মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না : প্রধানমন্ত্রী

ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না : প্রধানমন্ত্রী

সংলাপ ॥ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিরুদ্ধে সচেতন করার পাশাপাশি ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনার বিপক্ষে বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৬ আগস্ট, মঙ্গলবার এই বছরের হজ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে তিনি বলেন, “ইসলাম শান্তি ও প্রগতির ধর্ম। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে কেউ ইসলামের বদনাম করুক - এটা আমরা চাই না।” রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার -এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে”। তিনি বলেন, “ধর্ম একটি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।”
বস্তুত, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধ্বজাধারীরাই ধর্মকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে। ইসলামের মতো মহান ধর্মকে, ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা পরিণত করেছে তাদের আত্মস্বার্থ হাসিলের ধর্মে। বাংলাদেশে ধর্ম ব্যবসা এখন সবচেয়ে বড় ব্যবসা। অথচ এদেশের মানুষ বারবার প্রতারিত হয়েছে ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে।
নবী (সা.)-এঁর তিরোধানের পর থেকেই আরবে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি ও সংঘাত শুরু হয়। রাজনীতির সাথে ধর্ম মিশ্রিত হলে সংঘাত অনিবার্য। কারণ, রাজনীতিতে দলের বিরুদ্ধে দলের সমালোচনা, কুৎসা রটনা এবং বিষোদগার করা স্বাভাবিক ব্যাপার। কোন রাজনৈতিক দলের নামের সাথে ইসলাম যুক্ত হলে এবং তা নিয়ে নির্বাচন ও ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে স্বাভাবিক কারণেই তা চরমভাবে বিতর্কিত ও সমালোচিত হবেই হবে। নির্বাচন ও ভোটের লক্ষ্য সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা, সেক্ষেত্রে সাধারণ ভোটাররা ইসলামের নামে আবেগ তাড়িত হয়, তাই সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে পারে না।
একজন সফল রাজনীতিককে শেয়ালের মতো ধূর্ত আর সিংহের মতো হিংস্র হতে হয়। কিন্তু একজন ধার্মিক ব্যক্তিকে হতে হয় নম্র, বিনয়ী, সত্যবাদী। মুসলিম শব্দের অর্থ - শান্ত, ভদ্র। যে ব্যক্তি শান্তি ধারণ, পালন ও লালন করেন তিনিই মুসলিম। মুসলিমের লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল নয়, আল্লাহ্র নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন। তাই ব্যক্তিগত, দলীয়, বংশীয় স্বার্থে ইসলামের ব্যবহার কুরআনে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ হয়েছে এবং এজন্য কঠোর শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা একটা ইহজাগতিক ব্যাপার আর আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ পারলৌকিক। কুরআন বলছে - ‘যারা পারলৌকিকতার বিনিময়ে ইহজাগতিকতা খরিদ করে তাদের শাস্তি শিথিল করা হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না।’ (২:৮৬)।
ইসলামী দলগুলো বলে, মহানবী (সা.) নাকি রাজনীতিক ছিলেন! মোহাম্মদ (সা.) রাজনীতি করেছেন এটা মেনে নিলে মেনে নিতে হয় যে ইসলাম একটি রাজনৈতিক দল।  কুরআন মতে রসুল (সা.) ছিলেন - স্পষ্ট সতর্ককারী (৩৮:৭০), বার্তাবাহক (৭:১৫৭) সুসংবাদদাতা (৭: ১৮৮)। জ্ঞানময় কুরআনের শপথ করে আল্লাহ্‌‌ বলেছেন যে, তিনি অবশ্যই প্রেরিতদের মধ্যে একজন (৩৬ : ১)  তিনি পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী (২৫ : ৩২) কিন্তু রাজনীতিক অবশ্যই নন। আল্লাহ  সুবহানুতায়ালা মোহাম্মদ (সা.)-কে ‘হে রসুল’ বলে ডাক দিয়েছেন। মোহাম্মদ (সা.) এঁর বিদ্রুপকারীরা তাঁকে পাগল, যাদুকর বলেছে কিন্তু বিদ্রুপ করেও কেউ কখনো তাঁকে রাজনীতিক  বলেনি।  অথচ এখন একদল ক্ষমতালোভী মানুষ ক্ষমতার স্বার্থে আল্লাহ্‌র রসুলকে রাজনীতিক বানিয়েছেন। আল্লাহ যাঁকে একবারও রাজনীতিক বলেননি মানুষ কেমন করে কোন্‌ সূত্রে তাঁকে রাজনীতিক বলে অভিহিত করে? এরা কারা? এরা কি মোহাম্মদ (সা.)-কে রাজনীতিক বলে তাকে সম্মান করছেন  না  অসম্মান করছেন এ প্রশ্ন আজ বিদ্ধ করছে রসুল (সা.) ভক্ত মুসলিমদের বিবেক।
আল্লাহ বলেন - ‘যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন কাজের  দায়িত্ব  আপনার নেই’। (৬:১৫৯)। সম্ভবত এ কারণেই মহানবীর (সা.) একনিষ্ঠ ভক্ত হযরত আবু জর গিফারি বলেছিলেন - ‘আমার লাশ যেন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কোন ব্যক্তি স্পর্শ না করে।’ মোহাম্মদ (সা.) কোন দলের  স্বার্থে পৃথিবীতে আসেননি। তিনি পৃথিবীতে এসেছেন সমগ্র মানবজাতির জন্য।  আল্লাহ বলেন - ‘(হে মোহাম্মদ!) আমি তো আপনাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে পাঠিয়েছি, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ তা বুঝে না।’ (৩৪:২৮)। ‘প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট। সুতরাং ওদের কিছু কালের জন্য বিভ্রান্তিতে থাকতে দিন। (২৩:৫২-৫৪)।
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার চলতে থাকলে বাংলাদেশ তথা গোটা  বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটতে পারে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্কের। এমনকি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বও পৃথিবীকে এক নারকীয় অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে মানব সমাজ ক্রমান্বয়ে সচেতন হয়ে উঠছে। কিন্তু ধর্মের অপপ্রয়োগ নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো উদ্যোগ নেই। বরং বিশ্ব জুড়েই ধর্মের অপব্যাখ্যা উগ্রবাদকে উস্‌কে দিচ্ছে। একশ্রেণীর ধর্মবেত্তা এই অপকর্মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের উদ্ভব হয়েছে মানবতার পতাকাকে সামনে রেখে। অথচ সেসব ধর্মের অপব্যাখ্যার কারণে মানবতাবাদ নির্বাসনে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

কুরআনের নিষেধাজ্ঞা ও ইসলামের রীতি-নীতিকে উপেক্ষা করে যারা ইসলামকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছে তারা ধর্ম ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। এসব অপরাধীদের ব্যাপারে নবী মোহাম্মদ (সা.) এঁর আদেশ হলো - ‘যে কেহ কাউকে অপরাধরত দেখবে তৎক্ষণাৎ তাকে হাত তথা বলপ্রয়োগ করে হলেও তা থেকে বিরত করবে, আর যদি সে ক্ষমতা না থাকে তাহলে মুখে বারণ করবে, আর তাও যদি না পারে, তাহলে ঐ অপরাধকারীকে মনে মনে ঘৃণা করবে, এটা হলো দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন