দরিদ্রতা অধর্মের ফল
সিদ্ধার্থ ॥ মানুষের মৌলিক চাহিদা
পূরণের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সরঞ্জামের অভাবকে সাধারণত দরিদ্রতা বলা হয়। মোটা চালের
ভাত, আলুর ভর্তা, পাতলা ডাল দরিদ্রদের নিত্যদিনের খাবার ধরা হয়। এ খাদ্য যদি দেহের
পুষ্টি সাধনের জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে নিশ্চয় তা দরিদ্রতা। বস্ত্র পরিধানের উদ্দেশ্য
- লজ্জা নিবারণ করা এবং দেহকে তাপ ও শীত থেকে
রক্ষা করা। যার লজ্জা নিবারণ ও দেহকে শীত ও তাপ হতে রক্ষা করার মত কাপড় নেই তিনি অবশ্যই
দরিদ্র। ব্যাপক অর্থে যে কোন ব্যক্তিকেই দরিদ্র বলা যাবে যদি তার আয় নিজের অপরিহার্য প্রয়োজনের চেয়ে কম হয়।
দরিদ্রতা পরিমাপের আধুনিক পদ্ধতিতে
জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্র এবং দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরিকে মানদ- হিসেবে ধরা
হয়। গ্রামে ক্যালরির এই মাত্রাটি ২৪০০ এবং শহরে ২১০০। ভোগব্যয় কতটা হলে, অন্যান্য জরুরি
খরচ করার পর ন্যূনতম ক্যালরির প্রয়োজন মিটানো সম্ভব তার আর্ধিক মূল্য নির্ধারণ করে
স্থির করা হয় দরিদ্র সীমা। অর্থ নানা প্রকারে ব্যয় করা যায়, তাই বাস্তবে কারও ভোগব্যয়
নির্ধারিত সীমার উপরে থাকা ক্যালরি ভোগের নিশ্চয়তা নয়, সামর্থ্যের পরিমাপ মাত্র।
সাধক কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন
- 'হে দারিদ্র তুমি মোরে করিয়াছ মহান, তুমি
মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান'। যে দারিদ্র মানুষের জন্য অভিশাপ আকারে দেখা দেয়, সে
দরিদ্রতাকেই নজরুল শক্তির উৎসে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন কেবল নিজ সম্পদের অনুশীলন
ও পরিচালনের মাধ্যমে। পিতৃহারা দরিদ্র শিশু নজরুল জীবিকার জন্য রুটি বানাতেন আর অবসরে
আত্মবিকাশের অনুশীলন করতেন। কিশোর বয়সে তিনি
মুয়াজ্জিন, মসজিদের ইমাম, গানের ওস্তাদ, লেটো গানের রচয়িতা, গায়ক ইত্যাদি পেশায় কাজ
করেছেন। তারুণ্যের শক্তিকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন নিজেকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে। তাই
দারিদ্র তাঁকে অপমান দেয়নি, দিয়েছে খ্রীষ্টের সম্মান। দারিদ্র তাঁকে মহান করেছে, শিখিয়েছে
সততা, সত্য, প্রেম। নজরুল প্রমাণ করেছেন - লক্ষ্যে একনিষ্ঠ থাকলে কোন প্রতিকূলতাই মানুষকে
রোধ করতে পারে না।
দরিদ্রতা প্রশংসার বিষয় নয়। দরিদ্রতার
পূজা করে নজরুল সম্মান লাভ করেননি। ধনবান হয়েই তিনি সম্মান প্রাপ্ত হয়েছেন। দারিদ্র জয় করার নামই ধর্ম।
ধর্ম পালন করতে হলে, জীবনের স্বাদ পেতে হলে দরিদ্রতার কাছে পরাজিত হলে চলবে না। সংগ্রাম
করে নিজেকে মুক্ত করতে হবে দারিদ্রের শৃঙ্খল থেকে। তবেই আত্মার বিকাশের দিকে যাত্রা
করা সম্ভব। দরিদ্রতা মানুষকে মানুষের মুখাপেক্ষী করে রাখে, আত্মাকে করে রাখে হীন, দৃষ্টিভঙ্গিকে
করে সঙ্কীর্ণ। যে যত দরিদ্র তার দৃষ্টিভঙ্গি তত সংকীর্ণ।
কিন্তু তাই বলে অর্থ আমাদের জীবনের
লক্ষ্য নয়। আত্মার বিকাশই জীবনেরই লক্ষ্য। কিন্তু দেহকে উপেক্ষা করে আত্মার বিকাশ সম্ভব
না। আত্মা দেহ থেকে মহান নয়, দেহও আত্মা থেকে মহান নয়। যতক্ষণ দেহ আছে ততক্ষণই আত্মিক
বিকাশের জন্য প্রচেষ্টা করা যায়। একটি ব্যতীত অন্যটির অস্তিত্ব নেই। সুতরাং আত্মা ও
শরীর উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। দেহ ও আত্মা সামঞ্জস্যপূর্ণ
না হলে বিকাশ সম্ভব নয়।
দেহের জন্য প্রয়োজন - খাদ্য,
পরিচ্ছন্ন বস্ত্র, আরামদায়ক আশ্রয়, বাসস্থান, এবং পরিমিত বিশ্রাম। আত্মার বিকাশের জন্য
প্রয়োজন - নিজেকে পাঠ, গ্রন্থ পাঠ, ভ্রমণ, সৌন্দর্যের উপলব্ধি এবং কবিতা, গান, নাটক,
সাহিত্য ও শিল্পচর্যার সৃজনশীল মাধ্যম। আত্মার বিকাশের জন্য আরো চাই - ভালোলাগা, ভালোবাসা,
শ্রদ্ধা, ভক্তি, সমর্পণ। দারিদ্রের মধ্যে বাস করে কেবল ভালোলাগা পর্যন্ত গিয়েই থেমে
যেতে হয়। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসার স্তরে যেতে হলে দরিদ্রতাকে অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে।
কথায় বলে - 'অভাব যখন দরজা দিয়ে ঢুকে, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। আর দরজা জানালা
সব দিক দিয়েই যখন অভাব ঢুকে ভালোবাসার তখন মৃত্যু হয়। অভাব সকল ভাবকে তাড়িয়ে দেয়। দারিদ্রের
কষাঘাতে মানুষ হারিয়ে ফেলে ভালোবাসার ক্ষমতা। কারণ - ভালোবাসা পাওয়ার নয়, দেওয়ার প্রশ্ন।
যার দেবার মতো কিছু নেই সে কেমন করে ভালোবাসবে? কেমন করে তার মধ্যে সৃষ্টি হবে শ্রদ্ধা-ভক্তি
ও সমর্পণের আকাঙ্খা?
সুতরাং নিজেকে জানার জন্য, নিজের
বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ অবশ্যই থাকা চাই। দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করে নয়, দারিদ্রতাকে
জয় করার মাধ্যমেই সম্মান লাভ হয়, ধর্ম লাভ হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন