মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

আমি মানুষ হতে চাই

আমি মানুষ হতে চাই

সিদ্ধার্থ ॥ মানুষ শব্দটি এসেছে 'মনুষ্য' শব্দের অপভ্রংশ হিসাবে। মনু+ ষ্ণ্য (অপত্যার্থে)=মনুষ্য। অর্থাৎ মানুষ মনুর সন্তান এবং দানব দনুর সন্তান। ইংরেজি Man, জার্মান MannMensch, আবেস্তান Manu ইত্যাদি সব শব্দ একই উৎস সম্ভূত। মানুষের নানা রূপ। মানুষ যখন অনুভূতিশীল তখন মানুষের বিপরীত শব্দ অমানুষ, মানুষ যখন মানব জাতি, তখন বিপরীত শব্দ মানষ্যেতর, মানুষ যখন পরিণত বা প্রাপ্তবয়ষ্ক তখন বিপরীত শব্দ ছেলেমানুষ।
মানুষ শব্দের ক্রিয়াপদ 'মানুষ করা'। মানুষ করা অর্থ - লালন-পালন করা ও উপযুক্ত শিক্ষা দান করা। মানুষ  শব্দের দ্বিতীয় ক্রিয়াপদ মানুষ হওয়া। মানুষ হওয়া মানে সত্য বলা, কারো ক্ষতি না করা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, বিপদে-আপদে অন্যকে সাহায্য করা, সদাচরণ করা। সবাই যদি মানুষ হতো তাহলে মানব জাতি সুখে শান্তিতে থাকতো। আইন, আদালত, থানা, পুলিশ, পার্লামেন্ট কোন কিছুর প্রয়োজন হতো না। কারো কোন অভাব থাকতো না। আনন্দ ও সমৃদ্ধি থাকতো সর্বত্র।
হাজার হাজার বছর ধরে নবী, রসূল, ওলি, সাধক, শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক সকলেই মানুষকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ। মানুষ এখন বন্য জানোয়ার থেকে নিরাপদ কিন্তু মানুষ থেকে নিরাপদ নয়। সর্বদাই অমানুষের ভয়ে অস্থির থাকে মানব জাতি। সামান্য একটু খোঁচা দিলে ভদ্র মানুষগুলোও অভদ্র হয়ে ওঠে; চিৎকার চেঁচাম্যাচি, গালাগালি শুরু করে; ঝগড়া-মারামারি লেগে যায়; - কেন এমন হয়?
আমাদের শরীরটা আসলে মানুষ না। এটা অন্য সব পশুর মতই একটা পশু। পশু ভালো-মন্দ বোঝে না। একটি গাভি ফুলের বাগানে ঢুকে পড়লে মহূর্তের মধ্যে নির্ভয়ে সকলের সামনে বাগান নষ্ট করে দেয়। গাভি বুঝে না যে, এ কাজটা ভাল না। কিন্তু কোন মানুষ যখন বাগান নষ্ট করে তখন সে তা করে লুকিয়ে যেন কেউ না দেখে কারণ সে জানে যে এটা মন্দ কাজ। যে মানুষটি ভালো-মন্দ নির্ণয় করে সে কিন্তু শরীর নয়। লৌকিক ভাষায় আমার একে বিবেক বলি। ভালো কাজ করলে বিবেকের কাছে ভাল লাগে, খারাপ কাজ করলে বিবেক দংশন করে। মানুষের বিবেক আছে, পশুর বিবেক নেই। প্রশ্ন হলো - ভালো-মন্দ বুঝেও মানুষ মন্দ কাজ কেন করে?
যখন খিদে লাগে তখন দেহটা খাবার চায়। আমরা তখন তাকে খেতে দিই। আমরা যখন নির্ণয় নেই - উপবাস ব্রত পালন করব তখন দেহের দাবি আমরা উপেক্ষা করি। দেহ খাবার চাইলেও তাকে খেতে দেই না।
এতে করে দেহের উপর বিবেকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বিবেক সবল হলে দেহের বিরুদ্ধ দাবি পূরণ করে না। বিবেকের শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বিবেক যদি দুর্বল হয় তাহলে দেহ যখন যা চায়, তা-ই দিতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ  যার বিবেক কাজ করে সে মানুষ অর্থাৎ যে বিবেকের প্রয়োজনে দেহের দাবিকে অগ্রাহ্য করার শক্তি রাখে সে মানুষ। আর কোন বিচার বিবেচনা না করে দেহ যা চায় তা-ই যে দিতে বাধ্য হয় সে পশু।
মানুষ হতে হলে দেহের উপর বিবেকের কর্তৃত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিবেক যে কাজকে মন্দ বলে, দেহ দাবি করলেও তা পূরণ করা যাবে না। আমাদেরকে যখন কেউ অমানুষ বলে তখন নিজের কাছেই খারাপ লাগে। অমানুষের মতো কাজ করলে খারাপ লাগে না কিন্তু কেউ অমানুষ বললে কেন যে খারাপ লাগে তা এখনও খুঁজে পেলাম না।
ছোট বেলা থেকে বাবা মা কতো চেষ্টাই না করেছেন আমাদেরকে মানুষ বানাতে। মক্তবে, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন; এমনকি বিদেশে পর্যন্ত পাঠিয়েছেন মানুষ হওয়ার সর্বোচ্চ শিক্ষা নিতে। কিন্তু বড়ই আফসোস! আমি মানুষ হতে পারলাম না।  মানুষ হওয়ার চেষ্টা আমি করেছি বটে। মানুষ হওয়ার প্রয়াসে আমি বুঝেছি - মানুষ হওয়া খুব কষ্ট। অনেক কষ্ট ও ক্ষতির পর কেউ মানুষ হয়। তাই ভাবলাম, মানুষ হওয়া যখন এত কষ্টের তাহলে আমি মানুষ না হয়ে বরং অমানুষই হই! কিন্তু অমানুষও আমি হতে পারলাম না! ভেবে দেখলাম অমানুষ হওয়া মানুষ হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি  কষ্টের ও লাঞ্ছনার।
আমি কষ্ট ও ক্ষতি স্বীকার করতে চাই না তাই মানুষও হতে পারলাম না, অমানুষও হতে পারলাম না। আমি সুবিধাবাদী হয়েছি। কখনও মানুষ, কখনও অমানুষ। আমি কখনো সত্য বলি, কখনো মিথ্যা বলি; আমি কখনো উদার কখনও সংকীর্ণ; কখনো স্বপ্ন দেখি কখনও বা দুঃস্বপ্নে আঁৎকে ওঠি, কখনো ভালোবাসি কখনো ঘৃণা করি।

একবার এই দিকে আরেকবার ওইদিক দুলছি আমি। দুলতে দুলতে আমি ক্লান্ত, আমার মাথা ঘুরছে, আর ভালো লাগছে না, সহ্য হচ্ছে না। এবার আমি এক বিন্দুতে স্থির হওয়ার নির্ণয় নিয়েছি। আমি মানুষ হতে চাই। কতো মানুষ কতো ভাবেই না চেষ্টা করেছে আমাকে মানুষ বানাতে কিন্তু কেউ আমাকে মানুষ বানাতে পারেনি। আমাকে মানুষ হতে হবে নিজ প্রয়াসে। নিজের ধর্ম নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি তখন নিচে নেমে পশু হতে চাই না, উপরে ওঠে মানুষ হতে চাই।

কোন নির্দিষ্ট পোশাক ধর্মের পরিচয় নয়

সময়ের সাফ কথা ....
কোন নির্দিষ্ট পোশাক ধর্মের পরিচয় নয়

সংলাপ ॥ পোশাক পরিচ্ছদ সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শন। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে তা বিভিন্ন। মধ্যপ্রাচ্যের পুরুষরা হিজাবের মতো পোশাক পরিধান করে, সূর্যের প্রখর উত্তাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য। আবার সাইবেরিয়ার মুসলমানগণ ভাল্লুকের চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধান করে তীব্র শীত থেকে আত্মরক্ষার জন্য। পোশাক পরিচ্ছদ পরিবেশ থেকে রক্ষা এবং ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও পরিবেশ ও প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভদ্র ও শালীন পোশাক পরিধান করা শ্রেয়। আল্লাহ তায়ালা দীনের ব্যাপারে মানুষের উপর কোন সংকীর্ণতা আরোপ করেননি (দ্রষ্টব্য কুরআন ২২:৭৮)।
ইসলাম ধর্মের কোন নির্দিষ্ট পোশাক নেই। ইসলাম সমগ্র মানবজাতির জন্য। গরমের দেশে, শীতের দেশে, নাতিশীতোষ্ণ দেশে সবরকম আবহাওয়ায় বসবাসকারী সবার জন্য এক রকম পোশাক পরিধানের নির্দেশ যদি থাকতো তা হলে ইসলাম সমগ্র মানবজাতির জন্য না হয়ে কেবল নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকতো। তাই আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা.) নির্দিষ্ট কোন পোশাক পরিধানের আদেশ দেননি। বিশ্বনবী (সা.)-এঁর সময়ে তাঁর নিজের এবং সাহাবাদের পোশাক-পরিচ্ছদ এবং তখনকার আরব অমুসলমানদের পোশাক-পরিচ্ছদ একই ছিলো। বর্তমানেও আরবের মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা একই রকম পোশাক পরিধান করে। আরব দেশে পোশাক দেখে কে মুসলমান, কে খ্রিষ্টান আর কে ইহুদি তা নির্ণয় করা যায় না।
পোশাক পরিধানের কারণ - লজ্জানিবারণ, সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং শীত ও উত্তাপ থেকে দেহকে রক্ষা করা। তাই শীতপ্রধান দেশের মুসলমানদেরও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের অনুকরণে  পোশাক পরিধান করতে হবে এ ধারণা করা নিছক মূর্খতা। আল্লাহ্‌ বলেন, 'হে নবী, তুমি বলো আল্লাহ্‌ তায়ালার দেয়া সৌন্দর্যমন্ডিত পোশাক এবং পাক পবিত্র খাবার তোমাদের জন্যে কে হারাম করেছে?' (কুরআন ৭:২৬)। এ আয়াত প্রমাণ করে - সুন্দর, মার্জিত ও রুচিশীল সব ধরনের পোশাকই মুসলমানের পোশাক। প্যান্ট-শার্ট-টাই-স্যুট ইত্যাদি কোনকিছুই মুসলমান পুরুষের পোশাক হতে বাঁধা নেই।

কুরআনের কোথাও দাড়ি রাখা ও নির্দিষ্ট ধরনের পোশাক পরিধানের নির্দেশ নাই। কুরআন মতে তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম। আল্লাহর বাণী - 'হে আদম সন্তানরা, আমি তোমাদের উপর পোশাক সংক্রান্ত বিধান পাঠিয়েছি, যাতে করে তোমরা তোমাদের গোপন স্থানসমূহকে ঢেকে রাখতে পারো এবং নিজেদের সৌন্দর্যও ফুটিয়ে তুলতে পারো, তবে আসল পোশাক হচ্ছে তাকওয়ার পোশাক।' (কুরআন ৭:২৬)। 

কি বলে কুরআন

খাদ্যে বিষ -
কি বলে কুরআন

·        'হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তারা কখনো একে অপরের ধন-সম্পত্তি অবৈধ ভাবে গ্রাস করো না। ব্যবসা-বাণিজ্য যা করবে তা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই করবে এবং কখনো একে অপরকে হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি মেহেরবান।' (সুরা নিসা:২৯)।
·        'যারা (অন্যায়ভাবে ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করবে) আমি নিশ্চয় তাকে আগুনে পোড়াব।'   (সুরা নিসা:৩০)।
·        'হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা-কিছু হালাল ও বিশুদ্ধ খাদ্যদ্রব্য রয়েছে, তা থেকে তোমরা আহার করো আর তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।' (সুরা বাকারা:১৬৮)।

আরিফিন হক ॥ সুরা নেসার ২৯ নং আয়াতে 'অবৈধ ভাবে গ্রাস' বলতে আল্লাহ্‌র অননুমোদিত সকল পন্থাই বুঝানো হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল, প্রতারণা, ঘুষ, জুয়া, মওজুতদারী, কালোবাজারী এবং সুদসহ যাবতীয় নিষিদ্ধ বেচাকেনা এর আওতাভুক্ত। পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমেই লেনদেন বৈধ হতে পারে এবং পারস্পরিক সম্মতি অবশ্যই ন্যায় ভিত্তিক হতে হবে। অর্থাৎ লেন-দেন এমন হতে পারবে না যে, একজনের লাভ আর একজনের ক্ষতির মাধ্যমে অর্জিত হয়।
'কখনো একে অপরকে হত্যা করো না' আয়াতের এই অংশটির তাৎপর্য ব্যাপক। আল্লাহ্‌র হুকুম - আমরা নিজের জীবনের জন্য যেমন সাবধানতা অবলম্বন করি অন্যের জীবনের জন্যও তেমনি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ব্যবসায় অধিক লাভের আশায় এমন কিছু করা যাবে না যা অন্যের জীবনের জন্য ক্ষতিকর হবে। আমাদের দেশে জীবন রক্ষাকারী খাদ্যে এখন ফরমালিন, কার্বাইড, ইউরিয়া, হাইড্রোজ, ক্ষতিকর রং, এমাইলাম, ইথোপেনসহ নানা ক্ষতিকর ও রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হচ্ছে। পুকুরের মাছ ও আনারসে ব্যবহার করা হচ্ছে হরমোন। গরু, ছাগল ও মুরগিকে দেয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ রাসায়নিক খাদ্য। খাদ্যদ্রব্যে এ জাতীয় বিষের মিশ্রণ দেয়া নিজের ভাইকে হত্যার শামিল। এই হত্যাযজ্ঞেরই তা-বলীলা চলছে এখন বাংলাদেশে। দেশের ১৬ কোটি মানুষ আজ  ফরমালিনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। প্রতি বছর ৪০০ টন ফরমালিন ঢুকছে মানুষের পেটে। ফরমালিনের প্রভাবে জীবনঘাতী রোগের বিস্তার ঘটছে। ক্যান্সার, চর্মরোগ, আলসার, লিভার ও কিডনি সংক্রান্ত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে; শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে; কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হচ্ছে। রসূল (সা.) বলেছিলেন, 'মানব জাতির কাছে এমন একটা যমানা আসবে, যখন মানুষ কামাই রোজগারের ব্যাপারে হালাল হারামের কোন পরওয়া করবে না।' এটাই যেন সেই যমানা। রসূল (সা.) স্বয়ং হাট-বাজারে গিয়ে তদারকি করতেন এবং কোন অন্যায় তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে তৎক্ষণাৎ তা বন্ধ করে দিতেন। এক শস্য ব্যবসায়ীর দোকানে খাদ্যশস্যের স্তুপ এমনভাবে সাজানো ছিল যে, তার উপরিভাগ ছিল শুষ্ক আর নিচের দিকের শস্য ছিল ভেজা। নবী করীম (সা.)-এঁর সামনে ব্যাপারটি ধরা পড়ে যায়। তখন তিনি দোকানীকে লক্ষ্য করে বললেন, 'তোমার খাদ্যশস্যের নিচের ভেজা অংশ স্তুপের উপরে রাখলে না কেন? তাহলে ক্রেতারা তা দেখতে পেত এবং বুঝে-শুনে ক্রয় করতো। জেনে রাখো, যে লোক ধোঁকা দিয়ে ব্যবসা করবে, সে আমার উম্মত নয় এবং সে থাকতে পারবে না আমাদের মুসলিম সমাজে।' অতপর নবী করীম (সা.) সে দোকানীর দোকানই বাজার থেকে তুলে দিয়েছিলেন।
আমাদের দেশে আগে খাদ্যে ভেজাল উচ্চমানের সঙ্গে নিম্নমানের উপাদান মিশ্রণে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু এখন ভেজাল প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও রয়েছে ভেজাল। ভেজাল ওষুধ খেয়ে রোগ সারার বদলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অঙ্গ ও জীবনহানির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বোতলজাত পানিতেও ভেজাল। বাজারে এখন এমন কোন খাদ্য নেই যাতে ভেজাল নেই।
খাদ্যে ভেজাল দেয়া শুধু আল্লাহর আইনে নয় পার্থিব আইনেও মারাত্মক অপরাধ। আইনের ভাষায় ভেজাল খাদ্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে - 'কোন খাদ্যবস্তু ভেজাল বলে গণ্য হবে যদি এমন কোন বস্তু এর সঙ্গে মেশানো হয় যাতে খাদ্যের গুণাবলি হ্রাস পায় বা ক্ষতিকরভাবে নষ্ট হয় যার ফলে খাদ্যবস্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়।' অন্যান্য বিধানের মধ্যে রয়েছে - বিশুদ্ধতা সম্পন্ন না হলে খাদ্যের প্রস্তুত বা বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ, ভুয়া লেবেল ব্যবহার ও মিথ্যা প্রচারণা নিষিদ্ধকরণ, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন, জেলা পর্যায়ে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত স্থাপন, মামলা দায়ের, শাস্তি ইত্যাদি। ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির জন্য ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোন খাদ্য বা পানীয় দ্রব্যে ভেজাল দেয় তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা চৌদ্দ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে এবং তদুপরি জরিমানাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
আইন থাকলেও আইনের যথার্থ প্রয়োগ নেই। বি এস টি আই এর পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। দোষী ব্যবসায়ীদের কিছু জরিমানা করা হয় যা পরিশোধ করা তাদের জন্য কষ্টকর নয়। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণের জন্য দায়ী রাঘব-বোয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে খুচরা বিক্রেতার বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। অনেকে বলেন, রাঘব-বোয়ালদের রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। সব জেলায় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত স্থাপনের বিধানটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। টেস্টিং ল্যাবরেটরিগুলোর মানও প্রশ্নাধীন। সেগুলোতে উপযুক্ত জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব। ফলে, ফরমালিনের আমদানি বৈধপথে কমলেও অবৈধভাবে বেড়ে গেছে। নাগরিকদের জন্য খাদ্যসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ভেজাল খাদ্য সমাজের উঁচু-নিচুর মধ্যে ভেদাভেদ করে না। যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন তারাও ভেজাল খাদ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বরং ভেজাল মেশানো খাদ্যদ্রব্যে ক্ষমতাবান ও ধনীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেসব খাদ্যে প্রাণঘাতি ভেজাল মেশানো হয় সেসব খাদ্য গরীব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
বাংলাদেশে ভেজালের ব্যাপ্তি এতই ব্যপক ও বিশাল আকার ধারণ করেছে যে, বি এস টি আই-এর মতো একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এত বড় 'ভেজাল বাজার' নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের সমাজে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার সময় এসেছে। আল্লাহ্‌ বলেন, 'তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোককে বেড়িয়ে আসতে হবে, যারা মানুষকে কল্যাণ ও মঙ্গলের দিকে ডাকবে, ন্যায় ও সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ কাজ করবে তারাই কৃতকার্য হবে।' (৩:১০৪)।

মহানবী (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন যে প্রতারক ও ধোঁকাবাজ তাঁর উম্মত নয়। যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষই মোহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত দাবীদার সে দেশে এত প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির কারণ হলো ধর্মকে আমরা স্থান দিয়েছি কিতাব, টুপি আর বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে আর জীবনকে রেখেছি অধর্ম, অনৈতিকতা, প্রতারণা আর ধোঁকাবাজির নিকষ তমিস্রাতে আচ্ছন্ন করে। এখনো যাদের মধ্যে ধর্ম ও মানবতাবোধ বেঁচে আছে তাদের উচিত ভেজাল প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে অগ্রগামী হওয়া। 

কেন আমরা কৃতজ্ঞ হই না?


কেন আমরা কৃতজ্ঞ হই না?

ইলতুত ॥ পরিশ্রমের বিনিময় ব্যতীত করুণা দাতা রূপে আল্লাহ 'রহমান'। শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পূর্বেই মাতৃস্তনে দুগ্ধ, পিতা-মাতার স্নেহ-মমতা ইত্যাদি যাবতীয় করুণা অযাচিতভাবেই তিনি অবারিত রেখেছেন তাঁর প্রিয় সৃষ্টির জন্য। সুতরাং এই প্রাচুর্য প্রাপ্তির জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো কর্তব্য। যা করা হয়েছে তাকে বলে 'কৃত'। যে প্রকৃতি নিয়ে আমাদের জন্ম আমরা তা পেয়েছি পূর্বে কৃত বা প্রকৃষ্টভাবে কৃত অবস্থায়। যিনি তা করে রেখেছেন তাকে চিনা হলো কৃতজ্ঞতা। কীভাবে চিনবো তাঁকে? কোথায় আছেন তিনি? তিনি আছেন প্রাণরগের চেয়েও নিকটে (৫০:১৬); কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পাই না (৫৬:৮৩-৮৫) যখন আমরা তাঁকে ডাকি তখন নিশ্চয়ই তিনি আমাদের পাশেই থাকেন, তিনি ডাকে সাড়াও দেন (২:১৮৬)। সুতরাং, তাকে চিনতে হবে নিজেকে চিনে।
আল্লাহ বলেন - 'আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও' (২:১৫২); 'তাঁর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর' (১৬:১১৪); 'তাঁর উপাসনা কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর' (২৯:১৭)। শুধু কল্পনা ও অনুভূতিতে নয়, শব্দ ও তত্ত্বের মধ্যেই নয় - জীবনপ্রবাহের বাস্তবতায় থাকতে হবে কৃতজ্ঞতা। ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলার আগেই মহান প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো কর্তব্য যে আরো একটি দিন তিনি বরাদ্দ করেছেন জীবনের জন্যে।
প্রতিটি কর্মে এই কৃতজ্ঞতা থাকতে হবে যে, কর্ম সম্পাদনের মতো শক্তি ও সামর্থ্য তিনি দিয়েছেন। সবার আগে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি এই জন্য যে, আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছি - কুকুর, বিড়াল বা অন্য কোন প্রাণী হয়ে জন্মাই নি। আমরা জন্মেছি জগতের সবচেয়ে বিকশিত প্রাণী হয়ে।
কৃতজ্ঞতার অর্থ কেবল মুখে 'আলহামদুলিল্লাহ' উচ্চারণ করা নয়। মুখের কথা ও কর্মের মধ্যে মিল না থাকলে কৃতজ্ঞতার বাস্তবায়ন হয় না। আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন প্রাচুর্য, দিয়েছেন কান, চোখ, জিহ্বা, হাত, পেট, পা, অন্তর, স্নায়ু; দিয়েছেন উপাদেয় খাদ্য, আলো-বাতাস, পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, সাগর, পাখি, মরুভূমি, বনভূমি; ফুল, ফল, শস্য, শাক সবজীসহ অসংখ্য প্রাকৃতিক বস্তু দানের মাধ্যমে যে প্রাচুর্যতা আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন সেই প্রাচুর্য প্রাপ্তির পর শুধু 'আলহামদুলিল্লাহ' বললে কৃতজ্ঞতা জানানো শেষ হয় না। বরং মুখে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার পরই শুরু হয় চিন্তা-ভাবনা - কীভাবে নিজের প্রাচুর্য ব্যবহার করবো এবং অন্যকে উপকৃত করবো? যে নিজেই নিজের প্রাচুর্য থেকে উপকৃত হলো না সে কীভাবে  অন্যের উপকার করবে?
শিশু বয়সে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে হেলেন কেলার হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি। চোখ, কান ছাড়াই তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন এবং লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে ছিলো প্রাচুর্যের ব্যবহার এবং স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তিনি লিখেছেন - 'আমাকে এতকিছু দেয়া হয়েছে যে, কি দেয়া হয়নি তা নিয়ে ভাবার কোনো সময় আমার নেই।' একজন শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিহীন নারীও প্রাপ্ত প্রাচুর্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে পারেন কারণ তিনি প্রাচুর্যের সঠিক ব্যবহার করেছেন। যে প্রাচুর্যের ব্যবহার জানে না সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে কী করে?
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মৌখিক, মানসিক, ও প্রায়োগিক - এই তিনটি স্তর আছে। মৌখিক কৃতজ্ঞতা হলো - সকল প্রাচুর্য শুধুমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে, মৌখিকভাবে তা স্বীকার করা এবং নিজের জিহ্বাকে পরম দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে নিয়োজিত রাখা। স্মর্তব্য, যে ব্যক্তি কেবল মুখে কৃতজ্ঞতাসূচক বাক্য উচ্চারণ করে কিন্তু কর্মের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করে না তার অবস্থা ওই লোকের মতো, যার জামা আছে কিন্তু সে তা গায়ে না দিয়ে, কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ফলে শীতে, গরমে, তুষারে বা বৃষ্টিতে ওই জামা তার কোনো উপকারেই আসে না।
মানসিক কৃতজ্ঞতা হলো - প্রাচুর্যের উপলব্ধি এবং দ্বিধাহীন চিত্তে এটা স্বীকার করা যে সকল প্রাচুর্য আল্লাহ্‌রই করুণা। আল্লাহ অর্ন্তযামী তিনি অন্তরের খবর রাখেন। তাই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাকে হৃদয়ে স্থাপন করার গুরুত্ব অনেক। তবে, কৃতজ্ঞতার প্রায়োগিক স্তরই হলো সত্য-মিথ্যার প্রমাণ। মুখে যে কৃতজ্ঞতা সূচক শব্দ উচ্চারিত হয় তা সত্য কি-না, মানসিক স্তরে কোন কৃতজ্ঞতার উপলব্ধি সত্যই আছে কি না, তা প্রমাণের একমাত্র মানদ- হলো কর্ম। তাই বলা হয় - কর্মই ধর্ম। আল্লাহর হুকুম - 'তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কর্ম করে যাও। আমার দাসদের মধ্যে অল্পই আছে যারা কৃতজ্ঞ (কর্মের মাধ্যমে)' (৩৪:১৩)।
প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ মানুষের প্রাচুর্য। প্রতিটি অঙ্গ দ্বারা আদিষ্ট কর্ম সম্পাদন এবং নিষিদ্ধ কর্ম বর্জনের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উপায় রয়েছে। যেমন চোখের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় হলো চোখে মঙ্গলময় কিছু দেখলে তা প্রকাশ করা। অমঙ্গলজনক কিছু দেখলে তা গোপন করা। কানের কৃতজ্ঞতা হলো - ভালো কিছু শুনলে তা স্মরণে রাখা, মন্দ কিছু শুনলে তা ভুলে যাওয়া। পায়ের কৃতজ্ঞতা হলো, পায়ে হেঁটে নিষিদ্ধ স্থানে না যাওয়া, আদিষ্ট স্থানে যাওয়া। হাতের কৃতজ্ঞতা হলো, হাত দিয়ে নিষিদ্ধ কর্ম না করা, আদিষ্ট কর্ম করা। এভাবে প্রত্যেকটি অঙ্গের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা যায় অঙ্গ সমূহের সম্যক ব্যবহারের মাধ্যমে।
যে কৃতজ্ঞ তাকে আরও দেওয়া হয়। এই মর্মে আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, 'তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই আরো দেবো' (১৪ : ৭)।
অকৃতজ্ঞতা দেহে এসিডিক অবস্থা সৃষ্টি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, বিরক্তি, ক্ষোভ, দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা, সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করে। ফলে সমস্যা সংকটে পরিণত হয় এবং প্রাচুর্য ব্যবহারের সম্ভাবনা নষ্ট হয়। অকৃতজ্ঞ মানুষ সুখী হতে পারে না। না পাওয়ার হাহাকার, বিষণ্নতা ও বঞ্চণা হয় তার নিত্য সঙ্গী। তবুও মানুষ অকৃতজ্ঞ কারণ মানুষ যা পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট না। সন্তুষ্টি থেকেই আসে কৃতজ্ঞতা। যার যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞ না থাকতে পারলে সে যা পাবার প্রত্যাশী তা পেলেও কৃতজ্ঞ হবে না। দু'টি চোখ পেয়েও যে অকৃতজ্ঞ, চারটি চোখ পেলে তার মধ্যে দ্বিগুণ অকৃতজ্ঞতার সৃষ্টি হবে। আমরা যদি ভাবতে থাকি আমাদের কি নেই তা হলে কখনও কৃতজ্ঞ হতে পারবো না। আমাদের কি আছে সেদিকে চিন্তাযোগ থেকেই কৃতজ্ঞতা উৎপন্ন হয়। কৃতজ্ঞতার উদ্ভব ঘটে চিন্তার ইতিবাচক বিন্যস্তকরণ থেকে। আমরা পৃথিবীতে নিজের দেহটি ব্যতীত আর কিছু নিয়ে আসিনি, এখান থেকে চলে যাবার সময় কিছু নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। সুতরাং অনেক পেয়েও উল্লসিত হবার যেমন কোন কারণ নেই তেমনি হারালেও দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। আমরা কিছু নিয়ে আসিনি যে হারাবো। কিছুই 'আমার' নয়। এখন যা আমার তা কিছুদিন আগে অন্যের ছিল। কিছুদিন পর আবার তা অন্যের হবে। যা আছে আমি তার ব্যবহারকারী মাত্র। এমন চিন্তা থেকে সৃষ্টি হয় কৃতজ্ঞভাব।
জীবনের জন্য আশ্রয়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন খাদ্যের, খাদ্যের চেয়ে বেশি প্রয়োজন পানির, পানির চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাতাসের। বাতাস সম্পূর্ণ ফ্রি। যার যত খুশি বাতাস খেতে পারে, বাতাসের কোন অভাব নেই, পানিও ফ্রি। ঠিক একইভাবে খাদ্য এবং আশ্রয়ও যদি আল্লাহ তায়ালা ফ্রি করে দিতেন তবে কি মানুষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতো? বাতাস এবং পানি যে ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে এ জন্য কি মানুষের কোন কৃতজ্ঞতা আছে? আমরা কেন কৃতজ্ঞ নই?

আরো চাই, আরো চাই, যত পাই, তত চাই - এজন্য কি?

বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০১৪

'এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে যেদিন হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে'

'এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে'

সংলাপ ॥ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ভিন্নতা আছে কিন্তু ধর্মের মূলে কোন ভিন্নতা নেই। নানা পদ্ধতির মাধ্যমে একই চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়েছে এবং একই সত্যকে প্রকাশিত করার প্রয়াস রয়েছে। বিশ্বের সকল মানুষ একই উপাদানে তৈরি। বংশ, বর্ণ, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য হয় না। দ্বীনের নবী (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন - 'আদম সন্তানেরা সবাই সমান। স্রষ্টাপ্রেম ব্যতীত তাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই।' কোন মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে না। মানুষে মানুষে পার্থক্য অর্জিত গুণের ভিত্তিতে হয়। রক্তে, বর্ণে, গোত্রে, গোষ্ঠীতে, ভাষায়, রাষ্ট্রে, মানুষের মধ্যে পার্থক্য নেই। মানুষে মানুষে বিভক্তি শয়তানের কাজ। বিভক্ত না করে শয়তান তার শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা সকল মানুষের রব। তিনি কেবল মুসলমানদের রব নন। কেউ দাবি করতে পারে না যে তিনি শুধুই আমার। তিনি সকলের। সমগ্র সৃষ্টি জগতের। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্ব স্ব পরিবেশে বড়-ছোট, গরীব-ধনী, শিক্ষিত-মূর্খ-জ্ঞানী সবারই কাম্য 'শান্তি'। তাই যুগে যুগে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে আবির্ভূত হয়েছেন স্ব স্ব জাতির মধ্যে পথ প্রদর্শক। বাংলার বুকে অন্য জাতি, অন্য ভাষা ও অপসংস্কৃতি যখন বারবার হানা দিচ্ছিল সেই সময় লালন সাঁঈজীর আবির্ভাব ঘটে। সাঁঈজীর দর্শনে রয়েছে - সবার উপরে মানুষ সত্য, মানুষ মানুষের জন্য। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অমূল্য বাণী - 'এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে যেদিন হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে।' বাংলার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়ে বাঙালি জাতিকে দিয়ে আসছে দিক নির্দেশনা। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে সাঁঈজীর দর্শন বাংলার মানুষকে দেখালো নতুন দিগন্ত, নতুন প্রাণ যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান।

লালন সাঁঈজী একজন বাঙালি। এই বাংলায় বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষায় শান্তি-ধর্ম প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। শান্তি-ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে দর্শন দিয়েছেন তা বাঙালি জাতিকে একটি উন্নত জীবনধারার সন্ধান দিয়েছে। সহজ সরল সাধারণের ভাষায়, কবিতার ছন্দে, গানের মরমী সুরে তিনি যে 'লালন সংস্কৃতি' সৃষ্টি করে গেছেন, তা বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সাথে অবিচ্ছেদ্য। পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, ততদিন লালনও থাকবেন স্মরণীয় এবং বরণীয়। পূজিত হবেন একজন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার উর্ধ্বে 'শান্তি-ধর্ম' প্রচারক হিসেবে।

সময়ের সাফ কথা .... 'আমরা ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শে হানিফ'

সময়ের সাফ কথা ....
'আমরা ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শে হানিফ'

আরিফিন হক ॥ আল্লাহ আদেশ করেছেন - 'কুল বাল মিল্লাতা ইব্রাহিমা হানিফা' (২:১৩৫)। অর্থাৎ, 'বল, আমরা ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শে হানিফ।' আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.)-কে মানবজাতির নেতা হিসেবে মনোনীত করেছেন (২:১২৪); মক্কার কাবাঘর ইব্রাহিম (আ.)-ই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন (২:৯৬)। মানব-ধর্মে সংকল্পের বিধান তাঁর সময় থেকে। এক উপাস্যের তত্ত্ব দিয়ে তিনিই প্রথম প্রার্থনা বা সালাতের পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। মৌলিকভাবে মানব ধর্মের সূচনা করেছিলেন ইব্রাহিম (আ.)। তিনিই ধর্ম বিধান দিয়ে ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন (২:১৩১, ১৩২)। তাই কুরআন আদেশ করে - তোমরা হানিফ হয়ে ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর, ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শে হানিফ হও। কুরআনের আদেশটি পালন করা অবশ্য কর্তব্য।
হানিফ অর্থ একনিষ্ঠতা। একের প্রতি নিষ্ঠা আছে যার কেবল তার ক্ষেত্রেই আরবি হানিফ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। মোহাম্মদ (সা.) এঁর আবিভার্বের পূর্বেও একনিষ্ঠ মানুষ ছিল। এই একনিষ্ঠ সম্প্রদায়কে বলা হতো হানিফ সমপ্রদায়। ইব্রাহিম (আ.)-এঁর একনিষ্ঠতার বিবরণ সকলেরই জানা। স্বজাতির লোকেরা তাঁকে নিক্ষেপ করেছিল জ্বলন্ত আগুনে। কিন্তু কোন প্রতিকূলতাই টলাতে পারেনি একত্বের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও সমর্পণ।
ইব্রাহিম (আ.)-এঁর ধর্মাদর্শের সারকথা হানিফ। হানিফ বা একনিষ্ঠতা ব্যতীত ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শ পালন করা যায় না। হানিফ না হয়ে বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান পালন করলে দুনিয়া ও আখেরাত, অসার-অন্ধকার। হানিফ ব্যতীত মানব জীবন মূল্যহীন। হানিফ হলো আকাশ ও পৃথিবীর একমাত্র পালনীয় ধর্ম। গোটা মহাবিশ্বই কায়েম হয়েছে হানিফকে কেন্দ্র করে। মানব জীবনে হানিফ প্রতিষ্ঠার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে চাঁদ, সূর্য, সমুদ্র, আকাশ, বাতাস তথা মহাবিশ্ব। হানিফের জন্যই বিধিবদ্ধ হয়েছে জান-মাল ত্যাগের বিধান।
আকাশ ও পৃথিবী তথা গোটা মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও পালনকর্তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। সকল নিয়ামত ও বরকতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনি অদ্বিতীয় ইলাহ্‌, তাই ইবাদত বন্দেগীর সকল ধরন-ধারণ, অনুভূতি, ভাব, বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান নিবেদিত হবে কেবল মাত্র তাঁরই উদ্দেশ্যে। যারা হানিফ ভাবের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করতে নারাজ, যারা একত্বের শীতল  ছায়ায় নিজেদের দাঁড় করাতে অনিচ্ছুক, যারা আল্লাহর পাশাপাশি অন্য কাউকে মাবুদ বলে মানে, তারা অশান্তিতে আছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি থাকা সত্ত্বেও আকাশ ও পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় সত্য হানিফকে ধারণ না করার কারণে তারা মানুষ হয়েও সাধারণ জীবে অধঃপতিত।
হানিফ সবচেয়ে মূল্যবান শক্তি, যা একজন মানুষ এ পৃথিবীতে অর্জন করতে পারে। হানিফ এর সাথে যার মৃত্যু হলো সে মৃত্যুঞ্জয়ী হলো। যে ব্যক্তি হানিফকে অন্তরে ধারণ করে, হানিফ তার সকল পাপ মুছে দেয়। হানিফই হলো বড় মাধ্যম, যা অবলম্বন করে একজন মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার নিকটবর্তী হয়। হানিফের মাধ্যমেই অর্জিত হয় শান্তি ও স্থিরতা।
হানিফ অবলম্বনের জন্য প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য যে যতটকু অগ্রসর হয়, সে ততটুকুই নিরাপত্তা পায়। হানিফ এর সারমর্ম - সৃষ্টি একমাত্র আল্লাহই করেন, রিযক একমাত্র আল্লাহই দান করেন, জীবন ও মৃত্যু একমাত্র আল্লাহই দেন। মহাবিশ্বের পরিচালনা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই করেন। ইবাদত-বন্দেগী, প্রার্থনা, নজর-মান্নত, বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া, সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর  উদ্দেশে নিবেদিত। 'আপনারই আমরা ইবাদাত করি এবং আপনারই নিকট  সাহায্য চাই' (১:৫)।

হানিফ এমন একটি বিষয়, যা সদা যত্নের দাবি রাখে। হানিফকে সদা আলোকোজ্জ্বল ও স্বচ্ছ-শুভ্র রাখার জন্য প্রয়োজন হয় সার্বক্ষণিক পরিচর্যার। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা -  তিনি যেন আমাদের নিয়ত সংশোধন করে দেন। আমাদের ধর্ম চর্চাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যথার্থ রূপে হানিফ শক্তিতে শক্তিবান হওয়ার তাওফীক দান করুন। আপনি আমাদেরকে যথার্থ রূপে হানিফ বাস্তবায়ন করার তাওফীক দিন। আমরা যেন কখনো কোনো শির্‌কে লিপ্ত না হই সে তাওফীক আমাদের দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বুল আলামীন।

'খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা ?'

'খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়,
কে দেয় সেখানে তালা ?'

'তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী, 
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!
কোথা চেঙ্গিস গজনী-মামুদ, কোথায় কালা পাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যতো তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!'
                                     - কাজী নজরুল ইসলাম

সাদিকুল হক ॥ রসূল (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর মদীনার প্রাণকেন্দ্রে নির্মাণ করেছিলেন মসজিদে নববী। খেজুর পাতা আর কাদা মাটি দিয়ে নির্মিত হয়েছিল সে মসজিদ। কিন্তু খেজুর পাতার মসজিদটিতে ছিল অফুরন্ত প্রাণের উচ্ছ্বাস, দিশেহারা মানুষের দিশা, পথহারা মানুষের আলোকবর্তিকা, অন্ধকারে আলোক বিচ্ছুরণের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদে নব্বী একদিকে যেমন রসূল (সা.)-এঁর আবাসিক বাসভবন ছিল, অন্যদিকে তেমনি ছিল শিক্ষাকেন্দ্র, পাঠাগার, আশ্রয়হীনদের আশ্রয়স্থল, আত্মিক উন্নতির সাধনাক্ষেত্র, সমাবেশ ও সালাতের স্থান। মামলার শুনানি, বিচারকার্য পরিচালনা হতো মসজিদে, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকেও বন্দি করে রাখা হতো মসজিদেই। বাইতুল মাল প্রতিষ্ঠিত ছিল মসজিদেই। মসজিদে নববী ছিল অতিথি ভবন, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ ও সাহায্য সংস্থা কেন্দ্র, আহত ও অসুস্থদের চিকিৎসালয়, জ্ঞান অন্বেষীদের গবেষণাগার ও লাইব্রেরি। মসজিদে নববী ছিল মিলনকেন্দ্র বা কমিউনিটি সেন্টার। মসজিদেই অনুষ্ঠিত হতো বিয়ে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হাস্য-রস, কৌতুক, কবিতা পাঠের আসর হতো মসজিদে। তৎকালের প্রখ্যাত কবি হাসসান বিন সাবিত (রা.)-এর জন্য নির্মিত ছিল পৃথক মিম্বার। তার কবিতায় মুগ্ধ হয়ে রসূল (সা.) তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন নিজ গায়ের চাদর। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য মসজিদ ছিল উন্মুক্ত। চব্বিশ ঘণ্টা প্রাণের জোয়ার থাকতো মসজিদে। রসূল (সা.)-এঁর  শিষ্যগণ মসজিদ থেকে দীক্ষা নিয়ে শান্তি মঙ্গলের বার্তা ছড়িয়ে দিতেন মদিনার ঘরে ঘরে।
বর্তমানে আমাদের মসজিদ-গুলোর কী দশা? ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর। ঢাকার অলিতে-গলিতে অপূর্ব কারুকার্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক লাখ লাখ মসজিদ কিন্তু মসজিদে নববীর আদর্শ কি আছে সেসব মসজিদে? মসজিদগুলো এখন ধর্মজীবীদের দখলে, কেবল নামাজ পড়ার স্থান হিসেবে বিবেচিত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সর্বোপরি আড়াই ঘণ্টা আবাদ হয় মসজিদ। আবার এমন মসজিদও আছে যেগুলো জুমআর দিন ব্যতীত অনাবাদী থাকে। এখন মসজিদে কোন সামাজিক কার্যক্রম সম্পন্ন করাকে অবৈধ ও মসজিদের আদব পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাই মসজিদগুলো আজ প্রাণহীন, নীরব, নিস্তব্ধ।
মহানবী মুহাম্মদ (সা.) প্রায় পনেরশ' বছর আগে বলে গেছেন, এমন এক সময় আসবে, যখন অলিতে গলিতে সুন্দর সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করা হবে কিন্তু মসজিদে কোন শিক্ষা থাকবে না। এখন মসজিদ আছে কিন্তু এর ভেতরে কোন শিক্ষা নেই। জুমার নামাজে আমাদের মসজিদগুলোতে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটে। কিন্তু সালাতের কোন প্রভাব নেই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে। এরকম মসজিদেরও অভাব নেই যেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দখলদার পরিবর্তন হয়।  সরকার পাল্টায় আর পাল্টায় মসজিদ কমিটিও। সরকারের সাথে সাথে খোলস পরিবর্তন করতে হয় মসজিদের ইমাম খতিবদের। কারণ, অধিকাংশ ইমাম খতিবই তাদের এ পদকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম মনে করেন। মসজিদের ইমাম বা খতিব নয় তারা এখন কর্মচারী মাত্র। তাই জীবিকার প্রয়োজনেই তাদের রূপ পরিবর্তন করতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মসজিদের ইমাম সাহেবের মাথায় একথা ঢুকেই না যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বাইরে তাদের কিছু করণীয় আছে। আসলে এসব বেতনভুক্ত ইমামগণ কেউ প্রকৃত অর্থে ইমাম নয়, ঘরগুলোও প্রকৃত অর্থে মসজিদ নয়, আর ভেতরে যা করা হয় তাও প্রকৃত অর্থে সালাত নয়। ইসলামে পেশাদার ধার্মিকশ্রেণীর কোন অস্তিত্ব নেই।
মসজিদ এখন কাঁদে টাইলসের ভারে। আজ আমাদের মসজিদগুলো কারুকার্য, জাঁকজমক ও আড়ম্বরতার দিক থেকে অনেক অগ্রসর। দেশী-বিদেশী পাথর, রকমারি টাইলস আর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে সজ্জিত। মর্মর পাথর আর মখমলের গালিচা বিছানো মসজিদগুলো যেন রাজদরবার। রসূল (সা.) বলেছেন - 'লানত ও অভিসম্পাদ ওদের উপর, যারা মসজিদকে কারুকার্য খচিত করবে। পূর্বেকার জাতিসমূহ তাদের ইবাদতের ঘরসমূহ সাজগোজ করে মানুষকে বিপথগামী করেছে। তোমরা কখনও তা করবে না। যারা করবে, তাদের উপর আল্লাহর লানত।' রসূল (সা.)-এঁর নির্দেশ অমান্য করে কারা আজ অপূর্ব কারুকার্যময় মসজিদ তৈরি করছে? কারা টাকার যোগান দিচ্ছে? আমাদের দেশে এখন অনেক মসজিদই নির্মিত হচ্ছে অবৈধ উপায়ে অর্জিত আর্থিক প্রতিপত্তি মানুষকে জানানোর জন্য। যেন মানুষ তাকে দেখলে টাকার গরমে ভয় পায়। সালাম দেয়। একে তো অবৈধ টাকা তার উপর মসজিদ তৈরি করে দেমাক দেখানো! পার্শ্ববর্তী মসজিদের চেয়ে নিজের টাকায় তৈরি মসজিদকে কীভাবে আরেকটু দৃষ্টিনন্দন করা যায় সেই প্রতিযোগিতায় মত্ত আছে কিছু মানুষ। স্মরণে রাখা দরকার, ইসলামে কোন গোত্র বা গোষ্ঠীর নামে তৈরি মসজিদে সালাত হয় না। যদি কোন মসজিদকে ওমুকের মসজিদ বলা হয় তবে তা ওমুকেরই ঘর, আল্লাহর ঘর নয়। কোন ব্যক্তি, জাতি, গোষ্ঠী বা বর্ণের নামে নির্মিত মসজিদ আল্লাহর ঘর নয়।
এমন মসজিদও আছে যেখানে মাইক দিয়ে টাকা তোলা হয় কিন্তু তাতে আশপাশের লোকদের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে কি-না তা ভাববার অবকাশ তাদের নেই। মসজিদের জন্য রাস্তার পাশে চৌকি বসিয়ে চাঁদা তোলা হয়, যানবাহনগুলোতে কালেক্টর দিয়েও চাঁদা তোলা হয় আবার নামাজের পর দানবাক্স ঘুরিয়েও অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এসব কি ইসলামের কোনো আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? জানা যায়, মসজিদের জন্য আদায়কৃত অর্থ থেকে কালেক্টররা কমিশন খায়। মসজিদের জন্য আদায় করা অর্থ থেকে কোনোরকম কমিশন গ্রহণ কি কুরআন সম্মত?
দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদ। আর দুনিয়ার সর্বনিকৃষ্ট জায়গা হচ্ছে বাজার। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের নীচে, আশে-পাশে রয়েছে নিকৃষ্ট পণ্যের উৎকৃষ্ট বাজার। এক সময় ঢাকার পরিচয় ছিল বায়তুল মোকাররম মসজিদ। নবাবপুর থেকে উত্তরে তাকালে কাবা সদৃশ বায়তুল মোকাররম মসজিদ দেখা যেত। এখন আর সেই বায়তুল মোকাররমকে চেনাই যায় না। পূর্বপাশে তাকালে মনে হবে শিল্পকারখানার বিশাল টিনশেড। পশ্চিম পাশে তাকালে মনে হবে, একটি আধুনিক মার্কেট। দক্ষিণ পাশের অর্ধেক ঢেকে আছে যাত্রী ছাউনি দিয়ে। উত্তর পাশে তাকালে অসংখ্য কোম্পানির সাইনবোর্ড। কেন এমনটি হলো? টাকার জন্য? টাকার অভাব না-কি আদর্শের অভাব?
বাইরের আকৃতিতে অনেক উন্নত হয়েছে মসজিদ। খেজুর পাতা থেকে রূপান্তরিত হতে হতে কাঁচ, টাইলস আর গালিচার মসজিদ হয়েছে। আর ভেতরের দিকে অবক্ষয়ের এমন নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে যে অধিকাংশ মসজিদকেই ইসলামের স্মৃতি কংকাল বললে অত্যুক্তি হবে না। এসব মসজিদের সাথে জীবনের কোন সম্পর্ক নেই, সমাজের কোন সম্পর্ক নেই, বিশ্বাসী চেতনার কোন সম্পর্ক নেই, শান্তির প্রেরণা নেই, মঙ্গলের নিশানা নেই।  তাই এসব মসজিদে নামাজ পড়েও কোনও পরিবর্তন আসছে না। দেশ ও সমাজ দিন দিন ধাবিত হচ্ছে অবক্ষয়ের অতলান্তে। ১৫ কোটি মুসলমানের বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন, উৎপীড়ন, শোষণ, কালোবাজারি, মওজুদদারি, মুনাফাখোরিতে রেকর্ড করেছে। দেশে চলছে সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ও চরিত্রহীনদের রাজত্ব। এর কারণ কি? এতো হাজী, এতো হাফেজ, এতো খতিব, ইমাম, আলেম-ওলামায়ে দ্বীন, মুফতি-মোহাদ্দেস থাকতে দেশের এ দশা হবে কেন? তাহলে কি এঁরা রসূল (সা.)-এঁর দ্বীনকে অনুসরণ করে না? সৎ কাজের নির্দেশ ও অন্যায় কাজে বাধা দেয় না? কি দেখি আমরা তাদের আচরণে? অসংখ্য দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে আলেম-ওলামারা আজ পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ, কাদা ছোড়াছুড়িতে নিজেদের শক্তি, শ্রম, মেধা ও সময় নষ্ট করছেন। টাকার বিনিময়ে সেই গতানুগতিক ওয়াজ, নসিহত, টিভিতে আলোচনা, মোনাজাত চলছে বিরতিহীনভাবে। এসব করে শান্তির প্রচার ও প্রসার হয় না।
মসজিদ  যখন আদর্শচ্যুত হয় তখন তাকে বলে অনিষ্টকর মসজিদ বা মসজিদে দিরার। মহানবী (সা.) মসজিদে দিরার ধ্বংস করার জন্য লোক প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর নির্দেশে আদর্শ বিচ্যুত মসজিদে আগুন লাগিয়ে সমূলে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। যে মসজিদের কারুকার্য আছে কিন্তু ভেতরে আল্লাহর সাথে সংযোগ প্রচেষ্টাকারী নাই, সে মসজিদের তুলনা নদীর তীরবর্তী এমন মাটির সাথেই করা যায়, যাকে পানির ঢেউ নিচের দিকে সরিয়ে দেয়, কিন্তু উপর থেকে মনে হয় সমতল ভূমি। এর নির্মাতারা যেন জাহান্নামের পথ পরিষ্কার করলো। সুরা তওবার ১০৮ নং আয়াতে কুরআনে বলছেন  - 'লা- তাকুম ফীহি আবাদান ....'  'তুমি (সালাতের জন্য) এতে কখনও দাঁড়িয়ো না, যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন হতেই তাকওয়ার উপর স্থাপিত হয়েছে ওতেই সালাতের জন্য দাঁড়ানো উচিত'।
একমাত্র সে মসজিদই সম্মানের যা তাকওয়ার সাথে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্মিত হয় এবং যে মসজিদ নির্মাণে লোক দেখানো মনোবৃত্তির লেশ মাত্র থাকে না। কোন একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া মসজিদ নির্মিত বা পরিচালিত হলেই এটা বিপথগামী হয়ে দিরার মসজিদে পরিণত হতে বাধ্য। তাকওয়ার আদর্শে প্রতিষ্ঠিত সব মসজিদেরই এক রূপ। যুগে যুগে দেশে দেশে আদিকাল থেকে শুরু করে সর্বকালের সব আদর্শিক মসজিদই এক। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলেই আলেম-ওলামারা পরস্পর হানাহানি করে থাকে।
কুরআনের আদর্শে মসজিদের রূপান্তর চাই। এ জন্য প্রথমে দরকার নিজের রূপান্তর। এমন এক রূপে নিজেকে রূপান্তরিত করা চাই যা এক এবং অদ্বিতীয়। যার রূপের কোন অন্ত নাই তাঁর রূপে রূপান্তর। এ রূপান্তর সাধিত হলে প্রাণবন্ত, কর্মচঞ্চল মসজিদ নির্মিত হবে। হয়তো, পাতা আর মাটি হবে এর বাহ্যিক উপাদান। হয়তো, লোকে তাকে মসজিদ বলে স্বীকারই করবে না কিন্তু এর ভেতরে মানুষ হবার শিক্ষা থাকবে, থাকবে মানবিক গুণাবলির বিকাশ প্রচেষ্টা, পরস্পরের প্রতি মায়া ও প্রীতি, মমতা ও ভালোবাসা, প্রেম ও ত্যাগ। এমন একটা মসজিদের খুব প্রয়োজন - যেখানে মসজিদে নব্বীর কর্মসূচী থাকবে। যে মসজিদের মিম্বর থেকে শান্তি ও মঙ্গলের আহ্বান জানানো হবে, অত্যাচার প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হবে, সত্যে প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শন করা হবে,  যে মসজিদে পরিশুদ্ধ হবে মানবাত্মা, যে মসজিদে সালাতের আগে ও পরে থাকবে সেবা কার্যক্রম, যে মসজিদ হবে আশ্রয়হীনের আশ্রয়স্থল, যে মসজিদে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। যে মসজিদ হবে মানব জাতির মিলন কেন্দ্র।

দেশের প্রতিটি মসজিদ, গীর্জা, মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার সময় এসেছে যাতে সেখানে মানবিক অনুশীলন হয় এবং মুক্ত চিন্তার মুক্ত-মানুষ গড়ে উঠে। এটাই সময়ের দাবি দেশ ও জাতির কল্যাণে।

ধর্মাবলম্বী মানব জাতি তিন শ্রেণীতে বিভক্ত

ধর্মাবলম্বী মানব জাতি তিন শ্রেণীতে বিভক্ত

সংলাপ ॥ আজকের সমাজ ব্যবস্থায় গণজীবনে ধর্মের অবস্থান বিবেচনা করে আমরা ধর্মাবলম্বী মানব জাতিকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত দেখতে পাইঃ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ ও ধার্মিক। ধর্মভীরু মানুষ তারাই যারা জীবনাচরণ ও ধর্মাচরণের মাঝে কোন যোগসূত্র খুঁজে পায় না অথবা খোঁজে না। তারা ধর্মের দর্শনগত দিক উপেক্ষা করে শুধু আচরণবিধি পালন করে। ধর্মের শিক্ষা গ্রহণ করে না। স্থান-কাল ভেদে আচরণবিধি পরিবর্তনের পক্ষেও নয়। ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো ধারণ, পালন ও লালন করে না। সরল-সাধারণ শ্রেণীর মানুষ আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর। ভাগ্যে বিশ্বাসী ও ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক কর্মের মধ্যে সর্বদা নিয়োজিত। এরাই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। ক্ষমতা এই শ্রেণীকে অতি সহজে ব্যবহার করে।
ধর্মান্ধ-শ্রেণী সারা পৃথিবীতে ধর্মকে গতির মধ্যে বিচার করতে না পারার কারণে সবচেয়ে গোঁড়া হিসেবে বিবেচিত। ধর্মের দার্শনিক দিক স্বীকার করে কিন্তু ধারণ করে না। সমাজ পরিবর্তনে ধর্মের যোগসূত্র তৈরি করতে পারে না। সীমাহীন উগ্রতার আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর মনগড়া ধর্মতত্ত্ব তৈরি ক'রে ধর্মভীরু শ্রেণীর উপর তা চাপিয়ে দিতে জবরদস্তির আশ্রয় নেয়। ভাগ্যে বিশ্বাসী, কর্মে নয়। ধর্মশিক্ষায় বাহ্যিক শিক্ষিত কিন্তু জ্ঞানী নয়। তাদের ধর্মান্ধতা যুগোপযোগী জ্ঞানকে গ্রহণ করতে আপত্তি তোলে। ফলে চিন্তায় তারা বন্ধ্যা, গ্রহণশীলতায় তাদের অনীহা বিদ্যমান। ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক কর্মে সর্বদা নিয়োজিত থাকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পন করে তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সমাজে আধিপত্য বিস্তারের নেশায়। পৃথিবীর সকল ধর্মভিত্তিক অনাসৃষ্টির জন্য এই শ্রেণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদিও এরা সংখ্যালঘু শ্রেণী কিন্তু ধর্মভীরুদের উপর এদের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি।
ধার্মিক শ্রেণী সৃষ্টি রহস্যের গূঢ়তত্ত্ব ধারণ, পালন ও লালন করে, তাই তাঁরা সৃষ্টিশীল। তাঁরা বোঝেন ও বিশ্বাস করেন ধর্ম ও প্রগতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ধর্ম কর্মের প্রকৃতি আর প্রগতি তার গতি। গতির নিরিখে ধর্ম ও সভ্যতার জন্য এই শ্রেণী চিন্তা ও চেতনায় ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে। সংস্কারমুক্ত হওয়ার জন্য নিজের সাথে অবিরত যুদ্ধ করেন। ধার্মিক শ্রেণী ধর্মভীরু ও ধর্মান্ধ শ্রেণীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে চান না বরং তাদের পথ দেখাতে চান। ক্ষমতার দিকে এই শ্রেণীর দৃষ্টি নেই। ধর্মভীরু শ্রেণীর কাছে ধার্মিক শ্রেণী শ্রদ্ধেয়। ধর্মান্ধ শ্রেণী ধার্মিক শ্রেণীকে শত্রু মনে করে এবং প্রয়োজনে তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ধার্মিক শ্রেণী সংখ্যায় খুবই কম। সংস্কারমুক্ত হয়ে তাঁরা প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে ভালবাসেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ তথা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত সকল ধর্মের ধার্মিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু
* ধর্মভীরু শ্রেণীকে ধর্মান্ধ শ্রেণীর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
* সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
* সংস্কারমুক্ত ক'রে দেশবাসীকে এক কাতারে আনতে হবে।
* ব্যক্তি-মানুষের মনুষ্যত্ববোধ জাগরিত ক'রে মানবতাকে দুস্থ, দুর্বল, অসহায়দের রক্ষাকবচ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
* যুব সমাজকে সত্য, শান্তি ও অহিংসার ধর্মশিক্ষা দিতে হবে।
* 'ধর্ম মানবতার জন্য, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের জন্য নয়' - এই বোধ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্ব জীবন ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

* ধর্মান্ধ শ্রেণীকে চিহ্নিত ক'রে শুদ্ধ হওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে নচেৎ কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।