বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

সম্মান-আত্মসম্মান গোলকধাঁধায়



সম্মান-আত্মসম্মান গোলকধাঁধায়

সংলাপ ॥ সাধক সাধনার দ্বারা সমাজে যা দান করে যায়, তন্মধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্বই প্রধান। এটা খণ্ড সৃষ্টি নয়, সম্পূর্ণ সাধক-সত্ত্বা। সমস্ত খণ্ড সৃষ্টি এর মধ্যে বিধৃত। এই ব্যক্তিত্ব শুধু তাঁর পুত্র-কন্যাকে দান করে যায় না, সমস্ত মানব-সম্প্রদায়ই তার উত্তরাধিকারী; বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁর পুত্র-কন্যাই তা হতে বিশেষ ভাবে বঞ্চিত হয়। রক্তিয়রা অত্যন্ত নিকট হতে দ্যাখে বলে অনেক সময় তারা তাঁর সৌন্দর্য ও মহত্ব উপলব্ধি করতে পারে না।
সাধকের চিন্তা ও কর্ম যেখানে সকলের, সেখানে সে নৈর্ব্যক্তিক। চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে সাধক যতই নৈর্ব্যক্তিক হতে থাকে, ততই তাঁর ক্ষুদ্র ‘আমি’ ক্ষুদ্রতম হয়, বৃহৎ ‘তুমি’ বৃহত্তর হতে থাকে। নৈর্ব্যক্তিক হবার সহায়ক বলেই এক-এর আরাধনা মানব-চিত্তের পক্ষে এত কল্যাণকর। তিনি অনন্ত, অসীম ও প্রেমময়। সকলকে নিয়েই তিনি জেগে আছেন, সকলকে অতিক্রম করেও আছেন, তিনি অবিনশ্বর আর সকলে নশ্বর। এই ভাব মানুষকে যতটা উপলব্ধির ঔদার্য ও বিশালতা দান করতে পারে, আর কোন ভাবেই ততটা পারে না। এইখানেই বিধাতা-ধ্যানের শ্রেষ্ঠতা। ডিমোক্রেসি, এনার্কিজম, কোন কিছুতেই মানুষ এত বড় সার্থকতা লাভ করতে পারে না, এমন বিপুল ভাবে পরিপূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু যেখানে এই চারিত্রিক প্রভাব নাই, সেখানে তার বিভিন্ন অঙ্গনে পদচারনা  শুধুই আনুষ্ঠানিকতা পালন, শুধুই অভিনয় এবং দ্বিচারিতা।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গুণ গাইলাম, কিন্তু গুণে গুণান্বিত হলাম না; তার নাম করলাম, কিন্তু চরিত্রের দ্বারা প্রভাবান্বিত হলাম না-এর মতো বড় রকমের ঠাট্টা আর কি হতে পারে, ধারণা করা কঠিন। বঙ্গবন্ধু সবাক হলে নিশ্চয়ই চিৎকার করে বলতেন, বন্ধ করো চাটুকারিতা, শুনতে চাই না ওই অনুপযুক্ত মুখে আমার নাম-গান আর আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু তিনি নীরব বলেই তাঁকে ফাঁকি দেয়া রাজনীতিকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে।
অনেকে ব্যক্তিত্বকে প্রভুত্বের সঙ্গে এক করে দেখে - প্রতাপশালীকে ব্যক্তিত্বশালী বলে ভুল করে। কিন্তু বিশ্লেষণ করে দেখলে দেখা যাবে, যে অত্যন্ত সাধারণ, যার কোন বিকাশ নেই, তার ব্যক্তিত্বও নেই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোথাও তাঁর তিলমাত্র প্রভেদও নেই। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেবার সম্পর্কই বেশী। সেবার ভাব না থাকলে নৈর্ব্যক্তিক হওয়া যায় না, আর নৈর্ব্যক্তিক না হলে ব্যক্তিত্ব বিশাল ও গভীর হয় না। সেবার ভাব না জাগলে শুধু ‘আমি’র কারাগারে বন্দী থাকতে হয় বলে জীবনের পরিপূর্ণ আস্বাদ লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তোষামোদকারীর নৈর্ব্যক্তিক সাধনা নেই বলে তার ব্যক্তিত্বও নেই। তার প্রতাপ থাকতে পারে, কিন্তু প্রভাব নেই। যেটুকু থাকে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তা শেষ হয়ে যায়। সাধকের ব্যক্তিত্ব কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেও বহু বছর বেঁচে থেকে তাঁকে পৃথিবীতে অমর করে রাখে। নৈসর্গিক দ্রব্যের মতো ব্যবহারে লাগিয়ে মানুষ তা হতে প্রচুর উপকার লাভ করতে পারে। একথা সত্য যে, মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকবার জন্যই সাধক সাধনা করে না, কীর্তিমান হবার জন্যই কীর্তি গড়া তাঁর উদ্দেশ্য নয়। এই সাধনাতেই তাঁর আনন্দ, তৃপ্তি ও সমাজসেবা বলে তিনি তা করে থাকেন। ‘কীর্তি? নদী কি নিজের ফেনাকে গ্রাহ্য করে? কীর্তি তো সাধকদের ফেনা-ছড়াতে ছড়াতে চলে যাবে। ফিরে তাকাবে না।’
আদর্শিক রাজনীতিকের প্রথম ও প্রধান শত্রু লোভ-চাকচিক্যময় জীবনের প্রতি টান। দ্বিতীয় শত্রু প্রতিযোগিতা। উভয়ের সম্মিলিত অত্যাচারে তার জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। লোভ ও প্রতিযোগিতা প্রথমে তার ভিতর হতে জাগে না, অন্যে জাগিয়ে দেয়। তাকে সাবধান করে দিয়ে তার শুভানুধ্যায়ী বন্ধুগণ যে তার উপকার করে, তা বুঝতে পারে না। পারে না বলেই ক্ষমার পাত্র। নইলে তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা সাধনের অভিযোগ আনা সহজ হতো। রাজনীতিকদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সচেতন করলেও তার ভিতরের আনন্দের উৎসটি নষ্ট হয়ে যায়। তখন সে অথর্ব ও পঙ্গু হয়ে পড়ে। ইচ্ছাবৃত্তির দ্বারা স্বজনাবেগকে ধ্বংস করতে করতে সে ক্রমাগত তিক্ত ও বিরক্ত হয়ে ওঠে, তার জীবনের পূর্ণতা ও চরিত্রের অটুট ভাব নষ্ট হয়ে যায়।
অন্তরের সহজ প্রবৃত্তি নষ্ট হওয়ার দরুন রাজনীতিকরা ক্রমে তিক্ত ও বিরক্ত হয়ে ওঠে। তিক্ততা ধীরে ধীরে নৃশংসতায় পরিণত হয়, আর সেই নৃশংসতাকে সে কখনো সাহস, কখনো নৈতিকতার ছদ্মবেশ পরিয়ে চালাতে থাকে। ক্রমে প্রতিযোগিতার ইচ্ছা বলবতী হয়, অর্থাৎ নিজের সুখ-সৃষ্টির চাইতে পরের দুঃখ সৃষ্টির স্পৃহা প্রবল হয়ে দেখা দেয়। নিজের ভিতরের কাজ করবার প্রেরণা স্তব্ধ হয়ে আসে, অন্যকে জব্দ করবার জন্যই তাকে সবকিছু করতে হয়। জীবন ও সমাজ  বিকাশে আর আনন্দ পায় না বলে যে-কোন ক্ষেত্রে যে-কোন উপায়ে সার্থকতা লাভকেই সে বড় করে দেখতে শুরু করে। সার্থকতা লাভের জন্য সে এত ব্যস্ত  হয়ে উঠে যে, নিজের বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে নিতান্ত সাধারণ হয়ে পড়তেও তার কুন্ঠাবোধ হয় না। এইরূপে জনগণের সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আদর্শিক আরাধনা চিত্তের সৌকুমার্য নষ্ট করে নিজেই নিজেকে একেবারে অনুভূতিহীন জীবে পরিণত করে।
অপরদিকে, সাধক সাধনা শিল্পে কি করে নতুনত্ব সৃষ্টি করা যায়, সেই দিকেই তাঁর ঝোঁক। একলা ঘরে বসে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর দিন কাটে বেশ। জীবিকা অর্জনের চাইতে জীবনার্জনের দিকেই তাঁর নজর বেশী। তিনি অনুভব করেন তাঁর চিত্তে স্পর্শমণির মতো এমন এক দুর্লভ বস্তু আছে যার স্পর্শে সামান্য ধূলিবালিও সোনা হয়ে ওঠে, নিতান্ত সাধারণ জিনিসও অসাধারণত্ব লাভ করে। সেই স্পর্শমণির স্পর্শ লাভ করবার জন্য, কীট-পতঙ্গ, তৃণলতা সমস্ত কিছু নিয়ে বিশ্ব-সংসার তাঁর চিন্তাজগতে হয় অতিথি। আনন্দের অফুরন্ত ভাণ্ডার বলে তিনি তাঁর নিজের প্রতি সতত শ্রদ্ধাশীল। কস্তুরী মৃগের মত তিনি আপনার গন্ধে আপনি পাগল। কিন্তু তাঁর এই তন্ময়তার অবস্থা আমৃত্যু। তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন তাঁর শিল্পচর্চায় খুশী না হয়ে তাঁকে বাস্তবজগতে উন্নতি করার জন্য উপদেশ দিতে থাকে। তাঁর আত্মীয়-স্বজন অন্যের নজীর দেখিয়ে তাঁকে বড়লোক হতে বলে। সাধক প্রথম প্রথম তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে ওঠেন, তিনি চিন্তা করেন তাঁকে আত্মহত্যা করার জন্য উপদেশ দেয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও ক্রমে ক্রমে কুমন্ত্রণাদাতারা রাজনীতিকদের হৃদয় জুড়ে বসে তার ভিতরের আদর্শের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ করতে বাধ্য করে। সন্দেহ ঠোঁট বাঁকা করে বলতে থাকে - ফেলে রাখো তোমার আদর্শ। ওসব দিয়ে কি হয়? পারো তো অন্যদের মতো একখানা অট্টালিকা নির্মাণ করো, বিত্তশালী হও, আর লোকের আভূমি-প্রণত সেলাম গ্রহণ করো। আদর্শ তখন তিরস্কারের সুরে বলেঃ ছি ছি একি তোমার মতিগতি? শেষে কাঞ্চন ফেলে কাঁচ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হলে?
আদর্শ বলে বিকাশেই তোমার তৃপ্তি, কেন ওসব বাইরের আবর্জনার প্রতি নজর দাও? পরিণামে বহু দ্বন্দ্বের পর রাজনীতিক লোভ ও ভোগের কাছে পরাজয় বরণ করে। সন্দেহ জয়ী হয়ে তাকে বাস্তব জগতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে তথাকথিত উন্নতি-সংগ্রামে প্রবৃত্ত করে। ক্রমে প্রতিযোগিতার স্পৃহা জাগে এবং তার আনুষঙ্গিক বেআইনী কর্মকাণ্ড অন্তর-রাজ্য দখল করে বসে। চারিদিকে তার জয়জয়কার পড়ে যায়। তার তথাকথিত উন্নতি ও সম্মান দেখে তার আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব বলে, এতদিনে সে মিথ্যা কল্পনা পরিহার করে মানুষ হয়েছো বলে করমর্দন করে।
আদর্শ হারিয়ে ফেলায় রাজনীতিকের আনন্দ তার নিকট হতে চির-বিদায় গ্রহণ করে। সমস্ত পৃথিবী খুঁজেও সে এক বিন্দু আনন্দ লাভ করতে পারে না। যা তার জন্য আকাশ আলোর মতো অজস্র ছিল, যা নিজে উপভোগ করে অন্যকে বিলিয়েও উদ্বৃত্ত থাকত, তা এমন  দুর্লভ হলো কি করে, শত চিন্তা করেও সে তা বুঝে উঠতে পারে না। শুধু চিন্তা করে, কি-যেন তার পৃথিবী হতে পালিয়ে গেছে, কি যেন নেই। যে সন্ধ্যাতারা প্রতি সন্ধ্যায় তার জন্য আনন্দ-বার্তা বহন করে আনত, তা যেন এখন বিদ্রূপবার্তা  নিয়ে আসে। তার মুখে হাসি নেই, আছে ব্যঙ্গ।
সে জানেনা যে সে আত্মহত্যা করেছে! তথাকথিত আত্মসম্মানের জন্য আত্মাকে বিক্রি করতেও সে প্রস্তুত। তবু সে রাজনীতিক। ব্যক্তিস্বার্থের ব্যাপারে পান হতে চুন খসলে অস্থির হয়ে পড়ে। হায় রে, আদর্শের খাঁচাটি নিয়ে সে নৃত্য করছে, আদর্শ পাখিটি কবে উড়ে গেছে, সেদিকে তার ও সঙ্গী-সাথীদের লক্ষ্য থাকে না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন