বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

আগে জন্ম তারপর ধর্ম




সংলাপ ॥ নির্বোধ আর মতলববাজ। চরিত্র বিপরীত! সময়ে অথবা প্রায়শই এ দু’য়ের ভূমিকা হয়ে পড়ে অভিন্ন।  দেশটার নাম বাংলাদেশ। আছে শুধু ভাষা নয়, অভিন্ন কৃষ্টি, অভিন্ন সংস্কৃতি ও অভিন্ন ঐতিহ্য। আছে পাঁচ হাজার বছরের অভিন্ন ভৌগোলিক সামাজিক আর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারও। স্বাধীনতার পর আমরা বিশ্বখ্যাত একটি সংবিধান পেয়েছিলাম। ছিলো তার মধ্যে দেশ ও জাতির জন্য চারটি মূলনীতি ঃ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদের কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সংবিধানে দেয়া হয়নি। যার ফলে আজও এই দুটো নীতি নিয়ে চলছে নোংরা রাজনীতি আর বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি।
তাই মতলববাজরা, জাতিদ্রোহী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারীরা, ১৯৭১ সালের পর ১০ বছরের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা পাঁচ হাজার বছরের বাঙালি জাতির মাথায় সাইনবোর্ড লটকে দিয়েছে বাংলাদেশী জাতি বলে। গায়ের জোরে সাংবিধানিক স্বীকৃতি করিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তা। মূলত বিশ্ববাসী আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখলো এ জাতির উভয় প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার এক নিকৃষ্ট হীন অপচেষ্টাকে। এ অপচেষ্টা হচ্ছে এই জাতির সত্ত্বাকে মুছে দেয়ার, তিন সহস্র বছরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঢেকে ফেলার। যেন ১৯৭১ এর আগে কিছুই ছিলোনা এ জাতির। ’৭১-এ জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ থেকেই এর যেন প্রথম যাত্রা শুরু।
মতলববাজদের এই অপচেষ্টার আড়ালে ঢাকা রয়েছে ওদের ঘৃণিত প্রত্যাখ্যাত চেহারা। ধর্মের নামে তথাকথিত ধর্মকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, সম্প্রদায়গত, কিংবা রাষ্ট্রীয়গত শোষণ, লুটপাট ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা সর্বোপরি কর্তৃত্ব বজায় রাখা। এরাই মুসলমানিত্বের জিকির তুলে ১৯৪৭ সালে ভারতকে খন্ড বিখন্ড করেছিলো, বিভক্ত করেছিলো সমৃদ্ধ বাংলাকে। সৃষ্টি করেছিল বর্বর ধর্মীয় প্রতারণার রাষ্ট্র পাকিস্তান! যে বর্বরতা আজো তাড়া করে চলছে রাষ্ট্রটিকে। মতলববাজ ধর্মব্যবসায়ী ও তাদের প্রভু-গডফাদাররা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মতো আরোও এক উদ্ভট মতলবি তত্ত্ব তৈরী করে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে আর বলে বেড়াচ্ছে, ‘আমরা আগে মুসলিম তারপর বাঙালি’। সত্য চিরন্তন পথের দিশারী। আল কুরআনে সুস্পষ্টভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে একটি জাতির ভাষাকে যার উপর ভিত্তি করে, যাকে কেন্দ্র করেই ওই জাতির অস্তিত্ব এবং এর কৃষ্টি-সংস্কৃতি। ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য’ (১৪:৪), ‘আর তাঁর নির্দশনাবলীর মধ্যে অন্যতম নিদর্শন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে’ (৩০:২২)। জ্ঞানীদের জন্য এরূপ সুস্পষ্ট নিদর্শন থাকলেও তা চোখে পড়ে না রাজনৈতিক ইসলামপন্থী অজ্ঞ নির্বোধদের? আল্লাহ্ যা বলার তা রাখ ঢাক না করেই বলে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘কুরআন আমি তো আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পারো’ (১২:২)। আরও খোলাখুলিভাবে এও জানিয়ে দিয়েছেন, ‘এইভাবে আমি তোমার উপর আরবি ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি সতর্ক  করতে পারো নগর অধিবাসীদেরকে ও তার আশে পাশে যারা বাস করে তাদেরকে আর সতর্ক করতে পারো সমবেত হওয়ার দিন সম্পর্কে, যার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই’ (৪২:৭)। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতারই প্রতিফলন দেখা যায় আরবীয়দের মাঝে। তারা নিঃসংকোচে পরিচয় দেয় নিজেদের আরবীয় হিসাবে। আশির দশকের  কথা, আরব নিউজ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন সৌদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা আগে আরব, তারপর মুসলমান’। অথচ এই সৌদীদেরই ‘ফেৎরা-ভোগী’ এদেশীয় ধর্মবেত্তা মতলববাজরা ষাট দশক ধরে  চিৎকার করে বাঙালিকে বোঝাবার চেষ্টা করে বলে চলেছে, ‘আমরা আগে মুসলমান তারপর বাঙালি’!
এদেশের প্রায় ১৫ কোটি বাঙালি মুসলমান। ঠেকে-ঠকে জেনেছে উপলব্ধি করেছে মুসলমানিত্ত্ব তাদের প্রথম পরিচয় নয়- বাঙালিত্ত্বই তাদের প্রথম পরিচয়। অক্ষমতা নির্বুদ্ধিতার বলেই হোক আর বিভ্রান্তির কবলে পড়েই হোক - যারা বলতে চায় আমরা আগে মুসলমান তারা নিজের অজান্তেই নিজেকে জাতিকে কুলাঙ্গারে পরিণত করে তুলেছে -পরিণামে হয়ে উঠেছে জাতিদ্রোহী এমনকি ধর্মদ্রোহীও!
তাই এখনো সময় আছে। নিজেকে চিনুন। মা-মাতৃভাষা-মাতৃভূমিকে চিনুন। নিজের সংস্কৃতিকে চিনুন তাহলে যে ধর্মাবলম্বীই হোন না কেন তা সঠিকভাবে ধারণ-লালন-পালন করে সত্যকার ধার্মিক হতে পারবেন। নচেৎ শুধু অন্য ভাষায় লেখাপড়া করে তোতা পাখির মতো বুলি পড়ে ধর্ম পালন করলে নিজেকে নিজেই প্রতারণা করবেন। সুতরাং সত্যের পথে আসুন এবং শান্তির (ইসলাম) ঝান্ডা তুলে ধরুন যাতে ওই ঝান্ডা হেলে না পড়ে এবং দেশও বাঁচে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন