বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৪

মানুষ যাবে কোথায়?



মানুষযাবে কোথায়?

আরিয়ান হোসেন ॥ রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের ঠিক বাইরে দিনে দুপুরে দুষ্কৃতিকারীরা কুপিয়ে খুন করল এক জনপ্রিয় অধ্যাপককে। একেএম সফিউল ইসলাম (৪৮) নামে সমাজ বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক তার অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা ও জীবনধারণের জন্য পরিচিত ছিলেন। ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন তাদের ফেসবুক পেজ-এ  হত্যার দায় স্বীকার করে বলেছে, ‘এই অধ্যাপক বোরখা না-পরে ক্লাসে আসার জন্য মেয়েদের প্ররোচিত করাতেই তাকে খতম করা হল।’ হামলার পরে ঘটনাস্থল থেকে একটি কাগজ মেলে, যাতে লেখা ‘সাধক!’
লালন ফকিরের ভাবধারার অনুসারী ছিলেন এই অধ্যাপক। বাড়িতে লালনগীতি ও বাউল গানের চর্চাও করতেন তিনি। তার ছাত্ররা বলছেন, সম্ভবত সেই কারণেই মৌলবাদীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন অধ্যাপক সফিউল। তবে পুলিশ জানিয়েছে, কে বা কারা তাঁকে আক্রমণ করল, কেনই বা তাঁকে নিশানা করা হল, সে বিষয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে মৌলবাদী ও জঙ্গি মতবাদ প্রচার করা এই সংগঠনটি এর আগে রাজীব হায়দর ও আশরাফুল আলম নামে দুই ব্লগারকে খুনের দায় স্বীকার করে বলেছে, ‘এরা নাস্তিক বলেই খতম করা হল’। আসিফ মহিউদ্দিন ও রাকিব মামুন নামে আরও দুই ব্লগারকে যে কোনও দিন খতম করা হবে বলেও ফেসবুকে হুমকি দিয়েছে সংগঠনটি।
এ দিন অধ্যাপক সফিউল দুপুর আড়াইটের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে কিছু দূরে বিহাস পল্লিতে তাঁর বাড়ির দিকে রওনা হন। হঠাৎই এক দল লোক তাঁকে ঘিরে ধরে কোপাতে থাকে। তার পরে অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে তারা উধাও হয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় একটি রিঙায় উঠে হাসপাতালে যেতে বলেন অধ্যাপক। কিন্তু কিছু দূরে গিয়েই রিঙা থেকে পড়ে যান। স্থানীয় লোকেরাই তুলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সন্ধ্যায় সেখানে তিনি মারা যান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, অধ্যাপক সফিউলের ঘাড় ও মাথায় গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের খবর জানাজানি হতেই রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। আততায়ীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা সড়ক অবরোধ করেন। সমাজ বিজ্ঞানের আর এক অধ্যাপক নিলুফার সুলতানা জানান, অধ্যাপক সফিউলের উপর এই হামলার ঘটনায় তাঁরা আতঙ্কিত।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী এখনও হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পারেনি। প্রসঙ্গত যেখানে এই নৃশংস হত্যকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেখান থেকে মাত্র অর্ধ-কিলোমিটারের মধ্যে যাব-৫-এর সদর দপ্তর। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সমাজের মানুষদের কাছে সম্মিলিত প্রতিরোধ প্রত্যাশা করার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক জনপ্রিয় মানবতাবাদী অধ্যাপক মহম্মদ ইউনুসকে ২০০৪-এ একই ভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়। সেই খুনের দায়িত্ব স্বীকার করেছিল জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)। তার সুষ্ঠু বিচার এখনও সম্পন্ন হয় নি। এর ঠিক দু’বছরের মাথায় ড. তাহের খুন হন। ড. তাহেরের খুনীদের বিচারে দোষীরা সাব্যস্ত হলেও বিচারিক কার্য সম্পন্ন হয় নি, ইউনুস হত্যার আজও কোনো কূল-কিনারা কেউ করতে পারে নি। দেশের প্রচলিত আইনে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য কোনো অধ্যাপকের বিচার হয় না, বছরের পর বছর তা ঝুলে থাকে, অন্ধকারে পড়ে থাকে তখন প্রকারান্তরে এরকম হত্যার পথ প্রসারিত হয়। অপরাধীরা জানে যে হত্যা করলে কিছুই হয় না। সমাজে তারা নির্বিচারে ‘নিরাপদে’ই বাস করতে পারে। অপরাধীরা এতে অনুপ্রাণিতই হয়। অপরাধীরা যেমন জানে তাদের আইনের আওতায় আনা যাবে না তেমনি সমাজের মানুষও জানে এর বিচার হয়তো হবে না। এই যদি হয় সমাজের বিধিলিপি, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন