বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ'



'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ'

সংলাপ ॥ বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার এখন হরতাল-অবরোধ। অতীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে হরতাল দেয়া হতো। আর এখন শুরুতে হরতাল, মাঝখানে হরতাল, শেষেও হরতাল। ২৪ অক্টোবরের পর থেকে বিরোধী দলের অবরোধ-হরতালে হত্যা করা হয়েছে ১৭০ জন মানুষ। আহত হয়েছে শত শত। নিহতদের অধিকাংশই নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ। শুধু কি মানুষ মরেছে? চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে  দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। গত ২ দশকের অর্থনৈতিক অর্জন ২ মাসে মলিন হয়ে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবাহ। গার্মেন্টস সামগ্রী রপ্তানি ও রেমিট্যান্স হ্রাস পেয়েছে আশংকাজনকভাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ উভয়ই বিঘ্নিত হচ্ছে। সহিংস আন্দোলনের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ঝুঁকির মধ্যে আছেন দেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সমাজ।
আইএমএফ-এর চলতি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে সাড়ে ৫ শতাংশে। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এ ধরনের পতন এর ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল্‌স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) হিসেবে গত জানুয়ারি  থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সেই বিনিয়োগ এখন তাদের গলার ফাঁস হয়ে গেছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। আবার উৎপাদনও বন্ধ করা যাচ্ছে না। কিছু দিন আগে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইর জরিপে প্রতিদিনের হরতালে ২ হাজার  কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে জানানো হয়। বিটিএমএর  হিসেবে, প্রতি মাসে ১২ হাজার ট্রাক লাগে শুধু বস্ত্র খাতের তুলা ও সুতা পরিবহনে। অথচ এখন ট্রাকের মালিকেরা ভাড়ায় যেতে চান না। হরতাল অবরোধের সময় সরকার রপ্তানি পণ্য বোঝাই ট্রাক বন্দর পর্যন্ত যেতে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করলেও তাকে ঝুঁকিমুক্ত মনে করেন না ট্রাক মালিকেরা। অবরোধের মধ্যে অনেক পণ্যবাহী ট্রাক জ্বালিয়ে  দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই তা অব্যাহত রয়েছে। ফলে কোন কোন মালিক ঝুঁকিতে ট্রাক চালালেও ১৫ হাজার টাকার ট্রাক ভাড়া এখন এক লাখ টাকা হাঁকছেন। ফলে তুলা আনা যাচ্ছে না। উৎপাদিত সুতাও এখন তৈরি  পোশাক কারখানায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। কীভাবে এর সমাধান হবে জানা নেই কারোরই। এ অবস্থা আর কিছুদিন চললে অনেক শিল্প-কারখানাতেই তালা ঝুলবে।  বেকার হবে লাখ লাখ শ্রমিক।
রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের শিল্পঋণে। আগের সব রেকর্ড ভেঙে এবারই প্রথমবারের মতো ব্যাংকের শিল্পঋণের পরিমাণ কমেছে। অন্যদিকে এ খাতে বেড়েছে  খেলাপি ঋণের পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে শিল্প খাতে মোট ৩৩ হাজার ৪১ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে বিতরণ হয়েছিল ৩৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। একই সময়ের তুলনায় এ খাতে ঋণ কমেছে ১ হাজার ৫১৩  কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর একই সময়ের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে সামপ্রতিক সময়ে শিল্প খাতে বড় ঋণের চাহিদা কমেছে। এর প্রভাবে সামগ্রিকভাবে শিল্প ঋণের পরিমাণ কমে গেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফায়ও  লেগেছে চরম আঘাত।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি ব্যবসায়ীরা। তিল তিল করে গড়ে  তোলা সম্পদ যেমন পুড়ছে, সেই সঙ্গে ব্যবসা না হওয়ার কারণে সুদ  বেড়ে ঋণের বোঝাতে পরিণত হচ্ছে। রাজনীতির নামে এখন দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। দেশের পোশাক শিল্প এখন অগ্নিকুন্ডে ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হরতাল ও অবরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের অর্থনীতি জ্বলছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানুষ না খেয়ে মরবে। কী নিয়ে রাজনীতি করবেন রাজনীতিকরা?
৭১'র পরাজিত শক্তি দানবরূপে আবির্ভূত হয়ে পাল্টে দিয়েছে হরতাল-অবরোধের সংজ্ঞা। হরতাল-অবরোধ মানেই এখন দানবীয় তা-ব, অগ্নিসংযোগ, বীভৎস হত্যা-খুন, নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ ও ব্যভিচারী নৈরাজ্য সৃষ্টি। আন্দোলনের নামে এখন যা ঘটছে তা সভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম বর্বরতা। আতঙ্কে ঘরবন্দী হয়ে বসে থাকা মানুষের অসহায়ত্বকেই রাজনৈতিক দলগুলো বলছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ হরতাল পালন করেছে।
সামপ্রতিক হরতালরোধে বর্বরতার যে চিত্র দেখা যায়, কোন সভ্য দেশে এর নজির নেই। হরতালকারীরা বর্বরতার চরম মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। কিশোর মুনিরকে গান পাউডার দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে তার বাবার সামনে।  শাহবাগে বাসে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে ১৯ জনকে। কোন মানব সন্তান কি এমন পৈশাচিক কাজ করতে পারে? অথচ এসব পশু একের পর এক নির্বিঘ্নে ঘটিয়ে চলছে এমন নারকীয় কা-। নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা কখনই একটি সভ্য  দেশের কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হতে পারে না।
৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তার এ দেশীয়  দোসর জামাত, রাজাকার-আল বদর, আল শামসসহ অন্যরা যে পৈশাচিকতা এ দেশে চালিয়েছিল ঠিক একই নারকীয় তান্ডব আজ হরতালের নামে চালানো হচ্ছে সারা দেশে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য স্বাধীনতার পক্ষশক্তিকে ধ্বংস করা। হরতাল-অবরোধ, আগুন দিয়ে যারা মানুষ হত্যা করছে, গাছ কাটছে, জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংস করছে, তারা আসলে পাকিস্তানের এজেন্ট।  দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া সাধারণ মানুষের গত্যন্তর থাকে না। যারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, তারা আজ হোক আর কাল হোক জেগে উঠবেনই। কবির ভাষায়, 'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ'। এই ঋণ একদিন কড়ায়-গন্ডায় অবশ্যই শোধ করিতে হইবে। ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের জন্য কঠিন মূল্য দিতে হবে।
সরকারের উচিত হরতাল-অবরোধ  প্রতিরোধের জন্য সর্বস্তরের মানুষকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো। নিশ্চয়ই সরকারের আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিবে এদেশের ছাত্র শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সর্বস্তরের জনগণ। এখনই সময় হরতালের বিরুদ্ধে গণভোট অনুষ্ঠানের এবং একটি আইন পাস করার। আইন অমান্যকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে এতে। বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনীতির কবর দিতেই হবে, নইলে ঋণ শোধ হবে না। আর এ কাজটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করা সময়ের দাবী।

রাজনীতি থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে




সময়ের সাফ কথা ....
রাজনীতি থেকে ধর্মকে

সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে

সংলাপ ॥ সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপ দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখতে সেমিনার, সভা-সমাবেশ ও প্রকাশনার মাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে আসছে। ইসলামের মতো মহান ধর্মকে ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা পরিণত করেছে তাদের আত্মস্বার্থ হাসিলের ধর্মে। বর্তমান সংলাপের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে বলা হয়েছে - রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার চলতে থাকলে বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটতে পারে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্কের। এমনকি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বও পৃথিবীকে এক নারকীয় অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
গত শুক্রবার ঢাকায় সফররত কানাডিয়ান সংসদীয় প্রতিনিধি দলও বলেছেন - রাজনীতি থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে প্রতিনিধি দলটি। গত শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানানো হয়। অপরদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর নির্যাতন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
কানাডাভিত্তিক ধর্ম ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ওয়ান ফ্রি ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল'র পক্ষ থেকে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর নির্যাতন সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ শেষে শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিনিধি দলটি। কানাডিয়ান সংসদের চার সদস্যের প্রতিনিধি দলটি বেসরকারীভাবে ঢাকায় সফর করেন। এই প্রতিনিধি দলে রয়েছেন কানাডিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য ও মানবাধিকার সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মাজিদ এল-শাফি, ব্র্যাড বাট, জ্য এ্যাস্পিন ও স্যাম পিট।
ঢাকায় পৌঁছে প্রতিনিধি দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করে। তবে জামাতের  সঙ্গে কোন বৈঠক করেননি প্রতিনিধি দলটি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজনীতি করবেন রাজনীতিবিদরা। আর ধর্ম পালন মানুষের একটি ব্যক্তিগত বিষয়। রাজনীতি এবং ধর্ম আলাদা থাকা উচিত। যখন ধর্ম ও রাজনীতি এক হয়ে যায়, তখন সহিংসতার আশংকা বেড়ে যায়।
বিএনপির সঙ্গে জোট বাধা জামাতের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রতিনিধি দলটি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন, ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা মানুষের আবেগের অপব্যবহার করছে, তারা যে কোন সময় প্রতিঘাতের শিকার হতে পারে।
আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে প্রতিনিধি দলটির সদস্যরা বলেন, আমরা সরকারী কোন প্রতিনিধি দল নই। আমরা বাংলাদেশের সরকারের পক্ষেও নই। বিরোধী দলের পক্ষেও নই। আমরা কেবল নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এসেছি। আর নির্বাচন কেমন হবে সেটা এদেশের রাজনীতিবিদ এবং জনগণই ঠিক করবেন।
সংখ্যালঘু ধর্মীয় সমপ্রদায়ের ওপর সহিংস হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে কানাডিয়ান এমপিরা বলেন, এ ধরনের সহিংস হামলা বেড়েই চলেছে। এসব হামলা বন্ধ করতে রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করতে হবে। তাহলেই কেবল সকল সমপ্রদায়ের মানুষের অধিকার সংরক্ষিত হবে। তারা বলেন, ধর্মীয় উগ্রবাদ শুধু সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের জন্য নয়, বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্যই ক্ষতির কারণ।
বাংলাদেশ এখন সঙ্কটময় মুহূর্ত পার করছে উল্লেখ করে প্রতিনিধি দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এ মুহূর্তে ধর্মীয় উগ্রবাদ চরম আকার ধারণ করতে পারে, এই ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলায় প্রত্যেক মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কেউ যদি সত্যিকার ও আধুনিক মুসলমান হয়, তাহলে তার উচিত হবে নীরবতা পালন না করে সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের ইতিহাস সমৃদ্ধ। এদেশের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। একই সঙ্গে এদেশের মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতায়ও বিশ্বাসী। তবে বিপরীতে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সমপ্রদায়ের  লোকজনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকের সংখ্যাও এদেশ থেকে কমে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হলে সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের অধিকার নিশ্চিত হবে।
বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর কানাডিয়ান মানবাধিকার সংগঠক ও এমপিদের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিবৃতিতে বলা হয়, তারা বিএনপির প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছেন, এখনকার জামাতে ইসলাম এবং পূর্বেকার জামাতে ইসলাম এক নয়। এখনকার জামাতে ইসলাম অনেক বেশি সহিংস।

প্রসঙ্গঃ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সাংসদ



প্রসঙ্গঃ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সাংসদ

আল্লামা নূরী ॥ গণতন্ত্র মানে জনগণ দ্বারা জনগণ থেকে জনগণ কল্যাণে নির্বাচিত সরকার। আপাততঃ এটাই গণতন্ত্র'র স্বীকৃত সংজ্ঞা। এ হিসাবে নির্বাচন ও গণতন্ত্র মুদ্রার এপীঠ-ওপীঠ। সুতরাং নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র'র অবর্তমানে নির্বাচন কল্পনা আকাশে কুসুম রচনা অথবা ডুমুরের ফুল কামনার শামিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐকমত্য গণতন্ত্রের যেমন অন্যতম স্বীকৃত মূলনীতি তেমনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াও গণতন্ত্রের অন্যতম স্বীকৃত নীতি; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়সহ দেশীয় ও দলীয় পর্যায়ে এর প্রচুর উদাহরণ রয়েছে।
বলাই বাহুল্য যে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ গণতন্ত্র'র বিধানে সর্বত্রই সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হিসাবে সাধারণভাবে বিবেচ্য ও গৃহীত। এমতাবস্থায়, প্রয়োজনে ভোট গণনায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, নির্বাচন কেন্দ্রের ভোটগুলো সাধারণ নিয়মে অবশ্যই নির্বাচনের পক্ষে গণ্য হবে; কারণ:
১। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বা অংশগ্রহণে আইনি বা সরকারি কোন বাধার প্রমাণ নেই;
২। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা অংশগ্রহণ করা বা না করার অধিকার নির্বাচকম-লীর গণতান্ত্রিক অধিকার, তবে ঐচ্ছিক।
৩। প্রত্যেক ভোটার কোন প্রার্থীকে 'না' ভোট দেয়ার অধিকারী এবং
৪। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ভোটকেন্দ্রের ভোট বা ভোটাংশ নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে গণনা করার পক্ষে নিছক অনুমান ছাড়া কোন আইনি তথ্য বা ভিত্তি নেই। সর্বোপরি, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি বা মনোনয়নপত্র দাখিল করেও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তারাও অবশ্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় 'নির্বাচিত'র পক্ষে; অন্ততঃ মৌন সমর্থক; এ নিয়ে বিধানিক ভিত্তিহীন অনর্থক বিতর্ক হতে পারে, গণতন্ত্রে অনুরূপ বিতর্কের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
এমতাবস্থায়, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ভোটকেন্দ্রের ভোটগুলো নিঃসন্দেহে নির্বাচনের পক্ষেই গণ্য, এর অন্যথা গণতান্ত্রিক নীতি-বিধি বহির্ভূত।
তবে, যে কোন নির্বাচিত সদস্যর একমাত্র প্রতিবিধান হতে পরে সংশ্লিষ্ট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের লিখিত অনাস্থা বা তাহার উপর থেকে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার; তা না করা পর্যন্ত তিনি নির্বাচিত সদস্য বা সাংসদ এবং ভোটারগণ তার সমর্থক বই নয়।

সংসদ অধিবেশন ও নির্বাচনে যোগ না দেয়া কোন্‌ ধরনের গণতন্ত্র ?



সংসদ অধিবেশন ও নির্বাচনে যোগ
না দেয়া কোন্‌ ধরনের গণতন্ত্র ?

সংলাপ ॥  নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদ অধিবেশনে যোগ না দেয়া, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়া কোন্‌ ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার? এসব কি গণতন্ত্র-পরিপন্থী কাজ নয়?  একটি দেশে রাজনীতি করতে হলে সংবিধানের বাইরে কি যাওয়া যায়? নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা অথচ সংশ্লিষ্ট এলাকা ও জনগণের সুখ-দুঃখের সাথী না হয়ে বরং আন্দোলনের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে ভূমিকা রাখা কোন্‌ ধরনের রাজনীতি?
সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোট ছাড়া অন্য কোন উপায় আছে কি? প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় এবং এর আগে নবম জাতীয় সংসদের অধিকাংশ আসনে এই দলের সদস্যদের অনুপস্থিতির ঘটনায় এইসব প্রশ্ন আজ অত্যন্ত জোড়ালোভাবেই দেখা দিচ্ছে দেশের সচেতন ও বিবেকবান মহলে। দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এবং নবম সংসদের অধিকাংশ আসনে অনুপস্থিত থেকে বিএনপি প্রমাণ করেছে যে, তারা সংবিধানকে থোরাই তোয়াক্কা করে।
নবম জাতীয় সংসদে ছিল মোট ৪১৮ কার্যদিবস, যা দেশের সংসদীয় ইতিহাসে রেকর্ড। বিল পাসের ক্ষেত্রেও এ সংসদ রেকর্ড করেছিল। মোট পাস হওয়া বিলের সংখ্যা ২৭১। তবে বিরোধী দলের অর্থাৎ, বিএনপির এক্ষেত্রে রেকর্ডটি ছিল  বিপরীত দিক দিয়ে। নবম জাতীয় সংসদে বিরোধী দল অনুপস্থিত ছিল ৩৪৬ কার্যদিবস, উপস্থিত ছিল মাত্র ৭৬ কার্যদিবস।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জামায়াতী-হেফাজতীদের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়ে  অনেকবার সরকারকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে এখনো সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করেননি, তার দলের কোনো সদস্যও পদত্যাগ করেননি জাতীয় সংসদ থেকে। আন্দোলন-সংগ্রামে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, জনগণকে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে, তাদেরকে কাছে টানতে যেভাবে জনগণের দাবি-দাওয়ার সাথে একাত্ম হতে হয় তার কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বরং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের যে আন্দোলন, তার চাইতে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবীটি আরও অনেক বেশি জোড়ালো বলে তারা প্রমাণ করছেন তাদের তাবৎ 'রাজনৈতিক' কর্মকান্ডে। বিরোধী দলীয় নেত্রী ও তার দলের সমর্থন ও যোগসাজসে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা দেইল্লা রাজাকারদের মুক্তির দাবিতে ব্যানার-ফেষ্টুন, শ্ল্লোগান দিয়ে বিজয়ের মাসে কলঙ্কিত করা হয়েছে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত পূণ্যভূমি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে। তাদের মুখে ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীর আন্দোলন, কিন্তু অন্তরে ছিল অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দিবাস্বপ্ন ! বিএনপির মতো একটি বড় দলের সহযোগিতা ও সমর্থন না পেলে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে কখনো এমন সাহস জামায়াত দেখাতো পারতো কি ? নিশ্চয়ই পারতো না।
পবিত্র কুরআনের ৫ নম্বর সূরার ৩২ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা আছে,  যে ব্যক্তি কোনো মানুষকে হত্যা করলো, কোনো হত্যাকান্ড কিংবা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টির জন্য বিচারে শাস্তি বিধান ছাড়া, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করলো'। অথচ গত দু'মাসে কতগুলো নিরীহ মানুষকে মরতে হলো! ২৪ অক্টোবর খালেদা জিয়া বললেন, আজ থেকে শেখ হাসিনার সরকার অবৈধ। কিন্তু তিনি বা তার দল বা জোটের কোনো সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেন না। ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় দশম সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোনে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে ৬০-ঘন্টার হরতাল প্রত্যাহার করে গণভবনে আসার আমন্ত্রণ জানালে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, হরতাল প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। বিরোধী দলের সেই হরতালেই ঝরে যায় ১৯টি তাজা প্রাণ। এরপর থেকে সংসদ কার্যকর থাকা অবস্থায় সারা দেশে সহিংসতা চলতেই থাকলো। ২৪ অক্টোবরের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিরোধী দলের অবরোধ হরতালের বলি হয়েছে প্রায় ১৭০ জন মানুষ। আহত হয়েছে শত শত। নিহতদের অধিকাংশই নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক।
এসব হত্যাকান্ডের দায় কে নেবে? বিগত পাঁচ বছরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার মতো বহু ইস্যু বিরোধী দলের ছিল, সরকারের অনুগত বিভিন্ন মহলের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে বিরোধী দল আরও অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারতো যা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাজে লাগানো যেতো। কিন্তু জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে কোনো কিছুই করতে দেখা গেলো না বিরোধী দলকে। কিন্তু জনগণকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল তা যখন বাস্তবায়ন করতে গেল তখনই তারা জামায়াত হেফাজতকে লেলিয়ে দিল সরকারের বিরুদ্ধে। খালেদা জিয়া সরকারের প্রতি আল্টিমেটাম দিলেন হেফাজতিদের অন্ধকার যুগের দাবি মেনে নেয়ার। কিন্তু সংসদ থেকে পদত্যাগ করার মতো সাহস দেখাতে পারলেন না। কিন্তু এরপর কোনো সংসদ অধিবেশনেও যোগ দিলেন না।
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে আবারো নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের প্রতি দায়বদ্ধ, ওরা চিরদিনই পাকিস্তানের দালাল। যে কারণে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাসের মতো ধৃষ্টতা তারা দেখাতে পেরেছে। তালেবানরা ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাই কমিশন উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। তাই রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে আরো বেশি শক্তি অর্জন করতে হলে নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে বলে মনে করছে জনগণের প্রতি বিশ্বাসী জনশক্তি। লাখো শহীদের তাজা রক্ত আর অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকার তথা পাকিস্তানপন্থীদের রাজনীতির দিন চূড়ান্তভাবেই শেষ হয়ে এসেছে। পাকিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষেরা । নতুন করে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে           প্রজন্মের মধ্যে।