জাতীয়
জয়ধ্বনিঃ জয় বাংলা
সংলাপ ॥ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের
প্রেরণা ও জয়ধ্বনি ‘জয় বাংলা’ হুঙ্কারটি কেন আমাদের সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য
হচ্ছে না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
আমাদের দেশে সহজ
সরল ধর্মভীরু মানুষদের বোঝানো হচ্ছে যে জয় শব্দটি হিন্দুদের কথা, আর জিন্দাবাদ হল ইসলামী
শব্দ। এটি একটি মস্ত বড় ধাপ্পা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে আমাদের
দেশের জনগণের ওপর, আমাদের মা-বোনদের ওপর, আমাদের ছেলেমেয়ে ও বাপ-ভাইদের ওপর অত্যাচার
করতে পাকিস্তানীদের সাহায্য করেছে তারা মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে জেনে-শুনে
এই মিথ্যা কথাটি প্রচার করেছে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো
সম্বন্ধে অতটা অবহিত নয় বলেই এতোবড় ডাহা মিথ্যা কথাটা বলে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা পার পেয়ে
যাচ্ছে।
একটি শব্দকে তখনই
শুধু মুসলমানদের শব্দ বলা যায়, যখন পৃথিবীর সব দেশের মুসলমানরাই সেই শব্দটিকে ব্যবহার
করে, কিংবা শব্দটি অন্য কোন ধর্মে ব্যবহৃত না হয়ে কেবলমাত্র ইসলাম ধর্মেই ব্যবহৃত হয়।
সে হিসেবে আল্লাহ্, রসুল ইত্যাদি শব্দকে আমরা মুসলমানদের শব্দ বলতে পারি। কারণ দল,
গোত্র, মজহাব, বর্ণ, জাতি, ভাষা নির্বিশেষে সারা বিশ্বের মুসলমানরাই এই শব্দ দুটিকে
ব্যবহার করে থাকে।
আমাদের উপমহাদেশের
বাইরে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে বিশেষ করে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া
সহ কোনো মুসলমান দেশেই জয়ধ্বনিতে তারা জিন্দাবাদ শব্দটি ব্যবহার করে না।
সৌদি আরবে তাদের
দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে সে দেশের লোকেরা আল বালাদি, আল বালাদি, আল ওয়াতান
(আমার দেশ, আমার দেশ, আমার জন্মভূমি) বলে। বেশিরভাগ আরবি ভাষাভাষী দেশগুলোতে জয়ধ্বনি
হিসেবে দেশের নামের সঙ্গে তাহিয়া বা আত্তায়িস শব্দটি জুড়ে দেয়। যেমন লিবিয়ার লোকেরা
বলে তাহিয়া আল জামাহিরিয়া বা আত্তায়িস জামাহিরিয়া। কিন্তু তারা কেউ কখনোই ‘লিবিয়া
জিন্দাবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করে না। সৌদিরাও তেমনি কোনোদিন ‘আরাবিয়া আস সৌদিয়া জিন্দাবাদ’
বলে না। এমনকি জিন্দাবাদ শব্দটিরই কোনো ব্যবহার নেই আরবি ভাষায়।
ইরানীরা হয়তো তাদের
দেশের জয়ধ্বনি হিসেবে ‘ইশতকলালে অওজাদী (আজাদী) জমহুরিয়ে ইসলামী’ বলে কিন্তু কখনোই
‘জমহুরিয়ে ইসলামী জিন্দাবাদ’ বা ‘ইরান জিন্দাবাদ’ বলে না। তারা তাদের জননেতাদের জয়গান
গাইতে হলে ‘ইয়ারে ইমাম খোশ আমদিদ’ কিংবা খোদা তোর্অ নিগাহ্ দর’ কিংবা ‘খোদা ইয়া ইনকেলাবে
খোমেইনীর্অ নিগাহ্ দর’ বলে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ‘খোমেইনী জিন্দাবাদ’ বা ‘খালখালী
জিন্দাবাদ’ বলে না।
বিভিন্ন মুসলমান
অধ্যুষিত দেশে বহুদিন ধরে বাস করেছে এমন অনেক মানুষকে আজ এ দেশে পাওয়া যাবে। তাদের
মধ্যে কেউ ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে অন্য কোনো দেশের জয়ধ্বনির মধ্যে জিন্দাবাদ শব্দটি
শুনেন নাই। তাহলে এটি ইসলামী জয়ধ্বনি হয় কি করে?
একটু বিশ্লেষণ করলেই
দেখা যাবে, যে কয়টি শব্দ সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ এবং বিশেষভাবে প্রচলিত
তার সব কয়টিই আরবি শব্দ।
‘জিন্দা’ শব্দটি
আরবি নয় ফার্সি। আমরা যদি ধরেও নেই যে কুরআনের ভাষা বলে আরবি ভাষাটিকে আমরা ইসলামী
ভাষা বলবো, তা হলেও আরবি ছাড়া অন্য ভাষাগুলোর মধ্যে একটা আর একটার চেয়ে বেশি ইসলামী
হয় কি করে? বাংলা ও ফার্সিতো একই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর ইন্দো-ইরানীয় শাখার দুটি
ভাষা। তা হলে তাদের মধ্যে একটি ইসলামী আর একটি অনৈসলামী ভাষা হয় কি করে? ফার্সি ভাষাভাষী
দেশের মানুষ ইরানীরাও তো তাদের জয়ধ্বনি হিসেবে ইরান জিন্দাবাদ বলে না।
জিন্দাবাদ শব্দটি
স্লোগান হিসেবে শুধুমাত্র ভারত ও পাকিস্তানে ব্যবহৃত হয়। ভারতের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ,
খৃষ্টান সবাই প্রায় সমানভাবেই এই শব্দটি ব্যবহার করে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ (মানে বিপ্লব
জেগে উঠুক) ধ্বনিটি সেখানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ইত্যাদি
সকল সাম্যবাদীর কাছেই সমানভাবে জনপ্রিয় স্লোগান। কিন্তু পাকিস্তান আমলেও তৎকালীন বাংলাদেশের
বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের জয়ধ্বনি হিসেবে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বাক্যটি ব্যবহার
করতো না। তারা ব্যবহার করতো ‘জয় সর্বহারা’ স্লোগানটিকে।
আর জিন্দাবাদ ধ্বনিটি
কিন্তু পাকিস্তানেরও একমাত্র রণহুঙ্কার নয়। জিয়ে শব্দটিকেও সেখানে রণহুঙ্কার হিসেবে
ব্যবহার করা হয়। ‘জিয়ে ভুট্টো’, ‘জিয়ে সিন্ধ’, ‘জিয়ে বেনজির’ ইত্যাদি রণহুঙ্কার দিয়ে
চিৎকার করে সেখানকার লক্ষ জনতা এখনো তাদের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে।
আলজেরীয় মুক্তিযুদ্ধের
রণহুঙ্কার ছিল ‘ইয়াহ্ ইয়া আল্ জাজায়ের’। এই ধ্বনিটিই হচ্ছে সে দেশের জয়ধ্বনি।
আলজেরীয় মুসলমানরা
যদি তাদের মাতৃভাষায় রচিত ‘ইয়াহ্ ইয়া আল্ জাজায়ের’ ধ্বনিটিকে তাদের জয়ধ্বনি রূপে
ব্যবহার করতে পারে, ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা যদি তাদের মাতৃভাষায় ‘ইন্দোনেশিয়া মের্দেকা’
কিংবা ‘মের্দেকা ইন্দোনেশিয়া’ ধ্বনিটিকে তাদের জয়ধ্বনি রূপে ব্যবহার করতে পারে, সিন্ধুর
মুসলমানগণ যদি তাদের মাতৃভাষায় ‘জিয়ে ভুট্টো’ এবং ‘জিয়ে সিন্ধে’ বলে রণহুঙ্কার দিতে
পারে, তাহলে আমরা কেন আমাদের মাতৃভাষায় রচিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণহুঙ্কারকে আমাদের
প্রেরণা ও জয়ধ্বনি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবো না? আমাদের দেশের জনগণের অর্থে কেনা,
জনগণের রক্ত পানি করা টাকায় পরিচালিত রেডিও টেলিভিশনে কেন ‘জয় বাংলা’ সেস্নাগানটি আজও
স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আর যে ধ্বনিটি ব্যবহার করে পাকিস্তানী বাহিনী
আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে, তাদের অসম্মান করেছে, আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ
নর-নারীর গলায় ছুরি চালিয়েছে, তাদের বুকে বেয়নেট চার্জ করেছে, সেই জিন্দাবাদ ধ্বনিটিকেই
কেন বাংলার মাটিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ?
‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির
প্রতি কয়েকটি দলের এতো বীতরাগের কারণ কি, সে কথা জিজ্ঞেস করলে যেসব উত্তর পাওয়া যায়,
তার মধ্যে প্রধান একটা উত্তর হলো, এ স্লোগানটি হলো আওয়ামী লীগের জয়ধ্বনি। স্লোগানটি
সম্বন্ধে তাদের এই দাবি খুব একটা ধোপে টেকে না। কারণ আওয়ামী লীগের মঞ্চ থেকে এই স্লোগানটি
প্রথম দিকে ব্যবহৃত হয়ে থাকলেও পরবর্তী সময়ে এটা আর আওয়ামী লীগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পরবর্তী আগেই এটা বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্খা প্রকাশের মাধ্যম
রূপে পরিগণিত হয়ে গিয়েছিল। সে সময় এই জয়ধ্বনিটি কতোটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তার একটা আভাস
পাওয়া যায় ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ইতিহাস থেকে।
সেই নির্বাচনের সময়
পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয়তার নিরিখে আওয়ামী লীগের পরেই স্থান ছিল মোজাফ্ফর ন্যাপ
ও তখনকার আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ শক্তির। যৌথভাবে এই দল দু’টির ছিল বিরাট
একটি সুশিক্ষিত, মেধাবী এবং সংস্কৃতিবান, উদ্যমশীল, পরিশ্রমী এবং পার্টি অন্তপ্রাণ,
ত্যাগী ও নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী। ন্যাপ-কমিউনিস্ট মোর্চার (কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা
তখন ন্যাপের ব্যানারেই কাজ করতেন) মেনিফেস্টোও তখন আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোর মতো জনগণের
প্রাণের দাবিগুলোর সঙ্গে সমানভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। তাই সেদিন মোটামুটিভাবে মনে হচ্ছিল
যে পাকিস্তানের এই অঞ্চলে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন পেলেও ন্যাপ তুলনামূলকভাবে
খুব মন্দ করবে না এবং তাদের আসন সংখ্যা হবে এই অঞ্চলে দ্বিতীয় বৃহত্তম।
এই ধারণাটি সেদিন
এতই স্পষ্ট বলে মনে হচ্ছিল যে, পাকিস্তান সরকারও সাহস করে কিছু বলেনি। কারণ তারা ভেবেছিল
যে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ ভোট ভাগাভাগি হবে। উর্দু পছন্দ পার্টিগুলোও
বেশ কিছু সংখ্যক আসন জয় করে নিতে পারবে। ফলে পূর্ববাংলার এই উর্দুপছন্দ সদস্যদের সঙ্গে
মিলে শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানীরাই দেশ শাসন করতে পারবে।
সে সময় ন্যাপ ও কমিউনিস্ট
পার্টির প্রিয় জয়ধ্বনি ছিল ‘জয় সর্বহারা’। তাই আওয়ামী লীগ কর্মীরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি
উচ্চারণ করলে তার বদলায় নিজেদের অস্তিত্ব প্রচার ও প্রতীয়মান করার জন্য ন্যাপ ও কমিউনিস্ট
পার্টির কর্মীরা ‘জয় সর্বহারা’ বলে গর্জন করে উঠতো। সে যুগে প্রায়ই দেখা যেতো যে আওয়ামী
লীগ ও কমিউনিস্ট কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি তাদের নিজ নিজ জয়ধ্বনি উচ্চারণ করার প্রতিযোগিতা
চলেছে।
মানুষ তখন ‘জয় বাংলা’
ধ্বনিটিকে এতো ভালোবেসে ফেলেছে যে, তার পিঠেপিঠি ‘জয় সর্বহারা’ ধ্বনিটি শুনলেই মানুষ
বিরক্ত হয়ে উঠতো। তাদের কাছে এই স্লোগানটিকে ‘জয় বাংলা’ বিরোধী কোনো একটা ষড়যন্ত্র
বলে চিন্তা করতো। জয় বাংলা স্লোগানটিকে দাবিয়ে দেয়ার জন্যই যেন এর সৃষ্টি। সাধারণ জনগণের
মধ্যে যারা ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল তাদের অনেকের সমর্থনও আওয়ামী
লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে দেখা যায় যে, সেবার পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইন সভায় তৎকালীন
পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। প্রচুর
সংখ্যক নিঃস্বার্থ সমাজসেবক প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও ন্যাপ-কমিউনিস্ট মোর্চা সে বছর
কেন্দ্রীয় আইন সভার কোনো আসনেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হতে পারেনি।
‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি
সেদিন এ দেশে এতো জনপ্রিয়তা পাবার পরও যদি কেউ ভাবে যে এ ধ্বনিটি এখনো আওয়ামী লীগের
নিজস্ব জয়ধ্বনি রয়ে গেছে, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ দেশের স্বাধীনতা এসেছে বলে
তো সেই স্বাধীনতাকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা না বলে আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা বলতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়
এই স্লোগানটির জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে গিয়ে এটি সত্যিকার অর্থে সর্বজনীন হয়ে ওঠে। এ দেশের
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই কোনো একটা বিশেষ দলের লোক ছিল না। আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্যান্য অনেক
দলের কর্মীরা এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের
একটা বিরাট অংশ, সম্ভবত বেশিরভাগ ছিল কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কহীন, এ দেশের
সাধারণ মানুষ। আমরা জানি, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েই এদের সবাই দেশের জন্য প্রাণ দিতে
এগিয়ে গিয়েছে। এই জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে হুঙ্কার দিয়েই এরা যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানী
নরপিশাচদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিজয়ের ক্ষণে বা পাকিস্তানী বাহিনী কিংবা রাজাকার, আল-বদর নামধারী এদেশী কাউকে যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করতে পারলে,
আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধাই ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে তাদের উল্লাস প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে
শহীদ হবার পূর্ব মুহূর্তে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে তারা তাদের জীবনের শেষ মুহূর্তে
শেষ প্রত্যয়, শেষ আকাঙ্খা ব্যক্ত করে গিয়েছে।
এ দেশের জনগণের মধ্যে
যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেনি, তাদের মধ্যেও একমাত্র রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস
ও তাদের মদদ দানকারী দেশদ্রোহী ছাড়া আপামর বাঙালির কাছে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি ছিল প্রাণের
মতোই প্রিয়। এই ধ্বনিটি শুনলে সেই সময়কার ভীতি-বিহ্বল মুহূর্তগুলোতেও তাদের মনে সাহস
ও আশার সঞ্চার হতো।
অতএব, মুক্তিযুদ্ধের
আগে থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত এই জয়ধ্বনিটির সর্বজনীনতাপ্রাপ্ত
হবার পর এটা আওয়ামী লীগের একচেটিয়া সম্পদ থাকেনি। এটা এ দেশের সকল মানুষের, এ দেশের
আপামর জনসাধারণের সম্পদ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল
বলে যেমন এটাকে আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা বলা যায় না, এটা হলো আমাদের বাঙালি জাতির স্বাধীনতা;
তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বজনীনতা প্রাপ্তির পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকেও আওয়ামী লীগের
দলীয় সম্পত্তি বলা যাবে না, এটা সমগ্র বাঙালি জাতির সম্পদ, এটা আপামর বাঙালির জয়ধ্বনি।
স্বাধীনতা পরবর্তী
সময়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া যে দু’টি রাজনৈতিক দল এদেশে সরকার গঠন ও পরিচালনা করেছে তাদের
অনেক নেতা-কর্মীই তো এসেছেন আওয়ামী লীগ থেকে। তাই তারা যখন আওয়ামী লীগ থেকে সরে এসে
নতুন পার্টি গঠন করেছেন, তখন স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল যে এসব পার্টি তাদের পৃথক অস্তিত্বের
কারণ হিসেবে, তারা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ ও নীতিমালার দিক দিয়ে আওয়ামী লীগের
থেকে অন্যরকম, সেই কথাটাই জনগণের কাছে বড় করে তুলে ধরবে এবং এর উপরেই তারা বেশি জোর
দিবে। কিন্তু তা না করে তারা তাদের নেতা পৃথক, তাদের স্লোগান পৃথক, তাদের ভাষায় বেতার
সংস্থার নাম পৃথক ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর বেশি প্রাধান্য দিতে থাকে এবং এগুলোকেই তারা
তাদের পৃথক অস্তিত্বের কারণ হিসেবে প্রতীয়মান করার চেষ্টা করতে থাকে।
রাজনৈতিক দলগুলো
না হয় তাদের পৃথক অস্তিত্ব প্রমাণ করতে অন্য কোনো জোরালো যুক্তি দেখাতে না পেরে এ দেশের
বেতার ও টেলিভিশনে জয় বাংলা স্লোগানটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়ে সেখানে একটা বিকল্প
স্লোগান চালু করেছিলো এবং তাদের স্লোগানটিই যে ভালো তা বোঝাবার জন্য কোশেশ করেছিলো,
কিন্তু তাই বলে আমরা, যারা জনগণ, যারা কোনো পার্টির সদস্য নই, তাদের কি উচিত হবে এতো
সহজে শান্ত ছেলের মতো বাংলা ভাষায় রচিত ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আমাদের নিজস্ব
জয়ধ্বনিটি বিসর্জন দিয়ে, কোনোরূপ বিচার বিবেচনা না করে, যে পাকিস্তানের আমরা কলোনি
ছিলাম, যাদের অধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের দেশের তিরিশ লক্ষ নর-নারীকে জীবন
বিসর্জন দিতে হয়েছে, সেই পাকিস্তানের স্লোগান থেকে জিন্দাবাদ শব্দটি আমাদের বাংলাদেশের
নামের সঙ্গে গ্রহণ করা এবং সেই সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানটিকে আমাদের মন থেকে
বিসর্জন দেয়া যুদ্ধপরাধের শামিল এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতাও বলা যেতে পারে। পাকিস্তান-পছন্দ
পার্টিগুলো জানে যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত দেশবাসীর মন থেকে জয় বাংলা স্লোগানটি
নির্বাসিত করা সহজ হবে না। তাই তারা জাতীয়তাবাদের যুক্তি বাদ দিয়ে এ দেশের মানুষের
মনের ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে বোঝাতে চেয়েছে যে, জয় শব্দটি ইসলামী নয় - ওটা
হিন্দুদের শব্দ, তাই ও শব্দটি বলা চলবে না, তার বদলে আমাদেরকে জিন্দাবাদ শব্দটি বলতে
হবে।
আমার মাকে আমি বাংলা
ভাষায় ‘মা’ বলতে পারবো। বাংলাদেশকে বাংলা ভাষায় ‘বাংলাদেশ’ বলতে পারবো। তাতে কোনো আপত্তি
নেই। কিন্তু জয় বাংলাকে আমার মায়ের ভাষায় ‘জয় বাংলা’ বলতে পারবো না। সেটা আমাকে বলতে
হবে পাকিস্তানীদের ভাষায়! বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা বলে কি কিছুই থাকতে নেই?
আওয়ামী লীগ এখনো
পর্যন্ত এই জয়ধ্বনিটিকে টিকিয়ে রেখেছে। যে সুরে এই রণহুঙ্কারটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে
ব্যবহৃত হয়েছে, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে এই রণহুঙ্কারটি যে সুরে উচ্চারণ করে আমাদের
শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শেষ কামনা, তাদের শেষ প্রত্যয় ব্যক্ত করে গিয়েছে সে উচ্চারণটি
ছিল, দৃপ্ত ভাবে জোরালো উচ্চারণের হুঙ্কার ‘জয় বাংলা’।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে
রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিকে আলতাফ মাহমুদ কর্তৃক একটি চিরায়ত সুর দেবার পর থেকে
যেমন আমরা সবাই মেনে নিয়েছি যে সেই সুরেই এখন থেকে আমরা এই গানটি গাইবো, তেমনি মুক্তিযোদ্ধারা
যে সুরে হুঙ্কার দিয়ে ‘জয় বাংলা’ বাক্যটিকে সুরারোপিত করে গেছেন, সেই সুরেই এটাকে চিরদিন
উচ্চারণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
স্মরণ রাখতে হবে
যে, কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধার মুখ দিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এই দু’টি শব্দ একটিবার
বলাবার জন্য পাকিস্তানী নমরুদরা প্রথমে তার হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলেছে, তারপর পা, তারপর
হাতের কব্জি, তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার চোখ উপড়িয়ে ফেলেছে, তারপরও তার
মুখ দিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিটি বের করতে পারেনি, তার বদলে তার মুখ থেকে দৃপ্ত
অহঙ্কারের সাথে বেরিয়ে এসেছে ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনিটি। এরপরও যদি আমরা আমাদের জয়ধ্বনি
‘জয় বাংলা’র থেকে জয় শব্দটিকে বাদ দিয়ে জিন্দাবাদ শব্দটি বলার জন্য লালায়িত হয়ে উঠি,
তাহলে ধিক আমাদের বাঙালি জাতিকে!
আমরা যে দলের, যে
ধর্মের, যে বর্ণের লোকই হই না কেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা যে পার্টির সদস্যই হই, জয়
বাংলা বাক্যটিকেই আমাদের সবার জন্যই জাতীয় জয়ধ্বনি, আমাদের সর্বজনীন জয়ধ্বনি হিসেবে
গ্রহণ অবশ্যই করতে হবে, আজ না হয় কাল।
জয় বাংলা,
বাংলার জয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন