পারি। কিন্তু পঙ্খীরাজ ঘোড়ার ছবির পিঠে বসে আকাশে উড্ডয়ন করা যায় না। কল্পনার সাথে বিশ্বাস যুক্ত না হলে কল্পনা সহায়ক শক্তি হয় না। চোখ বন্ধ করে কল্পনায় এখনই আমরা চাঁদে চলে যেতে পারি। কল্পনায় যেহেতু চাঁদে চলে গেছি বাস্তবে আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই এমন সিদ্ধান্ত নিলে আমরা আর অগ্রসর হতে পারবো না। কল্পনার সাথে যদি বিশ্বাস থাকে যে, হ্যাঁ বাস্তবেও আমি চাঁদে যেতে পারবো এবং যাবো তাহলেই কেবল কল্পনা সৃজনশীল হয়। নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস থেকেই আসে চলার গতি। যদি চাঁদ সত্যিই থাকে এবং আমার বিশ্বাসও থাকে যে চাঁদে আমি যেতে পারবো তাহলে চাঁদে যাওয়ার কল্পনা আমার দৈনন্দিন কর্মতৎপরতায় তন্ময়তা সৃষ্টি করবে। বিশ্বাস কল্পনাকে থামতে দেয় না, দিক্‌ পরিবর্তন করতে দেয় না। যদি আমাদের উপলব্ধিতে আসে যে, কল্পনার সাথে বিশ্বাসের সংযোগ নাই তাহলে কল্পনা আমাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে।
বিশ্বাস স্বতঃস্ফূর্ত। কল্পনা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। যখন বিশ্বাস কল্পনার সাথে যুক্ত হয় তখন তা বুঝা যায়। কারণ বিশ্বাসের সাথে আত্মায় প্রবেশ করে সত্যের কিরণ। বিশ্বাসের মধ্যে সত্য বেড়ে ওঠে। কারণ বিশ্বাস সত্যের বেষ্টনী, সত্যের আবরণ উন্মোচনকারী।