বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

আগে জন্ম তারপর ধর্ম




সংলাপ ॥ নির্বোধ আর মতলববাজ। চরিত্র বিপরীত! সময়ে অথবা প্রায়শই এ দু’য়ের ভূমিকা হয়ে পড়ে অভিন্ন।  দেশটার নাম বাংলাদেশ। আছে শুধু ভাষা নয়, অভিন্ন কৃষ্টি, অভিন্ন সংস্কৃতি ও অভিন্ন ঐতিহ্য। আছে পাঁচ হাজার বছরের অভিন্ন ভৌগোলিক সামাজিক আর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারও। স্বাধীনতার পর আমরা বিশ্বখ্যাত একটি সংবিধান পেয়েছিলাম। ছিলো তার মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য চারটি মূলনীতি ঃ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদের কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সংবিধানে দেয়া হয়নি। যার ফলে আজও এই দুটো নীতি নিয়ে চলছে নোংরা রাজনীতি আর বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি।
তাই মতলববাজরা, জাতিদ্রোহী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারীরা, ১৯৭১ সালের পর ১০ বছরের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা পাঁচ হাজার বছরের বাঙালি জাতির মাথায় সাইনবোর্ড লটকে দিয়েছে বাংলাদেশী জাতি বলে। গায়ের জোরে সাংবিধানিক স্বীকৃতি করিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তা। মূলত বিশ্ববাসী আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখলো এ জাতির উভয় প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার এক নিকৃষ্ট হীন অপচেষ্টাকে। এ অপচেষ্টা হচ্ছে এই জাতির সত্ত্বাকে মুছে দেয়ার, তিন সহস্র বছরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঢেকে ফেলার। যেন ১৯৭১ এর আগে কিছুই ছিলোনা এ জাতির। ’৭১-এ জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ থেকেই এর যেন প্রথম যাত্রা শুরু।
মতলববাজদের এই অপচেষ্টার আড়ালে ঢাকা রয়েছে ওদের ঘৃণিত প্রত্যাখ্যাত চেহারা। ধর্মের নামে তথাকথিত ধর্মকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, সম্প্রদায়গত, কিংবা রাষ্ট্রীয়গত শোষণ, লুটপাট ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি কর্তৃত্ব বজায় রাখা। এরাই মুসলমানিত্বের জিকির তুলে ১৯৪৭ সালে ভারতকে খন্ড বিখন্ড করেছিলো, বিভক্ত করেছিলো সমৃদ্ধ বাংলাকে। সৃষ্টি করেছিল বর্বর ধর্মীয় প্রতারণার রাষ্ট্র পাকিস্তান! যে বর্বরতা আজো তাড়া করে চলছে রাষ্ট্রটিকে। মতলববাজ ধর্মব্যবসায়ী ও তাদের প্রভু-গডফাদাররা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মতো আরোও এক উদ্ভট মতলবি তত্ত্ব তৈরী করে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে আর বলে বেড়াচ্ছে, ‘আমরা আগে মুসলিম তারপর বাঙালি’। সত্য চিরন্তন পথের দিশারী। আল কুরআনে সুস্পষ্টভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে একটি জাতির ভাষাকে যার উপর ভিত্তি করে, যাকে কেন্দ্র করেই ওই জাতির অস্তিত্ব এবং এর কৃষ্টি-সংস্কৃতি। ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য’ (১৪:৪), ‘আর তাঁর নির্দশনাবলীর মধ্যে অন্যতম নিদর্শন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে’ (৩০:২২)। জ্ঞানীদের জন্য এরূপ সুস্পষ্ট নিদর্শন থাকলেও তা চোখে পড়ে না রাজনৈতিক ইসলামপন্থী অজ্ঞ নির্বোধদের? আল্লাহ্ যা বলার তা রাখ ঢাক না করেই বলে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘কুরআন আমি তো আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পারো’ (১২:২)। আরও খোলাখুলিভাবে এও জানিয়ে দিয়েছেন, ‘এইভাবে আমি তোমার উপর আরবি ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি সতর্ক  করতে পারো নগর অধিবাসীদেরকে ও তার আশে পাশে যারা বাস করে তাদেরকে আর সতর্ক করতে পারো সমবেত হওয়ার দিন সম্পর্কে, যার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই’ (৪২:৭)। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতারই প্রতিফলন দেখা যায় আরবীয়দের মাঝে। তারা নিঃসংকোচে পরিচয় দেয় নিজেদের আরবীয় হিসাবে। আশির দশকের  কথা, আরব নিউজ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন সৌদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা আগে আরব, তারপর মুসলমান’। অথচ এই সৌদীদেরই ‘ফেৎরা-ভোগী’ এদেশীয় ধর্মবেত্তা মতলববাজরা ষাট দশক ধরে  চিৎকার করে বাঙালিকে বোঝাবার চেষ্টা করে বলে চলেছে, ‘আমরা আগে মুসলমান তারপর বাঙালি’!
এদেশের প্রায় ১৫ কোটি বাঙালি মুসলমান। ঠেকে-ঠকে জেনেছে উপলব্ধি করেছে মুসলমানিত্ত্ব তাদের প্রথম পরিচয় নয়- বাঙালিত্ত্বই তাদের প্রথম পরিচয়। অক্ষমতা নির্বুদ্ধিতার বলেই হোক আর বিভ্রান্তির কবলে পড়েই হোক - যারা বলতে চায় আমরা আগে মুসলমান তারা নিজের অজান্তেই নিজেকে জাতিকে কুলাঙ্গারে পরিণত করে তুলেছে -পরিণামে হয়ে উঠেছে জাতিদ্রোহী এমনকি ধর্মদ্রোহীও!
তাই এখনো সময় আছে। নিজেকে চিনুন। মা-মাতৃভাষা-মাতৃভূমিকে চিনুন। নিজের সংস্কৃতিকে চিনুন তাহলে যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন তা সঠিকভাবে ধারণ-লালন-পালন করে সত্যকার ধার্মিক হতে পারবেন। নচেৎ শুধু অন্য ভাষায় লেখাপড়া করে তোতা পাখির মতো বুলি পড়ে ধর্ম পালন করলে নিজেকে নিজেই প্রতারণা করবেন। সুতরাং সত্যের পথে আসুন এবং শান্তির (ইসলাম) ঝান্ডা তুলে ধরুন যাতে ওই ঝান্ডা হেলে না পড়ে এবং দেশও বাঁচে।

হিংসার ধর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে




শেখ উল্লাস ॥ খাঁটি বাংলা শব্দ ধর্ম - অর্থ ধারণ করা। যে যেটা ধারণ করে সেটাই তার ধর্ম। ক্ষমতা বা আধিপত্য কায়েমের জন্য প্রতিপক্ষকে নির্মূল বা নির্মূল করার ষড়যন্ত্র, হিংসা-প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা বাংলার সাধারণ মানুষের ধর্ম-সংস্কৃতি-স্বভাব-আচার-ব্যবহার-এসবের কোনোটাই নয়। গাঙ্গেয় বদ্বীপের এ অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সহজ-সরল-উদার ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী বলেই এখানে অন্যূন পাঁচ হাজার বছর ধরে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনের ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। আজ থেকে প্রায় আট শ’ বছর আগে থেকেই এখানে ইসলামের মর্মবাণী প্রচারের জন্য আরব-ইয়েমেন-ইরান-তুর্কী দেশ থেকে আগত সূফীসাধকগণ ধর্ম প্রচারের উপযুক্ত পরিবেশে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের মানবতা ও সাম্যবাদী আচার-ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি এ অঞ্চলের সহজ-সরল মানুষেরা সহজেই আকৃষ্ট হয় এবং তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এইসব কারণে জীবন চলার পথে এদেশের মানুষের ঐতিহ্যই হচ্ছে তারা অতীব সরল-অল্পতেই তারা তুষ্ট।
কিন্তু কথায় বলে, নদীর জল বা পানি যাই বলি না কেন এর পলির সাথে কাঁকর (কঙ্কর),সাপ-বিচ্ছুও আসে এবং এগুলোই পরিবেশকে দূষিত করে। নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের ওপর বর্ষিত) -এঁর ওফাতের পর থেকে মক্কা-মদীনা-দামেস্ক-সহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি (ইসলাম) ধর্মকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি বানানোর পরিণতিতে যে তা-বলীলা শুরু হয় তার প্রভাব ভারতবর্ষ এবং পরবর্তীকালে বাংলায়ও এসে পড়ে-যাকে এক কথায় এজিদী ইসলাম এবং মুহাম্মদী ইসলাম-এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।  এই উপমহাদেশের এই এজিদী ইসলামই বিগত দুই শতাধিক বছর ধরে বিশ্বে ওহাবী-সৌদী-মওদুদী-তাবলিগী ইসলাম নামে বিশ্বে আধিপত্য বিরাজ করে রেখেছে। দুইশত বছরের ইংরেজ শাসন ও তেইশ বছরের পাকিস্তানী শাসনামলে এই বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এই ওহাবী ইসলাম বিভিন্নভাবে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, এই ইংরেজ ও পাকিস্তানী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ফকির বিদ্রোহ, সন্নাস বিদ্রোহসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে এদেশের মানুষ অংশ নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশেষ করে ৭১’এর পরাজিত দেশি-বিদেশি শত্রু এদেশের সরকার  ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে তাদের এজেন্টরা এমনভাবে অনুপ্রবেশ করে রেখেছে যে, সময়-সুযোগ পেলেই তারা তাদের টার্গেট পূরণ করে যাচ্ছে। ৭৫-এর ১৫ই আগষ্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ৩ নভেম্বর জাতীয় ৪ নেতা হত্যা, ৭ নভেম্বর দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা-সৈনিক হত্যা, জিয়াউর রহমানের আমলে সেনাবাহিনীতে কু-পাল্টা ক্যু ঘটিয়ে সাধারণ সৈনিক হত্যা এবং ২১ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলাসহ তাঁকে ১৯ বার হত্যাচেষ্টা সবই ছিল এদেশীয় পাকিস্তানী এজেন্টদের ষড়যন্ত্রের ফসল। এইসব ষড়যন্ত্র, হত্যাকান্ড ও নৃশংসতার সাথে এদেশের সাধারণ কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষ কখনো জড়িত ছিল না, বরং পাকিস্তানী এজেন্ট ও সৌদি-ওহাবীদের প্রভাবেই এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবন বিভিন্ন সময়ে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা কখনো চায় না বাংলার মানুষ শান্তিতে থাক, স্বস্তিতে থাক।
বাংলাদেশে পাকিস্তানী-সৌদি-ওহাবীপন্থী এদেশীয় রাজনীতিজীবীরা ক্ষমতার জন্য কত নৃশংস, প্রতিহিংসাপরায়ণ, মিথ্যাচারী হতে পারেন তার নিকট ইতিহাসে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ২০০৪ সালের ২১ একুশে আগষ্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, এর ঠিক আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের সকল নেতা-কর্মীকে হত্যার চেষ্টার ঘটনা। সেই লোমহর্ষক ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ দলীয় অনেক নেতৃবৃন্দ প্রাণে বেঁচে গেলেও বিশিষ্ট নেত্রী বেগম আইভী রহমানসহ  ২৪ জন নিহত এবং আহত হয় বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ। আহতদের চিকিৎসা যেন না হয় সে চেষ্টাও করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এরা সবাই অংশ নিতে গিয়েছিল সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে। রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়, সেখানে রাষ্ট্রের পুলিশ, গোয়েন্দাসংস্থা, সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের সকল যন্ত্র ব্যবহার করে একটি রাজনৈতিক দলকে গ্রেনেড হামলা করে গুঁড়িয়ে দেওয়ার এমন ষড়যন্ত্র পৃথিবীর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে বিরল। অথচ ওই সময় যারা সরকারে ছিল সেই বিএনপি-জামাতজোট তারা তাদের নেতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে প্রচার করে থাকে। কিন্তু এরা গণতন্ত্র ও এই তন্ত্রের মূল্যবোধকে কতটুকু শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তার প্রমাণ তারা আবারও দিয়েছে ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের রায় ঘোষণার পর। এই রায়ের মাধ্যমে আদালত কর্র্র্তৃক তৎকালীন খালেদা-নিজামী সরকারের একজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব, জাতীয় গোয়েন্দাসংস্থার মহাপরিচালক, ডিজিএফআইএর মহাপরিচালকসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হলেও বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে এ নিয়ে কোন বিকার নেই। দুঃখ-প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা, অনুশোচনা, অনুতাপ প্রকাশ করা তো পরের কথা।
বহুদলীয় রাজনীতির নামে ক্ষমতা দখল করার জন্য মানুষ এমন মিথ্যাচার ও জঘন্য কাজ করতে পারে তা এদেশের সহজ-সরল-মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ। পবিত্র কুরআনে আছে, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকো না, আর জেনে-শুনে সত্য গোপণ করোনা’। ১৪ বছর আগে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে যা ঘটেছিল তা দিবালোকের মতো সত্য। কিন্তু সেই সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারের লোকজন সেই সত্যকে বেমালুম অস্বীকার করে এখনো এদেশে রাজনীতি করে যাচ্ছেন,পত্র-পত্রিকাসহ সকল মিডিয়াতে বহাল তবিহতে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন তা এদেশের আকাশ-বাতাস-মাটি-আবহাওয়া-জলবায়ুতে কতটুকু সহ্য হবে তা সময়েই বলে দেবে। তবে, ইতিহাস স্বাক্ষী বাংলার মাটিতে এজিদ- মুয়াবিয়া- মীরজাফর- রাজাকারসহ সকল বিশ্বাসঘাতকের নাম ঘৃণাভরেই উচ্চারিত হয়। মিথ্যাচারী আপাতদৃষ্টিতে যত শক্তিশালীই হোক, তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ঘৃণাভরেই উচ্চারিত হয়। যেমন- এদেশের কেউ নামের আগে এজিদ-মুয়াবিয়া রাখে না, কেউ রাজাকার হিসেবে পরিচয় দিতে চায় না, খন্দকার মুশতাক বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর কিছুদিনের জন্য দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেও চিরকালের জন্য ইতিহাসের এক বিশ্বাসঘাতকের নাম। মার্কিন-পাকিস্তান-সৌদি-ওহাবী মদদপুষ্ট প্রতিহিংসা ও হানাহানি-সংঘাতপূর্ণ তাদের এই রাজনৈতিক ধারা বাংলার মাটিতে কখনো ঠাঁই হবে না। কারণ, দেশটির নাম বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান ও তাদের সহযোগী সকল অপশক্তিকে মোকাবেলা করেই ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করেছে। তবে, এদেশের সকল স্তরে অশুভ চক্রের বিভিন্ন এজেন্ট যেভাবে
এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সকল স্তরে দেশপ্রেমিক-প্রগতিশীল-গণমুখী মানুষদেরকে যথাযথভাবে দায়িত্বভার না দিতে পারলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অপকর্মের চিরঅবসান ঘটানো কখনো সম্ভব হবে না বলেই আশঙ্কা থেকে যায়। তাই অবিলম্বে ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার  বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মাধ্যমে সমাজজীবনে শান্তি-স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে দ্রুতগতিতে। জঙ্গীপনা, ধর্মের নামে উগ্র-সন্ত্রাসী কর্মকান্ড মানুষ আর দেখতে চায় না। বাংলার জলবায়ু-আবহাওয়া পাকিস্তান-আফগানিস্তান-তুর্কী-ইরান বা আরববিশ্বের মতো নয়। হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি করে ক্ষমতার স্থায়ী আসনলাভ এদেশের প্রকৃতিই সমর্থন করে না। এদেশের গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতে হলে হিংসা-প্রতিহিংসার বৃত্ত থেকে বের হয়ে মানুষকে ভালোবাসতে হবে-দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২১আগষ্ট গ্রেনেড হামলার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশে-বাতাসে এই কথাটিই আবারও প্রতিধবনিত হচ্ছে।

শেকড়ের সন্ধানে সত্যমানুষ




আপনি আপনার মনের জান ঠিকানা
পরের অন্তর সে যে সমুদ্দুর, কিসে যাবে জানা।
সংলাপ ॥ উন্মুল স্বদেশ ভাসছে সময়ের স্রোতে। ভুগছে পরিচয়-সঙ্কটে। নদ-নদী বিধৌত এ বঙ্গভূমির মানচিত্র বার বার শিকার হয়েছে ভাঙ্গা-গড়ার। নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে এর পরিচয় বিভ্রান্তি। অভিন্ন আকাশ, অভিন্ন মাটি আর জলবায়ুতে হাজার বছরে বেড়ে ওঠা এই জনপদের মানুষগুলো পরস্পর ভিন্ন হয়ে পড়ে পরিচিতির প্রশ্নে। দু’শ বছরের ইংরেজ শাসন আর ১৯৪৭-এর ঐতিহাসিক প্রতারণা এই পরিচয় বিভ্রান্তিকে ঠেলে দেয় আরো অতলে। সিকি শতাব্দির লড়াই- সংগ্রাম আর কঠিন ‘ঠেকে শেখার’ বিনিময়ে ১৯৭১-এ এসে খন্ডিত বাংলার পূর্বাঞ্চলের মানুষ খুঁজে পায় আপনারে। ‘বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা-আমি বাঙালি।’ এই শাশ্বত সত্য ধরা পড়ে উপলব্ধিতে।
তবে সে উপলব্ধি ধরে রাখা যায়নি স্থায়ীভাবে। মানচিত্রের বিভক্তির মতই বাঙালি জাতি জড়িয়ে পড়ছে সর্বনাশা মানসিক বিভক্তিতে। টান পড়ছে খোদ জাতিসত্ত্বার মূলে। মানুষে-মানুষে, বাঙালি-বাঙালিতে ভেদাভেদ আজ বর্তমান। অথচ, সেই মধ্যযুগেই বাঙালি কবি চন্ডিদাস বলেছিলেন-
শোন হে মানুষ ভাই
সবার উপর মানুষ সত্য
তাহার উপর নাই।
গত শতাব্দীর গোড়ায় সাধক নজরুল ইসলাম বলেছিলেন -
ওরা হিন্দু না মুসলিম
ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী- বলো ডুবিছে মানুষ
সন্তান মোর মা’র।
একই জনপদে একই জলবায়ুতে অভিন্ন ভাষা, অভিন্ন কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পরিচিতিটাই বড় এবং প্রথম। সত্যকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে বুঝে বা না বুঝে প্রতিনিয়ত নিজের সাথে নিজে প্রতারণা করে চলেছি আমরা। আজ প্রয়োজন এই আত্মপ্রতারণার আঁধার থেকে বেরিয়ে আসা।
সত্যমানুষ লালন সাঁঈজী ঠিক এক্ষেত্রেই গোটা বাঙালি জাতিকে দেখিয়ে গেছেন আলোর পথ। ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের উর্দ্ধে উঠে গিয়ে গেয়েছেন শাশ্বত মানবতার জয়গান। অকুতোভয়ে উচ্চারণ করেছেন -
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।
সাঁঈজীর এই আদর্শ মানব সমাজ প্রতিষ্ঠা আজ নতুন শতকের দাবি। বাঙালি জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য তা জরুরীও বটে।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘বাউল’ মতের মূল ভাবধারা। কালক্রমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্ম-দর্শন ও সাধনার সমন্বয়ে এ ধারা আরো সমৃদ্ধ ও ব্যাপকতা লাভ করেছে। ড. আহমদ শরীফ বলেছেন “বিভিন্ন মতবাদের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাউল মত। হিন্দু-মুসলমানের মিশ্রনে হয়েছে বাউল সম্প্রদায়, তাই পরমত সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গ্রহণশীলতা, বোধের বিচিত্রতা, মনের ব্যাপকতা ও উদার সদাশয়তা এদের বৈশিষ্ট্য। বৈশিষ্ট্যে ও বৈচিত্র্যে এই বাউল মতধারার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে উনিশ শতকের বাউল সাধক লালন সাঁঈজীর সাধনা ও সৃষ্টির সম্ভারে।
বাঙালি সংস্কৃতিতে ‘লালন’ একটি অপরিহার্য নাম। একজন কুঠিবাসী সত্যমানুষ মধ্য যুগের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে যে সত্য-দর্শনের ভেদ উন্মোচন করে দিয়ে জীবনকে সুন্দর করার মহান পথ বাতলে দিয়েছেন তা বর্তমান আধুনিক যুগেও প্রত্যেক বাঙালিকে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
তথাকথিত সভ্য সমাজের শহুরে সভ্যতার কৃত্রিম বলয়ে নিজেকে নিপতিত না করে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় নির্জন গ্রামীণ পরিবেশে আর্তজনের আত্মার আত্মীয় হয়ে স্বকীয় সাংস্কৃতিক আবর্তে লালন হয়ে উঠেছেন চিরন্তন এক সত্তা ও বোধ। অসাধারণ প্রজ্ঞায় ও ধর্মতত্ত্বের দ্বারা তিনি পথভ্রষ্ট মানুষকে দিয়েছেন সৎ-সত্য পথের দীক্ষা। ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘বাউল ধর্ম সম্প্রদায় আর্য-অনার্য, হিন্দু, বৌদ্ধ ও সূফী ভাবধারার সমন্বয়ে গঠিত বাংলার একান্ত নিজস্ব একটি ধর্ম সম্প্রদায়। এই ধর্ম কোন অভিজাত সম্প্রদায়ের ধর্ম নয়। এটা জনসাধারণের ধর্ম। লৌকিক ধর্ম। আমরা জানি, ধর্ম সংস্কৃতিরই একটি অঙ্গ। সুতরাং বৃহৎ চিন্তায় আমরা বলতে পারি লালন-সংস্কৃতি বাংলার একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতি বাঙালিরই সংস্কৃতি।’
সভ্যতার ক্রমবিকাশে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, প্রতিটি ধর্মকেই বাঙালি তার সংস্কৃতির সাথে মিশ্রিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে সাগরের মতো উদার হয়ে। তাই প্রতিটি ধর্ম সম্বন্ধীয় মতবাদ থেকেই বাঙালি তার জন্য প্রযোজ্য সত্যকে অনুসন্ধান করে নিজেকে করেছে সমৃদ্ধ। ধর্মীয় চেতনাগত সত্যে বাঙালি গড়ে তুলেছে ঐক্যের বন্ধন। এই চেতনিক ঐক্যে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে শান্তির ঠিকানা। যার জন্য সত্যমানুষ লালন সাঁঈজীর কাছে এসে বাঙালিকে ঋণী হতেই হয়। চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব শান্তি-ধর্ম এর দিক নির্দেশক হিসেবে তাঁকে অর্পণ করে হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার্ঘ।

মানুষকে চেনাই শান্তি ধর্মের লক্ষ্য




সংলাপ ॥ কুরআন মতে, বিশ্বের সব মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। মানবজাতি আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার সন্তান। কালের প্রবাহে বংশবৃদ্ধির কারণে মানুষ বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হয়েছে। নবী করীম (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর কন্ঠে ঘোষিত হয়েছে শান্তিধর্মের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত - ‘হে মানবজাতি! তোমাদের  রব একজন, তোমাদের আদি পিতা একজন এবং তোমরা সকলেই আদমের সন্তান।’ সকল মানুষ একই উপাদানে, একই লক্ষ্যে সৃষ্ট। বিশ্বের সকল জাতি-সম্প্রদায় ও বর্ণের মানুষ আল্লাহ্ তায়ালার বৃহৎ পরিবারভুক্ত। তাই মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষই সমান মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার পাবার যোগ্য। আল্লাহ্ তায়ালার নিকট সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা প্রিয় যে ব্যক্তি তার বৃহৎ পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক রাখে ও সদাচরণ করে। দ্বীনের নবী (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক) ঘোষণা দিয়েছেন - ‘আদম সন্তানেরা সবাই সমান। তাকওয়া ব্যতীত তাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই।’ মানুষে মানুষে পার্থক্য হয়, কে কি গুণ অর্জন করতে পেরেছে, কার মধ্যে মনুষ্যত্ব কতটা বিকশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে। জাতি-বর্ণ-ভাষা মানুষের মর্যাদার মানদ- নয়। রসুল (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক) ঘোষণা করেছিলেন - ‘আজ থেকে বংশগত কৌলীন্য বিলুপ্ত হলো। সে-ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে স্বীয় কর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। আরবদের ওপর অনারবদের, সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই’।
এ ঘোষণার মাধ্যমে তিনি (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক) জাতি, বর্ণ এবং বংশগত কৌলীন্য ভেঙ্গে বিশ্বনবী হলেন। বিশ্বনবী আবদ্ধ থাকতে পারেন না রক্ত, বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠী, ভাষা কিংবা রাষ্ট্রের প্রাচীরে। বিশ্বনবী আরবীয়, ভারতীয়, কিংবা মিসরীয়দের নবী নন, তিনি সমগ্র মানব জাতির নবী। যারা তাঁকে গোষ্ঠী, বর্ণ, দেশ ও জাতির ঊর্ধ্বে পথপ্রদর্শক হিসেবে মানে তারাই মুসলিম। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র, ভৌগোলিক সীমারেখা বা বংশ পূজারীরা কখনও আল্লাহর পূজারী  হতে পারে না।
কুরআন মতে আল্লাহ্ তায়ালা সকল মানুষের রব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানব জাতির পালনকর্তা তিনি। তাঁর পালনকর্মে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। কোন দেশ, সম্প্রদায় বা জাতি দাবি করতে পারে না যে, আল্লাহ্ তায়ালা কেবল তাদের। তিনি সমানভাবে সকলের, সমগ্র সৃষ্টি জগতের। আল্লাহ্ তায়ালা বিশ্বজনীন তাই তাঁর নবী-রসুলগণও বিশ্বজনীন। নবী-রসুলগণের আগমন ঘটেছে বিভেদ তৈরির জন্য নয়, বিভেদের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য, বিচ্ছিন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি গোত্রের কাছে সমসাময়িক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে স্থানীয় ভাষায় পথপ্রদর্শকরূপে মনোনীত ব্যক্তিকে পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন ঐশী বাণী। সুরা ইব্রাহিমের ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে - ‘আর আমি প্রত্যেক রসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ এসব প্রত্যাদেশে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। সময়ের প্রয়োজনে প্রকাশভঙ্গিতে কিছু তারতম্য আছে মাত্র। আল্লাহ্ বলেছেন - ‘তোমাদের জন্য সেই বিধানই দেয়া হয়েছে, যা নূহকে দেয়া হয়েছিল এবং যা তোমাকে প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, তাই প্রত্যাদেশ করা হয়েছিল ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসাকে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করো, এবং তাতে কোন দ্বিমত সৃষ্টি  করো না’ (৪২ : ১৩)। সুরা আলে ইমরানের ৮৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে - ‘বলো আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ্তে আর যা আমাদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছে, আর যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহিম, আর ইসমাইল আর ইসহাক আর ইয়াকুব আর গোত্রদের কাছে; আর যা দেয়া হয়েছিল মুসাকে আর ঈসাকে আর পয়গম্বরদের তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে, তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য আমরা করি না।’ পৃথিবীর সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি এই হচ্ছে কুরআনিক সিদ্ধান্ত। কুরআন কোন সাম্প্রদায়িক বিধান নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসৃতব্য বিধান। কুরআন মতে, সকল নবী রসুল একই ধর্ম প্রচার করেছেন। ১ লক্ষ ২৪ হাজার বার্তাবাহক তাঁদের সময়ের প্রতিনিধি। যখন কেউ কুরআন মেনে মুসলিম হয়, তখন সে আল্লাহ্ ও নবীর (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর প্রকৃতি অনুসরণ করে বিশ্বমানব হবার চেষ্টায় রত থাকে। তার আর কোন দেশ থাকে না, গোষ্ঠী থাকে না, জাতি থাকে না। বিশ্বমানব না হয়ে কেউ সত্যিকারের মুসলিম হতে পারে না।
কুরআন সমগ্র মানব জাতিকে শান্তিতে বসবাসের পথনির্দেশ দিয়েছে। কোন সম্প্রদায় বা ব্যক্তি মানুষের উপর অন্যায় আচরণ ও জুলুমকে ইসলাম সমর্থন করে না। মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ্ তায়ালা ইচ্ছা করলে সবাইকে একই ধর্মের অনুসারী বানাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নিজেই যেহেতু মানুষকে বিভিন্ন ধর্ম মতে বিভক্ত করেছেন তাই আমাদের কোন ধর্মের অনুসারীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা মোটেও ঠিক নয়। আমরা যদি সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করি এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালোবাসতে পারি তবেই পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হতে পারে। বাংলাদেশ ও বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধর্ম-বর্ণ-জাতি ইত্যাদি মনোভাবে বিচ্ছিন্ন মানবজাতি ঐক্যবদ্ধ হলেই শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে।

অস্থিরতার মাঝে তারুণ্যের নিয়ন্ত্রণ!


সংলাপ ॥ অস্থিরতা আর তার সাথে আছে অসহিষ্ণুতা। চারপাশে তাকালে মনে হয়, মানুষের মধ্যে ধৈর্য-সহ্য সহানুভূতির মতো গুণগুলো যেন প্রায় হারিয়েই গেছে। সবসময় একটা উগ্রতা, একটা লড়াই-লড়াইভাব সবার মধ্যে। রাজনীতিকরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। অন্যের ভালো দেখলে যেন তাদের বুক জ্বলে যাচ্ছে। সে জ্বালা মেটাতেই সংশ্লিষ্টের সর্বনাশের চিন্তা চড়বড় করে উঠছে তাদের মাথায়! আর তার পরিণতিতেই ঘটে যাচ্ছে অপ্রীতিকর মর্মান্তিক ভয়াবহ সব ঘটনা। যে সহনশীলতা, কোমলতা, মায়া-মমতা দেশে এবং দেশের বাইরে বাঙালিকে একটা আলাদা সুনাম ও স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিল তা আজ কোথায়? আজকের বাঙালির চেহারায়, চরিত্রে, সাজ-পোষাকে, কথায়, হাবেভাবে তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে? সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেও কেমন যেন পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। বদমেজাজ, বেহিসেবীপনা খরচ আর স্বার্থপূরণের উচ্চাশা ঘরসংসার, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব যেন বাড়িয়েই চলেছে। সেই গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো জেগেছে ফেসবুক, ট্যুইটার হোয়াটস আপের মতো হাজারো সামাজিক মাধ্যম! পাশাপাশি বসে ভাবের আদান-প্রদান এবং  কথা বলার অভ্যাসটাই নষ্ট করে দিচ্ছে এইসব যান্ত্রিক ব্যাপার-স্যাপার। এর সঙ্গে অতি প্রগতিশীল বিত্তবাদী হওয়ার ঝোঁক নারী-পুরুষের স্বাভাবিক ও দায়কে অস্বীকার করার প্রবণতা আরও গুলিয়ে তুলছে গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই। সব মিলিয়ে হয়তো আমাদের চিরাচরিত সম্পর্কের বাঁধনগুলোই আলগা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে মানুষের কাছে। নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ, নিজের ইচ্ছে, নিজের সুবিধেটাই বড় হয়ে উঠছে। বাবা-মা ভাই-বোন, স্ত্রী-স্বামীর মধ্যে সমাজ ছাড়িয়ে যে স্নেহ মায়া-মমতার বাঁধনটা ছিল এতদিন, তা শিথিল হয়ে পড়ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসার সম্পর্কগুলো বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। বাবা মায়ের মহিমা, সন্তানের ঐশ্বর্য, শিক্ষকের মান, গুণীর কদর, সহকর্মী, আত্মীয়-প্রিয়জনের গুরুত্ব কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করছি না আমরা। আর তার পরিণতিতে কোথাও অপ্রীতিকর, মর্মান্তিক কিছু একটা ঘটলে খানিক সন্দেহ, সমালোচনা আর পুলিশের ওপর দোষারোপ করে দায় সারছি। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণ বাবা-মা আছেন, দায়িত্বশীল ছেলেমেয়েরা আছে, সহৃদয় সজ্জন মানুষজনেরও অভাব নেই। কিন্তু, সেই ব্যতিক্রমের পর্দা দিয়ে আমাদের আজকের ক্রমবর্ধমান উদভ্রান্তি-অস্থিরতা আর অসহিষ্ণুতাকে আর আড়াল করা যাচ্ছে কী? আমাদের স্নেহ-ভালবাসার সম্পর্কগুলোর স্বাভাবিকতা যথাযথভাবে বজায় আছে জোর গলায় পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন দাবিও কি করতে পারছি আমরা? নাকি আমাদের সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে দিনের পর দিন সংশয়টাই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে? একটু ভেবে দেখার সময় এসেছে ।
তারুণ্য বড় বেগবান। তারুণ্য বড়ই উদ্দাম। সেই তারুণ্য যখন ভ্রান্ত পথে ছুটে যায় কিংবা সেই তারুণ্যের যখন অপব্যয় হয়ে যায় অথবা সেই তারুণ্য যখন মোমের মতো গলে যায়, তখন তা সত্যিই মর্মযন্ত্রণার শামিল হয়।  পরপর এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে মনে হয় এ কি শুধু তারুণ্যের দোষ? নাকি এই সমাজের কোনও অন্ধকার প্রশ্রয় তাদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর পথে! রাজনীতিকদের কোনও নিয়ন্ত্রণহীনতা বা নজরদারির অভাবই এইসব দুঃখজনক অবস্থার উৎস নয়তো?
সাম্প্রতিক অতীতের পরপর ঘটনাগুলোর দিকে তাকালেই তবে দেখা যাবে, তারুণ্যের ভ্রান্তি কিছু অমূল্য প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। তাৎক্ষণিক অ্যাডভেঞ্চারিজমের নেশা তাদের বিপদ ডেকে আনছে। এইসব ঘটনা অবশ্যই এড়ানো যেত। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকদের চোখ-কান খোলা থাকেনি। রাজনীতিকরা প্রকারান্তরে এক ধরনের পশ্রয় দিয়েই তাদের এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, যেখান থেকে সন্তান এবং অভিভাবকদের দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মাদকের প্রভাব আর যৌবনের হঠকারিতা তাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিচ্ছে অনেক দূরে। শুধু শোক এই বিপথগামিতাকে আটকাতে পারবে না। আমাদের আরও কিছু কর্তব্য, আরও কিছু দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। তারুণ্যের দীপ্তি তাদের সবকিছুকে উপেক্ষা করতে শিখিয়েছে। শুধু দৌঁড়ালেই তো হয় না, থামতে শিখতে হয়। কোথাও কোথাও গতি কমাতে হয়। আমরা আমাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দিতে চাই। আধুনিক জীবন দিতে চাই। ভালোভাবে বেঁচে থাকার আরাম দিতে চাই। কিন্তু কখনও নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিই না। প্রশমণের শিক্ষা দিই না। এটাই আমাদের জীবনের এক বিষাদরেখা।
বিগত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বেপরোয়া জীবন-যাপনের ঝোঁক দিনদিন বাড়ছে। গতির জীবন তাদের টানছে। সেইসঙ্গে মাদক আসক্তি কিংবা মাদক গ্রহণের একটা দুর্নিবার আকর্ষণ তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নিয়ম না মানার প্রতি তীব্র আকর্ষণ। হুল্লোড় জীবনের প্রতি টান। তারুণ্যের গতির শেষ ঠিকানা মৃত্যুই। তারুণ্যের জলতরঙ্গ উন্মার্গগামী।
সেই সঙ্গে বলতে হয়, সাধারণ মানুষের  কিছু দায়-দায়িত্ব থেকে যায়। ছোটদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড়রা বহুক্ষেত্রে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এই বিচ্ছিন্নতার অভিশাপ দূর হোক। তারুণ্যের গতি, তারুণ্যের বেগ শুভ কাজে লাগুক। এই বয়সে যেভাবে বিরাট দুঃসাহসেরা উঁকি দেয়, তা তাদের জীবনকে বিপথে না টেনে রঞ্জিত করুক মানবতার পথে এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
সর্বত্রই একটা জাতি। তার মধ্যে ছোট-বড় ভেদের কোনও অর্থ হয় না। মানবজাতির ধর্ম কি? মানবধর্ম। সকলেরই এক ধর্ম মানবধর্ম। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য ইত্যাদি কোন ভেদ এর শাস্ত্রীয় নাম ‘বর্ণ’। ইংরেজ, জার্মান, ফরাসী জাতি এ ঠিক নয়। এসব জাতির ধর্মও আলাদা নয়। মানবজাতির একটাই ধর্ম মানবধর্ম। এ ধর্ম বাদ দিলে সর্বনাশ। আপনি আর মানুষই রইলেন না। একথা যদি বলি শিক্ষা হবে ধর্মহীন, তাহলে বুঝব ঐ শিক্ষায় মানুষ গড়বে না। ছাত্র-ছাত্রীদের মনুষ্যত্ব্ হবে না। শিক্ষায় ধর্ম থাকবে না মানে, এ শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হবেন তারা মনুষ্যত্ব লাভ করবেন না। সাবধান হোন! মনুষ্যত্ব লোপ পেয়ে যাবে। স্টেট হবে ধর্মহীন, তার অর্থ হ’ল স্টেট যে হবে অর্থাৎ যারা শাসন করবেন তাদের কোন ধর্ম থাকবে না। মানুষের মনুষ্যত্ব না থাকার ফলে মানুষ চুরি করবে, মিথ্যা কথা বলবে, পরকে হিংসা করবে, পরের ক্ষতি করবে। অতএব তার জন্য তৈরী হউন। মনুষ্যত্ব বাদ দিয়ে কোন প্রতিষ্ঠান তৈরী করাও যা, অ্যাটম বোমা দিয়ে সব শেষ করে দেয়াও তাই। যারা এসব কথা বলেন তারা হয়ত ধর্ম কি তা বোঝেন না। কি করে বোঝাব বলুন তো? বড় বড় লোক বলছে, তাদের কথাই বা অস্বীকার করি কী করে? বাংলা ধর্ম বলতে যা বোঝায় ইংরেজি ‘রিলিজিয়ান’ তা বোঝায় না। শাস্ত্রের ভাষায় কিংবা মহাপুরুষদের ভাষায় মনুষ্যত্বের দু-তিনটি সংজ্ঞা আছে। সবচেয়ে ছোট সংজ্ঞাটি: ‘অহিংসা সত্যমস্তেয়ং শৌচং সংযমমেব চ।/ এতৎ সামাসিকং প্রোক্তং ধর্মস্য পঞ্চ লক্ষণম্।।’ মনুষ্যত্বের পাঁচটি লক্ষণ হলো চুরি না করা, শুচি থাকা, হিংসা না করা, সংযমী হওয়া এবং সত্যাশ্রয়ী হওয়া। অহিংসার ব্যাখ্যা তো গত ৫০ বছর বিরাট ভাবে হয়েছে। অহিংসার মূর্ত আচার্য জীবন দিয়ে অহিংসার ব্যাখ্যা করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর কথা বলছি। অহিংসার অর্থ মানুষকে হিংসা না করা অর্থাৎ মানুষকে ভালবাসা, মানুষকে শ্রদ্ধা করা, মানুষকে মানুষ হিসাবে সম্মান দেয়া এই তো অহিংসা। হিংসা তো পশুর ধর্ম। রাস্তা দিয়ে একটা কুকুর যাচ্ছে, আপনার বাড়ির কুকুরটি তাকে দেখে ঘেউঘেউ করে উঠল, আশ-পাশ থেকে আট-দশটা কুকুর এসে রাস্তার মধ্যে শুরু করে দিল কামড়া-কামড়ি রক্তারক্তি। এ নিছক কুকুরের ধর্ম। আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, পাশের বাড়ির লোক বেরিয়ে এসে আপনাকে মারতে আরম্ভ করল, ক্রমে বহু লোক লোক জমে বিরাট মারামারি হয়ে গেল। এখন যদি বলি, মানুষগুলো কুকুরের ধর্ম ছাড়তে পারেনি তাহলে খুব অন্যায় হবে কি? মানুষ আজ সভ্যতার গর্ব করে। আকাশে উড়ছি, চাঁদে যাচ্ছি, জলের তলায় মাছের রাজ্য দখল করেছি, কিন্তু রাস্তা দিয়ে মানুষের মত হাঁটতে শিখিনি। মানুষকে মানুষের মর্যাদা, প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে।