বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ভাষা ব্যবহারে মাথাব্যথা!


ভাষা ব্যবহারে মাথাব্যথা!
সায়মুল হাসান ॥ একটা প্রচলিত গল্প দিয়েই শুরু করছি। এক ব্যক্তি রিক্সায় উঠে রিক্সাচালককে বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেতে। রিক্সাওয়ালা বিশ্ববিদ্যালয় চেনে না। অবশেষে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলে চালক। রিক্সাচালক পরিচিত ভবন দেখে বললো, ‘ও ইউনিভার্সিটি তাই কন। ইংরেজি কইলে বুঝবো ক্যামনে?’
বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা ইউনিভার্সিটি বেশি প্রচলিত শব্দ সাধারণের কাছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গল্পের রিক্সাওয়ালার মতো এই সাধারণ মানুষ হচ্ছে শিক্ষাবঞ্চিত। শিক্ষা লাভকারী মানুষের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গৃহীত, আনুষ্ঠানিক ও আভিধানিক শব্দ। এটা পরিহার করা চলবে না। বাংলায় বলা ও লেখার সময় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংরেজি বলা ও লেখার ক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটি, ভার্সিটি ব্যবহারই ভাষার প্রতি ন্যায়বিচার হবে।
কিন্তু এ থেকে দেশের শিক্ষিত মানুষও এখন কত দূরে! প্রতিনিয়ত সাধারণ কথোপকথনে অবিরাম ইংরেজি শব্দের মিশেল দেয়া হচ্ছে। প্রচলিত চমৎকার সব বাংলা শব্দ পরিহার করে আজকাল ইংরেজি মিশিয়ে খিচুড়ি কথাবার্তা হয়। প্রায়ই বাক্য সম্পূর্ণ হয় না। প্রতিদিন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান বা টক শো চলছে তা শুনলে এই অদ্ভুত ব্যাপারটা রীতিমতো কানে খোঁচা মারে। শুধু শ্রাব্য মাধ্যমেই নয়, মুদ্রিত সংবাদপত্রেও অপ্রয়োজনে প্রচুর ইংরেজি শব্দের ছড়াছড়ি দেখা যায়।
অনেকে ব্যাঙ্গ করে একে বাংরেজি বা বাংলিশ ভাষা বলছেন। কিন্তু বিষয়টাকে কি হাল্কা করে দেখা যায়? না, একেবারেই না। ভাষা ব্যবহার আমাদের বিশ্ব প্রতিযোগিতায় সক্ষম জাতি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে মৌলিক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বে একমাত্র আমরাই ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে শহীদ হয়েছে দেশের বীর সন্তানরা। মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে এই সংগ্রাম। অন্য বহু জনগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষার প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে - এই গৌরবের সঙ্গে বর্তমানে মাতৃভাষার প্রতি আমাদের অবজ্ঞা, ভাষা চর্চা ও তার সমৃদ্ধি সাধনে অবহেলা, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও মর্যাদাবোধের অভাব প্রভৃতির কি কোনো মিল আছে? তাহলে আমরা আত্মপ্রেরণার উৎস ভাষার সাথেই আত্মপ্রতারণা করে চলছি কেন? কী তার কারণ? কী এর ভবিষ্যৎ?
বর্তমানে, বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন বা এনজিও’র কাজ ইংরেজিতেই হচ্ছে। যদি বিদেশী দাতা সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেয়া হয় এবং একজন বিদেশী উপস্থিত থাকেন তবে তাকে দোভাষী দিয়ে সাহায্য করার পরিবর্তে উপস্থিত বঙ্গভাষীরা দুর্বল ইংরেজিতে সভা করেন। এতে শুধু হীনমন্যতাই প্রকাশ পায় না, বক্তব্যে বিষয় ও আলোচনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ বুঝা যায় না। অবশ্যই মাতৃভাষায় বক্তব্য যত স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করা যেত তা হয় না এবং শতভাগ অংশগ্রহণকারীর কাছে বক্তব্য বোধগম্য হয় না। উদ্যোক্তারা যেন বিদেশী দাতাদের জন্যই অনুষ্ঠানে অভিনয় করে যাচ্ছেন - ফলাফল যাই হোক।
ষাটের দশকে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চাসহ বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের জন্য প্রাণপাত করতে প্রস্তুত অনেকেই সনৱানকে আর্থিক কষ্ট সত্ত্বেও ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যমে পড়িয়েছেন ‘ভবিষ্যৎ নিরাপদ’ বলে। এই বাস্তবতা আমাদের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আবার মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে বিকাশ সম্ভব, ভবিষ্যৎ সুফল পাবো - এটা কি নিশ্চিত? শেষে আম ও ছালা দুটোই হারাবো না - এই নিশ্চয়তা কি আছে?
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বাংরেজি বা বাংলিশ যাদের ভাষা তারা না জানে বাংলা, না শিখেছে ইংরেজি। এতে ভাষাচর্চাও বড় কিছু করা সম্ভব নয়। গত দুই-আড়াই দশক ধরে শিক্ষার মানের অবনতির জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা স্নাতক হয়ে বেরুচ্ছেন তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এই দুর্বলতা ধরা পড়ছে। ইংরেজি না পারলেও বাংলা শুদ্ধ লিখতে পারেন - এমন লোক পেশাদার কর্মশক্তিতে এখন কম পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা সার্বিকভাবে পিছিয়ে পড়ছি।
শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টত এই সুচিন্তিত মত দিয়েছেন যে, মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া শিক্ষা পূর্ণ হয় না। সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে মাতৃভাষা। বৈজ্ঞানিকভাবেও এ কথা সত্য। জ্ঞান লাভ প্রক্রিয়ার সাথে ভাষার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে বিদেশী ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাও রেখেছেন। আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞান অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা - ইংরেজি, জার্মান, স্পেনীয়, ফরাসি ও রুশ প্রভৃতির প্রয়োজন হবেই। কিন্তু শিক্ষা অর্জনে এর কোনো একটি দ্বিতীয় ভাষা হবে। মাতৃভাষার বিকল্প হতে পারে না।
জ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন বেঁচে থাকতে তাঁর নেতৃত্বে একটি দীর্ঘ কর্মশালায় সিদ্ধান্ত হয়েছিলো যে, প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি চাপানো ক্ষতিকর। বর্তমানে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল ও বহুধা বিভক্ত। তাই সবদিক ভেবে-চিন্তে মাতৃভাষাকে মূখ্য ভূমিকায় সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম রেখে পুরো জাতিকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে।
শুধু বাঙালির জন্য নয়, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর ভাষাও রক্ষার লক্ষ্য থাকবে নীতিতে এবং প্রাথমিকের পরে মাধ্যমিক বা তৎপরবর্তী স্তরের জন্য ইংরেজি থাকবে। এটাই পুরো জাতিকে যোগ্য জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার সহায়ক হবে। আর সরকারী কাজে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যেখানে যেমন প্রয়োজন তেমনি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাই দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহৃত হতে পারবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই ভাষানীতি আছে। বহুজাতির দেশ বলে ভারতীয়রা একাধিক ভাষায় দক্ষ। দু’শ বছর ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনে আমরা শোষিত হয়েছি। কিন্তু তা থেকে সুফল বের করে আমরা কি একটি ‘দ্বিভাষিক জাতি’ হতে পারি না? কথাটা বিশেষজ্ঞ  ও পন্ডিতরা ভেবে দেখতে পারেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন