মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩

বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মজিজ্ঞাসা - এখনো কেন জ্বলছে আগুন, মরছে মানুষ?



বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মজিজ্ঞাসা -
এখনো কেন জ্বলছে আগুন, মরছে মানুষ?

সাদিকুল হক ॥ এটা কি সেই বাংলাদেশ যার জন্য এদেশের জনগণ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল? এই কি সেই বাংলাদেশ যার জন্য লাখ লাখ মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল? কোথায় সেই বাংলাদেশ যেখানে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে জনগণ আর শাসকগোষ্ঠী দ্বারা শোষিত হবে না, যেখানে সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ ঘটবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে বলে আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম?
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি পৃথক জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের জন্য ছিল না। এ দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র তথা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন নিশ্চিত করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। কিন্তু গত ৪২ বছরে কী গণতন্ত্র উপহার দিয়েছেন আমাদের রাজনীতিকরা?
দুইটি দলের ক্ষমতার লড়াইয়ে জনসাধারণ পিষ্ট হচ্ছে। জাতীয় জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রেই অগ্রগতি ও উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। এজন্যই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম?
গণতন্ত্র, আইনের শাসন, উন্নয়ন, জনজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই, সেখানে জনগণের সার্বিক উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত ৪২ বছরে কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই কিন্তু যেখানে আমাদের সীমাহীন ব্যর্থতা ও পরাজয় কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না সেটা হচ্ছে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তাহীনতা ও ন্যায়বিচারের অভাব। প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হচ্ছে, পুড়িয়ে মানুষ মারা হচ্ছে নৃশংসভাবে অথচ কোন বিচার নেই! রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থের বেদিতে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের অধিকারকে যখন এমনিভাবে বলি দেয়া হচ্ছে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে - এজন্যই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম?
জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা আজ মূর্ত হয়ে ওঠেছে। একাত্তরে ১৬ ডিসেম্বরে এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। আমরা সবাই ছিলাম মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর পদলেহি হয়ে কাজ করেছিল এদেশের মুষ্টিমেয় যেসব দালাল, তাদের সবাই সেদিন আত্মগোপন করেছিল জনরোষের ভয়ে, রাজাকার নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ জাতি হিসেবে আমরা বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আমরা একে অপরের পরম শত্রু হয়ে পড়েছি, যা দারুণভাবে শান্তি বিঘ্নিত করছে। প্রতিহিংসা ও আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি আমাদের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করে দিয়েছে। দাউ দাউ জ্বলছে আগুন বাসে, ট্রেনে। হিংসা আর সংঘাতের বিস্তারে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এত হানাহানি, এত বিভেদ, এত বিভাজনের জন্যই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম?
বিজয়ের মাসে এক নিদারুণ গ্লানি আমাদের পীড়া দেয় যখন শুনি একাত্তরের পরাজিত শক্তির হুঙ্কার। বিএনপির পিঠে সওয়ার হয়ে দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ করছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা। তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা দেশ, পুড়িয়ে মারছে মানুষ একাত্তরের মতোই, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-বোমা মেরে-গুলি করে তারা আবার বাংলাদেশ দখল করে নিতে চায়। এতেই প্রমানিত হয় যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।
জামাত - শিবির যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু তবুও নিষিদ্ধ হয় নি তাদের কর্মকান্ড। তাই তারা পারছে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী তান্ডব চালাতে।  জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে বাসে, গাড়িতে, ট্রাকে আগুন দিচ্ছে। অযৌক্তিক রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে বিভিন্ন স্থানে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এখন পর্যন্ত আমরা বহুবার তাদের বীভৎসতা দেখেছি, নিরীহ জনগণ বারবার এ ধরনের বীভৎসতার শিকার হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই তথাকথিত আদর্শের প্রতি ছিটেফোঁটা সমর্থনও সাধারণ মানুষের নেই। জনসমর্থন থাকলে কোনো দল বা সংগঠনকে এমন উগ্র জঙ্গিবাদী তৎপরতার আশ্রয় নিতে হয় না। জনসমর্থন কমলে বা শূন্যে নেমে গেলেই তথাকথিত আদর্শে অন্ধ বিশ্বাসীরা জ্ঞানশূন্য হয়ে মানুষকে আর মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। আর এই গণ্য না করা থেকেই তারা অন্য মানুষের প্রতি নৃশংস ও নিষ্ঠুর আচরণ করতে দ্বিধা করে না।
স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তিকে আর কোনো ছাড় দেওয়া উচিত হবে না। তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। তাদের জানিয়ে দিতে হবে, বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ ও উগ্রপন্থার কোনো স্থান নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে একসঙ্গে এই অপশক্তির মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। সরকারে উচিত হবে মুক্তবুদ্ধির ও প্রগতিশীল সব মানুষকে নিয়ে জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার কাজটি এগিয়ে নেওয়া। যার যার অবস্থান থেকে আমাদেরও প্রতিবাদ জানাতে হবে। যেমনটি ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষ দলমত-নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী শক্তিকে যে কোন মূল্যে প্রতিহত করতেই হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন