মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

দখলের রাজনীতি আর কতদিন?

দখলের রাজনীতি আর কতদিন?

হরিভজন কুন্তল ॥ সরকারি জমি দখল করে 'জমিদার' ক্ষমতাসীনেরা। একটি দৈনিকের চট্টগ্রাম সংবাদদাতা এ শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন করেছেন গত ২১ সেপ্টেম্বর। কর্ণফুলি নদীতে জেগে ওঠা 'চর' ক্ষমতাসীনদের দখল বাণিজ্যে এখন পাঁড়-বস্তি। শুধু ক্ষমতাসীন তক্‌মাধারীরাই নয়, স্থানীয় প্রভাবশালী, ব্যবসায়ী, পক্ষ-বিপক্ষে বিরোধী রাজনৈতিক পদলেহীরাও মোটামুটি এই দখলে সম্পৃক্ত। সরকারি সম্পত্তি দখলের ইতিহাস অতি প্রাচীন না হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে চার দশক সময় ধরে  বেশ দাপটের সাথেই ইতিহাসের পরিসর প্রশস্ত হয়েছে। সংশ্ল্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট কোন রেকর্ড নেই যে, কী পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি বেহাত কিংবা জবর দখল হয়েছে অপরাজনীতির মারপ্যাচে। যখন-যারা ক্ষমতায় এসেছেন তখন-তাদের দলীয় লোকজন  সরকারি সম্পত্তি গ্রাস করায় মেতে উঠেছেন।  দখলবাজরা এই আগ্রাসী মত্ততাকে আইনের প্যাচে কিংবা প্রশাসনিকভাবে রোধ করার যে কোন পথ বন্ধ করে কাজটি সম্পন্ন করে। এরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যাতে প্রতিহত করাতো দূরে থাক সময়তে ক্ষমতাসীনরাও এর মদদ জুগিয়ে চলে। দখল শব্দটির উৎপত্তির ইতিহাস জানা না থাকলেও দখলের অভিজ্ঞতা প্রায় অনেকেরই কম বেশি আছে। নদী, নালা, খাল, বিল, হাওড়, জঙ্গল, পুকুর, জলাশয় এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা ভিপি সম্পত্তি যা-ই হোক না কেন দখল হয়ে যায়, যদি থাকে পিছনে সরকারি দলের প্রভাব। জানা গিয়েছে এ বছর অধিকাংশ কুরবানি পশুর হাটের দখলও চলে গেছে ক্ষমতাসীনদের দখলে। কেউ কেউ আবার সরকারি সম্পত্তি দখল করে নিজ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক হবার খায়েশ পূর্ণ করছেন। এরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে ঢাকার শাহজাহান পুরের রেলওয়ের জমি দখল করে গড়ে উঠা 'মির্জা আব্বাস মহিলা কলেজ'। সারা দেশে এরকম চিত্র বহু আছে। আগারগাঁও বিএনপি বস্তি এখন তো বেশ বিখ্যাত চোরাকারবারি মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য। হাট বাজার অফিস আদালত সর্বত্রই এই দখল বাণিজ্য আছে, তার প্রত্যেকটার সাথে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার রাজনীতিও আছে। ঢাকা শহরের একটি ফুটপাতও খুঁজে পাওয়া যাবে না যেটি বাণিজ্যিক দখলে নেই, সংশ্লিষ্টদের চাঁদা দিয়ে কয়েক লক্ষ হকার রাজধানী দখল করে আছে। নবাবপুরের বিখ্যাত রাস্তাটি এখন চলাচলের অযোগ্য। বিকেল বেলা দক্ষিণ বঙ্গের যাত্রীরা অনুধাবণ করতে পারেন দখল কাকে বলে, ঘাটে পৌঁছাতে তাকে পোহাতে হবে চরম দুর্ভোগ! তিনি লঞ্চে উঠতে পারবেন না, গুঁতো খেয়ে নিচে পড়ে ওখানকার মানুষের করুণা চাইবেন। বেঁচে থাকলে স্বজনের কাছে ফেরা হবে নয়তো ওখানেই শেষ।

দখল ও টেন্ডার বাণিজ্যের কথা আমরা সকলেই জানি, ক্ষমতাসীনরাও জানেন কিন্তু ক্ষমতার অলিখিত খাতায় সেটি  যায়েজ। তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি যতো হোক প্রতিকারের রাস্তা আমাদের গণতন্ত্রের সংসদ আজ অব্দি খুঁজে পায়নি, অবশ্য তাদের মাথায়ও আসেনি, কারণ সংসদ পর্যন্ত আসতে তাদের অনেককেই দখল বাণিজ্যের বিস্তার ঘটিয়েই আসতে হয়েছে। সেই সুনামেই দলীয় টিকিটের নিশ্চয়তা এবং নির্বাচিত। এখন তারা কী করে দখলের বিরুদ্ধে সংসদে বিতর্ক চালাবেন? তার চেয়ে ভালো নয় কী বিরোধীদের পিণ্ডি চটকানো? তারা সেটাই করছেন। ইতিহাস, ভূগোল এক করে খিস্তি খেউড়ের জলসা। বেশ চলছে। না চলবার কারণ নেই, ওটাও যে দখলেরই প্রাপ্তি। দখল করতে ত্রিশ হাজার ঝাউ কাছ কেটে ফেললেন এক সাংসদ, কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের ন্যূনতম সাহসও ছিলোনা তাকে প্রশ্ন করে। পরে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হয়েছিলো, তাতে মামলাও হয়ে ছিলো তখন কিন্তু সে মামলার কোন কিনারা হয়েছে আজ অব্দি আমরা শুনিনি। খেপুপাড়ার তখনকার পানিমন্ত্রী তো দখলের বন্যা বইয়ে দিয়ে ছিলেন তার এলাকায়। এবার অবশ্য তিনি মন্ত্রী হতে পারেননি তবে     জবর-দখলের জন্য তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয়েছে শুনিনি। দেশের যতগুলো সরকারি হাসপাতাল এবং জেলখানা আছে তার সব কয়টাই ক্ষমতাসীন দলের  টেন্ডারবাজদের দখলে, বেশ আছেন তারা রোগীর খাদ্য ঔষধ আর কয়েদীদের আহার মেরে দিয়ে। চিড়িয়াখানাও বাদ যায় না। এসব এখন সাধারণ। কারণ রাজনীতির দখলদারিত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে জবর-দখলের বাণিজ্য স্থান পুরণ করে নিয়েছে। তাই ঘরে বাইরে, আসমানে   কিংবা জমিনে সর্বত্রই দখল বাণিজ্য। তার সবটাই রাজনীতির নামে, রাজনীতিকদের সীমাহীন ভোগ-বিলাসী আকাঙ্খা পুরণের জন্য, জনঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। তাইতো নির্বাচন দিয়ে দখলি রাজনীতির ইতিহাসটা পোক্ত করার সকল ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন। রাজনীতির বিদায়, অনেকটা 'গুডবাই লন্ডন হান্ড্রেড ইয়ার্সের' মতো। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন