মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মানুষ চায় রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন

মানুষ চায় রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন

মহিবুল্লাহ বাদশা ॥ হরতাল চলছে, তার উপর বৃষ্টি এই আসে এই যায় বিদ্যুতের মতোই। তারপরও জেলা শহরটিতে রিক্‌শা কিংবা ইজিবাইক জাতীয় গাড়ি বেশ চলছে। মানুষজন তাদের নিয়মিত কাজে ছুটছেন। শুধু শহরের দোকানপাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সাটার সামান্য খুলে ভিতরে বসে আছেন। বাণিজ্যে সুবিধা হবে না তারা তা জানেন কিন্তু ঘরে বসে থাকতে কার ভালো লাগে? প্রতিদিনের অভ্যেসকে চট্‌ করে বস্তাবন্দী করে থিতু হয়ে বসাটা কী সহজ? তার উপর পেটের দায় তো থাকেই। হরতাল ঘোষকরা সে কথা চিন্তা করতে মোটেই প্রস্তুত নয়। ক্ষমতা হারিয়ে এতটা বছর ধরে রাজপথে মহড়া দিয়েও ক্ষমতার নাগালটি তাদের অধরাই থেকে গেলে নিদারুন মনকষ্টে, তাই মাঝে মাঝে তাদেরকে জানান দিতে হয় তারা আছেন রাজনীতির মাঠে। ক্ষমতাসীনদের অবশ্য কিছু যায় আসে না, তারা বেশ ভালো করেই জেনে গেছেন জনগণ থেকে তারা যেমন বিচ্ছিন্ন আছেন তেমনি তাদের বিরোধীরাও। পাঁচ জানুয়ারি ইতোমধ্যেই তারা হালাল করতে না পারলেও হাতের মুঠোর বাইরে যেতে দিচ্ছেন না কোন রকমই। তাই তারা সংবিধানের দোহাই ছেড়ে দিয়ে সংবিধানটিই পরিবর্তন করে নিয়েছেন। এই সংশোধনী প্রতিরোধ করতে হরতাল দিয়েছে বিএনপি।
দেশের মানুষ ইতোমধ্যে জেনে গেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারকদের ঠিক সময় মতো লাল কার্ড দেখিয়ে সংসদ তাদেরকে
বিদায় জানাতে পারেন সেই ক্ষমতা এখন সাংসদের হাতে। এরকম একটি আইনের পায়তারা থেকে বিদগ্ধজনেরা নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন এমনটি না করার জন্য কিন্তু তারা শোনেননি। কেন শুনতে যাবেন? তারা তো দেখেছেন তাদের ইচ্ছাই গণতন্ত্র। সে ইচ্ছাকে তারা যেভাবে খুশি সাজাতে পারেন, পাঁচ জানুয়ারি থেকে সে ইচ্ছার কোন ব্যত্যয় তো ঘটেনি। বিচারকদের নিয়ে আইনটি বেশ জটিল যেটি এখন তারা সংবিধানে জুড়ে দিলেন তাতে সংবিধানের যে একটি ধারালো শিং গজিয়ে গেলো সেটা নিশ্চিত করেছেন দেশের বিজ্ঞ আইনবিদরা। সেই শিং এর গুঁতো খেয়ে কখন কোন্‌ উচ্চ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ভূলুন্ঠিত হবেন সেটি দেখার অপেক্ষা আমরা করতেই পারি।
তবে এই আইনের ফলে আরও দুইটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যে আইনগত স্বাধীনতাটুকুও  হারালেন,  কলাম লেখক মিজানুর রহমান খান সেটি দেখিয়েছিলেন বেশ কয়েকদিন এই বিষয়ের আলোচনা প্রসংঙ্গে। কিন্তু তাতে ক্ষমতাসীনদের কিছু যায় আসে না। তারা জানেন নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের পরে উচ্চ আদালতের ঝাঁপিয়ে পড়ার
মতো সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি কিংবা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার দখল উদ্ধারে বার বার আদালতের লম্বা নাকের উপস্থিতি কোন রকম স্বস্তি দেয় না। আরও জটিলতা আসতে পারে সরকারে থেকে বিরোধী সাজবার নৈতিকতার প্রশ্ন নিয়ে কিংবা দেড় শতাধিকের ফ্রি নির্বাচনের উদ্ভট গণতন্ত্রের সাংবিধানিক নৈতিক বাস্তবতার প্রশ্নে। সে যাই হোক ক্ষমতার ইচ্ছাই শেষ ইচ্ছা, তাকে যারা মানতে নারাজ তাদেরকে আইনের শৃঙ্খলে রাখাটা একান্ত জরুরি।
সাত মাস পরে বিএনপি জোট হরতাল কর্মসূচি দিয়ে মাঠে এসে এই অগণতান্ত্রিকতাকে প্রতিরোধ করতে চাইছে, কিন্তু জনগণ বরাবরের মতো সাইড লাইনে। পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে তাদের আন্দোলনে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ছিলেন সেই নির্মম বর্বরতার দৃশ্য সাধারণের অন্তর থেকে মুছে যায়নি। তা কোনদিন মুছবে মনে করাটা ভুল হবে। রাজনীতির চরিত্র নিয়ে এখানেই এক বিশাল প্রশ্ন সাধারণ মানুষের কাছে। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেয়ার রাজনীতি আর কতো! তারাতো সেখানেই আছেন ক্ষমতা হারাবার সময় যেখানে ছিলেন, সেই যুদ্ধপরাধী, মৌলবাদ আর দুর্নীতিবাজদের নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচি। হাওয়া ভবনের অদৃশ্য হাতে দৃশ্যায়ন অনেকেরই মানস পটে জ্বল জ্বল করছে। তাহলে ক্ষমতা ফিরে পেলে আবার সেখানেই ফিরে যাওয়া, এমনটা হলে কী দরকার জানবাজি রেখে আন্দোলন করা?

ঢাকা শহরে বসে মিডিয়ার সামনে গলা ফুলিয়ে বক্তৃতা দিয়ে কিংবা লণ্ডনে বসে ক্ষুদে ঐতিহাসিক হবার নয়া বাসনায় এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মনের নাগাল পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই সামান্য। সুতরাং সাধারণ মানুষ এখন চায় রাজনীতির আমূল পরিবর্তন এবং তা গুনগত। বার বার ওঠা নামায় তারা রাজনীতিকদের চিনে ফেলেছেন, জোব্বা টুপি আজকান চাপকান আর স্বার্থের কোট যে আর গণতন্ত্রের মুক্তি আনতে সক্ষম নয় বরং ফ্রাংকেষ্টাইনের দৈত্যদের হাতে রাজনীতিকে বন্ধক রেখে সকলেই যে দেশ উদ্ধার করেন তা বোঝার জন্য কাউকে আর ডক্টরেট করার প্রয়োজন হয় না। সংবিধান এবারই যে মর্যাদা হারিয়েছে তাতো নয়। সাড়ে চার দশকের ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে বহুবারই তার চেহারার পরিবর্তন এসেছে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণের জন্য। গণতন্ত্রবিহীন  রাজনীতির হাত এমনি করেই জন অধিকারকে লুট করে।

সময়ের সাফ কথা .... গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখা জরুরি

সময়ের সাফ কথা ....
গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখা জরুরি

শামসুর রহমান ॥ গত ১৫ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর 'আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত হয়। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের প্রস্তাবে বলা হয়, গণতন্ত্রের কোনো একক মডেল নেই। কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট সীমানায় আবদ্ধ না থেকে সার্বত্রিক বিরাজমানতা বজায় রেখেছে। গণতন্ত্রে জনগণ নিজেরাই নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছার বহি:প্রকাশ হিসেবে নিজ নিজ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এর সাথে সাথে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার গুলোর প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে সাধারণ মানুষের মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। গণতন্ত্র কি শুধুই নির্বাচন নির্বাচন খেলা না আস্থা অনাস্থার জায়গাও কিছু বাকি আছে! রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কুড়িদলীয় জোট, তৃতীয় শক্তি কিংবা সাম্প্রদায়িক শক্তির মিথ্যা আর দ্বৈতনীতির অবস্থান থেকে পরিচালিত কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের জনগণকে নিজেদের কাছে টানতে ব্যর্থ হয়েছে। বিপরীতে সরকারের দৃঢ়তা, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স', যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে অনমনীয় অবস্থানের পাশাপাশি জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তি ও সমর্থন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দৃশ্যত ৯ মাস বয়সী বর্তমান সরকার সম্পর্কে জনগণের সমর্থনের গুণগত এই পরিবর্তনের ভিত্তি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
সম্প্রতি পরিচালিত জনমত জরিপে বর্তমান সরকার এবং সরকার বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলোর বাস্তব অবস্থান উঠে এসেছে। জরিপে বর্তমান সরকারের জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে দেশের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ সন্তুষ্ট। সরকারের প্রথম ছয় মাসের কর্মকাণ্ডে দেশের ৭৫ দশমিক তিন শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। দেশের  ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ মনে করে সরকার সঠিক পথেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। আর দেশের অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৫৩ শতাংশ মানুষ মনে করে বর্তমান সরকার তার পুরো মেয়াদ শেষ করা উচিত।
জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৫৫ ভাগ মানুষ মনে করে এই মুহূর্তেই ধর্মের লেবাসধারী দলের সংসর্গ পরিত্যাগ করা উচিত বিএনপির। আর ৭৭ ভাগেরও বেশি জনগণ মনে করে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বর্তমান সরকারের ভূমিকায় তারা সবচেয়ে সন্তুষ্ট।
শুধু ওই পরিসংখ্যানই নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি রিপোর্টেও সরকারের জনপ্রিয়তার এই উর্ধ্ব ব্যারোমিটার উঠে এসেছে। সাবেক বিরোধি জোটসহ বর্তমানে রাজনীতির মাঠে নানাভাবে সক্রিয় ওই তিন ফ্রন্টের কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট যে, আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। আর সে কারণে রাজপথের আন্দোলনে ন্যূনতম জনসমর্থন আদায় হচ্ছেনা বলেই দলে ও জোটের ভেতরেই নানা মতের তৈরি হচ্ছে।
এই বাস্তবতা থেকেই নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। আর এতে সরকারের পালাবদল ঘটলেও সাধারণ জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন হবে কতটুকু এমন প্রশ্ন সকলের। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশ পরিচালনায় ধারাবাহিকতায়  মোট উন্নয়ন ধারাকে অব্যাহত রাখে।

সবদিক বিচারে গণতন্ত্রের প্রসারে দেশের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে কি না, তা আরো বেশি করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। সংবিধানের সংশোধনী কিংবা বিচারিক আইনের রক্ষাকর্তারা কী ভুমিকা রাখছেন তারও একটা স্বচ্ছ চিত্র থাকা জরুরী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকগণ। আর যারা প্রতিবাদ করতে গিয়ে নাশকতা করছেন তাদের বিচার দেশের প্রচলিত আইনেই হবে, এমনটা না হয়ে যেন প্রতিহিংসা প্রকাশ না পায় কোনো কাজে সেটাই এখন সময়ের দাবি। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে এ বিষয় গুলো নজর রাখা জরুরি।

দখলের রাজনীতি আর কতদিন?

দখলের রাজনীতি আর কতদিন?

হরিভজন কুন্তল ॥ সরকারি জমি দখল করে 'জমিদার' ক্ষমতাসীনেরা। একটি দৈনিকের চট্টগ্রাম সংবাদদাতা এ শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন করেছেন গত ২১ সেপ্টেম্বর। কর্ণফুলি নদীতে জেগে ওঠা 'চর' ক্ষমতাসীনদের দখল বাণিজ্যে এখন পাঁড়-বস্তি। শুধু ক্ষমতাসীন তক্‌মাধারীরাই নয়, স্থানীয় প্রভাবশালী, ব্যবসায়ী, পক্ষ-বিপক্ষে বিরোধী রাজনৈতিক পদলেহীরাও মোটামুটি এই দখলে সম্পৃক্ত। সরকারি সম্পত্তি দখলের ইতিহাস অতি প্রাচীন না হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে চার দশক সময় ধরে  বেশ দাপটের সাথেই ইতিহাসের পরিসর প্রশস্ত হয়েছে। সংশ্ল্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট কোন রেকর্ড নেই যে, কী পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি বেহাত কিংবা জবর দখল হয়েছে অপরাজনীতির মারপ্যাচে। যখন-যারা ক্ষমতায় এসেছেন তখন-তাদের দলীয় লোকজন  সরকারি সম্পত্তি গ্রাস করায় মেতে উঠেছেন।  দখলবাজরা এই আগ্রাসী মত্ততাকে আইনের প্যাচে কিংবা প্রশাসনিকভাবে রোধ করার যে কোন পথ বন্ধ করে কাজটি সম্পন্ন করে। এরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যাতে প্রতিহত করাতো দূরে থাক সময়তে ক্ষমতাসীনরাও এর মদদ জুগিয়ে চলে। দখল শব্দটির উৎপত্তির ইতিহাস জানা না থাকলেও দখলের অভিজ্ঞতা প্রায় অনেকেরই কম বেশি আছে। নদী, নালা, খাল, বিল, হাওড়, জঙ্গল, পুকুর, জলাশয় এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা ভিপি সম্পত্তি যা-ই হোক না কেন দখল হয়ে যায়, যদি থাকে পিছনে সরকারি দলের প্রভাব। জানা গিয়েছে এ বছর অধিকাংশ কুরবানি পশুর হাটের দখলও চলে গেছে ক্ষমতাসীনদের দখলে। কেউ কেউ আবার সরকারি সম্পত্তি দখল করে নিজ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক হবার খায়েশ পূর্ণ করছেন। এরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে ঢাকার শাহজাহান পুরের রেলওয়ের জমি দখল করে গড়ে উঠা 'মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজ'। সারা দেশে এরকম চিত্র বহু আছে। আগারগাঁও বিএনপি বস্তি এখন তো বেশ বিখ্যাত চোরাকারবারি মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য। হাট বাজার অফিস আদালত সর্বত্রই এই দখল বাণিজ্য আছে, তার প্রত্যেকটার সাথে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার রাজনীতিও আছে। ঢাকা শহরের একটি ফুটপাতও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেটি বাণিজ্যিক দখলে নেই, সংশ্লিষ্টদের চাঁদা দিয়ে কয়েক লক্ষ হকার রাজধানী দখল করে আছে। নবাবপুরের বিখ্যাত রাস্তাটি এখন চলাচলের অযোগ্য। বিকেল বেলা দক্ষিণ বঙ্গের যাত্রীরা অনুধাবণ করতে পারেন দখল কাকে বলে, ঘাটে পৌঁছাতে তাকে পোহাতে হবে চরম দুর্ভোগ! তিনি লঞ্চে উঠতে পারবেন না, গুঁতো খেয়ে নিচে পড়ে ওখানকার মানুষের করুণা চাইবেন। বেঁচে থাকলে স্বজনের কাছে ফেরা হবে নয়তো ওখানেই শেষ।

দখল ও টেন্ডার বাণিজ্যের কথা আমরা সকলেই জানি, ক্ষমতাসীনরাও জানেন কিন্তু ক্ষমতার অলিখিত খাতায় সেটি  যায়েজ। তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি যতো হোক প্রতিকারের রাস্তা আমাদের গণতন্ত্রের সংসদ আজ অব্দি খুঁজে পায়নি, অবশ্য তাদের মাথায়ও আসেনি, কারণ সংসদ পর্যন্ত আসতে তাদের অনেককেই দখল বাণিজ্যের বিস্তার ঘটিয়েই আসতে হয়েছে। সেই সুনামেই দলীয় টিকিটের নিশ্চয়তা এবং নির্বাচিত। এখন তারা কী করে দখলের বিরুদ্ধে সংসদে বিতর্ক চালাবেন? তার চেয়ে ভালো নয় কী বিরোধীদের পিণ্ডি চটকানো? তারা সেটাই করছেন। ইতিহাস, ভূগোল এক করে খিস্তি খেউড়ের জলসা। বেশ চলছে। না চলবার কারণ নেই, ওটাও যে দখলেরই প্রাপ্তি। দখল করতে ত্রিশ হাজার ঝাউ কাছ কেটে ফেললেন এক সাংসদ, কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের ন্যূনতম সাহসও ছিলোনা তাকে প্রশ্ন করে। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হয়েছিলো, তাতে মামলাও হয়ে ছিলো তখন কিন্তু সে মামলার কোন কিনারা হয়েছে আজ অব্দি আমরা শুনিনি। খেপুপাড়ার তখনকার পানিমন্ত্রী তো দখলের বন্যা বইয়ে দিয়ে ছিলেন তার এলাকায়। এবার অবশ্য তিনি মন্ত্রী হতে পারেননি তবে     জবর-দখলের জন্য তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয়েছে শুনিনি। দেশের যতগুলো সরকারি হাসপাতাল এবং জেলখানা আছে তার সব কয়টাই ক্ষমতাসীন দলের  টেন্ডারবাজদের দখলে, বেশ আছেন তারা রোগীর খাদ্য ঔষধ আর কয়েদীদের আহার মেরে দিয়ে। চিড়িয়াখানাও বাদ যায় না। এসব এখন সাধারণ। কারণ রাজনীতির দখলদারিত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে জবর-দখলের বাণিজ্য স্থান পুরণ করে নিয়েছে। তাই ঘরে বাইরে, আসমানে   কিংবা জমিনে সর্বত্রই দখল বাণিজ্য। তার সবটাই রাজনীতির নামে, রাজনীতিকদের সীমাহীন ভোগ-বিলাসী আকাঙ্খা পুরণের জন্য, জনঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। তাইতো নির্বাচন দিয়ে দখলি রাজনীতির ইতিহাসটা পোক্ত করার সকল ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন। রাজনীতির বিদায়, অনেকটা 'গুডবাই লন্ডন হান্ড্রেড ইয়ার্সের' মতো। 

নেতৃত্বের বেচা-কেনা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য

নেতৃত্বের বেচা-কেনা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য

বর্ষা ॥ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী এবং চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনাকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সম্পর্কে দেশের সাধারণ তথা সচেতন মহলের আগ্রহের শেষ নেই। কারণ, আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের ইতিহাসের পার্থক্য খুব সামান্যই। যদিও দেশ ও দলের চরম ক্রান্তিলগ্নে অর্থাৎ ৭৫-এর ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এত বড় একটা দলের ক'জন নেতা সেদিন খুনীদের বিরুদ্ধে  দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে রাজপথে নেমেছিলেন, আর কেনই বা পারেননি তা বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম ছিলেন জেলখানায় নিহত জাতীয় চার নেতা যারা নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তারা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু তথা দেশবাসীর সাথে কীভাবে এবং কতটুকু আত্মিক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। এক্ষেত্রে আরও ব্যতিক্রম হচ্ছে আওয়ামী লীগের সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত সমর্থক, সাধারণ কর্মী, শ্রমিক, কৃষকসহ খেটে খাওয়া এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক মানুষ  যারা শত-সহস্র প্রতিকূলতার মুখেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দিয়ে এসেছে, যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগের নেতারা সংসদ সদস্য-মন্ত্রী হতে পেরেছেন এবং সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হওয়ার লোভে কিংবা রাষ্ট্রীয় বড় বড় সুযোগ ও পদবী লাভের প্রত্যাশায় ব্যবসায়ী ও আমলাসহ তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের অনেকেই এখন দলটিতে এসে ভীড় করেছেন। বর্তমানে দলের অবস্থা এমনই যে, খোদ আওয়ামী লীগ প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনী মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন যা এদেশের প্রগতিশীল ও মানুষের মুক্তির আন্দোলনের ইতিহাসের জন্য দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। এমনি যখন এদেশ ও রাজনীতির চিত্র তখনই নিজ দলের নেতাদের নিয়ে আস্থাহীনতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৪ই সেপ্টেম্বর রোববার সংসদ অধিবেশন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের সব নেতাকে কেনা যায়।” এদিন সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের বিল নিয়ে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন হয়, যে উদ্যোগের সমালোচনা ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যেও। অধিবেশন শেষে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাছান মাহমুদ, দবিরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন খসরু, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে এগিয়ে বিচারপতিদের অপসারণ সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে কথা বলছিলেন।
একই সময় প্রধানমন্ত্রীর পেছনের আসনে থাকা প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সামনের সারিতে বসা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চান।
কয়েকজন সংসদ সদস্য সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের অবস্থান তুলে ধরে বিচারপতিদের সরানোর ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরানো নিয়ে বিভিন্ন জটিলতার কথা বলছিলেন।
শেখ হাসিনা তখন অধিবেশন কক্ষ থেকে বের হতে হতেই বলেন, “আওয়ামী লীগের সব নেতাকে কেনা যায়। এটাই সমস্যা। শেখ হাসিনা ছাড়া।” তার এই কথা সংসদের গ্যালারি থেকেও শোনা যাচ্ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য যে, ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন, 'বাংলার কৃষক ভাল, বাংলার শ্রমিক ভাল। যদি খারাপ হই-তবে আমরা এই তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। করাপশন বাংলার কৃষকরা করেনা, মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ-যারা ওদের টাকা দিয়েই লেখাপড়া শিখেছি'। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল এদেশের দুঃখী মানুষর মুখে হাসি ফুটানো। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও এদেশে যেখানে এখনো কোটি কোটি মানুষ বাস করে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে। দুর্নীতি, অন্যায়, শোষণ, মিথ্যাচার, ধর্ম ও শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য যখন এদেশে এখনো প্রাত্যহিক বিষয় সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা এবং শিক্ষিত সমাজ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর কন্যার বক্তব্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয় রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা দিয়ে কেনা গেলে অন্য দলের নেতাদের কাছ থেকে জাতি কী আশা করতে পারে? কারণ, টাকা তো আর সাধারণ মানুষের কাছে থাকেনা। এদেশের টাকা এখন চলে গেছে নব্য লুটেরা-ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ, ধর্মজীবী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে। সমাজের এই অপগোষ্ঠীর কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে গেলে সমাজ ও জাতির জন্য আরও অধপতন নেমে আসতে বাধ্য। তাই আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পর্কে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য এক দিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, অন্য দিকে অনেক বেদনায়ক। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অনেক দুঃখ থেকে তাঁর দলের নেতাদের সম্পর্কে এইসব কথা বলেছেন। নেতাদের এই অবস্থা শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, অন্য যেকোনো বড় দলের অনেক নেতার সম্পর্কেই এই জাতীয় মন্তব্য উঠে আসবে গবেষণা করা হলে। তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পর্কে এই জাতীয় মূল্যায়ণ নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী আমলে বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এই দলটির অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রচার ও প্রসারের জন্য যেসব নেতা-কর্মী ও সংগঠক কাজ করে গেছেন তারা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন দেশ ও মানুষের প্রতি, কোনো স্বার্থ কিংবা টাকা-পয়সার কাছে তারা কখনো বিক্রি হয়ে যাননি। ওইসব নেতাদের অবদানেই এদেশের মানুষ আজ স্বাধীন দেশে বাস করছে। এই দলেরই অনেক নেতা বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি স্বার্থ কিংবা অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে দল, দেশ এমনকি বঙ্গবন্ধুর সাথে বেঈমানী করেছিল, আজ তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে আজকের দিনের আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আর না হলে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া নেতাদেরকে  দল থেকে বের করে দিতে হবে।

জাতির বিবেকের কাছে আজ প্রশ্ন উঠে এসেছে টাকার কাছে বিক্রি হওয়া নেতাদের দিয়ে দেশের উন্নতি কতটুকু সম্ভব? তাই দলে চালাতে হবে শুদ্ধি অভিযান। শুদ্ধ চিত্তের অধিকারী, ত্যাগী এবং গণমানুষের সাথে যাদের সম্পৃক্ততা আছে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান করে দিতে হবে। নচেৎ, সামনের দিনগুলোতে আরও ভয়ংকর পরিণতি জাতিকে এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বহন করতে হতে পারে ।

চাঁদাবাজি

চাঁদাবাজি

সংলাপ ॥ আমাদের দেশে দীর্ঘ দিনের সমস্যা চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজদের কারণে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। ঈদকে সামনে রেখে তাদের তৎপরতা বাড়ছে। এদের ব্যাপারে এখনই সতর্ক হওয়া দরকার।
রাজধানী কিংবা দেশের সর্বত্র নির্মাণ খাত, পরিবহন খাতসহ সব ধরনের ব্যবসা এদের হাতে জিম্মি। চাঁদার জন্য এরা হুমকি দেয় বিভিন্ন মাধ্যমে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাঁদা না দিলে অনেক সময় জীবন নিয়েও সংশয় দেখা দেয়। ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা এদের প্রধান টার্গেট। সাধারণত এ চার পেশায় নিয়োজিতদের আয় রোজগার বেশি; তাই চাঁদাবাজদের কোপানলে তাদেরই পড়তে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে পারে না। চাঁদাবাজি দমনে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সুস্থ সমাজ সর্বদাই শুভবোধ, বুদ্ধি এবং আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। চাঁদাবাজি একটি বৃহত্তর সমাজ কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয় । সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত হলে চাঁদাবাজি কমে আসবে বলে ধারণা করা হয়। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজদের তৎপরতা বেড়ে থাকে এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তা না হলে এরা এত সাহস পায় কোথা থেকে? শোনা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশের সঙ্গে চাঁদাবাজদের সংযোগ রয়েছে। জোরপূর্বক চাঁদা আদায় অপরাধ। কোন কোন সংগঠনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন দল ও সংস্থার নামেও চাঁদা আদায় করে থাকে। বিশেষ করে পরিবহন খাতে এ ধরনের চাঁদাবাজি বেশি লক্ষ্য করা যায়। চাঁদা আদায় হয় হাট-বাজারে, ফেরিঘাটে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালীর নামে। দেখা গেছে ঈদের সময় বাস ভাড়া বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। এর পেছনে সংশ্লিষ্টদের স্বেচ্ছাচারিতা যেমন রয়েছে তেমনি চাঁদাবাজরাও এর জন্য দায়ী। চাঁদা না দিয়ে কোন ব্যবসাই করা সম্ভব নয়। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে কোন কোন চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে মামলা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করে। তাহলে দুর্নীতি রোধ করবে কে? উন্নয়ন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য চাঁদাবাজি অন্যতম অন্তরায়। দেশ থেকে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও জড়িত থাকে, তাদেরও আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত।

বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

অঙ্গে আমার বঙ্গ রক্ত বহে....

অঙ্গে আমার বঙ্গ রক্ত বহে....

শেখ উল্লাস ॥ বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য অন্যূন তিন হাজার বছরের। সেই ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে আজীবন ব্যাপৃত একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদ-এঁর ভাষায়-'নবী নূহের কথা বলছি- চার ছেলে তাঁর- সাম, হাম, ইয়াফেস ও কেনান- অবুঝ অবাধ্য কেনান, প্লাবনে সেনান করে দিয়েছিল প্রাণ। আর সাম, হাম ও ইয়াফেসের বংশধর পৃথিবীতে আজও বেঁচে আছে। পৃথিবীর বুকে মানুষের দ্বিতীয় পত্তনে হামের অধস্তন হিন্দ যখন সিন্ধুর তীরে বসতি নামায় তারও কিছুকাল পরে- হামের অধস্তন আরেক পুরুষ বঙ্গ-হিন্দের সন্তান অথবা সন্তানের সন্তান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে ছিল তারই আবাদী আবাস। পিতা বঙ্গের বংশধরেরা বৃদ্ধি পেয়ে গড়েছে সভ্যতা কালে কালে। পদ্মা-যমুনা-মেঘনার বাঁকে বাঁকে তাঁরই নামে আজ সাগরের নাম, তিনিই জনক বাঙালির। তাঁর গড়া রাষ্ট্রের নামই বঙ্গ। ব-দ্বীপের পললে পললে-পললের রন্ধ্রে রন্ধ্রে-সন্তান-সন্ততীর তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে আজও পিতা বঙ্গের সূত্র গাঁথা। যুগে যুগে তাই বিস্মিত বিশ্ব দেখে বঙ্গের সন্তানের কন্ঠে ধ্বনিত হয় সাহসী বারতা....অঙ্গে আমার বঙ্গ রক্ত বহে, আমরা যে ভাই নবী নূহের আদূরে তনয় সাহসী হামের কওম। বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা আমাদের রাজধানী আজ বাঙালি সভ্যতার ভিত। বঙ্গভবন হেথা পেয়েছে নতুন সাজ, এ যুগে জাতির নতুন স্থপতি বঙ্গবন্ধু ভবনও সেখানে আছে। ভূবন বঙ্গে আমরা অযুত বঙ্গ তনয় আজিকে সত্যি সাহসী নির্ভীক অকুতোভয়। পিতা বঙ্গ আমাদের রাষ্ট্রের জনকই শুধু নন-তিনিই করেছিলেন আমাদের একেশ্বরবাদী সংস্কৃতির গোড়াপত্তন।' অর্থাৎ, বাঙালি জাতির আদি পিতার নাম বঙ্গ এবং তিনি একেশ্বরবাদী ছিলেন। একেশ্বরবাদীরা স্বভাবতই সুন্দর ও শান্তির পূজারি। তারা মগ্ন থাকেন এক চিন্তায়, এক ধ্যানে, অনুসারী হন সরল ও সত্য পথের। প্রকৃতিই এখানকার মানুষকে সরল ও স্বাভাবিক জীবন দান করেছে। কালের বিবর্তনে তাই দেখা গেছে, শাসন ক্ষমতার মালিক হয়েও অনেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সূফী-দরবেশ হিসেবে। বাগেরহাটের সূফী সাধক খান জাহান আলী এঁদের একটি উদাহরণ। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে (১৪৯২-১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দ) শ্রী চৈতন্য বাংলায় প্রচার করেছিলেন বৈষ্ণব ধর্ম। বিভিন্ন সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে এ অঞ্চলের মানুষের সরল ও শান্তির পথ বিঘ্নিত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী মোগল, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানী শাসনামলের কুপ্রভাব হিসেবে এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষদের ওপর যে ধাক্কা লাগে তার পরিণতি আজও ভোগ করতে হচ্ছে এদেশের জনগণকে। বিশেষ করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একশ' বছরের শাসনের সময় (১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ) এদেশে ইংরেজদের তৈরি তল্পিবাহক অর্থাৎ, দালাল গোষ্ঠীটিই পার্থিব সব ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জন করে। নব্য জমিদার ও তাদের তল্পিবাহক নতুন নতুন গোষ্ঠী, পরিবার ও ব্যক্তির আধিপত্য কায়েম হয়। এ অঞ্চলের সূফীবাদী ও শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো ওইসব আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম  করেছে বিভিন্ন সময়ে। অপরদিকে, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ আমলে এ উপমহাদেশে শত শত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ধর্মশিক্ষার নামে মানুষকে ধর্মান্ধতার পথে ধাবিত করা হয়েছে। অথচ এদেশের মানুষকে শাসন ও শোষণ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় আজও এ অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে ধর্মভীরু ও ধর্মান্ধদের সংখ্যাটাই বেশি। সমাজে ধার্মিক মানুষের সংখ্যা সব সময়ই খুবই কম। এভাবে  সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তি ধর্মের নামে গান গেয়ে মানুষকে ঘুম পাতিয়ে রেখেছে। যখনই কেউ শাসন ও শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির কথা বলেছে তখনই শাসকবর্গ থেকে 'ধর্ম গেল' বলে জিগির তোলা হয়েছে। দেশের কথা, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা যখনই বলা হয়েছে, তখনই সেখানে ধর্ম প্রসঙ্গ আনা হয়েছে, দেশপ্রেমকে ধর্মবিরোধী কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এমনি করে মহাকালের বহু বাঁক অতিক্রম করে ১৯৭১'র ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন এবং তাঁরই ডাকে এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় এগিয়ে আসলেন, যে ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনী ২৫শে মার্চ বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে গণহত্যা চালালো তখনই সাম্রাজ্যবাদের সেই তল্পিবাহকদের প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হলো। এদেরই কেউ কেউ গিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানালো এবং অন্য কেউ গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলো এবং তাদের অনুগতদের দিয়েই সারা দেশে তৈরি হলো শান্তিকমিটি, রাজাকার-আলবদর-আলশামস্‌ যারা এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো ৯টি মাস ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতা চালিয়েছিল এদেশের মানুষদের ওপর, ঘৃণ্য সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে আজো তারা টিকিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও তারা ক্ষমা চায়নি তাদের বর্বর ভূমিকার জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, তারা বা তাদেরই বংশধর বা অনুচরেররা মিশে আছে এদেশেরই বিভিন্ন ক্ষেত্রে-রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, গণমাধ্যমসহ সর্বস্তরে। এদেরকে আজো সনাক্ত করা হয়নি যা দুভার্গ্যজনক বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।

এই অবস্থারই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত ১১ই সেপ্টেম্বর বৃহষ্পতিবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিহ্নিত রাজাকার-আল-বদর-আলশামস বাহিনী প্রধানদের দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে বিচারকার্য শুরু করা হবে। ভবিষ্যতে রাজাকার-আলবদর ও মানবতাবিরোদীদের উপজেলা ভিত্তিক তালিকা করার বিষয়েও মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় আরও বলেছেন, 'পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী মানব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত করে বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল বধ্যভূমিতে। বাঙালি জাতি পাকিস্তানী বাহিনীর এই ঘৃণ্য বর্বরতাকে কখনও ভুলবেনা। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের এ জাতি মনে রাখবে আজীবন, স্মরণ করবে অনন্তকাল। আগত প্রজন্মের কাছে  মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি'। এদেশের শান্তিপ্রিয় বিবেকবান মানুষ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর এইসব কথায় আশাবাদী হয়ে থাকতে চায়। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে জালিয়াতির বিরুদ্ধে এই মন্ত্রীর নেয়া বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ইতোমধ্যে বিবেকবান মহলে প্রশংসা পেতে শুরু করেছে। অস্বীকার করার  কোনো উপায় নেই যে, রাজাকার-আলবদর-আলশামস ছাড়া এদেশের মানুষ সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য অবদান রেখেছিল এবং এই অর্থে সেই মানুষদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা, তবে যারা সেদিন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে  মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল, প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, সংসারধর্ম ছেড়ে দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিল, তারা এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, তারা মুজিবনগর কিংবা মুক্তিবাহিনীর লোক হিসেবে পাকিস্তানীদের কাছে তালিকাভুক্ত ছিলেন। দেশ স্বাধীন না হলে তারা কখনো স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারতেন না। এর বিপরীতে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন দিনগুলোতে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তা করেছিল, রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে ঘৃণ্য বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছিল তারা বাঙালি নামের কলঙ্ক, এক আল্লাহ্‌ বা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলে তারা কখনো নিজের জাতির সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারতো না। তারা একেশ্বরবাদী বাঙালি চেতনারই শত্রু। সে কারণেই সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি রাজাকারদের তালিকা তৈরি এবং তা সর্বত্র প্রচার ও প্রকাশের ব্যবস্থা করাও আজ জরুরি। ভুলে গেলে চলবে না যে, হাজার হাজার রাজাকার ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র ও তার সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে টিকিয়ে রাখার জন্যই তারা শপথ নিয়েছিল। তারা তাদের শপথ থেকে এক বিন্দুও সরে গেছে বলে মনে করা এতদিন ভুল হয়েছে, সেই ভুলের খেসারত বাঙালি জাতি আর দিতে চায় না। উদারতা, সরলতা, শান্তি ও সত্যবাদিতার মধ্যেই প্রোথিত বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের শিকড়, এই ঐতিহ্যে কলঙ্ক লেপন করেছে রাজাকারেরা। সুতরাং এই রাজাকারদেরকে তালিকা করে নতুন প্রজন্মকে চিনিয়ে না দিলে সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাঙালি জাতির সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে পড়তে পারে। 

জ্ঞানার্জন শান্তি লাভের পূর্ব শর্ত

সময়ের সাফ কথা ....
জ্ঞানার্জন শান্তি লাভের পূর্ব শর্ত

শাহ্‌ লিয়াকত আলী ॥ শ্রম ব্যক্তির কর্ম নির্ভর শক্তি। মানুষ তার চলা, বলা, দেখা, শোনা, স্পর্শ করা, ইত্যাদি কর্ম দেহ যন্ত্রের আশ্রয়ে সম্পন্ন করে। আবার চিন্তা, ভাবনা, বুদ্ধি, উপলব্ধি, বোধ, আস্থা, ভাল-লাগা, ভালবাসা, স্নেহ, সম্মান, প্রেম শ্রদ্ধা-ভক্তি ইত্যাদি মানুষের চিন্তা জগতের এক এক স্তরের কর্ম। দৈহিক কিংবা চিন্তা ভিত্তিক সকল কর্মই ব্যক্তির শ্রম শক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই শ্রম দৈহিক কিংবা মানসিক উভয় বিধ হতে পারে। দৈহিক শ্রম কেবলই দেহ নির্ভর কিন্তু মানসিক শ্রম দেহ ও চিন্তা নির্ভর হয়ে থাকে। উভয় বিধ শ্রমের পরিশ্রমে ক্লান্তি আছে। তবে দেহ নির্ভর শ্রমের ক্লান্তি অপেক্ষা চিন্তা নির্ভর শ্রমের ক্লান্তি অপেক্ষাকৃত বেশি।
ক্লান্তি নিবারণের ক্ষেত্রে দেহ নির্ভর শ্রমিকের চেয়ে চিন্তা নির্ভর শ্রমিকের বিশ্রাম অধিক প্রয়োজন। বিশ্রাম হলো ক্লান্তি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। নির্দিষ্ট কর্ম থেকে বিরত হয়ে কিছুটা অবসর জীবন যাপনের মাধ্যমে বিশ্রাম নেয়া যায়। আবার নিদ্রার মাধ্যমেও বিশ্রাম নেয়া যায়। অবসরের বিশ্রাম অপেক্ষা নিদ্রার বিশ্রাম অধিক শক্তিশালী। বাস্তবে দেখা যায়, দিনের প্রথম প্রহরে ব্যক্তি কর্ম করতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে দিবসের শেষ প্রহরে ব্যক্তি কর্ম করতে ততটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা। এর কারণ সাধারণত দিনের বেলা বিশ্রাম কিংবা নিদ্রার মাধ্যমে যতটা ক্লান্তি প্রশমিত হয় রাত্রির বিশ্রাম কিংবা নিদ্রায় তদপেক্ষা অধিক ক্লান্তির অবসান ঘটে। ক্লান্তি অসুখ তথা রোগ ব্যাধির কারণ কিন্তু বিশ্রাম কিংবা নিদ্রা অসুখ বা রোগ ব্যাধি উপশম করে। তাই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান রোগীর বিশ্রাম কিংবা নিদ্রা ব্যবস্থাপনায় অনেক জটিল ও কঠিন অসুখ উপশম করার পরামর্শ দেয়।
কর্ম ছাড়া কোন কিছুই করা যায় না। কর্ম করেই মানুষ শারিরীক, মানসিক কিংবা আধ্যাত্মিক সকল ক্ষেত্রের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। একজন ভিখারী চাইলে উন্নত কর্মের আশ্রয়ে দাতায় পরিণত হতে পারে। আবার উন্নত কর্ম পরিহার করে একজন দাতা ভিখারীতে পরিণত হয়। কে ভিখারী থাকবে কে দাতা হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তির চিন্তা, কর্ম,  উপলব্ধি, অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার উপর। কর্ম উপলব্ধিজাত শক্তির মাধ্যমে সম্পাদন করা যায়। আবার পড়ে, শুনে কিংবা দেখে-দেখেও করা যায়। দেখে, শুনে কিংবা পড়ে কর্ম করার অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধিজাত শক্তির সাহায্যে কর্ম করার অভিজ্ঞতা আপতভাবে অনুরূপ আস্থা সম্পন্ন মনে হলেও আস্থার সন্তুষ্টির বিচারে উপলব্ধিজাত শক্তির সাহায্যে অর্জিত আস্থায় ব্যক্তির সন্তুষ্টি অধিক থাকে। উভয় ক্ষেত্রের কর্মে ব্যক্তির সন্তুষ্টির পার্থক্যের কারণ তলিয়ে দেখলে দেখা যায় পড়া, শোনা কিংবা দেখে দেখে কর্ম করার অর্জিত অভিজ্ঞতায় ব্যক্তির বুঝে কর্ম করার ক্ষমতা ততটা থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যক্তির কেবলই অনুমান ও ধারণা ভিত্তিক কর্ম করার অভিজ্ঞতা [শক্তি] অর্জিত হয়। আবার উপলব্ধিজাত শক্তির সাহায্যে কর্ম করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি বুঝে কর্ম করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে বিধায় এক্ষেত্রে ব্যক্তি তার স্বজ্ঞা শক্তির আশ্রয়ে কর্ম করার ক্ষমতা লাভ করে।
বুঝে কর্ম করার অর্থ জানা ও চেনার স্তরের শক্তিতে কাজ করা। বাস্তবে জানা ও চেনা শক্তিতে শক্তিবান ব্যক্তিই তার সকল শক্তির আত্মবল উপলব্ধি করতে সক্ষম। সজ্ঞা শক্তিতে কর্ম করার মাধ্যমে কোন কর্ম যতটা নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব, পড়া, শুনা কিংবা দেখার মাধ্যমে সেভাবে নিখুঁত ও নির্ভুল কর্ম করা যায় না। তাই নিখুঁত ও নির্ভুল কর্ম করার সন্তুষ্টি অপেক্ষা ধারণা ও অনুমান নির্ভর কর্ম করার সন্তুষ্টিতে ব্যক্তির মাঝে আত্মবলের জাগরণ কম হয়। কর্মে ব্যক্তির মাঝে আত্মবলের জাগরণ কম বেশি হওয়ার কারনেই ব্যক্তির মাঝে সন্তুষ্টির মাত্রাও কম বেশি হয়ে থাকে। ব্যক্তির সন্তুষ্টি-কর্ম-নির্ভর এবং কর্ম শ্রম নির্ভর হয়ে থাকে। যে শ্রমের কর্মে ব্যক্তির সন্তুষ্টির মাত্রা অধিক থাকে, সে কর্মে ব্যক্তির বিত্ত-বৈভব কম থাকলেও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য অধিক থাকে। তাই এসব কর্মের মাধ্যমে ব্যক্তি দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, আর যেসব কর্মে বিত্ত-বৈভব বেশি কিন্তু সন্তুষ্টির মাত্রা কম থাকে সে সব কর্মে ব্যক্তির আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাচ্ছন্দ তেমনটা থাকেনা। তাই এক্ষেত্রে ব্যক্তি সার্বিকভাবে সুখী না হয়ে অসুখী ও নিরানন্দের জীবন যাপন করে থাকে।
মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব তাঁরাই যারা অপেক্ষাকৃত অধিক সুখী জীবন যাপন করেন। অপেক্ষাকৃত অধিক সুখী তারা-যারা ভাল-মন্দের মাত্রাগত পার্থক্য করতে পারেন। তারাই ভাল-মন্দের মাত্রাগত পার্থক্য করতে পারেন যারা অনুমান-ধারণা নির্ভর না হয়ে বুঝে কর্ম করতে পারেন। তারাই বুঝে কাজ করতে পারেন যারা সজ্ঞায় কর্ম করেন। তারাই সজ্ঞায় কর্ম করতে সক্ষম যাদের আত্মবল জাগ্রত। তাদেরই আত্মবল জাগ্রত যারা জ্ঞান শক্তিতে বলীয়ান।

যারা জ্ঞান শক্তিতে বলীয়ান হয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ শ্রম-নির্ভর শান্তির জীবন লাভ করতে চান, তাদের জন্য জ্ঞান অর্জন করা অত্যাবশ্যক। আর শান্তির জীবন যাপন করা জ্ঞানার্জন ছাড়া সম্ভব নয়। জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্‌র শক্তি। এ জ্ঞান শক্তি অর্জন করার জন্য আল্লাহর গুণে গুনান্বিত ব্যক্তিত্ব তথা আল্লাহ্‌ ওয়ালাদের অনুসারী হয়ে জীবন যাপনের কর্ম অভ্যাস গড়ে তোলা আবশ্যক। তাহলেই মর্যাদাবান শ্রমের অধিকারী হয়ে অপেক্ষাকৃত সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বাদ আস্বাদান করা সম্ভব হবে। অন্যথায় গতানুগতিক মরিচিকাতুল্য সাময়িক সুখের জীবনের অপেক্ষায় দু:খভরা মর্যাদাহীন জীবনের গ্লানি সহ্য করে ধুকে ধুকে মরা ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না। 

ডিজিটাল বাংলাদেশ

ডিজিটাল বাংলাদেশ

সাদি ॥ কয়েক দশক পূর্বেও বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। সময় যত গড়িয়েছে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে জ্যামিতিক হারে। ফলে সারা বিশ্বেই মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন। এ ইতিবাচক ও উন্নয়নমুখী পরিবর্তন আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, যোগাযোগ, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের। আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনেক জনগোষ্ঠীও এখন এই পরিবর্তনের অংশীদার। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রযুক্তিক্ষেত্রে এমনই এক বৈপ্লবিক সময় পার করছে। অতীতের অনেক কল্পনাই এদেশের মানুষের কাছে এখন বাস্তব রূপ লাভ করেছে।
'ডিজিটাল বাংলাদেশ' নামে যে ধারণাটি এক সময় এদেশের মানুষের কাছে অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ছিল, কয়েক বৎসরের ব্যবধানে এখন তার স্পর্শ লেগেছে নিভৃত পল্লী ও নেহায়েত দরিদ্র মানুষটির জীবনেও। এদেশের লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও তথ্যপ্রযুক্তি যে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে তাহার স্বাক্ষর অনেক আগেই রেখেছে এ খাতটির উদ্যোক্তারা। গত কয়েক বৎসরে এদেশের তরুণদের দ্বারা উদ্ভাবিত সফটওয়্যার রপ্তানির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে। অধিক আশার কথা হলো - অর্জিত অর্থের এ পরিমাণকে কয়েক কিংবা কয়েকশত গুণ বৃদ্ধি করারও সুযোগ রয়েছে। তবে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া দরকার। এ খাতে আগ্রহীদের বিনিয়োগের জন্য প্রাথমিক অর্থ যোগান, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দেশি-বিদেশি বাজার সৃষ্টিতে যে সহায়তা প্রয়োজন-তা নিশ্চিত করতে হবে।

বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সৃজনশীল ধারণা এবং মেধার সমন্বয় সম্ভব না হলে প্রযুক্তি খাতের লক্ষ্য অর্জিত হওয়া কঠিন। এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান এবং কতক ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির অভাবে মাঝপথে অনেক উদ্যোগই থেমে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের যথাযথ সহযোগিতা ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং এর প্রতি সযত্ন দৃষ্টি রাখা হলে এ খাতে আরও উন্নয়ন সম্ভব। দেশের চাহিদা মিটিয়ে দক্ষ জনশক্তিকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে তা আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে নূতন দ্বার উন্মোচন করবে নিঃসন্দেহ। তরুণদের জন্য কার্যকর সহযোগিতার যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি তরুণদেরও দায়িত্ব রয়েছে প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার এবং সামর্থ্যের পরিপূর্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করার। হাজারও নূতন উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রযুক্তিক্ষেত্রে এক নূতন যুগে প্রবেশ করুক-এমনটিই প্রত্যাশা।

দরিদ্রতা অধর্মের ফল

দরিদ্রতা অধর্মের ফল

সিদ্ধার্থ ॥ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সরঞ্জামের অভাবকে সাধারণত দরিদ্রতা বলা হয়। মোটা চালের ভাত, আলুর ভর্তা, পাতলা ডাল দরিদ্রদের নিত্যদিনের খাবার ধরা হয়। এ খাদ্য যদি দেহের পুষ্টি সাধনের জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে নিশ্চয় তা দরিদ্রতা। বস্ত্র পরিধানের উদ্দেশ্য - লজ্জা নিবারণ  করা এবং দেহকে তাপ ও শীত থেকে রক্ষা করা। যার লজ্জা নিবারণ ও দেহকে শীত ও তাপ হতে রক্ষা করার মত কাপড় নেই তিনি অবশ্যই দরিদ্র। ব্যাপক অর্থে যে কোন ব্যক্তিকেই দরিদ্র বলা যাবে  যদি তার আয় নিজের অপরিহার্য প্রয়োজনের চেয়ে কম হয়।
দরিদ্রতা পরিমাপের আধুনিক পদ্ধতিতে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্র এবং দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরিকে মানদ- হিসেবে ধরা হয়। গ্রামে ক্যালরির এই মাত্রাটি ২৪০০ এবং শহরে ২১০০। ভোগব্যয় কতটা হলে, অন্যান্য জরুরি খরচ করার পর ন্যূনতম ক্যালরির প্রয়োজন মিটানো সম্ভব তার আর্ধিক মূল্য নির্ধারণ করে স্থির করা হয় দরিদ্র সীমা। অর্থ নানা প্রকারে ব্যয় করা যায়, তাই বাস্তবে কারও ভোগব্যয় নির্ধারিত সীমার উপরে থাকা ক্যালরি ভোগের নিশ্চয়তা নয়, সামর্থ্যের পরিমাপ মাত্র।
সাধক কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন -  'হে দারিদ্র তুমি মোরে করিয়াছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান'। যে দারিদ্র মানুষের জন্য অভিশাপ আকারে দেখা দেয়, সে দরিদ্রতাকেই নজরুল শক্তির উৎসে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন কেবল নিজ সম্পদের অনুশীলন ও পরিচালনের মাধ্যমে। পিতৃহারা দরিদ্র শিশু নজরুল জীবিকার জন্য রুটি বানাতেন আর অবসরে আত্মবিকাশের অনুশীলন করতেন। কিশোর বয়সে  তিনি মুয়াজ্জিন, মসজিদের ইমাম, গানের ওস্তাদ, লেটো গানের রচয়িতা, গায়ক ইত্যাদি পেশায় কাজ করেছেন। তারুণ্যের শক্তিকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন নিজেকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে। তাই দারিদ্র তাঁকে অপমান দেয়নি, দিয়েছে খ্রীষ্টের সম্মান। দারিদ্র তাঁকে মহান করেছে, শিখিয়েছে সততা, সত্য, প্রেম। নজরুল প্রমাণ করেছেন - লক্ষ্যে একনিষ্ঠ থাকলে কোন প্রতিকূলতাই মানুষকে রোধ করতে পারে না।
দরিদ্রতা প্রশংসার বিষয় নয়। দরিদ্রতার পূজা করে নজরুল সম্মান লাভ করেননি। ধনবান হয়েই তিনি  সম্মান প্রাপ্ত হয়েছেন। দারিদ্র জয় করার নামই ধর্ম। ধর্ম পালন করতে হলে, জীবনের স্বাদ পেতে হলে দরিদ্রতার কাছে পরাজিত হলে চলবে না। সংগ্রাম করে নিজেকে মুক্ত করতে হবে দারিদ্রের শৃঙ্খল থেকে। তবেই আত্মার বিকাশের দিকে যাত্রা করা সম্ভব। দরিদ্রতা মানুষকে মানুষের মুখাপেক্ষী করে রাখে, আত্মাকে করে রাখে হীন, দৃষ্টিভঙ্গিকে করে সঙ্কীর্ণ। যে যত দরিদ্র তার দৃষ্টিভঙ্গি তত সংকীর্ণ।
কিন্তু তাই বলে অর্থ আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়। আত্মার বিকাশই জীবনেরই লক্ষ্য। কিন্তু দেহকে উপেক্ষা করে আত্মার বিকাশ সম্ভব না। আত্মা দেহ থেকে মহান নয়, দেহও আত্মা থেকে মহান নয়। যতক্ষণ দেহ আছে ততক্ষণই আত্মিক বিকাশের জন্য প্রচেষ্টা করা যায়। একটি ব্যতীত অন্যটির অস্তিত্ব নেই। সুতরাং আত্মা ও শরীর উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। দেহ ও আত্মা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে বিকাশ সম্ভব নয়।
দেহের জন্য প্রয়োজন - খাদ্য, পরিচ্ছন্ন বস্ত্র, আরামদায়ক আশ্রয়, বাসস্থান, এবং পরিমিত বিশ্রাম। আত্মার বিকাশের জন্য প্রয়োজন - নিজেকে পাঠ, গ্রন্থ পাঠ, ভ্রমণ, সৌন্দর্যের উপলব্ধি এবং কবিতা, গান, নাটক, সাহিত্য ও শিল্পচর্যার সৃজনশীল মাধ্যম। আত্মার বিকাশের জন্য আরো চাই - ভালোলাগা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, সমর্পণ। দারিদ্রের মধ্যে বাস করে কেবল ভালোলাগা পর্যন্ত গিয়েই থেমে যেতে হয়। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসার স্তরে যেতে হলে দরিদ্রতাকে অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। কথায় বলে - 'অভাব যখন দরজা দিয়ে ঢুকে, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। আর দরজা জানালা সব দিক দিয়েই যখন অভাব ঢুকে ভালোবাসার তখন মৃত্যু হয়। অভাব সকল ভাবকে তাড়িয়ে দেয়। দারিদ্রের কষাঘাতে মানুষ হারিয়ে ফেলে ভালোবাসার ক্ষমতা। কারণ - ভালোবাসা পাওয়ার নয়, দেওয়ার প্রশ্ন। যার দেবার মতো কিছু নেই সে কেমন করে ভালোবাসবে? কেমন করে তার মধ্যে সৃষ্টি হবে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সমর্পণের আকাঙ্খা?

সুতরাং নিজেকে জানার জন্য, নিজের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ অবশ্যই থাকা চাই। দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করে নয়, দারিদ্রতাকে জয় করার মাধ্যমেই সম্মান লাভ হয়, ধর্ম লাভ হয়। 

বাল্য বিয়ের শাস্তি বাড়ছে

বাল্য বিয়ের শাস্তি বাড়ছে

সংলাপ ॥ বাল্য বিয়ে বন্ধের জন্য দুই বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রেখে নতুন আইন করার প্রস্তাবে সায় দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে 'বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪' এর খসড়ায় নীতিগত অনুমাদন দেয়া হয়। বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের জানান, ছেলের বয়স ২১ ও মেয়ের বয়স ১৮ বছরের কম হলে প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী তা 'বাল্যবিয়ে' এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। "বিবাহকারী, বিয়ে পরিচালনাকারী ও অভিভাবককে এই শাস্তি দেয়া যাবে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে কারাদণ্ড প্রযোজ্য হবে না।" সচিব জানান, নির্বাহী মেজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তাৎক্ষণিভাবে এ ধরনের বিয়ে বন্ধ করে দোষীদের সাজা দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়।

তিনি  বলেন, বাল্য বিয়ে বন্ধে তৈরি ১৯২৯ সালের আইনে ১ মাসের জেল ১ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল। পরে তা সংশোধন করে ১ মাস জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। তারপরও বাল্য বিয়ের ঘটনা ঘটায় শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দুই বছরের কারাদণ্ড- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রেখে নতুন করে এই আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান সচিব।

মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

জঙ্গীবাদের হুমকি মোকাবিলা সময়ের দাবি

জঙ্গীবাদের হুমকি
মোকাবিলা সময়ের দাবি

সাদিকুল হক ॥ সারা দুনিয়ায় নৃশংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টিকারী শীর্ষ জঙ্গী-সংগঠন এবার ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের শাখা স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। ইন্টারনেটে প্রচারিত ভিডিও বার্তায় সংগঠনটির প্রধান শীর্ষ নেতা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে তাদের কর্মকা- ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভারত ওই শীর্ষ নেতার বার্তাকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দেশজুড়ে জরুরি সতর্কতা জারি করেছে। বাংলাদেশও এই বিষয়কে খাটো করে দেখছে না। কয়েক মাস আগেও এক অডিও বার্তায় ওই নেতা বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। অনেক দিন থেকেই এই শীর্ষ জঙ্গী সংগঠন বাংলাদেশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে চলেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এবারের হুমকি তারই ধারাবাহিকতা। তাদের মতে, এ ধরনের হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথভাবে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে।
পাকিস্তান থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত অনেক দেশেই এখন এই জঙ্গী সংগঠনের পরিচয়, সাধারণ মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, লেবানন, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, মিসর, নাইজেরিয়া, সোমালিয়াসহ মুসলমান অধ্যুষিত অনেক দেশেই তারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। জিহাদের পতাকা ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার ধুয়া তুলে সক্রিয় এ সংগঠনটি প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও মানবতার দুশমন হিসেবেই পরিচিত। তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে পবিত্র ইসলাম ধর্মের শান্তি ও সহিষ্ণুতার সুমহান আদর্শের কোনো মিল নেই। জঙ্গিবাদের নামে চরম নিষ্ঠুর ও নৃশংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা দুনিয়াব্যাপী ইসলামের ভাবমূর্তি কেবল ক্ষুণ্নই করছে না, বরং বিপদগ্রস্ত করে তুলছে।
বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বাংলাদেশে তিন ডজনেরও বেশি জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা জঙ্গীদের দেয়া তথ্যেও বলা হয়েছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসারুল্লাহ সুন্নাহ, জামাতুল মুসলিমিন, জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহ্‌রীরসহ আরো কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে ওই শীর্ষ জঙ্গী সংগঠনের যেমন মতাদর্শের মিল রয়েছে, তেমনি তাদের অনেকের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগও রয়েছে। এছাড়া ২০০২ সালে ওই প্রধান শীর্ষ জঙ্গী নেতা বাংলাদেশে অবস্থান করেছিলেন বলেও জানা যায়। ফলে বাংলাদেশে তাদের নতুন ঘোষণাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশই নেই।
শাখা খোলার ঘোষণা থেকে ধারণা করা যায় যে, তারা ইতোমধ্যে এখানকার কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এদের চিহ্নিত করে নির্মূল করা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে বর্তায়। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী ধর্মীয় চরমপন্থি সংগঠনগুলোর তৎপরতা মোকাবেলায় সরকার সফলতার পরিচয় দিয়েছে। এ কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বে দূরদৃষ্টির পরিচয় সময়ের দাবি। সমাজে বিদ্যমান পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে নিজেদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট থাকে এই উগ্র জোটটি। তারা ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টিতেও পারঙ্গম। সরকার জঙ্গীগোষ্ঠীর নেটওয়ার্ক সফলতার সঙ্গে ভেঙে দিতে পারলেও এ নিয়ে আত্মপ্রসাদের অবকাশ নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকগণ। শীর্ষ ওই জঙ্গী সংগঠনটি যদি সত্যিই ভারত বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের সাংগঠনিক ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে থাকে, সেটাকে সর্বাত্মক আঘাত হেনে অঙ্কুরেই বিনাশ করা জরুরি। জঙ্গী সংগঠনগুলো ওই ভিডিও বার্তার পর সক্রিয়তা বাড়াতে এবং তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে উৎসাহী হবে। গোড়াতেই এদের ছিন্নভিন্ন করে দেয়া চাই। সরকার, গণতান্ত্রিক শক্তি এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিকের জন্যই এটা চ্যালেঞ্জ। তারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত হয় এমন কাজ কোনো মহল থেকেই কাম্য নয়। এই সন্ত্রাসী অপশক্তিকে মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতারও প্রয়োজন রয়েছে। সম্প্রতি ভিডিও বার্তা প্রকাশের কয়েকদিন আগেই ঢাকায় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধনকালে বহুমাত্রিক সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবিলায় একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের তাগিদ দিয়েছেন। উগ্র জঙ্গী হামলা মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জিং মিশনে এটা অবশ্যই কার্যকর পন্থা।
বাংলাদেশে সামপ্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থাগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এখানেই থামলে হবে না। এখনো আমাদের গোয়েন্দা কর্মকা- যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। জেলখানায় বসেও জঙ্গীরা নজরদারি এড়িয়ে বাইরে যোগাযোগ রাখতে পারে। সীমান্তপথে জঙ্গীরা প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক ও আধুনিক অস্ত্র আনতে পারছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। জঙ্গীবাদের আর্থিক উৎস নিয়ন্ত্রণেও আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে। এসব দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে। পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিবাদের হুমকি মোকাবিলায় যৌথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে নিজেদের অস্তিত্ব ও ইসলাম রক্ষার প্রয়োজনেই।

আমি চিন্তা করি আমি পূর্ণ সুতরাং আমি পূর্ণ



সময়ের সাফ কথা ....
আমি চিন্তা করি আমি পূর্ণ
সুতরাং আমি পূর্ণ

সিদ্ধার্থ ॥ আমার যদি স্মৃতি না থাকে, চিন্তা না থাকে, তাহলে কি জগতকে জগত হিসেবে চিনতে পারবো? চিন্তা ব্যতীত আমি কী? চিন্তা ব্যতীত আমি কাউকে চিনতে পারবো না, কোন কিছুকে পৃথকভাবে সনাক্ত করতে পারবো না। কে সৃষ্টি করে স্বর্গ, নরক, দেবদূত, অপ্সরী, শরাবান তহুরা? চিন্তা। কে সৃষ্টি করে আত্মা, জীবাত্মা, মহাত্মা, পরমাত্মা? চিন্তা। আত্মা বলে কিছু নেই, জীবাত্মা, পরমাত্মা বলে কিছু নেই যদি এ নিয়ে চিন্তা না থাকে। আমরা এমনভাবে কথা বলি যেন আত্মা, প্রেম, সততা, ন্যায়, সত্য এসব কোনো বাস্তব বস্তু। কিন্তু এসব কিছুই চিন্তা। আমরা জীবনকে উপলব্ধি করি চিন্তা দ্বারা এবং জীবন যাপনের জন্য চিন্তাকে ব্যবহার করি। এটি আমাদের চিন্তারই দূষণ যে আমরা কোন কোন বিষয়কে শ্রেষ্ঠ আর কোন কোন বিষয়কে নিকৃষ্ট বলি। বাস্তবে কোন কিছুই উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট নয়।
চিন্তা ব্যতীত বাহ্যজগতের উদ্দীপনায়ও আমরা সাড়া দিতে পারি না। হাতে উত্তাপ অনুভবের সাথে সাথেই আগুন সম্বন্ধে চিন্তা আসে। চিন্তা ব্যতীত আমরা অনুভবও করতে পারি না। উদ্দীপক ও সাড়ার মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে চিন্তা। বিভক্তি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আগুনকে আগুন হিসেবে সনাক্ত করতে পারি না। আমাদের সকল সংবেদন চিন্তা দূষিত। সংবেদন থেকে পাওয়া চিন্তা ব্যতীত সংবেদন অনুভব করার কোনো উপায় নেই।
উদ্দীপক ও সাড়ার মধ্যে বাস্তবে আছে কেবল পূর্ব ধারণা, যে পূর্ব ধারণা আমরা সঞ্চয় করেছি এবং বংশ পরম্পরায় আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে এসেছে। আমরা যাকে 'আমি' বলি তা পূর্ব ধারণার মাধ্যমেই সৃষ্টি করি, আর তারপর দেহের কর্মকা- থেকে পৃথক হিসেবে এই 'আমি'কে অনুভব করি। 'আমি' বলে কি কিছু আছে? আমরা দৈনন্দিন জীবনে 'আমি', 'তুমি', 'সে' ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করি জীবন যাপনের প্রয়োজনে। দেহের কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো 'আমি' আছে কি? যদি কেউ বলে আছে তবে তা কেবলই তার চিন্তা। চিন্তা ব্যতীত নিজেকে একটি অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করার কোনো উপায় নেই। আমি, অহং, আত্মা যে শব্দই আমরা ব্যবহার করি না কেন তা চিন্তারই সৃষ্টি এবং চিন্তার মাধ্যমেই আমরা চিন্তা সৃষ্ট প্রবঞ্চগুলো অনুভব করি।
আত্মা পরমাত্মা তো দূরের কথা চিন্তা ব্যতীত নিজের দেহকে দেহ হিসেবে অনুভব করতে পারি না আমরা। আমার আকার আকৃতি সম্বন্ধে যে সব তথ্য স্মৃতিতে ধারণ করা আছে তার ভিত্তিতেই আমি আমাকে সনাক্ত করি। চিন্তা ব্যতীত কোন কিছু দেখার কিংবা শ্রবণ করার উপায় নেই। চিন্তা ব্যতীত একটি পা ফেলার উপায়ও নেই। আমাদের সংবেদজ প্রত্যক্ষণ নিজের হাতকেও হাত বলে সনাক্ত করতে পারে না। আমাদের চিন্তাই বলে যে, এটা একটা হাত এবং এটা আমার হাত, তোমার কিংবা তার হাত নয়।
চিন্তা ব্যতীত নিজের হাতও নিজে চিনতে পারি না আমরা। হাত সম্পর্কে যে পূর্ব ধারণা আছে তা ব্যতীত হাতকে হাত বলে সনাক্ত করার কোন উপায় নেই। শিশুকালে আমাদেরকে বার বার শেখানো হয়েছে -এটা হাত, এটা নাক, এটা চোখ। নামকরণের মাধ্যমে অঙ্গকে সনাক্ত করণের শিক্ষা আমরা পেয়েছি বলেই হাতকে হাত হিসেবে সনাক্ত করছি যা আমাদের চিন্তারই উপাদান। আমার কোন নাম ছিল না। আমাকে একটা নাম দেয়া হয়েছে এবং বারবার সেই নামকরণের মাধ্যমে আমাকে সনাক্ত করা হয়েছে, যা আটকে আছে আমার স্মৃতিতে। এভাবেই মানব জীবন আটকে আছে চিন্তার দুষ্টচক্রে।
স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেললে আমাদের বাসস্থান হবে পাগলা গারদে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে চিন্তাই সব, চিন্তা ব্যতীত আর কিছু নেই। কিন্তু চিন্তা কী? যা-কিছু আমরা জানি তা চিন্তার দ্বারাই জানি কিন্তু চিন্তা কী তা আমরা জানি না। কারণ যখনই আমরা চিন্তার দিকে দৃষ্টি দেই তখন আমরা চিন্তা বিষয়ক চিন্তা দেখি কিন্তু চিন্তা দেখতে পাই না।
চিন্তাই জন্ম, চিন্তাই মৃত্যু। চিন্তার যেখানে সমাপ্তি সেখানে জীবনেরও সমাপ্তি। চিন্তা না থাকলে কী থাকে তা আমরা জানি না। পদার্থবিজ্ঞানীরা বস্তুর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন অণু, অণুর মধ্যে পরমাণু, পরমাণুর মধ্যে কণিকা, কণিকার মধ্যে কার্ক, এবং শেষমেশ তারা বলেন যে আসলে বস্তু বলে কিছুই নেই। আছে শুধু চিন্তা। চিন্তাই সৃষ্টি করেছে দেহ এবং চিন্তাই আবিষ্কার করেছে জন্ম, মৃত্যু, স্থান, কাল পরকাল। চিন্তাই সৃষ্টি করেছে সময় এবং বলছে যে জীবনের একটা শুরু আছে, একটা শেষ আছে। চিন্তা স্থান-কালের বাহিরে কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করতে পারে না। চিন্তাই স্থান ও কালের সৃষ্টি করার মাধ্যমে স্থান ও কালে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করে কিন্তু বাস্তবে স্থান-কাল বলে কিছু নেই। যা আছে তা হলো স্থান-কাল সম্বন্ধে চিন্তা। স্থান-কালের উদ্ভাবন না করে চিন্তা গতিশীল হতে পারে না।
মানুষের সকল আকাঙ্খা এমনকি আকাঙ্খা শূন্য হওয়ার আকাঙ্খা ভবিষ্যত নির্ভর। কিন্তু 'ভবিষ্যৎ' মানুষের উদ্ভট কল্পনা মাত্র। ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। আমরা আগামীকালের কল্পনা করি আর গতকালকে স্মরণ করি। কিন্তু বাস্তবে সময়ের কোন অস্তিত্বই নেই। সময় শ্বাশত। শ্বাশত অর্থ অনেক বড় কোন সময় নয়, অনন্ত মানে অনেক অনেক অনেক বড় নয়। 'সময় অনন্ত' - অর্থই হলো অতীত, ভবিষ্যত নেই। বাস্তব সময় হলো এখন। আমরা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারি কেবল এখন। আমরা  সত্য বুঝতে পারি না বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে। অর্থাৎ চিন্তা করে সত্য উপলব্ধির কোন উপায় নেই।
আমরা এমন একটা কারাগারে বন্দী যে কারাগারটাও চিন্তারই সৃষ্টি। আমরা এই কারাগার থেকে মুক্তি চাইছি অর্থাৎ চিন্তা নিজেই নিজের তৈরি কারাগার থেকে মুক্তি চাইছে। চিন্তা হলো সেই কুকুরের মতো যে কুকুরটা একটা শুকনো হাড় তুললো মুখে, তারপর সে কামড়াতে লাগলো হাড়টা, হাড়ে তার মাড়ি ক্ষত হয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। কুকুরটা চিন্তা করছে যে রক্ত ওই হাড় থেকেই বেরুচ্ছে, অথচ সেটা বেরুচ্ছে তার নিজেরই মাড়ি থেকে। এমনই এক স্ব-রচিত ফাঁদে আটকে আছে চিন্তার সমগ্র কাঠামো। আর সর্বক্ষণই সে স্বয়ংসৃষ্ট ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এটাই মানব প্রজাতির দুর্দশা। চিন্তা তার নিজের তৈরি ফাঁদ থেকে মুক্তিকে নামকরণ করেছে মোক্ষ, নির্বাণ, পরমানন্দ ইত্যাদি আরো কতো কি! চিন্তার ফাঁদ থেকে বের হওয়ার যত রকমের পদ্ধতি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তার সব চিন্তারই ফসল। বাস্তবে এসব পদ্ধতি চিন্তার তৈরি ফাঁদ মাত্র।
জীবন যাপনের একটি মৌলিক সমস্যা হচ্ছে অভাব ও অপূর্ণতার উপলব্ধি। অভাব দেখা দিলে আমরা বাহ্যিক জগতের বস্তুসমগ্র প্রাপ্তির মাধ্যমে অভাব মোচনের প্রচেষ্টা করি। সারা জীবন আমরা তা-ই করে এসেছি। কিন্তু আমাদের অভাব মোচন হয়নি, আমাদের পূর্ণতার উপলব্ধি এখনও আসেনি। আমি এখনও ততটুকুই অপূর্ণ যতটুকু অপূর্ণ ছিলাম কিংবা তার চেয়েও বেশি। আমার এখনও ততটুকুই অভাব রয়েছে যতটুকু ছিল কিংবা তার চেয়েও বেশি। আমার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে কারণ আমি সত্য বলে ধরে নিয়েছিলাম যে এটা বা ওটা পেলে আমার অভাব মোচন হবে, আমি পূর্ণতার উপলব্ধি প্রাপ্ত হবো।
এটা আমার অজ্ঞতা। আমার এই অজ্ঞতাও চিন্তারই ফল। ১০ বছর আগে যে অভাবের তাড়নায় আমি যুদ্ধ করেছিলাম তা আজ কোথায়? কোথায় সে আনন্দ? কোথায় সে দুঃখ? কোথায় হারিয়ে গেলো সব? কিছুই হারিয়ে যায়নি, কারণ বাস্তবে কিছু ছিল-ই না। একই ঘটনা ঘটছে আজও। আজকের এই সুখ-দুঃখও হারিয়ে যাবে। যখন মৃত্যু আসবে তখন কি থাকবে আমার? শূন্য।


আমি বুঝে গেছি যে, সকল অভাবের সৃষ্টি আমার চিন্তা থেকে। আমি উপলব্ধি করেছি যে, আমার চিন্তাই সৃষ্টি করে অপূর্ণতার উপলব্ধি। সুতরাং আমি বদলে দিয়েছি আমার চিন্তা। আমি চিন্তা করি আমার কোন অভাব নেই। আমি চিন্তা করি আমি পূর্ণ। সুতরাং আমি পূর্ণ। আমার চিন্তা সঠিক কিংবা বেঠিক নয়, পাপ কিংবা পুণ্য নয়। আমার চিন্তা কেবল আমার অভাব মোচনের অভিনব একটা পদ্ধতি।

জনগণের সেবাই প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত প্রত্যেকের কর্তব্য



জনগণের সেবাই প্রজাতন্ত্রে
নিযুক্ত প্রত্যেকের কর্তব্য

শেখ উল্লাস ॥ সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১ নং অনুচ্ছেদের ৭নং ধারার প্রথমেই বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইব”। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সংক্রান্ত ২১ নং ধারায় নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, দ্বাদশ সংশোধন আইন, ১৯৯১ (১৯৯১ সনের ২৮ নং আইন)-এর ধারাবলে রাষ্ট্রপরিচালনার ১১ নং ধারায় এ কথাটিও সন্নিবেশিত হয়েছে যে, “প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’’। বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও পদের মানক্রম অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরের মর্যাদা পেয়ে থাকেন। এই হিসেবে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান যারা রাষ্ট্রীয় ও সরকারি বেতন, ভাতা ও সম্মানী পেয়ে থাকেন তাঁরাও নিশ্চয়ই প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী সকল সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করাই তাদের কর্তব্য। উল্লেখ্য যে, 'কর্তব্য' শব্দটি একটি বিশেষণ এবং বাংলা একাডেমীর সহজ বাংলা অভিধান অনুযায়ী যা করা উচিত বা করণীয় তাই কর্তব্য।
এদিকে, সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতির ২০(১) ধারায় অধিকার ও কর্তব্য-রূপে কর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং ''প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’’-এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন। বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই এখন যোগ্যতা অনুসারে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। নিম্নস্তরের পদে কর্মরতদের বেতন-ভাতা, সম্মানী নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ থাকলেও উঁচু পদে কর্মরতদের বেতন-ভাতা বা সম্মানী নিয়ে কোনো অসন্তোষ নেই বললেই চলে। উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায়, সরকারি-বিরোধী দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও এমপিদের বেতন-ভাতাসহ অন্য যেকোনো সুবিধাদি সব সময় বাড়ানোর ব্যাপারে জাতীয় সংসদে কোনো আপত্তি উঠতে কখনো দেখা যায় না। তেমনিভাবে উচ্চপদস্ত সরকারি কর্মচারিদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ে, পদোন্নতি কার্যক্রমে সাম্প্রতিককালে তো এদেশের বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যতই থাকুক না কেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা হতে দেখা যায় না, বরং, এই ক্ষেত্রে পদোন্নতি দিতে দিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, প্রশাসনের উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের সংখ্যাটি নির্ধারিত পদের চাইতে অনেক গুণ বেড়ে গেছে। প্রারম্ভিক পদের কর্মকর্তাদের যেমন-সহকারী সচিব পদের সংখ্যাটি প্রয়োজনের তুলনায় কমে গেছে, কিন্তু অনেক বেড়ে গেছে সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্নসচিবদের সংখ্যাটি।  অনেক ক্ষেত্রে মাথাভাড়ি প্রশাসন বলতে যা বোঝায়, আমাদের দেশে এখন সেই অবস্থাটি সৃষ্টি হয়ে অত্যন্ত বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবরাই বিষয়টি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে যাচ্ছেন।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, যে বা যারা এই প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে কর্মে নিয়োজিত এবং প্রজাতন্ত্র থেকে নিয়মিত পারিশ্রমিক, সম্মানী, পদোন্নতিসহ সকল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তারা রাষ্ট্র এবং জনগণের সেবায় কতটুকু আত্মনিয়োগের চেষ্টা করছেন সেটা জানাই আজকের দিনের সবচেয়ে বেশি জরুরি। কারণ, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র সৃষ্টি না হলে এদেশের মানুষ কখনো সরকারের শীর্ষস্থানীয় পদে কর্মরত হতে পারতো না। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদে যারা কর্মরত ও দায়িত্বরত, বিশেষ করে যারা এই কর্ম ও দায়িত্ব পালনের জন্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন তাদেরকে সবার আগে অবশ্যই দেশের কথাটি স্মরণ রাখতে বাধ্য করা উচিত বলে মনে করছেন বিবেকবান মানুষেরা। দেশের আপামোর জনগণের কথা মাথায় রেখেই সংবিধানে এই ধারাটি সন্নিবেশিত হয়েছে যে, 'সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য'। দেশের বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত সম্পর্কে সামান্য অভিজ্ঞতাও যাদের আছে তারাও জানেন, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন ধরনের জটিলতা কীভাবে সেগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এবং সরকারি অফিসে দুর্নীতি থাকলে তার কুপ্রভাব বেসরকারি অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও পড়তে বাধ্য এবং এ সব কারণেই সর্বস্তরের সুশাসন প্রতিষ্ঠা আজ এতটা কঠিন হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে। দুর্নীতিতে দেশ পৃথিবীর মধ্যে রেকর্ড সৃষ্টি করছে যা সরকার ও দেশের জনগণের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ও দুঃখজনক ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা অবশ্যই বের করতে হবে।  চাকুরিকে শুধুমাত্র চাকুরি হিসেবে না দেখে একে দেশসেবার সুযোগ হিসেবে চিন্তা করে এগিয়ে গেলে প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত যেকোনো মানুষ তার নিজের জীবনকে স্বার্থক করে তুলতে পারেন। কারণ, রাষ্ট্র তার রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে রেখেছে। বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের এক্ষেত্রে সুযোগ অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সমস্যা অবশ্যই আছে। তবে আন্তরিক হলে সব সমস্যা মোকাবেলা করেই এক একজন সরকারি কর্মকর্তা তাদের জীবনকে ধন্য করতে পারেন। বাংলাদেশের প্রবাদে আছে, 'মানুষ বাঁচে তাহার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নহে'। কে কত বছর সরকারি উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন সেটা বড় কথা নয়, কে উচ্চ পদে অবস্থান করে দেশসেবা করেছেন সময়ের হিসেবে সেটাই বিবেচ্য হবে। এদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো অনেক বড় বড় আমলা বা সরকারি কর্মকর্তার নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়, যারা শুধু চাকুরিই করেননি, চাকুরির মাধ্যমে দেশসেবা করেছিলেন। স্বাধীন দেশে সরকারি চাকুরি করে এই দেশসেবার সুযোগ এখন অনেক বেশি। শুধু থাকতে হবে ইচ্ছা। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত লাখো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে এই ইচ্ছা শক্তি জাগ্রত হবে, দেশের সর্বস্তরে সুশাসন, সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হবে, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদেরকে কাজের পরিবেশ করে দেয়া হবে- এইসব প্রত্যাশাই করে দেশের বিবেকবান মানুষ।