বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সম্মান-আত্মসম্মান গোলকধাঁধায়



সম্মান-আত্মসম্মান গোলকধাঁধায়

সংলাপ ॥ সাধক সাধনার দ্বারা সমাজে যা দান করে যায়, তন্মধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্বই প্রধান। এটা খণ্ড সৃষ্টি নয়, সম্পূর্ণ সাধক-সত্ত্বা। সমস্ত খণ্ড সৃষ্টি এর মধ্যে বিধৃত। এই ব্যক্তিত্ব শুধু তাঁর পুত্র-কন্যাকে দান করে যায় না, সমস্ত মানব-সম্প্রদায়ই তার উত্তরাধিকারী; বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর পুত্র-কন্যাই তা হতে বিশেষ ভাবে বঞ্চিত হয়। রক্তিয়রা অত্যন্ত নিকট হতে দ্যাখে বলে অনেক সময় তারা তাঁর সৌন্দর্য ও মহত্ব উপলব্ধি করতে পারে না।
সাধকের চিন্তা ও কর্ম যেখানে সকলের, সেখানে সে নৈর্ব্যক্তিক। চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে সাধক যতই নৈর্ব্যক্তিক হতে থাকে, ততই তাঁর ক্ষুদ্র ‘আমি’ ক্ষুদ্রতম হয়, বৃহৎ ‘তুমি’ বৃহত্তর হতে থাকে। নৈর্ব্যক্তিক হবার সহায়ক বলেই এক-এর আরাধনা মানব-চিত্তের পক্ষে এত কল্যাণকর। তিনি অনন্ত, অসীম ও প্রেমময়। সকলকে নিয়েই তিনি জেগে আছেন, সকলকে অতিক্রম করেও আছেন, তিনি অবিনশ্বর আর সকলে নশ্বর। এই ভাব মানুষকে যতটা উপলব্ধির ঔদার্য ও বিশালতা দান করতে পারে, আর কোন ভাবেই ততটা পারে না। এইখানেই বিধাতা-ধ্যানের শ্রেষ্ঠতা। ডিমোক্রেসি, এনার্কিজম, কোন কিছুতেই মানুষ এত বড় সার্থকতা লাভ করতে পারে না, এমন বিপুল ভাবে পরিপূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু যেখানে এই চারিত্রিক প্রভাব নাই, সেখানে তার বিভিন্ন অঙ্গনে পদচারনা  শুধুই আনুষ্ঠানিকতা পালন, শুধুই অভিনয় এবং দ্বিচারিতা।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গুণ গাইলাম, কিন্তু গুণে গুণান্বিত হলাম না; তার নাম করলাম, কিন্তু চরিত্রের দ্বারা প্রভাবান্বিত হলাম না-এর মতো বড় রকমের ঠাট্টা আর কি হতে পারে, ধারণা করা কঠিন। বঙ্গবন্ধু সবাক হলে নিশ্চয়ই চিৎকার করে বলতেন, বন্ধ করো চাটুকারিতা, শুনতে চাই না ওই অনুপযুক্ত মুখে আমার নাম-গান আর আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু তিনি নীরব বলেই তাঁকে ফাঁকি দেয়া রাজনীতিকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে।
অনেকে ব্যক্তিত্বকে প্রভুত্বের সঙ্গে এক করে দেখে - প্রতাপশালীকে ব্যক্তিত্বশালী বলে ভুল করে। কিন্তু বিশ্লেষণ করে দেখলে দেখা যাবে, যে অত্যন্ত সাধারণ, যার কোন বিকাশ নেই, তার ব্যক্তিত্বও নেই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোথাও তাঁর তিলমাত্র প্রভেদও নেই। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেবার সম্পর্কই বেশী। সেবার ভাব না থাকলে নৈর্ব্যক্তিক হওয়া যায় না, আর নৈর্ব্যক্তিক না হলে ব্যক্তিত্ব বিশাল ও গভীর হয় না। সেবার ভাব না জাগলে শুধু ‘আমি’র কারাগারে বন্দী থাকতে হয় বলে জীবনের পরিপূর্ণ আস্বাদ লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তোষামোদকারীর নৈর্ব্যক্তিক সাধনা নেই বলে তার ব্যক্তিত্বও নেই। তার প্রতাপ থাকতে পারে, কিন্তু প্রভাব নেই। যেটুকু থাকে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তা শেষ হয়ে যায়। সাধকের ব্যক্তিত্ব কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেও বহু বছর বেঁচে থেকে তাঁকে পৃথিবীতে অমর করে রাখে। নৈসর্গিক দ্রব্যের মতো ব্যবহারে লাগিয়ে মানুষ তা হতে প্রচুর উপকার লাভ করতে পারে। একথা সত্য যে, মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকবার জন্যই সাধক সাধনা করে না, কীর্তিমান হবার জন্যই কীর্তি গড়া তাঁর উদ্দেশ্য নয়। এই সাধনাতেই তাঁর আনন্দ, তৃপ্তি ও সমাজসেবা বলে তিনি তা করে থাকেন। ‘কীর্তি? নদী কি নিজের ফেনাকে গ্রাহ্য করে? কীর্তি তো সাধকদের ফেনা-ছড়াতে ছড়াতে চলে যাবে। ফিরে তাকাবে না।’
আদর্শিক রাজনীতিকের প্রথম ও প্রধান শত্রু লোভ-চাকচিক্যময় জীবনের প্রতি টান। দ্বিতীয় শত্রু প্রতিযোগিতা। উভয়ের সম্মিলিত অত্যাচারে তার জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। লোভ ও প্রতিযোগিতা প্রথমে তার ভিতর হতে জাগে না, অন্যে জাগিয়ে দেয়। তাকে সাবধান করে দিয়ে তার শুভানুধ্যায়ী বন্ধুগণ যে তার উপকার করে, তা বুঝতে পারে না। পারে না বলেই ক্ষমার পাত্র। নইলে তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা সাধনের অভিযোগ আনা সহজ হতো। রাজনীতিকদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সচেতন করলেও তার ভিতরের আনন্দের উৎসটি নষ্ট হয়ে যায়। তখন সে অথর্ব ও পঙ্গু হয়ে পড়ে। ইচ্ছাবৃত্তির দ্বারা স্বজনাবেগকে ধ্বংস করতে করতে সে ক্রমাগত তিক্ত ও বিরক্ত হয়ে ওঠে, তার জীবনের পূর্ণতা ও চরিত্রের অটুট ভাব নষ্ট হয়ে যায়।
অন্তরের সহজ প্রবৃত্তি নষ্ট হওয়ার দরুন রাজনীতিকরা ক্রমে তিক্ত ও বিরক্ত হয়ে ওঠে। তিক্ততা ধীরে ধীরে নৃশংসতায় পরিণত হয়, আর সেই নৃশংসতাকে সে কখনো সাহস, কখনো নৈতিকতার ছদ্মবেশ পরিয়ে চালাতে থাকে। ক্রমে প্রতিযোগিতার ইচ্ছা বলবতী হয়, অর্থাৎ নিজের সুখ-সৃষ্টির চাইতে পরের দুঃখ সৃষ্টির স্পৃহা প্রবল হয়ে দেখা দেয়। নিজের ভিতরের কাজ করবার প্রেরণা স্তব্ধ হয়ে আসে, অন্যকে জব্দ করবার জন্যই তাকে সবকিছু করতে হয়। জীবন ও সমাজ  বিকাশে আর আনন্দ পায় না বলে যে-কোন ক্ষেত্রে যে-কোন উপায়ে সার্থকতা লাভকেই সে বড় করে দেখতে শুরু করে। সার্থকতা লাভের জন্য সে এত ব্যস্ত  হয়ে উঠে যে, নিজের বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে নিতান্ত সাধারণ হয়ে পড়তেও তার কুন্ঠাবোধ হয় না। এইরূপে জনগণের সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আদর্শিক আরাধনা চিত্তের সৌকুমার্য নষ্ট করে নিজেই নিজেকে একেবারে অনুভূতিহীন জীবে পরিণত করে।
অপরদিকে, সাধক সাধনা শিল্পে কি করে নতুনত্ব সৃষ্টি করা যায়, সেই দিকেই তাঁর ঝোঁক। একলা ঘরে বসে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর দিন কাটে বেশ। জীবিকা অর্জনের চাইতে জীবনার্জনের দিকেই তাঁর নজর বেশী। তিনি অনুভব করেন তাঁর চিত্তে স্পর্শমণির মতো এমন এক দুর্লভ বস্তু আছে যার স্পর্শে সামান্য ধূলিবালিও সোনা হয়ে ওঠে, নিতান্ত সাধারণ জিনিসও অসাধারণত্ব লাভ করে। সেই স্পর্শমণির স্পর্শ লাভ করবার জন্য, কীট-পতঙ্গ, তৃণলতা সমস্ত কিছু নিয়ে বিশ্ব-সংসার তাঁর চিন্তাজগতে হয় অতিথি। আনন্দের অফুরন্ত ভাণ্ডার বলে তিনি তাঁর নিজের প্রতি সতত শ্রদ্ধাশীল। কস্তুরী মৃগের মত তিনি আপনার গন্ধে আপনি পাগল। কিন্তু তাঁর এই তন্ময়তার অবস্থা আমৃত্যু। তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন তাঁর শিল্পচর্চায় খুশী না হয়ে তাঁকে বাস্তবজগতে উন্নতি করার জন্য উপদেশ দিতে থাকে। তাঁর আত্মীয়-স্বজন অন্যের নজীর দেখিয়ে তাঁকে বড়লোক হতে বলে। সাধক প্রথম প্রথম তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে ওঠেন, তিনি চিন্তা করেন তাঁকে আত্মহত্যা করার জন্য উপদেশ দেয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও ক্রমে ক্রমে কুমন্ত্রণাদাতারা রাজনীতিকদের হৃদয় জুড়ে বসে তার ভিতরের আদর্শের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ করতে বাধ্য করে। সন্দেহ ঠোঁট বাঁকা করে বলতে থাকে - ফেলে রাখো তোমার আদর্শ। ওসব দিয়ে কি হয়? পারো তো অন্যদের মতো একখানা অট্টালিকা নির্মাণ করো, বিত্তশালী হও, আর লোকের আভূমি-প্রণত সেলাম গ্রহণ করো। আদর্শ তখন তিরস্কারের সুরে বলেঃ ছি ছি একি তোমার মতিগতি? শেষে কাঞ্চন ফেলে কাঁচ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হলে?
আদর্শ বলে বিকাশেই তোমার তৃপ্তি, কেন ওসব বাইরের আবর্জনার প্রতি নজর দাও? পরিণামে বহু দ্বন্দ্বের পর রাজনীতিক লোভ ও ভোগের কাছে পরাজয় বরণ করে। সন্দেহ জয়ী হয়ে তাকে বাস্তব জগতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে তথাকথিত উন্নতি-সংগ্রামে প্রবৃত্ত করে। ক্রমে প্রতিযোগিতার স্পৃহা জাগে এবং তার আনুষঙ্গিক বেআইনী কর্মকাণ্ড অন্তর-রাজ্য দখল করে বসে। চারিদিকে তার জয়জয়কার পড়ে যায়। তার তথাকথিত উন্নতি ও সম্মান দেখে তার আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব বলে, এতদিনে সে মিথ্যা কল্পনা পরিহার করে মানুষ হয়েছো বলে করমর্দন করে।
আদর্শ হারিয়ে ফেলায় রাজনীতিকের আনন্দ তার নিকট হতে চির-বিদায় গ্রহণ করে। সমস্ত পৃথিবী খুঁজেও সে এক বিন্দু আনন্দ লাভ করতে পারে না। যা তার জন্য আকাশ আলোর মতো অজস্র ছিল, যা নিজে উপভোগ করে অন্যকে বিলিয়েও উদ্বৃত্ত থাকত, তা এমন  দুর্লভ হলো কি করে, শত চিন্তা করেও সে তা বুঝে উঠতে পারে না। শুধু চিন্তা করে, কি-যেন তার পৃথিবী হতে পালিয়ে গেছে, কি যেন নেই। যে সন্ধ্যাতারা প্রতি সন্ধ্যায় তার জন্য আনন্দ-বার্তা বহন করে আনত, তা যেন এখন বিদ্রূপবার্তা  নিয়ে আসে। তার মুখে হাসি নেই, আছে ব্যঙ্গ।
সে জানেনা যে সে আত্মহত্যা করেছে! তথাকথিত আত্মসম্মানের জন্য আত্মাকে বিক্রি করতেও সে প্রস্তুত। তবু সে রাজনীতিক। ব্যক্তিস্বার্থের ব্যাপারে পান হতে চুন খসলে অস্থির হয়ে পড়ে। হায় রে, আদর্শের খাঁচাটি নিয়ে সে নৃত্য করছে, আদর্শ পাখিটি কবে উড়ে গেছে, সেদিকে তার ও সঙ্গী-সাথীদের লক্ষ্য থাকে না!

সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস



সময়ের সাফ কথা....
সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস

সত্যদর্শী ॥ বাংলায় বহু পুরোনো একটি প্রবাদ আছে - সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। সঙ্গ দোষে মানুষ বিপথগামী হয়। সঙ্গ দোষেই সৎ হয়। সততার সৌন্দর্য আছে, সততার মর্যাদা সর্বত্র। অসৎ এর সঙ্গ কিছু লুকোচুরি জারিজুরি যাদুকরি মন্ত্রজাল সাময়িক তৈরি করে। পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা সবার জানা। নিশ্চিত অপঘাতে মৃত্যু অথবা ঘৃণিত জীবন। নেশাখোরের সাথে মিশলে নেশাখোর হয়, খুনির সাথে বন্ধুত্ব করলে খুনের দায় কাঁধে পড়বেই।
পাড়ার বখাটে যুবকদের সাথে মিশতে মিশতে বখাটের দল ভারী হয়। মান সম্মত শিক্ষকের সাহচর্য পেলে শিক্ষার্থীর মান উন্নত হবেই।
আপনি যার সাথে যাদের সাথে সঙ্গ দিচ্ছেন আপনি প্রকৃতই তার বা তাদের মত হয়ে উঠবেন। সমভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে সমচিন্তার মানুষের সাহচর্যে। জীবন একটি বর্তন প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করেই চলে। যাদের সাথে যে কাজে মানুষ যত বেশি সময় দেয় সেটিই তাকে নির্মাণ করে।
বর্তনের বহুমাত্রিক পর্যায় রয়েছে। পরিবারের কোটরে, শৈশবে, শিক্ষাজীবনে, সমাজনীতি, রাজনীতিতে, বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সর্বত্রই রয়েছে বর্তনশীল নানা পর্যায়। 
শৈশবেই একটি শক্তিশালী বর্তনমান গড়ে উঠে। যা ব্যক্তিত্ব, রুচি, চরিত্র, দেখা ও জানার ক্ষমতা গড়ে তোলে। পরবর্তী জীবনে মানুষের প্রতিটি কর্মে মানুষ সবকিছুকে দেখার চেষ্টা করে অর্জিত বর্তনের মান অনুযায়ী। 
পূর্বধারণা সব কিছুকে আলাদা করে দেখায়। একজন ব্যক্তি প্রথমত পিতা-মাতার মস্তিস্কের কার্যকারণ বহন করে নিয়ে আসে। তার অভিরুচির অনেকটাই এক সংকেতলিপির উপর নির্ভর করে।
জন্মের শুভক্ষনে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব, পিতা-মাতার মনন মেজাজ অনুভূতি সুস্পষ্টভাবেই সন্তানের মস্তিস্কের মধ্যে ঢুকে যায়। উপরন্তু পারিবারিক শাসন কাঠামো, পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষিত, প্রেক্ষাপট চাল-চলন, এবং অভিভাবকের শাসন ক্ষমতা চাপিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখা তৈরি করে দেয়।
পারিবারিক ঐতিহ্য বংশীয় গৌরব, নানা উত্থান-পতন, গ্রুপ, সার্কেল, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব মিলেই ব্যক্তির চিন্তাজগত গড়ে উঠে। পারিবারিক বিদ্যালয়ই প্রথম বিদ্যালয়, পরবর্তীতে সমাজে কাদের সাথে কোন্‌ কাজে তাদের সন্তান জড়িত হয়ে পড়েছে, কাদের সাথে মিশছে, কি দেখছে, কি করছে সব ব্যাপারে খোলামেলা দৃষ্টি রাখতে হবে পিতা-মাতাকে। মাতৃকুলের শিক্ষা সন্তানের বুনিয়াদ গড়ে দেয়। পরবর্তী জীবনে যত ঝড় আসুক সে ঝড়ে সন্তান ঘুরে দাঁড়াতে জানে, যত ফাঁদ সৃষ্টি করা হোক সে ফাঁদ থেকে বের হবার কৌশল  বের করতে পারে। স্কুলে, কোচিং সেন্টারে, মসজিদে মাদ্রাসায়, নেট-ইন্টারনেটে, বন্ধুদের আড্ডায় সতর্ক দৃষ্টি রাখলে কোন সন্তানই বিপথগামী হবে না। দেশ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞানকে জানার সুযোগ শিশুকালে করে দেয়া গেলে প্রত্যেকটি সন্তানই যোগ্য মানুষ হয়ে গড়ে উঠবেই।
প্রায়শই কিছু  তরুণের নির্মম অমানবিক কর্মকাণ্ডে শিহরিত হয় গোটা জাতি। টকশো পত্র- পত্রিকায় এ নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে। বিকৃত মনস্তত্বের দিকেই যাচ্ছে নব প্রজন্ম এমন কথা জোরে সোরে বলা হয়।
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে এর জন্য প্রধানত দায়ী পরিবার, দ্বিতীয়ত সামাজিক অবস্থা। পরিবার কাঠামোর মধ্যেই অসততা, ভন্ডামী, অজ্ঞতায় ভরা। সীমাহীন অস্থিরতা উন্মাদনার মধ্যে থাকেন পিতা-মাতা তদরুপ সুযোগ পান সন্তানরাও।
পরিবার ব্যবস্থাপনার সব কিছুই গড়ে উঠছে বাজার কেন্দ্রীক। ফলে শরীর ও প্রযুক্তি নির্ভর জীবন আর কিই বা উপহার দিতে পারে। পরিবারের কোন মুরুব্বী আর নীতিবাক্য, সত্যভাষণ শোনানোর প্রয়োজন বোধ করেন না বরং কিভাবে বেশি টাকা উপার্জন করা যাবে, কোন্‌ কোন্‌ পোশাক পরতে হবে, কোন্‌ কোন্‌ পারফিউম-সাবান, নেইলপলিশ-স্নো ব্যবহার করতে হবে, সেটা নিয়ে সময় পার করে দেয়। অভিভাবকরা যদি সন্তানের জীবনের মানে তুলে না ধরেন তবে সন্তানতো ভুল করবেই। টিভি সিরিয়ালে যে সময় ব্যয় হয় তার শতকরা দশভাগ সন্তানের দিকে দিলে অনায়াশে সন্তান সঠিক পথ খুঁজে পাবে। অন্যদিকে সমাজের নেতৃস্থানীয় অভিভাবকরা কোন দায় অনুভব করেন না । সামাজিক দায়বদ্ধতা জাগ্রত করা না গেলে অসৎ সামাজিক কাঠামো শত-শত অসৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেই। সব সংকটের শুরু হচ্ছে সমাজে। সমাজে অসৎ, খারাপ, লুটেরা, ঘুষখোর, মাস্তানদের মাথা উঁচু করে চলার সাধারণ মানুষ সুযোগ দেয় বলেই এরা শক্তি পায়। সমাজে বিপরীতমূখী সাংঘর্ষিক একাধিক মনগড়া ধর্মীয় মতবাদ ছড়িয়ে দেয়া হয় বলেই সমাজ অশান্ত অস্থির-রক্তাক্ত হয়। সামাজিক শাসন সুসংহত  না হলে রাষ্ট্রীয় শাসনের সুফল কোন কালেই পাওয়া যাবে না। 
অফিসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা অসৎ হলে দিন দিন তার আশপাশে থাকা অনেকেই তাল মেলাতে মেলাতে অসৎ হয়ে উঠে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রবিধান অনুযায়ী খুবই ক্ষমতাধর। পরিদর্শক, সহকারী পরিদর্শক, অতিরিক্ত পরিদর্শক, হাবিলদার, সিপাহী এসব পদ থাকলেও প্রত্যেকটি থানায় একাধিক কোষাধ্যক্ষ রয়েছে। এসব কোষাধ্যক্ষ ফুটপাতের সব দোকান, মদ ও নেশার দোকান থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। ফলমূল, শাক-সব্‌জি, অতিথি পাখি, বাগানের বড় বড় লিচু, খাল বিলের বড় বড় মাছ এসব কিছু চলে আসে ক্ষমতাধর কর্তার কাছে। থানার কোষাধ্যক্ষ মাঝে মধ্যে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়, মাসোহারা ঠিকমত না পেলে।  ট্রাফিক সিগন্যালের ট্রাফিক ভ্যান রিক্সা ট্রাক থেকে প্রকাশ্যে উৎকোচ নেয়। এই যে এতসব নেয়ার চিত্র তুলে ধরলাম এগুলো এখন পদ্ধতি। অসৎ বলয়ে সবাই অসহায়। উর্দ্ধতনদের ঘুষ দিয়ে নিয়োগ, উর্দ্ধতনদের সাথে সাথে থাকতে হলে পুরো দস্তর অসৎ হয়ে যাওয়ায় সবই অসৎ সঙ্গে সর্বনাশের মত। তাই সবাই বন্ধু নয়, সবাই সহপাঠী নয়, সবাই প্রেমাস্পদ কিংবা প্রেমিক নয়।

জনগণ প্রভু নয় সেবক চায়



জনগণ প্রভু নয় সেবক চায়

সংলাপ ॥ আমাদের সংবিধানে যাই লেখা থাক এবং গত দুই শতকে মানবিচারে উপমহাদেশের সব রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যত পরিবর্তনই হোক, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের গর্ভজাত প্রশাসন ব্যবস্থা ও আমলারা এখনো দেশ ও জনগণের প্রভু এবং অভিভাবক রয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করেছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী তাঁর বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে আমলারা জনগণের সেবক না হয়ে শাসকে পরিণত হয়েছে। তারা মানুষের উপকার না করে সমস্যার সৃষ্টি করছে। গভীর আক্ষেপের সঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, তার সরকারের সহায়তায় বহু প্রশিক্ষণ দিয়েও এদেশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। তার মতে, আমলাদের সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের অবৈধ যোগাযোগ রয়েছে। তারা পুরো ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে। ২শ’ বছরের পুরনো এই আমলাতন্ত্র পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, এছাড়া কোনো অগ্রগতি সম্ভব হবে না। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওই বক্তব্য ছাপাও হয়েছিল অধিকাংশ জাতীয় পত্রিকায়।
বাংলাদেশে এর চেয়ে কঠিন সত্য আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। স্বাধীনতার পর ৪৪ বছরে এ দেশে যত দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ঘটনা ঘটেছে তার নেপথ্যে আমলাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ভূমিকা মুখ্য হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি।
বাংলাদেশে বর্তমানে ঔপনিবেশিক ধাঁচের যে আমলাতন্ত্র চালু আছে সেটার জনক হচ্ছে ওই ব্রিটিশ সরকার। আনোয়ার চৌধুরীর মন্তব্যটি সেই কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে বাংলাদেশের বর্তমান আমলাতন্ত্র সম্পর্কে বলার জন্য বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ কূটনীতিকের চেয়ে যোগ্য লোক আর কে হতে পারে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রিটিশের সৃষ্ট প্রভু মনোবৃত্তি থেকে আমাদের আমলাতন্ত্রকে মুক্ত করার বহু চেষ্টা হয়েছে - গঠিত হয়েছে অনেক কমিশন, কী দশা হয়েছে আমরা জানি। বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ ঠেকাতে আমলারা কি রকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। যতবার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে কার্যকর ও শক্তিশালী সহনীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছে ততবারই তাকে আঁতুর ঘরেই হত্যা করা হয়েছে গলা টিপে। সন্দেহ নেই অর্থবহ গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার চলমান উদ্যোগকে সফল করতে হলে অন্যান্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি দুশ’ বছরের পুরানো প্রভুত্ববাদী আমলাতন্ত্রের পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে। স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। এছাড়া সম্ভাবনাময় দেশ ‘বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার পথ কি হতে পারে!

বাংলাদেশের মানুষ মান-কে নিজেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে!



বাংলাদেশের মানুষ  
মান-কে নিজেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে!

নজরুল ইশতিয়াক ॥ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বয়স চুয়াল্লিশ বছর। চুয়াল্লিশ বছরের যুবক দেশটি অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের নানা সুচকে উর্দ্ধগামী। তলাবিহীন ঝুড়ি, ব্যর্থ রাষ্ট্র এসব কোন বিশেষণই এখন আর বলা হয় না। অগ্রসরমান বাঘ, স্বর্নময়ী সম্ভারের বিশেষণ এদেশের সামনে।
জিডিপির গ্রোথ ছয়ের উপরে, সামাজিক সূচকে দারিদ্রতা বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মা সুরক্ষা, স্যানিটেশন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, গড় আয়ু-পুষ্টি, সব ক্ষেত্রেই এসেছে দারুন সাফল্য। দেশের প্রতিটি জনপদে মিশেছে চকচকে রাস্তা, ইন্টারনেট সুবিধা, মোবাইল নেটওয়ার্ক। যে কোন ঘটনা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ফেসবুক টুইটার অনলাইন ব্লগ সর্বত্র তারুণ্যের ছাপ। মাত্র চুয়াল্লিশ বছরে পাঁচ গুন বেড়েছে কৃষি ও মৎস উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন দশ হাজার মেগাওয়াট ছুঁই ছুঁই। সাতশো কোটি টাকার বাজেট এখন তিন লক্ষ কোটি টাকার বাজেট।
বিশ্বের নামি-দামি ব্র্যান্ডের জুতা, জামা, প্যান্ট, পারফিউম, গাড়ী, মোবাইল, বিশ্বখ্যাত কোম্পানীগুলোর লোকাল সেলস্‌ সেন্টার ও উৎপাদন কেন্দ্র, বিশ্বের সব নামী-দামী খাবারের পসরা এই দেশে। বিশ্বখ্যাত গাড়ী, স্মার্টফোন-কম্পিউটার-ল্যাপটপ, চোখ ধাধানো সুরম্য প্রাসাদসম বাড়ি, বহুতল বিশিষ্ট আধুনিক মার্কেট, হোটেল-মোটেল যততত্র চোখে পড়ে।
কর্ম জগতে নারীর অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে। গার্মেন্টস্‌, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, এনজিও, প্রাইমারী শিক্ষক, ডাক্তার-আইনজীবী ও কর্পোরেট অফিসগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর সরব উপস্থিতি।
সুপ্রীম ইলেকট্রনিক মিডিয়া, মিডিয়া ওয়ার্ল্ড, শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে, সেলস্‌ সেন্টার ও কাষ্টমার কেয়ারে পদচারনা রয়েছে বিপুল সংখ্যক নারীর। দেশের শিক্ষিত মোট জনগোষ্ঠীর তিনভাগের একভাগ নারী। নারীর ক্ষমতায়ন তথা নারীর রাজনৈতিক অগ্রগতি বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রসংশিত।
বাঙালির জীবন দর্শন বিশ্ব সংস্কৃতির উপজীব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূফীতত্ত্বের ঘরানায় বাঙালির অবদান খুব গভীরে। জাপান-জার্মান ফ্রান্স ইটালি আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। হ্যামিলিওয়নের বাঁশিওয়ালার টানে ফোক ফেষ্ট, সাধু ফকিরের দরগায়, বাউল গানের আসরে, সভা সেমিনারে ইউরোপের হাজারো কৌতূহলী আগ্রহী অনুসন্ধানী মনের আগমন ঘটে। আমেরিকা-ইটালি-ফ্রান্সে দুই বাংলার বাউলের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। জাতিসংঘে, আন্তর্জাতিক মিউজিকাল উৎসবে বাংলার ফোক চরম দাপুটে অবস্থানে। ক্রিকেটে বাংলা বাঘের থাবায় কুপোকাত গোটা ক্রিকেট দুনিয়া।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশ এগিয়েছে বহুদূর, আমাদের অগ্রজরা কোন কোন ক্ষেত্রে শক্ত শেকড় গেড়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন, পিছিয়েছে কতদূর? অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আর্থিক স্বচ্ছলতা, রং-বাহারি বিকিকিনির আসর, রঙিন ঝলমলে আলোর বিপরীতে জীবন চিন্তার সামগ্রিক মান , মহানুভবতা, সৃজনশীলতা, মানবিক বোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে এই প্রশ্নও আজ খুব জোরালো হয়ে সামনে আসছে। বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম, সংস্কৃতি, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষকতা পেশার চিত্র এতটাই প্রশ্নবোধক যে তা নিয়ে বাড়ির বুয়া, বাগানের মালি, রিক্সাচালকরাও বিরূপ মন্তব্য করে।
সব শিল্পই এখন বাজারি পণ্যের মত কিনতে পাওয়া যায়। শিল্পের সৌখিন ক্রেতা অর্থ দিয়ে গায়ক হয়, নায়ক হয়, প্রদায়ক হয়, কবি সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, চালক পরিচালক, বিচারক সবই হতে পারে। রিয়েলিটি শো’র রিয়েল মালিকানাও বিকিকিনি হয়। সম্প্রসারিত এই শিল্পের বাজার দাদা-দাদি, নানা-নানির পুথি পাঠকে নাতি-নাতনির জন্য ব্যবসার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কন্ঠে পাঠ করা পুথির দোকান খুলে বসেছেন এমবিএ-বিবিএ করা শিল্প ব্যবসায়ী নাতি।
অন্যদিকে ওয়াজ মাহফিল ও বিভিন্ন জলসায় আসমানী দাঁতের মাজন, হাড়ি-পাতিল মাজনার ছাই-লবঙ্গদানী মোমবাতি, আতর- গোলাপ, তসবিহ্‌, বেহেস্তের তাবিজ-কবজ, মসল্লা, বই-পুস্তক, ধর্মীয় উপদেশ সমৃদ্ধ হাজারো হাজারো ফায়সালার মোটা মোটা বই, আরব্য রজনীর জায়নামাজ, হজ্ব-কাফেলা, বহুমাত্রিক হজ, যাকাত-ফিতরা, সঞ্চয় প্রকল্প’র নামে হাজারো ব্যবসা পেতে বসেছে ধর্মজীবিরা। ধর্মভীরু বাঙালির সহজ সরলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মজীবীরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মহা কুটকৌশলে ব্যস্ত। তাদের মুখরোচক বিভ্রান্তি বুঝতে না পারাটা অবশ্যই আমাদের চিন্তার নিম্ন মানকেই প্রকাশ করে।
মাদ্রাসা শিক্ষা সহ ধর্মীয় শিক্ষার নামে সুস্পষ্ট বিভাজন নিকট ভবিষ্যতে আরো রুগ্ন চেহারা নিয়ে হাজির হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রতি তিনজন ছাত্রের একজন মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত, এরা জনসম্পদ না হয়ে পরাগাছায় পরিণত হচ্ছে। কেউ কেউ টুপি-তস্‌বিহ, প্রেস-মুদি-বিকাশ-মোবাইলের দোকানদারি করে। মসজিদের ইমাম, হাফেজ, ক্বারীদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ নেই বললেই চলে। অথচ একজন বাঙালি মুসলিমই সবার শ্রদ্ধার পাত্র, সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিত্ব।
দেশ সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য বিমুখ বিশাল জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করে পুরোনো লুটেরা বণীকেরাই একটি মহাসংকট সৃষ্টির অপেক্ষায় বুদ হয়ে আছে।
প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ-মনুষ্যতা, শিল্পবোধ, নান্দনিকতা, সৃজনশীলতা, কাব্য রস হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবল বাণিজ্য। পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্যের কথা আমরা জানি কিন্তু গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় মোট বাণিজ্যের পরিমান কত তা জানি না। হাল আমলে এসো গণিত শিক্ষার নামে গনিত শিক্ষা বড্ড কৌতুকপূর্ণ। সৃজনশীল মেধার নামে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীর সৃজনী চিন্তাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সব ধরনের শিক্ষার মান তলানীতে এসে ঠেকেছে। যে কেউ ডাক্তারি পড়তে পারবে এবং নিশ্চিত ডাক্তার হয়ে মেজর অপারশেন করতে পারবেন। ভুল অপারেশনে রুগী মারা গেলে আইসিইউতে রেখে দেবার অধিকারও ডাক্তারদের রয়েছে।
যে কেউ টাকা থাকলে মনোনয়ন কিনে এমপি মেয়রও হতে পারেন, পারেন সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সভাপতি হতে।
পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে তথাকথিত প্রগতিবাদী মেরুদন্ডহীন তরুণেরা বারে, ক্যাসিনো, ক্যাফেতে মাতাল মাৎসর্যে, না হয় নেট ইন্টারনেটের নষ্ট বিশ্বে ডুব দিয়ে হারিয়ে ফেলছে নিজেদের অস্তিত্ব চিন্তাকে। ইন্টারনেটের বিশাল পৃথিবীতে শেখার হাজারো উপাত্ত থাকলেও অধিকাংশ তরুণ সেদিকে যায় না। শতকরা পঁচানব্বই জন তরুণ বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের কিয়দংশও জানে না।
দশটুকরো লাশের ছবি, পিটিয়ে শিশু হত্যা, কিশোরী ধর্ষণ, ধর্ষণের ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার বিবেক বর্জিত আস্ফালন প্রমাণ করে বিবেকের সৌন্দর্য কোথায় যেয়ে ঠেকেছে। শিশু ও নারী হত্যা একটি ভিন্ন অবস্থাকে নির্দেশ করে। এটি হচ্ছে রুগ্ন মনস্তত্বের সর্বনিম্ন স্তর। এটি প্রমাণ করে সবার সামনেই দ্রুত বর্ধনশীল রুগ্ন বৃক্ষের বাগান গজিয়ে উঠছে । জ্বলন্ত বাসে আগুন দিয়ে দিনের পর দিন মানুষ হত্যা আবার বার্ণ ইউনিটে যেয়ে অসহায় রুগীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া দুটোয় রুগ্ন মানসিকতার প্রমাণ দেয়। আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর ষড়যন্ত্র মানব সভ্যতাকেই হুমকীর মুখে নিয়ে গেছে। সামাজিক প্রতিবাদ- প্রতিরোধ, শাসন নেই বললেই চলে। পরিবার ব্যবস্থা বাজারি মনস্তত্বের হাওয়াই মিঠাই।
বাংলাদেশের টাকা চলে যায় কানাডা, আমেরিকা, হাল আমলে মালয়েশিয়ায়। যারা টাকা পাচার করে তারা আবার দেশ সেবার আওয়াজ তোলে। দ্বি-চারিতা কি মানুষের কাজ ! এসব দ্বি-চারি রাজনীতিক ব্যবসায়ী বুদ্ধিবিক্রেতার আস্ফালন প্রতিদিন মঞ্চস্থ হয়। ছাত্র রাজনীতিতে পদ- পদবী জোটে কেবলই মুরুব্বী নেতাদের লেজুড়বৃত্তি করে। দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য জানে না বললেই চলে।
সব পেশায় মিথ্যাচার এতই ভয়াবহ যে এ নিয়ে কারো নতুন করে কিছু বলার নেই। সব সম্পর্কের সেতু বন্ধন অর্থ, ক্ষমতা নির্ভর, সব দায়বদ্ধতা লেনদেন নির্ভর। সঙ্গত কারনে প্রশ্ন উঠছে শিক্ষা কি প্রকৃত পক্ষে মর্যাদা রক্ষায় কিছু শেখাচ্ছে। রাজনীতি কি জননীতিতে পরিণত হচ্ছে। সব ধরনের সেবার নেপথ্যে কি কেবলই লোক দেখানো প্রচার প্রপাগান্ডা আর অর্থ কামানো! হাসপাতালগুলো কি কেবলই বাণিজ্যিক ফার্ম। খোলা চোখে যা দেখা যায় তা কি ভুল হতে পারে। একদিকে যেমন চরম বৈষম্য অন্যদিকে চরম প্রাচুর্যতা।
কৃত্রিমতা চাতুর্যতায় ভরা সমাজে সবই যেন বাজারি পণ্যের বিশাল পসরা। যা মানকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।