মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

প্রাথমিক শিক্ষাকে বাণিজ্যিক চক্রের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা জরুরি

প্রাথমিক শিক্ষাকে বাণিজ্যিক চক্রের
করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা জরুরি

শেখ উল্লাস ॥ দেশে দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা নিয়ে ভিন্নতা থাকলেও সচেতন গবেষক ও বিশ্লেষকদের মতে, দেশের পাঁচ-ছয় কোটি মানুষই দরিদ্র। আর এই দরিদ্র মানুষগুলোর বিরাট অংশেরই বাস ঢাকা বিভাগে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)’র যৌথ উদ্যোগে গত ২৭শে আগষ্ট প্রকাশিত বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে দেখানো হয়েছে, দেশের দরিদ্র মানুষের ৩২ শতাংশই বাস করে ঢাকা বিভাগে। এই দরিদ্র মানুষের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য এখনো পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোই ভরসা। কিন্তু এই বিদ্যালয়গুলো যে কী অবস্থায় আছে তা সচেতন মানুষদের ভালোই জানা আছে। রাজধানীর বাংলাদেশ সচিবালয়ে অবস্থিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বেইলি রোডের একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হলে শিক্ষার্থীদেরকে খোলা আকাশের নিচে পরীক্ষা দেয়ার ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার তৈরি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক লিখেছে, ‘ঢাকা মহানগরের ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টির জমি ও শ্রেণীকক্ষ বেদখল হয়ে গেছে। ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে দখল হওয়া এসব জমির পরিমাণ ২৪০ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে সাত বিঘা। ৩৪২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টির জমি বেদখলে গেলেও বাকীগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। সাধারণ ঘরের সন্তানদেরও এখন এসব বিদ্যালয়ে পাঠানো হয় না।  একেবারে নিম্ন ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা এখানে পড়তে যায়। এগুলোর ওপর বেশি জোর দেয়া উচিত’। এসব চিত্র থেকে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী এবং শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাজমান বাস্তবতা চোখের সামনে ভেসে উঠে যা রীতিমতো উদ্বেগজনক।
সূফী সাধক আনোয়ারুল হক্‌ বলতেন - ‘চারা গাছে পানি দিয়েন’। মানবতার মহান ব্রতে জীবনকে উৎসর্গকারী এই মহান সাধকের সান্নিধ্য লাভ করে যিনি তাঁর আদর্শ ধারণ, পালন ও লালন করে যাচ্ছেন তাঁর মুখে এই বাণীটি প্রায়ই শোনা যায়। চারা গাছ বলতে সাধক কোমলমতি শিশুদেরকেই বুঝিয়েছেন। কারণ, শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। দেশ ও সমাজের নেতৃত্ব দেবে এই শিশুরাই। চারা গাছের যত্ন না নিলে যেমন গাছটি সুন্দর ও সুস্থভাবে বড় হবে না, বয়স্ক হলেও ঠিকমতো ফুল বা ফল দিতে পারবে না, মানুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মানুষের বাচ্চাকেও ঠিক মতো যত্ন ও শিক্ষা না দিলে সেও মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে না। কোমলমতি শিশুদের যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য সবার আগে প্রয়োজন একটি সুন্দর পরিবেশ ও সত্যিকারের দিক নির্দেশনা। একটি ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত একটি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই একজন শিশু সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার পরিবেশ খুঁজে পেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রায় শতভাগ বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক খাতে চলে গেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-গুলোকে করা হয়েছে অচ্ছ্যুৎ। পারত পক্ষে কোনো মা-বাবা তাদের ছেলেমেয়েকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ান না। আবার নামী-দামী স্কুলগুলোতে ভর্তি করিয়েও স্বস্তিতে নেই তারা। এসব কারণে কোমলমতি শিশু এমনকি তাদের মা-বাবা ও অভিভাবকরাও মোকাবেলা করছেন চরম বিব্রতকর অবস্থা। যেসব মা-বাবা অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক, অনেক বেশি খরচ করে যারা তাদের সন্তানদের বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পাড়ছেন, তাদের কথা হয়তো আলাদা। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষই তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। কারণ, স্কুল যতই নামী-দামী হোক না
কেনো, ‘কোথাও পড়াশোনা হয় না, শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ায় না, আলাদা কোচিং করতে হয়’- এ সব অভিযোগ এখন মানুষের মুখে মুখে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া শহরে বিশেষ করে রাজধানীতে বসবাসকারী মা-বাবারাও এখন স্বস্তিতে নেই, থাকতে হয় মারাত্মক চাপের মধ্যে। কারণটা এক দিকে যেমন অর্থনৈতিক, ঠিক তেমনিভাবে মানসিক। কারণ, শিক্ষকদের প্রতিও অভিভাবকদের আস্থা উঠে গেছে, শিশুরা কোমল বলে, ঈশ্বরের প্রতীক বলে, সরল মনে প্রথম প্রথম তারা শিক্ষকদেরকে গুরুত্ব দিলেও তা বেশিদিন টেকে না, কিছুদিন পরেই বুঝে যায় যে, শিক্ষকের সাথে তাদের সম্পর্কটিও ছিল অর্থনৈতিক। আদর্শ ও নৈতিকতার কোন স্থান সেখানে ছিল না। অবস্থাটা এরকম যে, সবাই  ছুটছে শুধু টাকার পেছনে, সেখানে শিক্ষকেরই বা দোষ কী? আশঙ্কা হচ্ছে,  প্রাথমিক স্তরে বিরাজমান এই অবস্থা জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। চারা গাছের সঠিক যত্ন নেয়া হচ্ছে না বলে এই জাতীয় সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়।
ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসন- শোষণ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর এদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে দেশের প্রায় সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি হয়ে যায়। এরই ফলশ্রুতিতে একদিকে প্রাথমিক শিক্ষকরা সরকারি শিক্ষক হিসেবে নিজেদের মর্যাদা পায়। অপরদিকে, বিনা বেতনে কোমলমতি ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করে।
এভাবে স্বাধীনতার অব্যহিত পরে দেশে প্রাথমিক শিক্ষার জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। স্বাধীনতার ৪৩ বছরের মাথায় আজ যারা এদেশে শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজসেবা, চিকিৎসাসহ প্রশাসনের সর্বস্তরে উচ্চ পদে আসীন, খোঁজ নিলে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছিল গ্রাম-মফস্বলের সেইসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। অথচ আজ দুঃখজনকভাবে দেখতে হয় এই উচ্চপদে আসীনদেরই চোখের সামনে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদেরই সহযোগিতায় ও হস্তক্ষেপে দেশের সরকারি ব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় কবর রচনা করে এই খাতকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়ী চক্রের কাছে। এই প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা এখন তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধারে কাছেও পাঠান না।
এসবেরই পরিণতিতে দেশে গড়ে উঠেছে কিন্ডার গার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সনসহ বিভিন্ন নামে আরো অনেক রকমের শিক্ষা ব্যবস্থা! এছাড়া দেশি-বিদেশি অশুভ চক্রের সহযোগিতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন রকমের মাদ্রাসা শিক্ষা, যেখান থেকে তৈরি হচ্ছে ধর্মান্ধ ও পরনির্ভরশীল একটি গোষ্ঠী যারা সমাজ ও দেশের শান্তি প্রিয় পরিবেশের পথে হয়ে উঠছে ভয়াবহ প্রতিবন্ধক। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে দেশে সুবিধা বঞ্চিত দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কাটা রয়েই যাবে।

দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলেও এই মানুষদেরকে শিক্ষিত করে  তোলার কোনো বিকল্প নেই। আর এর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আবারো নতুন চিন্তা-ভাবনা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। কোমলমতি শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির মানুষদের হাতে তুলে দেয়াকে কোনোভাবেই আর বুদ্ধিমানের কাজ বলে মেনে নেয়া যাচ্ছে না- সংকীর্ণ স্বার্থে আহম্মকের কাজ বলেই  প্রতীয়মান হচ্ছে বিবেকবান মানুষের কাছে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন