সময়ের সাফ কথা ....
আমি চিন্তা করি আমি পূর্ণ
সুতরাং আমি পূর্ণ
সিদ্ধার্থ ॥ আমার যদি স্মৃতি না থাকে, চিন্তা না থাকে, তাহলে
কি জগতকে জগত হিসেবে চিনতে পারবো? চিন্তা ব্যতীত আমি কী? চিন্তা ব্যতীত আমি কাউকে চিনতে
পারবো না, কোন কিছুকে পৃথকভাবে সনাক্ত করতে পারবো না। কে সৃষ্টি করে স্বর্গ, নরক, দেবদূত,
অপ্সরী, শরাবান তহুরা? চিন্তা। কে সৃষ্টি করে আত্মা, জীবাত্মা, মহাত্মা, পরমাত্মা?
চিন্তা। আত্মা বলে কিছু নেই, জীবাত্মা, পরমাত্মা বলে কিছু নেই যদি এ নিয়ে চিন্তা না
থাকে। আমরা এমনভাবে কথা বলি যেন আত্মা, প্রেম, সততা, ন্যায়, সত্য এসব কোনো বাস্তব বস্তু।
কিন্তু এসব কিছুই চিন্তা। আমরা জীবনকে উপলব্ধি করি চিন্তা দ্বারা এবং জীবন যাপনের জন্য
চিন্তাকে ব্যবহার করি। এটি আমাদের চিন্তারই দূষণ যে আমরা কোন কোন বিষয়কে শ্রেষ্ঠ আর
কোন কোন বিষয়কে নিকৃষ্ট বলি। বাস্তবে কোন কিছুই উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট নয়।
চিন্তা ব্যতীত বাহ্যজগতের উদ্দীপনায়ও আমরা সাড়া দিতে পারি
না। হাতে উত্তাপ অনুভবের সাথে সাথেই আগুন সম্বন্ধে চিন্তা আসে। চিন্তা ব্যতীত আমরা
অনুভবও করতে পারি না। উদ্দীপক ও সাড়ার মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে চিন্তা। বিভক্তি সৃষ্টি
না হওয়া পর্যন্ত আমরা আগুনকে আগুন হিসেবে সনাক্ত করতে পারি না। আমাদের সকল সংবেদন চিন্তা
দূষিত। সংবেদন থেকে পাওয়া চিন্তা ব্যতীত সংবেদন অনুভব করার কোনো উপায় নেই।
উদ্দীপক ও সাড়ার মধ্যে বাস্তবে আছে কেবল পূর্ব ধারণা, যে
পূর্ব ধারণা আমরা সঞ্চয় করেছি এবং বংশ পরম্পরায় আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে এসেছে। আমরা
যাকে 'আমি' বলি তা পূর্ব ধারণার মাধ্যমেই সৃষ্টি করি, আর তারপর দেহের কর্মকা- থেকে
পৃথক হিসেবে এই 'আমি'কে অনুভব করি। 'আমি' বলে কি কিছু আছে? আমরা দৈনন্দিন জীবনে 'আমি',
'তুমি', 'সে' ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করি জীবন যাপনের প্রয়োজনে। দেহের কর্মকাণ্ড থেকে
বিচ্ছিন্ন কোনো 'আমি' আছে কি? যদি কেউ বলে আছে তবে তা কেবলই তার চিন্তা। চিন্তা ব্যতীত
নিজেকে একটি অস্তিত্ব হিসেবে অনুভব করার কোনো উপায় নেই। আমি, অহং, আত্মা যে শব্দই আমরা
ব্যবহার করি না কেন তা চিন্তারই সৃষ্টি এবং চিন্তার মাধ্যমেই আমরা চিন্তা সৃষ্ট প্রবঞ্চগুলো
অনুভব করি।
আত্মা পরমাত্মা তো দূরের কথা চিন্তা ব্যতীত নিজের দেহকে
দেহ হিসেবে অনুভব করতে পারি না আমরা। আমার আকার আকৃতি সম্বন্ধে যে সব তথ্য স্মৃতিতে
ধারণ করা আছে তার ভিত্তিতেই আমি আমাকে সনাক্ত করি। চিন্তা ব্যতীত কোন কিছু দেখার কিংবা
শ্রবণ করার উপায় নেই। চিন্তা ব্যতীত একটি পা ফেলার উপায়ও নেই। আমাদের সংবেদজ প্রত্যক্ষণ
নিজের হাতকেও হাত বলে সনাক্ত করতে পারে না। আমাদের চিন্তাই বলে যে, এটা একটা হাত এবং
এটা আমার হাত, তোমার কিংবা তার হাত নয়।
চিন্তা ব্যতীত নিজের হাতও নিজে চিনতে পারি না আমরা। হাত
সম্পর্কে যে পূর্ব ধারণা আছে তা ব্যতীত হাতকে হাত বলে সনাক্ত করার কোন উপায় নেই। শিশুকালে
আমাদেরকে বার বার শেখানো হয়েছে -এটা হাত, এটা নাক, এটা চোখ। নামকরণের মাধ্যমে অঙ্গকে
সনাক্ত করণের শিক্ষা আমরা পেয়েছি বলেই হাতকে হাত হিসেবে সনাক্ত করছি যা আমাদের চিন্তারই
উপাদান। আমার কোন নাম ছিল না। আমাকে একটা নাম দেয়া হয়েছে এবং বারবার সেই নামকরণের মাধ্যমে
আমাকে সনাক্ত করা হয়েছে, যা আটকে আছে আমার স্মৃতিতে। এভাবেই মানব জীবন আটকে আছে চিন্তার
দুষ্টচক্রে।
স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেললে আমাদের বাসস্থান হবে পাগলা গারদে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে চিন্তাই সব, চিন্তা ব্যতীত আর কিছু নেই। কিন্তু চিন্তা কী? যা-কিছু
আমরা জানি তা চিন্তার দ্বারাই জানি কিন্তু চিন্তা কী তা আমরা জানি না। কারণ যখনই আমরা
চিন্তার দিকে দৃষ্টি দেই তখন আমরা চিন্তা বিষয়ক চিন্তা দেখি কিন্তু চিন্তা দেখতে পাই
না।
চিন্তাই জন্ম, চিন্তাই মৃত্যু। চিন্তার যেখানে সমাপ্তি সেখানে
জীবনেরও সমাপ্তি। চিন্তা না থাকলে কী থাকে তা আমরা জানি না। পদার্থবিজ্ঞানীরা বস্তুর
মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন অণু, অণুর মধ্যে পরমাণু, পরমাণুর মধ্যে কণিকা, কণিকার মধ্যে কার্ক,
এবং শেষমেশ তারা বলেন যে আসলে বস্তু বলে কিছুই নেই। আছে শুধু চিন্তা। চিন্তাই সৃষ্টি
করেছে দেহ এবং চিন্তাই আবিষ্কার করেছে জন্ম, মৃত্যু, স্থান, কাল পরকাল। চিন্তাই সৃষ্টি
করেছে সময় এবং বলছে যে জীবনের একটা শুরু আছে, একটা শেষ আছে। চিন্তা স্থান-কালের বাহিরে
কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করতে পারে না। চিন্তাই স্থান ও কালের সৃষ্টি করার মাধ্যমে স্থান
ও কালে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করে কিন্তু বাস্তবে স্থান-কাল বলে কিছু নেই। যা আছে
তা হলো স্থান-কাল সম্বন্ধে চিন্তা। স্থান-কালের উদ্ভাবন না করে চিন্তা গতিশীল হতে পারে
না।
মানুষের সকল আকাঙ্খা এমনকি আকাঙ্খা শূন্য হওয়ার আকাঙ্খা
ভবিষ্যত নির্ভর। কিন্তু 'ভবিষ্যৎ' মানুষের উদ্ভট কল্পনা মাত্র। ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই।
আমরা আগামীকালের কল্পনা করি আর গতকালকে স্মরণ করি। কিন্তু বাস্তবে সময়ের কোন অস্তিত্বই
নেই। সময় শ্বাশত। শ্বাশত অর্থ অনেক বড় কোন সময় নয়, অনন্ত মানে অনেক অনেক অনেক বড় নয়।
'সময় অনন্ত' - অর্থই হলো অতীত, ভবিষ্যত নেই। বাস্তব সময় হলো এখন। আমরা সত্যকে উপলব্ধি
করতে পারি কেবল এখন। আমরা সত্য বুঝতে পারি
না বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে। অর্থাৎ চিন্তা করে সত্য উপলব্ধির কোন উপায় নেই।
আমরা এমন একটা কারাগারে বন্দী যে কারাগারটাও চিন্তারই সৃষ্টি।
আমরা এই কারাগার থেকে মুক্তি চাইছি অর্থাৎ চিন্তা নিজেই নিজের তৈরি কারাগার থেকে মুক্তি
চাইছে। চিন্তা হলো সেই কুকুরের মতো যে কুকুরটা একটা শুকনো হাড় তুললো মুখে, তারপর সে
কামড়াতে লাগলো হাড়টা, হাড়ে তার মাড়ি ক্ষত হয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। কুকুরটা চিন্তা করছে
যে রক্ত ওই হাড় থেকেই বেরুচ্ছে, অথচ সেটা বেরুচ্ছে তার নিজেরই মাড়ি থেকে। এমনই এক স্ব-রচিত
ফাঁদে আটকে আছে চিন্তার সমগ্র কাঠামো। আর সর্বক্ষণই সে স্বয়ংসৃষ্ট ফাঁদ থেকে বেরিয়ে
আসতে চাইছে। এটাই মানব প্রজাতির দুর্দশা। চিন্তা তার নিজের তৈরি ফাঁদ থেকে মুক্তিকে
নামকরণ করেছে মোক্ষ, নির্বাণ, পরমানন্দ ইত্যাদি আরো কতো কি! চিন্তার ফাঁদ থেকে বের
হওয়ার যত রকমের পদ্ধতি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তার সব চিন্তারই ফসল। বাস্তবে এসব
পদ্ধতি চিন্তার তৈরি ফাঁদ মাত্র।
জীবন যাপনের একটি মৌলিক সমস্যা হচ্ছে অভাব ও অপূর্ণতার উপলব্ধি।
অভাব দেখা দিলে আমরা বাহ্যিক জগতের বস্তুসমগ্র প্রাপ্তির মাধ্যমে অভাব মোচনের প্রচেষ্টা
করি। সারা জীবন আমরা তা-ই করে এসেছি। কিন্তু আমাদের অভাব মোচন হয়নি, আমাদের পূর্ণতার
উপলব্ধি এখনও আসেনি। আমি এখনও ততটুকুই অপূর্ণ যতটুকু অপূর্ণ ছিলাম কিংবা তার চেয়েও
বেশি। আমার এখনও ততটুকুই অভাব রয়েছে যতটুকু ছিল কিংবা তার চেয়েও বেশি। আমার সকল প্রচেষ্টা
ব্যর্থ হয়েছে কারণ আমি সত্য বলে ধরে নিয়েছিলাম যে এটা বা ওটা পেলে আমার অভাব মোচন হবে,
আমি পূর্ণতার উপলব্ধি প্রাপ্ত হবো।
এটা আমার অজ্ঞতা। আমার এই অজ্ঞতাও চিন্তারই ফল। ১০ বছর আগে
যে অভাবের তাড়নায় আমি যুদ্ধ করেছিলাম তা আজ কোথায়? কোথায় সে আনন্দ? কোথায় সে দুঃখ?
কোথায় হারিয়ে গেলো সব? কিছুই হারিয়ে যায়নি, কারণ বাস্তবে কিছু ছিল-ই না। একই ঘটনা ঘটছে
আজও। আজকের এই সুখ-দুঃখও হারিয়ে যাবে। যখন মৃত্যু আসবে তখন কি থাকবে আমার? শূন্য।
আমি বুঝে গেছি যে, সকল অভাবের সৃষ্টি আমার চিন্তা থেকে।
আমি উপলব্ধি করেছি যে, আমার চিন্তাই সৃষ্টি করে অপূর্ণতার উপলব্ধি। সুতরাং আমি বদলে
দিয়েছি আমার চিন্তা। আমি চিন্তা করি আমার কোন অভাব নেই। আমি চিন্তা করি আমি পূর্ণ।
সুতরাং আমি পূর্ণ। আমার চিন্তা সঠিক কিংবা বেঠিক নয়, পাপ কিংবা পুণ্য নয়। আমার চিন্তা
কেবল আমার অভাব মোচনের অভিনব একটা পদ্ধতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন