মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

কেন আমরা কৃতজ্ঞ হই না?


কেন আমরা কৃতজ্ঞ হই না?

ইলতুত ॥ পরিশ্রমের বিনিময় ব্যতীত করুণা দাতা রূপে আল্লাহ 'রহমান'। শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পূর্বেই মাতৃস্তনে দুগ্ধ, পিতা-মাতার স্নেহ-মমতা ইত্যাদি যাবতীয় করুণা অযাচিতভাবেই তিনি অবারিত রেখেছেন তাঁর প্রিয় সৃষ্টির জন্য। সুতরাং এই প্রাচুর্য প্রাপ্তির জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো কর্তব্য। যা করা হয়েছে তাকে বলে 'কৃত'। যে প্রকৃতি নিয়ে আমাদের জন্ম আমরা তা পেয়েছি পূর্বে কৃত বা প্রকৃষ্টভাবে কৃত অবস্থায়। যিনি তা করে রেখেছেন তাকে চিনা হলো কৃতজ্ঞতা। কীভাবে চিনবো তাঁকে? কোথায় আছেন তিনি? তিনি আছেন প্রাণরগের চেয়েও নিকটে (৫০:১৬); কিন্তু আমরা তাঁকে দেখতে পাই না (৫৬:৮৩-৮৫) যখন আমরা তাঁকে ডাকি তখন নিশ্চয়ই তিনি আমাদের পাশেই থাকেন, তিনি ডাকে সাড়াও দেন (২:১৮৬)। সুতরাং, তাকে চিনতে হবে নিজেকে চিনে।
আল্লাহ বলেন - 'আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও' (২:১৫২); 'তাঁর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর' (১৬:১১৪); 'তাঁর উপাসনা কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর' (২৯:১৭)। শুধু কল্পনা ও অনুভূতিতে নয়, শব্দ ও তত্ত্বের মধ্যেই নয় - জীবনপ্রবাহের বাস্তবতায় থাকতে হবে কৃতজ্ঞতা। ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলার আগেই মহান প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো কর্তব্য যে আরো একটি দিন তিনি বরাদ্দ করেছেন জীবনের জন্যে।
প্রতিটি কর্মে এই কৃতজ্ঞতা থাকতে হবে যে, কর্ম সম্পাদনের মতো শক্তি ও সামর্থ্য তিনি দিয়েছেন। সবার আগে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি এই জন্য যে, আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছি - কুকুর, বিড়াল বা অন্য কোন প্রাণী হয়ে জন্মাই নি। আমরা জন্মেছি জগতের সবচেয়ে বিকশিত প্রাণী হয়ে।
কৃতজ্ঞতার অর্থ কেবল মুখে 'আলহামদুলিল্লাহ' উচ্চারণ করা নয়। মুখের কথা ও কর্মের মধ্যে মিল না থাকলে কৃতজ্ঞতার বাস্তবায়ন হয় না। আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন প্রাচুর্য, দিয়েছেন কান, চোখ, জিহ্বা, হাত, পেট, পা, অন্তর, স্নায়ু; দিয়েছেন উপাদেয় খাদ্য, আলো-বাতাস, পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, সাগর, পাখি, মরুভূমি, বনভূমি; ফুল, ফল, শস্য, শাক সবজীসহ অসংখ্য প্রাকৃতিক বস্তু দানের মাধ্যমে যে প্রাচুর্যতা আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন সেই প্রাচুর্য প্রাপ্তির পর শুধু 'আলহামদুলিল্লাহ' বললে কৃতজ্ঞতা জানানো শেষ হয় না। বরং মুখে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার পরই শুরু হয় চিন্তা-ভাবনা - কীভাবে নিজের প্রাচুর্য ব্যবহার করবো এবং অন্যকে উপকৃত করবো? যে নিজেই নিজের প্রাচুর্য থেকে উপকৃত হলো না সে কীভাবে  অন্যের উপকার করবে?
শিশু বয়সে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে হেলেন কেলার হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁর শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি। চোখ, কান ছাড়াই তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন এবং লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে ছিলো প্রাচুর্যের ব্যবহার এবং স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তিনি লিখেছেন - 'আমাকে এতকিছু দেয়া হয়েছে যে, কি দেয়া হয়নি তা নিয়ে ভাবার কোনো সময় আমার নেই।' একজন শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিহীন নারীও প্রাপ্ত প্রাচুর্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে পারেন কারণ তিনি প্রাচুর্যের সঠিক ব্যবহার করেছেন। যে প্রাচুর্যের ব্যবহার জানে না সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে কী করে?
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মৌখিক, মানসিক, ও প্রায়োগিক - এই তিনটি স্তর আছে। মৌখিক কৃতজ্ঞতা হলো - সকল প্রাচুর্য শুধুমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে, মৌখিকভাবে তা স্বীকার করা এবং নিজের জিহ্বাকে পরম দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে নিয়োজিত রাখা। স্মর্তব্য, যে ব্যক্তি কেবল মুখে কৃতজ্ঞতাসূচক বাক্য উচ্চারণ করে কিন্তু কর্মের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করে না তার অবস্থা ওই লোকের মতো, যার জামা আছে কিন্তু সে তা গায়ে না দিয়ে, কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ফলে শীতে, গরমে, তুষারে বা বৃষ্টিতে ওই জামা তার কোনো উপকারেই আসে না।
মানসিক কৃতজ্ঞতা হলো - প্রাচুর্যের উপলব্ধি এবং দ্বিধাহীন চিত্তে এটা স্বীকার করা যে সকল প্রাচুর্য আল্লাহ্‌রই করুণা। আল্লাহ অর্ন্তযামী তিনি অন্তরের খবর রাখেন। তাই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাকে হৃদয়ে স্থাপন করার গুরুত্ব অনেক। তবে, কৃতজ্ঞতার প্রায়োগিক স্তরই হলো সত্য-মিথ্যার প্রমাণ। মুখে যে কৃতজ্ঞতা সূচক শব্দ উচ্চারিত হয় তা সত্য কি-না, মানসিক স্তরে কোন কৃতজ্ঞতার উপলব্ধি সত্যই আছে কি না, তা প্রমাণের একমাত্র মানদ- হলো কর্ম। তাই বলা হয় - কর্মই ধর্ম। আল্লাহর হুকুম - 'তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কর্ম করে যাও। আমার দাসদের মধ্যে অল্পই আছে যারা কৃতজ্ঞ (কর্মের মাধ্যমে)' (৩৪:১৩)।
প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ মানুষের প্রাচুর্য। প্রতিটি অঙ্গ দ্বারা আদিষ্ট কর্ম সম্পাদন এবং নিষিদ্ধ কর্ম বর্জনের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উপায় রয়েছে। যেমন চোখের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় হলো চোখে মঙ্গলময় কিছু দেখলে তা প্রকাশ করা। অমঙ্গলজনক কিছু দেখলে তা গোপন করা। কানের কৃতজ্ঞতা হলো - ভালো কিছু শুনলে তা স্মরণে রাখা, মন্দ কিছু শুনলে তা ভুলে যাওয়া। পায়ের কৃতজ্ঞতা হলো, পায়ে হেঁটে নিষিদ্ধ স্থানে না যাওয়া, আদিষ্ট স্থানে যাওয়া। হাতের কৃতজ্ঞতা হলো, হাত দিয়ে নিষিদ্ধ কর্ম না করা, আদিষ্ট কর্ম করা। এভাবে প্রত্যেকটি অঙ্গের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা যায় অঙ্গ সমূহের সম্যক ব্যবহারের মাধ্যমে।
যে কৃতজ্ঞ তাকে আরও দেওয়া হয়। এই মর্মে আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, 'তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই আরো দেবো' (১৪ : ৭)।
অকৃতজ্ঞতা দেহে এসিডিক অবস্থা সৃষ্টি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, বিরক্তি, ক্ষোভ, দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা, সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করে। ফলে সমস্যা সংকটে পরিণত হয় এবং প্রাচুর্য ব্যবহারের সম্ভাবনা নষ্ট হয়। অকৃতজ্ঞ মানুষ সুখী হতে পারে না। না পাওয়ার হাহাকার, বিষণ্নতা ও বঞ্চণা হয় তার নিত্য সঙ্গী। তবুও মানুষ অকৃতজ্ঞ কারণ মানুষ যা পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট না। সন্তুষ্টি থেকেই আসে কৃতজ্ঞতা। যার যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞ না থাকতে পারলে সে যা পাবার প্রত্যাশী তা পেলেও কৃতজ্ঞ হবে না। দু'টি চোখ পেয়েও যে অকৃতজ্ঞ, চারটি চোখ পেলে তার মধ্যে দ্বিগুণ অকৃতজ্ঞতার সৃষ্টি হবে। আমরা যদি ভাবতে থাকি আমাদের কি নেই তা হলে কখনও কৃতজ্ঞ হতে পারবো না। আমাদের কি আছে সেদিকে চিন্তাযোগ থেকেই কৃতজ্ঞতা উৎপন্ন হয়। কৃতজ্ঞতার উদ্ভব ঘটে চিন্তার ইতিবাচক বিন্যস্তকরণ থেকে। আমরা পৃথিবীতে নিজের দেহটি ব্যতীত আর কিছু নিয়ে আসিনি, এখান থেকে চলে যাবার সময় কিছু নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। সুতরাং অনেক পেয়েও উল্লসিত হবার যেমন কোন কারণ নেই তেমনি হারালেও দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। আমরা কিছু নিয়ে আসিনি যে হারাবো। কিছুই 'আমার' নয়। এখন যা আমার তা কিছুদিন আগে অন্যের ছিল। কিছুদিন পর আবার তা অন্যের হবে। যা আছে আমি তার ব্যবহারকারী মাত্র। এমন চিন্তা থেকে সৃষ্টি হয় কৃতজ্ঞভাব।
জীবনের জন্য আশ্রয়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন খাদ্যের, খাদ্যের চেয়ে বেশি প্রয়োজন পানির, পানির চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাতাসের। বাতাস সম্পূর্ণ ফ্রি। যার যত খুশি বাতাস খেতে পারে, বাতাসের কোন অভাব নেই, পানিও ফ্রি। ঠিক একইভাবে খাদ্য এবং আশ্রয়ও যদি আল্লাহ তায়ালা ফ্রি করে দিতেন তবে কি মানুষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতো? বাতাস এবং পানি যে ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে এ জন্য কি মানুষের কোন কৃতজ্ঞতা আছে? আমরা কেন কৃতজ্ঞ নই?

আরো চাই, আরো চাই, যত পাই, তত চাই - এজন্য কি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন