বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

হিংসার ধর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে




শেখ উল্লাস ॥ খাঁটি বাংলা শব্দ ধর্ম - অর্থ ধারণ করা। যে যেটা ধারণ করে সেটাই তার ধর্ম। ক্ষমতা বা আধিপত্য কায়েমের জন্য প্রতিপক্ষকে নির্মূল বা নির্মূল করার ষড়যন্ত্র, হিংসা-প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা বাংলার সাধারণ মানুষের ধর্ম-সংস্কৃতি-স্বভাব-আচার-ব্যবহার-এসবের কোনোটাই নয়। গাঙ্গেয় বদ্বীপের এ অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সহজ-সরল-উদার ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী বলেই এখানে অন্যূন পাঁচ হাজার বছর ধরে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনের ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। আজ থেকে প্রায় আট শ’ বছর আগে থেকেই এখানে ইসলামের মর্মবাণী প্রচারের জন্য আরব-ইয়েমেন-ইরান-তুর্কী দেশ থেকে আগত সূফীসাধকগণ ধর্ম প্রচারের উপযুক্ত পরিবেশে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের মানবতা ও সাম্যবাদী আচার-ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি এ অঞ্চলের সহজ-সরল মানুষেরা সহজেই আকৃষ্ট হয় এবং তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এইসব কারণে জীবন চলার পথে এদেশের মানুষের ঐতিহ্যই হচ্ছে তারা অতীব সরল-অল্পতেই তারা তুষ্ট।
কিন্তু কথায় বলে, নদীর জল বা পানি যাই বলি না কেন এর পলির সাথে কাঁকর (কঙ্কর),সাপ-বিচ্ছুও আসে এবং এগুলোই পরিবেশকে দূষিত করে। নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের ওপর বর্ষিত) -এঁর ওফাতের পর থেকে মক্কা-মদীনা-দামেস্ক-সহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি (ইসলাম) ধর্মকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি বানানোর পরিণতিতে যে তা-বলীলা শুরু হয় তার প্রভাব ভারতবর্ষ এবং পরবর্তীকালে বাংলায়ও এসে পড়ে-যাকে এক কথায় এজিদী ইসলাম এবং মুহাম্মদী ইসলাম-এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।  এই উপমহাদেশের এই এজিদী ইসলামই বিগত দুই শতাধিক বছর ধরে বিশ্বে ওহাবী-সৌদী-মওদুদী-তাবলিগী ইসলাম নামে বিশ্বে আধিপত্য বিরাজ করে রেখেছে। দুইশত বছরের ইংরেজ শাসন ও তেইশ বছরের পাকিস্তানী শাসনামলে এই বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এই ওহাবী ইসলাম বিভিন্নভাবে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, এই ইংরেজ ও পাকিস্তানী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ফকির বিদ্রোহ, সন্নাস বিদ্রোহসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে এদেশের মানুষ অংশ নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিশেষ করে ৭১’এর পরাজিত দেশি-বিদেশি শত্রু এদেশের সরকার  ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে তাদের এজেন্টরা এমনভাবে অনুপ্রবেশ করে রেখেছে যে, সময়-সুযোগ পেলেই তারা তাদের টার্গেট পূরণ করে যাচ্ছে। ৭৫-এর ১৫ই আগষ্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ৩ নভেম্বর জাতীয় ৪ নেতা হত্যা, ৭ নভেম্বর দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা-সৈনিক হত্যা, জিয়াউর রহমানের আমলে সেনাবাহিনীতে কু-পাল্টা ক্যু ঘটিয়ে সাধারণ সৈনিক হত্যা এবং ২১ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলাসহ তাঁকে ১৯ বার হত্যাচেষ্টা সবই ছিল এদেশীয় পাকিস্তানী এজেন্টদের ষড়যন্ত্রের ফসল। এইসব ষড়যন্ত্র, হত্যাকান্ড ও নৃশংসতার সাথে এদেশের সাধারণ কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষ কখনো জড়িত ছিল না, বরং পাকিস্তানী এজেন্ট ও সৌদি-ওহাবীদের প্রভাবেই এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবন বিভিন্ন সময়ে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা কখনো চায় না বাংলার মানুষ শান্তিতে থাক, স্বস্তিতে থাক।
বাংলাদেশে পাকিস্তানী-সৌদি-ওহাবীপন্থী এদেশীয় রাজনীতিজীবীরা ক্ষমতার জন্য কত নৃশংস, প্রতিহিংসাপরায়ণ, মিথ্যাচারী হতে পারেন তার নিকট ইতিহাসে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ২০০৪ সালের ২১ একুশে আগষ্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, এর ঠিক আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের সকল নেতা-কর্মীকে হত্যার চেষ্টার ঘটনা। সেই লোমহর্ষক ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ দলীয় অনেক নেতৃবৃন্দ প্রাণে বেঁচে গেলেও বিশিষ্ট নেত্রী বেগম আইভী রহমানসহ  ২৪ জন নিহত এবং আহত হয় বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ। আহতদের চিকিৎসা যেন না হয় সে চেষ্টাও করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এরা সবাই অংশ নিতে গিয়েছিল সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে। রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়, সেখানে রাষ্ট্রের পুলিশ, গোয়েন্দাসংস্থা, সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের সকল যন্ত্র ব্যবহার করে একটি রাজনৈতিক দলকে গ্রেনেড হামলা করে গুঁড়িয়ে দেওয়ার এমন ষড়যন্ত্র পৃথিবীর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে বিরল। অথচ ওই সময় যারা সরকারে ছিল সেই বিএনপি-জামাতজোট তারা তাদের নেতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে প্রচার করে থাকে। কিন্তু এরা গণতন্ত্র ও এই তন্ত্রের মূল্যবোধকে কতটুকু শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তার প্রমাণ তারা আবারও দিয়েছে ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের রায় ঘোষণার পর। এই রায়ের মাধ্যমে আদালত কর্র্র্তৃক তৎকালীন খালেদা-নিজামী সরকারের একজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব, জাতীয় গোয়েন্দাসংস্থার মহাপরিচালক, ডিজিএফআইএর মহাপরিচালকসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হলেও বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে এ নিয়ে কোন বিকার নেই। দুঃখ-প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা, অনুশোচনা, অনুতাপ প্রকাশ করা তো পরের কথা।
বহুদলীয় রাজনীতির নামে ক্ষমতা দখল করার জন্য মানুষ এমন মিথ্যাচার ও জঘন্য কাজ করতে পারে তা এদেশের সহজ-সরল-মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ। পবিত্র কুরআনে আছে, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকো না, আর জেনে-শুনে সত্য গোপণ করোনা’। ১৪ বছর আগে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে যা ঘটেছিল তা দিবালোকের মতো সত্য। কিন্তু সেই সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারের লোকজন সেই সত্যকে বেমালুম অস্বীকার করে এখনো এদেশে রাজনীতি করে যাচ্ছেন,পত্র-পত্রিকাসহ সকল মিডিয়াতে বহাল তবিহতে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন তা এদেশের আকাশ-বাতাস-মাটি-আবহাওয়া-জলবায়ুতে কতটুকু সহ্য হবে তা সময়েই বলে দেবে। তবে, ইতিহাস স্বাক্ষী বাংলার মাটিতে এজিদ- মুয়াবিয়া- মীরজাফর- রাজাকারসহ সকল বিশ্বাসঘাতকের নাম ঘৃণাভরেই উচ্চারিত হয়। মিথ্যাচারী আপাতদৃষ্টিতে যত শক্তিশালীই হোক, তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ঘৃণাভরেই উচ্চারিত হয়। যেমন- এদেশের কেউ নামের আগে এজিদ-মুয়াবিয়া রাখে না, কেউ রাজাকার হিসেবে পরিচয় দিতে চায় না, খন্দকার মুশতাক বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর কিছুদিনের জন্য দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেও চিরকালের জন্য ইতিহাসের এক বিশ্বাসঘাতকের নাম। মার্কিন-পাকিস্তান-সৌদি-ওহাবী মদদপুষ্ট প্রতিহিংসা ও হানাহানি-সংঘাতপূর্ণ তাদের এই রাজনৈতিক ধারা বাংলার মাটিতে কখনো ঠাঁই হবে না। কারণ, দেশটির নাম বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান ও তাদের সহযোগী সকল অপশক্তিকে মোকাবেলা করেই ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভ করেছে। তবে, এদেশের সকল স্তরে অশুভ চক্রের বিভিন্ন এজেন্ট যেভাবে
এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সকল স্তরে দেশপ্রেমিক-প্রগতিশীল-গণমুখী মানুষদেরকে যথাযথভাবে দায়িত্বভার না দিতে পারলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অপকর্মের চিরঅবসান ঘটানো কখনো সম্ভব হবে না বলেই আশঙ্কা থেকে যায়। তাই অবিলম্বে ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলার  বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মাধ্যমে সমাজজীবনে শান্তি-স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে দ্রুতগতিতে। জঙ্গীপনা, ধর্মের নামে উগ্র-সন্ত্রাসী কর্মকান্ড মানুষ আর দেখতে চায় না। বাংলার জলবায়ু-আবহাওয়া পাকিস্তান-আফগানিস্তান-তুর্কী-ইরান বা আরববিশ্বের মতো নয়। হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি করে ক্ষমতার স্থায়ী আসনলাভ এদেশের প্রকৃতিই সমর্থন করে না। এদেশের গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতে হলে হিংসা-প্রতিহিংসার বৃত্ত থেকে বের হয়ে মানুষকে ভালোবাসতে হবে-দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২১আগষ্ট গ্রেনেড হামলার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশে-বাতাসে এই কথাটিই আবারও প্রতিধবনিত হচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন