মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

কি বলে কুরআন

খাদ্যে বিষ -
কি বলে কুরআন

·        'হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তারা কখনো একে অপরের ধন-সম্পত্তি অবৈধ ভাবে গ্রাস করো না। ব্যবসা-বাণিজ্য যা করবে তা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই করবে এবং কখনো একে অপরকে হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি মেহেরবান।' (সুরা নিসা:২৯)।
·        'যারা (অন্যায়ভাবে ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করবে) আমি নিশ্চয় তাকে আগুনে পোড়াব।'   (সুরা নিসা:৩০)।
·        'হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা-কিছু হালাল ও বিশুদ্ধ খাদ্যদ্রব্য রয়েছে, তা থেকে তোমরা আহার করো আর তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।' (সুরা বাকারা:১৬৮)।

আরিফিন হক ॥ সুরা নেসার ২৯ নং আয়াতে 'অবৈধ ভাবে গ্রাস' বলতে আল্লাহ্‌র অননুমোদিত সকল পন্থাই বুঝানো হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল, প্রতারণা, ঘুষ, জুয়া, মওজুতদারী, কালোবাজারী এবং সুদসহ যাবতীয় নিষিদ্ধ বেচাকেনা এর আওতাভুক্ত। পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমেই লেনদেন বৈধ হতে পারে এবং পারস্পরিক সম্মতি অবশ্যই ন্যায় ভিত্তিক হতে হবে। অর্থাৎ লেন-দেন এমন হতে পারবে না যে, একজনের লাভ আর একজনের ক্ষতির মাধ্যমে অর্জিত হয়।
'কখনো একে অপরকে হত্যা করো না' আয়াতের এই অংশটির তাৎপর্য ব্যাপক। আল্লাহ্‌র হুকুম - আমরা নিজের জীবনের জন্য যেমন সাবধানতা অবলম্বন করি অন্যের জীবনের জন্যও তেমনি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ব্যবসায় অধিক লাভের আশায় এমন কিছু করা যাবে না যা অন্যের জীবনের জন্য ক্ষতিকর হবে। আমাদের দেশে জীবন রক্ষাকারী খাদ্যে এখন ফরমালিন, কার্বাইড, ইউরিয়া, হাইড্রোজ, ক্ষতিকর রং, এমাইলাম, ইথোপেনসহ নানা ক্ষতিকর ও রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হচ্ছে। পুকুরের মাছ ও আনারসে ব্যবহার করা হচ্ছে হরমোন। গরু, ছাগল ও মুরগিকে দেয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ রাসায়নিক খাদ্য। খাদ্যদ্রব্যে এ জাতীয় বিষের মিশ্রণ দেয়া নিজের ভাইকে হত্যার শামিল। এই হত্যাযজ্ঞেরই তা-বলীলা চলছে এখন বাংলাদেশে। দেশের ১৬ কোটি মানুষ আজ  ফরমালিনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। প্রতি বছর ৪০০ টন ফরমালিন ঢুকছে মানুষের পেটে। ফরমালিনের প্রভাবে জীবনঘাতী রোগের বিস্তার ঘটছে। ক্যান্সার, চর্মরোগ, আলসার, লিভার ও কিডনি সংক্রান্ত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে; শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে; কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হচ্ছে। রসূল (সা.) বলেছিলেন, 'মানব জাতির কাছে এমন একটা যমানা আসবে, যখন মানুষ কামাই রোজগারের ব্যাপারে হালাল হারামের কোন পরওয়া করবে না।' এটাই যেন সেই যমানা। রসূল (সা.) স্বয়ং হাট-বাজারে গিয়ে তদারকি করতেন এবং কোন অন্যায় তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে তৎক্ষণাৎ তা বন্ধ করে দিতেন। এক শস্য ব্যবসায়ীর দোকানে খাদ্যশস্যের স্তুপ এমনভাবে সাজানো ছিল যে, তার উপরিভাগ ছিল শুষ্ক আর নিচের দিকের শস্য ছিল ভেজা। নবী করীম (সা.)-এঁর সামনে ব্যাপারটি ধরা পড়ে যায়। তখন তিনি দোকানীকে লক্ষ্য করে বললেন, 'তোমার খাদ্যশস্যের নিচের ভেজা অংশ স্তুপের উপরে রাখলে না কেন? তাহলে ক্রেতারা তা দেখতে পেত এবং বুঝে-শুনে ক্রয় করতো। জেনে রাখো, যে লোক ধোঁকা দিয়ে ব্যবসা করবে, সে আমার উম্মত নয় এবং সে থাকতে পারবে না আমাদের মুসলিম সমাজে।' অতপর নবী করীম (সা.) সে দোকানীর দোকানই বাজার থেকে তুলে দিয়েছিলেন।
আমাদের দেশে আগে খাদ্যে ভেজাল উচ্চমানের সঙ্গে নিম্নমানের উপাদান মিশ্রণে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু এখন ভেজাল প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও রয়েছে ভেজাল। ভেজাল ওষুধ খেয়ে রোগ সারার বদলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অঙ্গ ও জীবনহানির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বোতলজাত পানিতেও ভেজাল। বাজারে এখন এমন কোন খাদ্য নেই যাতে ভেজাল নেই।
খাদ্যে ভেজাল দেয়া শুধু আল্লাহর আইনে নয় পার্থিব আইনেও মারাত্মক অপরাধ। আইনের ভাষায় ভেজাল খাদ্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে - 'কোন খাদ্যবস্তু ভেজাল বলে গণ্য হবে যদি এমন কোন বস্তু এর সঙ্গে মেশানো হয় যাতে খাদ্যের গুণাবলি হ্রাস পায় বা ক্ষতিকরভাবে নষ্ট হয় যার ফলে খাদ্যবস্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়।' অন্যান্য বিধানের মধ্যে রয়েছে - বিশুদ্ধতা সম্পন্ন না হলে খাদ্যের প্রস্তুত বা বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ, ভুয়া লেবেল ব্যবহার ও মিথ্যা প্রচারণা নিষিদ্ধকরণ, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন, জেলা পর্যায়ে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত স্থাপন, মামলা দায়ের, শাস্তি ইত্যাদি। ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির জন্য ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোন খাদ্য বা পানীয় দ্রব্যে ভেজাল দেয় তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা চৌদ্দ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে এবং তদুপরি জরিমানাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
আইন থাকলেও আইনের যথার্থ প্রয়োগ নেই। বি এস টি আই এর পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। দোষী ব্যবসায়ীদের কিছু জরিমানা করা হয় যা পরিশোধ করা তাদের জন্য কষ্টকর নয়। খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণের জন্য দায়ী রাঘব-বোয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে খুচরা বিক্রেতার বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। অনেকে বলেন, রাঘব-বোয়ালদের রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। সব জেলায় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত স্থাপনের বিধানটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। টেস্টিং ল্যাবরেটরিগুলোর মানও প্রশ্নাধীন। সেগুলোতে উপযুক্ত জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব। ফলে, ফরমালিনের আমদানি বৈধপথে কমলেও অবৈধভাবে বেড়ে গেছে। নাগরিকদের জন্য খাদ্যসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। ভেজাল খাদ্য সমাজের উঁচু-নিচুর মধ্যে ভেদাভেদ করে না। যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন তারাও ভেজাল খাদ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বরং ভেজাল মেশানো খাদ্যদ্রব্যে ক্ষমতাবান ও ধনীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেসব খাদ্যে প্রাণঘাতি ভেজাল মেশানো হয় সেসব খাদ্য গরীব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
বাংলাদেশে ভেজালের ব্যাপ্তি এতই ব্যপক ও বিশাল আকার ধারণ করেছে যে, বি এস টি আই-এর মতো একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এত বড় 'ভেজাল বাজার' নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের সমাজে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার সময় এসেছে। আল্লাহ্‌ বলেন, 'তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোককে বেড়িয়ে আসতে হবে, যারা মানুষকে কল্যাণ ও মঙ্গলের দিকে ডাকবে, ন্যায় ও সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ কাজ করবে তারাই কৃতকার্য হবে।' (৩:১০৪)।

মহানবী (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন যে প্রতারক ও ধোঁকাবাজ তাঁর উম্মত নয়। যে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষই মোহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত দাবীদার সে দেশে এত প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির কারণ হলো ধর্মকে আমরা স্থান দিয়েছি কিতাব, টুপি আর বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে আর জীবনকে রেখেছি অধর্ম, অনৈতিকতা, প্রতারণা আর ধোঁকাবাজির নিকষ তমিস্রাতে আচ্ছন্ন করে। এখনো যাদের মধ্যে ধর্ম ও মানবতাবোধ বেঁচে আছে তাদের উচিত ভেজাল প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে অগ্রগামী হওয়া। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন