বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৪

অনুকরণ নয় জাতি চায় অনুসরণ



অনুকরণ নয়  জাতি চায় অনুসরণ

অনন্ত বিশ্বাস ॥ সত্য বটে- শৈশবে অন্যের হাত ধরেই জলে নামতে হয়, সাঁতারের কৌশলও শিখতে হয় কিন্তু সাঁতার কাঁটতে হয় নিজের মত করে। শিক্ষকের লিখিত আদর্শ দেখেই বর্ণমালা শিখতে হয়। কিন্তু যে লিখতে শিখে যায় সে তার মত লেখে। তাই প্রত্যেকের হাতের লেখা অনন্য হয়। শিশু বয়ঃপ্রাপ্তদের বাক্যানুকরণ করে কথা বলতে শিখে বটে কিন্তু আপন কন্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি ও বাচনভঙ্গিতে সৃষ্টি করে অনন্যতা। বয়ঃপ্রাপ্তের কার্য্য দেখে শিশু কার্য্য করতে শেখে কিন্তু নিজের কার্য্য নিজেকেই করতে হয়, নিজের মত করে। যে সৃজনশীলতার বিকাশ করার প্রচেষ্টা করে না তাকে চিরকালই অনুকরণ করতে হয়। সে কখনও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। শিক্ষণের প্রথমে অনুকরণ সকলকেই করতে হয় কিন্তু নিজস্বতা ব্যতীত অনুকরণ দুষ্ট। উপযুক্ত কাল উত্তীর্ণ হলে অনুকরণ প্রবৃত্তি বলবৎ থাকার মত বড়শি আর কিছু নেই।
অনুকরণ পদ্ধতি, অনুসরণ লক্ষ্য। অনুকরণ বাহ্যিক, অনুসরণ আদর্শিক। বাহ্যিক আচরণে অন্তর্গত আদর্শের প্রকাশ নাও থাকতে পারে। তাই অনুসরণ উত্তম, অনুকরণ অধম।
অনুকরণ অন্ধ, অনুসরণ আলোকিত। অন্ধ অনুকরণ সম্ভব কিন্তু অন্ধ অনুসরণ অসম্ভব। মহান ব্যক্তিত্বের অনুকরণে ঐ ব্যক্তি উচ্চকিত হতেও পারেন কিন্তু নিপাত যায় অনুকরণকারী।
অনুসরণ সৃজনশীল, অনুকরণ বন্ধ্যা। অনুকরণ পুরানো পথে চলে অনুসরণ নূতন পথ তৈরি করে। অনেকেই অনুকরণ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে নিজের স্বকীয়তা এবং স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা। এরপর আসে অনুশোচনা- ‘হায়! কী করলাম আমি জীবন নিয়ে’!
আদিম সভ্য জাতি অন্য কোন জাতির অনুকরণ না করেই শিক্ষিত এবং সভ্য হয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয় ও মিশরীয় সভ্যতা অনুকরণলব্ধ নয়। বুদ্ধ কারো অনুকরণ করে বোধি লাভ করেন নি, আইনস্টাইন কারো অনুকরণে আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন নি, রবীন্দ্রনাথ কারো অনুকরণে কবিতা লেখেন নি, লালন কারো অনুকরণে গান করেন নি, চার্লি চ্যাপলিন কারো অনুকরণে অভিনয় করেন নি তাই তাঁরা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। অনুসরণ উদার, অনুকরণ সংকীর্ণ। অনুকরণ নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে অনুসরণ বেঁচে থাকে যুগ যুগ ধরে।
রামায়ণের অনুসরণ মহাভারত-অনুকরণ নয়। রাম ও যুধিষ্ঠিরে কিছু মিল আছে কিন্তু প্রভেদ অনেক। রামায়ণের লক্ষ্মণ ও মহাভারতের অর্জ্জুন, রামায়ণের রাবণ ও মহাভারতের দুর্য্যোধন, রামায়ণের বিভীষণ ও মহাভারতের বিদুর এক সত্যকেই প্রকাশ করে কিন্তু স্টাইল এক নয়।
জগতে বৈচিত্র্য আছে বলেই জগত সুন্দর। পৃথিবীর সবদেশে একটি করে তাজমহল থাকলে তাজমহল দর্শনীয় হতো না। সকল ফুল যদি সাদা হতো তাহলে সাদা ফুলের কদর থাকতো না। সবাই যদি লালনের গান গাইতো তাহলে লালন সঙ্গীতের মর্যাদা থাকতো না। সকল কবিতাই যদি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অনুকরণে লেখা হতো তাহলে কোন মানুষ আর কবিতা পড়তো না। সকল পাখীই যদি ঘু ঘু করতো তাহলে ঘুঘুকে চিনতাম কী প্রকারে?
এডিসন যদি একই পরীক্ষা বারবার করতেন তাহলে পৃথিবীতে লাল-নীল বাতি জ্বলতো না। কর্মপ্রচেষ্টা যদি নূতন পথ না পায় তাহলে নূতন আবিষ্কার হবে কী প্রকারে? অনুসরণ কঠিন, অনুকরণ সহজ। মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী! সর্বদা সহজ পছন্দ করে। মানুষ নিজেই নিজেই নিজের অনুকরণ করে- একই কর্ম, একইভাবে পুনঃপুন করণের মাধ্যমে। তাই বিজ্ঞানী কম, ব্যবহারকারী অনেক।
সত্য এক কিন্তু সত্য আবিষ্কারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পথের আবশ্যকতা অবশ্যই আছে। সব কাজ একজন করতে পারে না। তাই এসেছে শ্রমবিভাজন। সকল মানুষ যদি একই পথে সত্যের অন্বেষা করে কিংবা একই ব্যক্তি যদি সকল পথে সত্যের অন্বেষা করে তাহলে মিথ্যার চোরাবালিতেই মৃত্যু হবে মানুষের। প্রকৃতিতে যেমন নানা রঙের ফুল আছে তেমনি ভালোবাসা প্রকাশেরও রয়েছে নানা রঙের পথ। বারবার একইভাবে ভালোবাসাঞ্জলি জ্ঞাপনের মধ্যে কোন ঐশ্বর্য নেই।
অধম যখন উত্তম হওয়ার অভিপ্রায়ে উত্তমের নিকট আসে তখন সে কী প্রকারে উত্তম হবে? অনুকরণ নাকি অনুসরণের মাধ্যমে?
মায়ুকাজি ছিলেন বৌদ্ধমঠের প্রধান গুরু। ধ্যান করার সময় তিনি পায়ের কাছে তাঁর পোষা বিড়ালটিকে রাখতেন। একদিন মায়ুকাজি পর্দা নিলেন। নতুন গুরুকে এক শিষ্য জিজ্ঞেস করল, ‘বিড়ালটা কি করব?’ গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ হিসেবে নতুন গুরু বিড়ালটিকে যথাস্থানে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আশেপাশের মঠেও বিড়ালের কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল। বিড়ালটি একসময় মারা গেল। কিন্তু, মঠবাসীরা ধ্যানের সময় বিড়ালের উপসি'তিতে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়ল যে, তারা আরেকটা বিড়াল ধরে আনল। মায়ুকাজি মঠের অনুকরণে অন্যান্য মঠেও বিড়াল পোষা শুরু হয়ে গেল। তাদের বিশ্বাস ছিল মায়ুকাজির বোধিলাভ ও অসাধারণ পাঠদানের মূলে রয়েছে ‘বিড়াল’।
এক প্রজন্ম পার হয়ে যাবার পর ‘ধ্যানে বিড়ালের গুরুত্ব’ শীর্ষক গবেষণা শুরু হলো। অনেক বই প্রকাশিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ঘোষণা করল- বিড়াল নেতিবাচক এনার্জি ফিল্ডকে নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে একাগ্রতা বৃদ্ধি করে। এবং এভাবে ওই এলাকায় ১০০ বছর ধরে ধ্যানচর্চার ক্ষেত্রে বিড়াল অপরিহার্য হয়ে উঠল।
তারপর এক আলোকিত গুরু এলেন, তিনি ধ্যানচর্চার ক্লাস থেকে বিড়াল বাদ দিতে চাইলেন। সব শিক্ষার্থী ও সাধুরা প্রতিবাদ শুরু করল। কিন্তু, গুরু অনড়। জ্ঞানচর্যার মাধ্যমে অবশেষে তিনি মায়ুকাজি মঠ থেকে বিড়াল খেদিয়েই ছাড়লেন। যেহেতু তিনি আলোকিত গুরু ছিলেন, তাঁর তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীরা বিড়াল ছাড়াই উন্নতি করতে লাগল।
অন্যান্য মঠগুলো এত বিড়ালকে খাওয়ানো নিয়ে আগে থেকেই সমস্যায় ছিল। বিড়াল তাড়ানোর খবর পেয়ে তারাও মঠ থেকে ঝেটিয়ে বিড়ালগুলো বের করে দিল। পরবর্তী ২০ বছর গোটা জাপানে আগুন ঝরানো সব প্রবন্ধ লেখা হলো: বিষয়- ‘বিড়াল ব্যতীত ধ্যানের গুরুত্ব’।
কথিত আছে- পুরো অঞ্চলে ধ্যানচর্চা বিড়ালমুক্ত করতে একশ বছর লেগেছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন