শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

দেশের রাজনীতি কি দুর্বৃত্ত-কবলিত ?

দেশের রাজনীতি কি দুর্বৃত্ত-কবলিত ?

সংলাপ ॥ ‘দেশের রাজনীতি দুর্বৃত্ত-কবলিত হয়ে পড়ছে। অনেক আগেই কালো টাকা ও পেশী শক্তি ক্রয়ের সামর্থ নির্বাচনী মনোনয়ন কেনাবেচার বাজারে প্রধান নির্ধারক হয়ে গেছে। চাঁদাবাজি ও মস্তানি কোটিপতি হওয়ার সোজা পথ, আবার এদের সবারই গডফাদার কোন না কোনো রাজনীতিক। গত ২৫ বছরের প্রতিটি ক্ষমতাসীন দল বা জোট তাদের শাসনামলে বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের পছন্দমত সাজিয়েছে নিজেদের পক্ষে আনার উদ্দেশ্যে।
আগষ্ট মাস আমাদের আমাদের জন্য শোকাবহ মাস (যদিও বাংলা শ্রাবণ-ভাদ্র মাস হিসেবে এই মাসটিকে আমরা বাংলার ঐতিহ্যকে মূল্যায়িত করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি!)। বাঙালি জাতির জীবনে এবং পাশাপাশি বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে আগষ্টই হচ্ছে আত্মোপলব্ধি ও দৃঢ়প্রত্যয়ী হওয়ার মাস। এই মাসের ৩০-৩১ শ্রাবণ (১৫ আগষ্ট) সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যার ধারাবাহিকতায় কার্তিক মাসে (নভেম্বরে) হত্যা করা হয়েছিল জাতীয় চার নেতাকে। ইং ২০০৪ সালের ৪ ভাদ্র (২১ আগষ্ট) তারিখে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ সকল নেতৃত্বকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। ইং ২০০৫ সালের ৩২ শ্রাবণ (১৭ আগষ্ট) জেএমবির সদস্যরা সারা দেশে ৪৫০টি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। এই মাসেই মহাপ্রয়াণে চলে গিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি সাধক কাজী নজরুল ইসলাম। ২১ শ্রাবণ, আগষ্ট মাসের ৬ তারিখেই জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চালিয়েছিল সভ্যতার বর্বরতম পারমাণবিক বোমা হামলা।
প্রতি আগষ্ট মাসেই বঙ্গবন্ধুর ওপর স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ২০০৯ সালে স্মারক বক্তা ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ব্যারিষ্টার সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, ২০১১ সালে  স্মারক বক্তা ছিলেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংভাবে হত্যার পর তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। বাঙালি জাতি বিশ্বাস করে, বঙ্গন্ধুর নাম কখনই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। কারণ, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটেছে তার জন্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশের ৪৫ বছরের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির পরিবর্তিত ধারার উন্নয়নের পথে সবচেয়ে মারাত্মক বাধা দুর্নীতি। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, ব্যবসায়িক দুর্নীতি, ঠিকাদারির দুর্নীতি সর্বোপরি মিথ্যা বলা ও মিথ্যাচার - সবই আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। দুর্র্নীতি দমন কমিশন তার বিশ্বাসযোগ্যতা আজও জাতির কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম বছরটি বাদ দিলে গত ৪৫ বছর সরকারগুলো আয়-বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখে চলেছে নিরন্তর। তাই, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য পর্বতপ্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকই তথ্য দিচ্ছে, বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ২৩ হাজার ২২৫ জনের উপরে। কালো টাকা, চোরাকারবারির টাকা, ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদের টাকা নিশ্চয়ই ওই হিসেবে আসেনি। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশের ১৬ লাখেরও কম মানুষ দেশের স্বাধীনতা-উত্তর ৪৫ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফসলটা কুক্ষিগত করে নিয়েছে।
দেশের ৯৯ শতাংশ জনগণ এই লুন্ঠনমূলক অর্থনীতির ন্যায্য সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে গেছে। কোনো নির্বাচনেই পরাজিত দল নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেয়নি গত ২৫ বছরে এবং নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর থেকে আবারো ক্ষমতাসীন হওয়া পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনের নামে সরকারের বিরুদ্ধে সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াটাই এদেশের রাজনীতিকদের সংস্কৃতি হিসেবে চালু হয়ে যাচ্ছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে উৎপাটন করেছে ১৯৭৫-১৯৯০ পর্বে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাইকারী সামরিক জান্তা। পাকিস্তানী ধারায় সেনা ছাউনির রাজনীতি উৎপাটিত করার চেষ্টা করেছে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে, জন্ম দেয়া হয়েছে মানচিত্র-ভিত্তিক, বিভেদকামী তথাকথিত ধর্মীয় জাতীয়তাবোধের কৃত্রিম ধারণা। সকল ধর্মের সম-মর্যাদা প্রদানকারী ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার প্রদানকারী সমাজতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ শব্দগুচ্ছের আড়ালে নির্বাসনে পাঠিয়ে পরনির্ভরশীল মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের দর্শন ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিকে’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে লালন করা হচ্ছে গত ৪১ বছর ধরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং বাঙালিত্ব। তাই রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে জনগণের মালিকানাধীন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা, যে রাষ্ট্র শোষিত-বঞ্চিত শ্রমজীবী জনগণের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সুকঠিন সংগ্রামে শ্রমজীবী জনগণের পক্ষের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, যে রাষ্ট্র সমাজ পরিবর্তনকে তার মূল ব্রত হিসেবে বিবেচনা করবে। কিন্তু সামরিক স্বৈরশাসকগণের চক্রান্তে তা হয়নি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কয়েকটি ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে সামরিকজান্তাদের অবৈধ ও অ-সাংবিধানিক কাটা-ছেঁড়ার পর্ব পেরিয়ে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বিধৃত রাষ্ট্রীয় চার মৌল নীতি সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু, ২০১১ সালে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হলো, তাতে রাজনীতির সাম্প্রতিক বাস্তবতা তুলে ধরা হলেও সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এ দুটো নীতিকেই বহাল রাখা হয়েছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ, সন্ত্রাস এবং স্বরচিত তথাকথিত ইসলাম নিয়ে চলছে ক্ষমতাসীন হওয়ার তান্ডব। মোহাম্মদি ইসলাম ধারণকারীরা এই তান্ডবের মধ্যে পড়ে বাকরুদ্ধ!
ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, দিনে দিনে প্রমাণিত হচ্ছে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে পারেননি এবং প্রমাণের উপাত্তসমূহ উঠে আসছে তার জবরদখলকৃত পুরো শাসনামল হতে! সুপরিকল্পিতভাবে তিনি এবং তার সৃষ্ট রাজনীতিকরা একে একে জনগণের মানসপট থেকে মুছে দিতে চেয়েছেন ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি আদর্শ, অর্জন ও গৌরবগাঁথা। তার এই দেশোদ্রোহীতামূলক পাকি সত্তার সবচেয়ে প্রমাণটি উদ্ঘাটিত হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের নারকীয় হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাটি সম্পর্কে তার আগাগোড়া অবহিত থাকা। অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় তার সম্মতি প্রদানের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে মূল ঘাতকদের জবানীতে জানাজানি হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, ওই ঐক্যবদ্ধ জাতিকে জিয়াউর রহমানই ধর্মীয় আবরণে আবার বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির কানাগলি দিয়ে প্রবিষ্ট করে গেছেন সুপরিকল্পিতভাবে যার কুফল আজও জাতি বহন করে চলেছে।

দেশের অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী বর্তমান সরকারের সাফল্যের পাল্লা ভারী।  বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশ, এর চলার পথে কোনরকম অসহযোগিতা করে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হলে তা বাঙালি জাতি প্রতিহত করার জন্য এখন দৃঢ়প্রত্যয়ী। 

সময়ের সাফ কথা.... অস্থিরতার মাঝে তারুণ্যের নিয়ন্ত্রণ !

সময়ের সাফ কথা....

অস্থিরতার মাঝে তারুণ্যের নিয়ন্ত্রণ !

সংলাপ ॥ অস্থিরতা আর তার সাথে আছে অসহিষ্ণুতা। চারপাশে তাকালে মনে হয়, মানুষের মধ্যে ধৈর্য-সহ্য সহানুভূতির মতো গুণগুলো যেন প্রায় হারিয়েই গেছে। সবসময় একটা উগ্রতা, একটা লড়াই-লড়াইভাব সবার মধ্যে। রাজনীতিকরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। অন্যের ভালো দেখলে যেন তাদের বুক জ্বলে যাচ্ছে। সে জ্বালা মেটাতেই সংশ্লি­ষ্টের সর্বনাশের চিন্তা চড়বড় করে উঠছে তাদের মাথায়! আর তার পরিণতিতেই ঘটে যাচ্ছে অপ্রীতিকর মর্মান্তিক ভয়াবহ সব ঘটনা। যে সহনশীলতা, কোমলতা, মায়া-মমতা দেশে এবং দেশের বাইরে বাঙালিকে একটা আলাদা সুনাম ও স্বাতন্ত্র্য দিয়েছিল তা আজ কোথায়? আজকের বাঙালির চেহারায়, চরিত্রে, সাজ-পোষাকে, কথায়, হাবেভাবে তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে? সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেও কেমন যেন পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। বদমেজাজ, বেহিসেবীপনা খরচ আর স্বার্থপূরণের উচ্চাশা ঘরসংসার, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব যেন বাড়িয়েই চলেছে। সেই গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো জেগেছে ফেসবুক, ট্যুইটার হোয়াটস আপের মতো হাজারো সামাজিক মাধ্যম! পাশাপাশি বসে ভাবের আদান-প্রদান এবং  কথা বলার অভ্যাসটাই নষ্ট করে দিচ্ছে এইসব যান্ত্রিক ব্যাপার-স্যাপার। এর সঙ্গে অতি প্রগতিশীল বিত্তবাদী হওয়ার ঝোঁক নারী-পুরুষের স্বাভাবিক ও দায়কে অস্বীকার করার প্রবণতা আরও গুলিয়ে তুলছে গোটা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই। সব মিলিয়ে হয়তো আমাদের চিরাচরিত সম্পর্কের বাঁধনগুলোই আলগা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে মানুষের কাছে। নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ, নিজের ইচ্ছে, নিজের সুবিধেটাই বড় হয়ে উঠছে। বাবা-মা ভাই-বোন, স্ত্রী-স্বামীর মধ্যে সমাজ ছাড়িয়ে যে স্নেহ মায়া-মমতার বাঁধনটা ছিল এতদিন, তা শিথিল হয়ে পড়ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসার সম্পর্কগুলো বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। বাবা মায়ের মহিমা, সন্তানের ঐশ্বর্য, শিক্ষকের মান, গুণীর কদর, সহকর্মী, আত্মীয়-প্রিয়জনের গুরুত্ব কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করছি না আমরা। আর তার পরিণতিতে কোথাও অপ্রীতিকর, মর্মান্তিক কিছু একটা ঘটলে খানিক সন্দেহ, সমালোচনা আর পুলিশের ওপর দোষারোপ করে দায় সারছি। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। স্বাভাবিক স্নেহপ্রবণ বাবা-মা আছেন, দায়িত্বশীল ছেলেমেয়েরা আছে, সহৃদয় সজ্জন মানুষজনেরও অভাব নেই। কিন্তু, সেই ব্যতিক্রমের পর্দা দিয়ে আমাদের আজকের ক্রমবর্ধমান উদভ্রান্তি-অস্থিরতা আর অসহিষ্ণুতাকে আর আড়াল করা যাচ্ছে কী? আমাদের স্নেহ-ভালবাসার সম্পর্কগুলোর স্বাভাবিকতা যথাযথভাবে বজায় আছে জোর গলায় পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন দাবিও কি করতে পারছি আমরা? নাকি আমাদের সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে দিনের পর দিন সংশয়টাই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে? একটু ভেবে দেখার সময় এসেছে ।
তারুণ্য বড় বেগবান। তারুণ্য বড়ই উদ্দাম। সেই তারুণ্য যখন ভ্রান্ত পথে ছুটে যায় কিংবা সেই তারুণ্যের যখন অপব্যয় হয়ে যায় অথবা সেই তারুণ্য যখন মোমের মতো গলে যায়, তখন তা সত্যিই মর্মযন্ত্রণার শামিল হয়।  পরপর এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে মনে হয় এ কি শুধু তারুণ্যের দোষ? নাকি এই সমাজের কোনও অন্ধকার প্রশ্রয় তাদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর পথে! রাজনীতিকদের কোনও নিয়ন্ত্রণহীনতা বা নজরদারির অভাবই এইসব দুঃখজনক অবস্থার উৎস নয়তো?
সাম্প্রতিক অতীতের পরপর ঘটনাগুলোর দিকে তাকালেই তবে দেখা যাবে, তারুণ্যের ভ্রান্তি কিছু অমূল্য প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। তাৎক্ষণিক অ্যাডভেঞ্চারিজমের নেশা তাদের বিপদ ডেকে আনছে। এইসব ঘটনা অবশ্যই এড়ানো যেত। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকদের  চোখ-কান খোলা থাকেনি। রাজনীতিকরা প্রকারান্তরে এক ধরনের পশ্রয় দিয়েই তাদের এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, যেখান থেকে সন্তান এবং অভিভাবকদের দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মাদকের প্রভাব আর যৌবনের হঠকারিতা তাদের জীবন থেকে সরিয়ে দিচ্ছে অনেক দূরে। শুধু শোক এই বিপথগামিতাকে আটকাতে পারবে না। আমাদের আরও কিছু কর্তব্য, আরও কিছু দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। তারুণ্যের দীপ্তি তাদের সবকিছুকে উপেক্ষা করতে শিখিয়েছে। শুধু দৌঁড়ালেই তো হয় না, থামতে শিখতে হয়। কোথাও কোথাও গতি কমাতে হয়। আমরা আমাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দিতে চাই। আধুনিক জীবন দিতে চাই। ভালোভাবে বেঁচে থাকার আরাম দিতে চাই। কিন্তু কখনও নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিই না। প্রশমণের শিক্ষা দিই না। এটাই আমাদের জীবনের এক বিষাদরেখা।
বিগত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বেপরোয়া জীবন-যাপনের ঝোঁক দিনদিন বাড়ছে। গতির জীবন তাদের টানছে। সেইসঙ্গে মাদক আসক্তি কিংবা মাদক গ্রহণের একটা দুর্নিবার আকর্ষণ তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নিয়ম না মানার প্রতি তীব্র আকর্ষণ। হুল্লোড় জীবনের প্রতি টান। তারুণ্যের গতির শেষ ঠিকানা মৃত্যুই। তারুণ্যের জলতরঙ্গ উন্মার্গগামী।
সেই সঙ্গে বলতে হয়, সাধারণ মানুষের কিছু দায়-দায়িত্ব থেকে যায়। ছোটদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড়রা বহুক্ষেত্রে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এই বিচ্ছিন্নতার অভিশাপ দূর হোক। তারুণ্যের গতি, তারুণ্যের বেগ শুভ কাজে লাগুক। এই বয়সে যেভাবে বিরাট দুঃসাহসেরা উঁকি দেয়, তা তাদের জীবনকে বিপথে না টেনে রঞ্জিত করুক মানবতার পথে এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

সর্বত্রই একটা জাতি। তার মধ্যে ছোট-বড় ভেদের কোনও অর্থ হয় না। মানবজাতির ধর্ম কি? মানবধর্ম। সকলেরই এক ধর্ম মানবধর্ম। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য ইত্যাদি কোন ভেদ এর শাস্ত্রীয় নাম ‘বর্ণ’। ইংরেজ, জার্মান, ফরাসী জাতি এ ঠিক নয়। এসব জাতির ধর্মও আলাদা নয়। মানবজাতির একটাই ধর্ম মানবধর্ম। এ ধর্ম বাদ দিলে সর্বনাশ। আপনি আর মানুষই রইলেন না। একথা যদি বলি শিক্ষা হবে ধর্মহীন, তাহলে বুঝব ঐ শিক্ষায় মানুষ গড়বে না।     ছাত্র-ছাত্রীদের মনুষ্যত্ব হবে না। শিক্ষায় ধর্ম থাকবে না মানে, এ শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হবেন তারা মনুষ্যত্ব লাভ করবেন না। সাবধান হোন! মনুষ্যত্ব লোপ পেয়ে যাবে। স্টেট হবে ধর্মহীন, তার অর্থ হ’ল স্টেট যে হবে অর্থাৎ যারা শাসন করবেন তাদের কোন ধর্ম থাকবে না। মানুষের মনুষ্যত্ব না থাকার ফলে মানুষ চুরি করবে, মিথ্যা কথা বলবে, পরকে হিংসা করবে, পরের ক্ষতি করবে। অতএব তার জন্য তৈরী হউন। মনুষ্যত্ব বাদ দিয়ে কোন প্রতিষ্ঠান তৈরী করাও যা, অ্যাটম বোমা দিয়ে সব শেষ করে দেয়াও তাই। যারা এসব কথা বলেন তারা হয়ত ধর্ম কি তা বোঝেন না। কি করে বোঝাব বলুন তো? বড় বড় লোক বলছে, তাদের কথাই বা অস্বীকার করি কী করে? বাংলা ধর্ম বলতে যা বোঝায় ইংরেজি ‘রিলিজিয়ান’ তা বোঝায় না। শাস্ত্রের ভাষায় কিংবা মহাপুরুষদের ভাষায় মনুষ্যত্বের দু-তিনটি সংজ্ঞা আছে। সবচেয়ে ছোট সংজ্ঞাটি: ‘অহিংসা সত্যমস্তেয়ং শৌচং সংযমমেব চ।/ এতৎ সামাসিকং প্রোক্তং ধর্মস্য পঞ্চ লক্ষণম্।।’ মনুষ্যত্বের পাঁচটি লক্ষণ হলো চুরি না করা, শুচি থাকা, হিংসা না করা, সংযমী হওয়া এবং সত্যাশ্রয়ী হওয়া। অহিংসার ব্যাখ্যা তো গত ৫০ বছর বিরাট ভাবে হয়েছে। অহিংসার মূর্ত আচার্য জীবন দিয়ে অহিংসার ব্যাখ্যা করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর কথা বলছি। অহিংসার অর্থ মানুষকে হিংসা না করা অর্থাৎ মানুষকে ভালবাসা, মানুষকে শ্রদ্ধা করা, মানুষকে মানুষ হিসাবে সম্মান দেয়া এই তো অহিংসা। হিংসা তো পশুর ধর্ম। রাস্তা দিয়ে একটা কুকুর যাচ্ছে, আপনার বাড়ির কুকুরটি তাকে দেখে ঘেউঘেউ করে উঠল, আশ-পাশ থেকে আট-দশটা কুকুর এসে রাস্তার মধ্যে শুরু করে দিল কামড়া-কামড়ি রক্তারক্তি। এ নিছক কুকুরের ধর্ম। আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, পাশের বাড়ির লোক বেরিয়ে এসে আপনাকে মারতে আরম্ভ করল, ক্রমে বহু লোক লোক জমে বিরাট মারামারি হয়ে গেল। এখন যদি বলি, মানুষগুলো কুকুরের ধর্ম ছাড়তে পারেনি তাহলে খুব অন্যায় হবে কি? মানুষ আজ সভ্যতার গর্ব করে। আকাশে উড়ছি, চাঁদে যাচ্ছি, জলের তলায় মাছের রাজ্য দখল করেছি, কিন্তু রাস্তা দিয়ে মানুষের মত হাঁটতে শিখিনি। মানুষকে মানুষের মর্যাদা, প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। 

দেশবাসী কবে - সত্যদ্রষ্টা সাধক নজরুলকে চিনবে!

দেশবাসী কবে -

সত্যদ্রষ্টা সাধক নজরুলকে চিনবে!


সংলাপ ॥ ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক অনাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে এবং প্রেম, সৌন্দর্য মানবতার পক্ষে সাধক কবি নজরুলের সৃজন কর্ম যুগ যুগ ধরে আজ পর্যন্ত প্রতিটি সূফী সাধকের কাছে সাধনায় অনুপ্রেরণার উৎস। তাই তিনি সাধকদের কাছে পুরুষোত্তম।
“মুখোশের যুগ এটা। মুখোশ! হা-হা মুখোশ চতুর্দিকে। শুয়োরের চামড়া ঢাকা, মাথায় মোষের শিং। ভাড়ামির রঙ্গশালায়। প্রগলভ সঙ্গীত, মুখোশের মঞ্চে মঞ্চে। মহাযোগ্যশালা পিচাশের প্রদর্শনী! শশংকিত, সুরক্ষিত দ্বার! টিকেট লাগেনা মুখোশে! মুখ খোলা নিষিদ্ধ এইখানে। খোলা কথা খোলাখুলি বলা অসম্ভব। মুখোশের আভিজাত্য উচ্চমার্গে উচ্চ প্রশংসিত। খোলাখুলি মত বিনিময় অবাঞ্চিত, অবাস্তব মুখোশের দেশে। মুখোশ হা হা মুখোশ চতুর্দিকে! মুখোশের রঙ্গালয়ে যারা আজো পায়নি টিকিট- অনাহূত, উপেক্ষিত, অনিমন্ত্রিত, অনন্তর, অদ্ভূত হস্তপদ- এ নগরী পথ নিষিদ্ধ যাদের কাছে, খোলামুখ, খোলাবুক, খোলামন ভৈরব উল্লাসে, তারা আসে, দলে দলে আসে। কাঁপে উঠে রঙ্গশালা’- ভেঙ্গে পড়ে নিষিদ্ধ তোরণ।”
এখানে প্রথম অংশে সমাজ চিত্র এবং পরে নজরুলের আত্মচিত্র ফুটে উঠেছে। জাহেরী অর্থ তো ব্যাখার অপেক্ষা রাখে না। হাকিকতে মানব দেহ নামক রঙ্গশালায় রব বন্দি এবং নফ্সের তাবেদারী সবাইকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন পুরুষোত্তম নজরুল, যাকে কথা বলতে ও কলম চালাতে ওই মুখোশধারীরা কারাগারে নিয়ে - কাফের ফতোয়া দিয়ে - নাস্তিক বলে বাধা প্রদান করতো। কিন্তু সে মুক্তপুরুষ কি আর কারো বাঁধা-বিঘ্নকে তোয়াক্কা করে নাকি! সে যে মুক্ত-চিরমুক্ত - তাঁকে বন্দিতে আনে কার সাধ্য! আলোকে কি কেউ ইচ্ছামত কোন ঘরে বন্দি করে রাখতে পারে নাকি - নাকি পেরেছে! কোন না কোন রাস্তা দিয়ে সে বাহিরে তথা খোলা জায়গায় মুক্ত আলোর সাথে মিলিত হবেই। বন্ধ ঘরে তথা মানব দেহে যে আলোর অংশ - যা কারামুক্তকামী বা মুক্তির দেশের সন্ধানী তাঁর অর্থাৎ ভগবান বা আল্লাহ্র অবস্থান যে মানব দেহে এবং এখানেই যে ইহার প্রকাশ বা জাহের সম্ভব সে সম্বন্ধে পুরুষোত্তম  বলেছেনঃ
তোমাদেরই বুকে জাগে নিত্য ভগবান
ভয়হীন, দ্বীধাহীন, মৃত্যুহীন তিনি।
তোমারে আধাঁর করিয়া সেই মহাশক্তি প্রকাশিত হন নিত্য,
চাহ আঁখি খুলি, আপনার মাঝে দেখ আপন স্বরূপ।
তোমাদের মাঝে আছে বীর সব্যসাচী।
আমি শুনিয়াছি বন্ধু সে ঐশীবাণী।
উর্ধ্ব হতে রুদ্র মোরে নিত্য কহে হাঁকি।
শোনাতে ঐ কথা, এই তাঁহার আদেশ।
কথিত আছে যে, আল্লাহকে যাহারা দর্শন করিয়াছেন, যুবক রূপেই দর্শন করিয়াছেন। তাই জ্বরা-জীর্ণ দেহে নয় বরং শুদ্ধ মানব দেহে ভগবান বা রবকে খুঁজতে পুরুষোত্তম এখানে ইঙ্গিত করেছেন এবং এই শুদ্ধদেহ বলে যৌবনের অধিকারী যুবককে বুঝাতে চেয়েছেন এবং যৌবনকে তিনি বয়সের ফ্রেমে বাঁধেননি। যার মাঝে প্রাণ-চাঞ্চল্য আছে -- নিজেকে জানার স্পৃহা আছে তাকেই তিনি যৌবনের অধিকারী বলেছেন। তাইতো তিনি যৌবনের গানই গেয়েছেন। এখানে যৌবন বলে এমন একটা শক্তিকে বোঝানো হয়েছে যে শক্তি নিজেকে না জানা পর্যন্ত অদম্য-অপ্রতিরোধ্য। ইহা সালাত ব্যতীত আর কিছু নয়। এ রকম যৌবনের অধিকারী তথা সালাতের মাঝে বা সালাতী সত্ত্বার মাঝেই বিদ্যমান বা জাগ্রত আপনার রব। তাই তিনি যৌবনকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধেননি। অর্থাৎ সালাতী লোকদেরকেই এখানে যুবক বলা হয়েছে যারা ধ্যান করতে জানে এবং তাদের মাঝেই আল্লাহ্ বা রবকে খুঁজে পাওয়া যায়। “যে নিজেকে জানলো সে তার রবকে জানলো” হাদিসটির পূর্ণ সমর্থন এখানে নজরুল সাহিত্যেও পাওয়া যায়। যুবকদের প্রতি ইঙ্গিত করে এখানে সালাতী সত্তাকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে এবং তাদের মাঝে “বীর সব্যসাচী” আছে বলে জুলফেকারকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ সব্যসাচী অর্থাৎ দু-ধারী তলোয়ার- ইহা জুলফেকার ব্যতীত কিছুই নয়।
যিনি সর্বশক্তিমান তাঁহার কাছে নজরুল-শুদ্ধ- জ্ঞান কামনা করেন যার দ্বারা ধরার ধূলিতে পুণ্য, প্রেম, ভক্তি মঙ্গল ও কল্যাণে গান তিনি গাইতে পারেন এবং সেই শুদ্ধ জ্ঞানের মাধ্যমেই নজরুল যে আত্মশক্তি অর্জন করেছিলেন তার বলেই গেয়ে উঠেনঃ
বিধি নিষেধের উর্ধ্বে স্থির,
রহি যেন চির উন্নত শির।
যাহা চাই-যেন জয় করে পাই।
গ্রহণ না করি যেন দান।
এতবড় কথা কেবল তাঁরাই বলতে পারে যাঁরা সেই শক্তির সন্ধান পেয়েছেন। এটা অহংকারের মত শুনালেও এটা অহংকার নয়। এটা পরমাত্মার জ্ঞান-আত্মোপলব্ধি-রবের জাগরণ-রবের জগৎ তথা আলোর বা নূরী জগতে অবগাহন করেই একথা বলেছেন পুরুষোত্তম নজরুল। যেমন মনসুর বলেছিলেন - ‘আনাল হক’। মন-মগজ চোখ ও কানে পর্দা বা পীড়া রেখে খোঁজাখুজি করলে এ দর্শনের সন্ধান মিলবে না। তাঁর ভক্তিগীতি, লোকগীতি, কাব্যগীতি, ইসলামী গান ইত্যাদিতে প্রচুর জ্ঞানের খোরাক বিদ্যমান। ‘বিদ্রোহী’ হয়ে এই বিদ্রোহীকে বা ‘কাফের’ হয়ে এই কাফেরকে বা ‘পাগল’ হয়ে এই পাগলের সন্ধান করতে হবে তাঁর  মাঝে। তবেই সম্যক স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যাবে এই কালোত্তীর্ণ পুরুষোত্তম নজরুলের এবং পাওয়া যাবে তাঁর দর্শনের দেশনা।
পুরুষোত্তম তাঁর নিজের সম্বন্ধে নিজে কি বলেছেন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে:
“আপনারা জেনে রাখুন- আল্লাহ্ ছাড়া আর কিছুর কামনা আমার নাই। আমার সব প্রার্থনা, নামাজ-রোজা, তপস্যা, জীবন-মরণ সবকিছু বিশ্বের একমাত্র পরম প্রভু আল্লাহ্র পবিত্র নামে নিবেদিত। আল্লাহে পূর্ণ আত্মসমর্পণ যার হয়েছে তিনি এই মুহূর্তে এই দুনিয়াকে ফেরদৌসে পরিণত করতে পারেন। আমার মন্ত্র “ইয়াকানা বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন”। অসুন্দরের সাধনা আমার নয়। আমার আল্লাহ্ পরম সুন্দর। তিনি আমার কাছে নিত্য প্রিয় ঘন সুন্দর, প্রেমঘন সুন্দর, রস-ঘন সুন্দর, আনন্দঘন সুন্দর। কুরআনের সূরা নূরের ভিতরে উল্লেখিত জয়তুন ও রসগুনের যেসব কথা রয়েছে, তার অর্থ অনুধাবন করার জন্য আমি সকলকে অনুরোধ জানাচ্ছি। দুঃখ সয়েছি, আঘাতকে আমি হাসিমুখে বরণ করেছি কিন্তু আত্মার অবমাননা কখনো করিনি। নিজের স্বাধীনতাকে (আজাদ) কখনো বিসর্জন দিইনি।”
“বলবীর, চির উন্নত মম শির”- এ গান আমি আমার এ শিক্ষার অনুভূতি হতেই পেয়েছি। আমার ‘বিদ্রোহী’ পড়ে যারা আমার উপর বিদ্রোহী হয়ে উঠেন, তারা যে হাফেজ-রুমীকে শ্রদ্ধা করেন - এও আমার মনে হয় না। আমিতো আমার চেয়েও বিদ্রোহী মনে করি তাঁদের। আবার বলি, যারা মনে করেন- আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তার সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি, তারা অনর্থক এ ভুল করেন। ইসলামের নামে যে সব কুসংস্কার, মিথ্যা আবর্জনা স্তুপীকৃত হয়ে উঠেছে- তাকে ইসলাম বলে না মানা কি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান? এ ভুল যারা করেন, তারা যেন আমার লেখাগুলি মন দিয়ে পড়েন দয়া করে। এ ছাড়া আমার আর কি বা বলবার থাকতে পারে? কেউ বলে আমার বাণী যবন, কেউ বলে ‘কাফের’, আমি বলি, এ দুটোর কোনটাই নই। বিদ্রোহ মানে কাউকে না মানা নয়, বিদ্রোহ মানে ‘যেটা বুঝিনা সেটা মাথা উঁচু করে ‘বুঝিনা’ বলা।’ আর বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, ‘আমি আপনাকে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ?”
“আমি সত্য, হাতে ন্যায় দন্ড।” আমার পক্ষে সকল রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অনন্ত কাল ধরে সত্য জাগ্রত ভগবান। আমার পক্ষে আদি অন্তহীন অনন্ত স্রষ্টা। রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনে রুদ্র। রাজার বাণী বুদবুদ, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র। আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। আমি ভগবাণের হাতের বীণা। সে যাহার সৃষ্টি তাঁহাকেই সে বন্দী করতে চায়, শাস্তি দিতে চায়। আমি সত্য প্রকাশের যন্ত্র। আমার হাতের বাঁশী কেড়ে বাঁশীর সুরের মৃত্যু হবে না; কেননা আমি আর এক বাঁশী নিয়ে বা তৈরি করে তাতে সেই সুর ফোটাতে পারি। সুর আমার বাঁশীতে নয়- আমার মনে ও বাঁশী সৃষ্টির কৌশলে। অতএব দোষ বাঁশীরও নয় - সুরেরও নয়, দোষ আমার, যে বাজায়, তেমনি যে বাণী আমার কণ্ঠ দিয়ে নির্গত হয়েছে তার জন্য দায়ী আমি নই। দোষ আমারও নয়-বীণারও নয়, দোষ- তাঁর যিনি আমার কণ্ঠে বীণা বাজান। সুতরাং রাজবিদ্রোহী আমি নই। প্রধান রাজবিদ্রোহী সেই বীণাবাদক ভগবান। রাজার অনুবাদক রাজসভায় সে বাণীর শুধু ভাষাকে অনুবাদ করেছে, তাঁর প্রাণকে অনুবাদ করেনি, তাঁর সত্যকে অনুবাদ করেনি, করতে পারেনি। আমি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি। আমি জানি এবং দেখেছি, আসামী কাঠগড়ায় আমি একা দাঁড়িয়ে নই, আমার পশ্চাতে স্বয়ং সত্য-সুন্দর ভগবানও দাঁড়িয়ে। আমার আত্মা সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা। আমি অজানা অসীম পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। এ আমার অহংকার নয় - আত্মোপলব্ধি, আত্মবিশ্বাসের চেতনালব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি। আমি সত্য রক্ষার ন্যায় উদ্ধারের বিশ্ব প্রলয় বাহিনীর লাল সৈনিক। মহারুদ্রের তীব্র আহ্বান নিদ্রিত ভূমে আমায় তিনি পাঠিয়েছিলেন অগ্রদূত তুর্যবাদক করে। অমৃতের পুত্র আমি। চিরশিশু প্রাণের উচ্ছল আনন্দের পরশমণি দিয়ে নির্যাতিত লোহাকে মনিকাঞ্চনে পরিণত করার শক্তি ভগবান আমায় না চাইতেই দিয়েছেন। আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই কেননা ভগবান আমার সাথে আছেন। আমি জানি আমাকে পরিপূর্ণরূপে আজো দিতে পারিনি, আমার দেয়ার ক্ষুধা আজো মেটেনি। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরি অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের একজন আমি। এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। কোন অনাসৃষ্টি করতে আমি আসিনি। আমি যেখানে ঘা দিয়েছি, সেখানে ঘা খাবার প্রয়োজন অনেক আগে থেকেই তৈরি ছিল।”
পুরুষোত্তম নজরুলের এতসব উক্তি কি কোনদিনও কেউ বিচার করে দেখবে না? অবশ্যই দেখবে। যারা দেখার তারা ঠিকই দেখবে। কিন্তু যাদের মগজে-কানে-চোখে পীড়া/পর্দা তারা যখন নজরুলকে নিয়ে হৈ-চৈ করে তখন যেমনি হাসি পায়- তেমনি দুঃখও লাগে। অনেক লেখক নজরুলকে স্ববিরোধী হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন তাদের বিশ্লেষণে এবং ‘বিদ্রোহীতে’ নাকি স্ববিরোধী উক্তি বিদ্যমান তাদের ভাষায়। এ রকম আরো বই বাজারে দেখা যায়, যার মাঝে ‘নজরুলকে স্রষ্টা বিরোধী ও অনুসরণকারী হিসাবে অংকিত করা হয়েছে’ আবার বলা হয়েছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছেন। আসলে তাদের বিশ্লেষণগুলো স্ব-বিরোধীতায় ভরপুর। মন-মগজে পর্দা নিয়ে পুরুষোত্তম নজরুলের স্বরূপ বুঝা এবং তাঁর দর্শনের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। অতএব নজরুলকে নিয়ে এরা নাড়াচাড়া করলে সম্মানের চেয়ে অসম্মানই হবে বেশি।
যেমনটি হচ্ছে প্রচলিত ভন্ড মোল্লাদের দ্বারা ইসলাম ও মহানবীর অমর্যাদা, যারা মহানবীকে তাদের বড় ভাই বানাতে সদা উদ্যত (নাউযুবিল্লাহ)। বহুল প্রচলিত আযানের দোয়ার মাধ্যমে মহানবীকে কতটুকু সম্মান করা হয় সেটা ভেবে দেখার বিষয় নয় কি? এজিদ পন্থী মোল্লা, মৌ-লভীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। ঠিক তেমনি আমাদের দেশের বিদ্যার জাহাজ ও দিকপালদিগকে আগে চিন্তা করতে হবে নজরুলকে তারা কি মনে করেন। এটা তাদের পান্ডিত্য বিস্তারের ক্ষেত্র নয়। পান্ডিত্য দিয়ে নজরুলের স্বরূপ বোঝা বা বুঝতে যাওয়া এক ধরনের মূর্খ বিলাসিতা। নজরুলের লেখা বা বাণীর উপর হাত দিতে গিয়ে প্রথমেই মনে করতে হবে যে, একজন মহাপুঁরুষ, আলোক শিশু, কালোত্তীর্ণ পুঁরুষ, নূরী বীর্যের ধারক-বাহক একজন মুক্ত পুঁরুষের বাণীর উপর হাত দিতে যাচ্ছি। এতটুকু মনে করতে না পারলে সেখানে নজরুল কবিতার ব্যাখ্যা হবে না। এতে করে মহাপুঁরুষের স্বরূপটি হয়ে উঠবে বিতর্কিত। এমতাবস্থায় যারা নজরুলকে ভালবাসেন তাদের নীরবে ভালবাসাই সমীচীন-সরব বা কলমে নয়। এই শুদ্ধ ও সিদ্ধ-পুঁরুষের ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতাটি ব্যাখ্যা করার মত কাউকে আমি জানিনা বা চিনিনা। হয়তো থাকতে পারে আমার পরিচয় নেই। দিকপাল বিদ্যার জাহাজদের কাছে অনুরোধ নিজেদের পান্ডিত্য বিস্তারের ক্ষেত্র হিসেবে পুরুষোত্তম নজরুল ও তাঁর দর্শনের সাহিত্য দয়া করে বেচে দিবেন না। এতে সম্মান দিতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। একজন নজরুল প্রেমিক হিসেবেই আমার অনুভূতিটুকু প্রকাশ করলাম মাত্র। কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। অবশ্যই নজরুল ও তাঁর সাহিত্যের উপর সবারই সমান অধিকার আছে। পাশাপাশি মহাপুঁরুষের ভাবমূর্তি ও তাঁর  দর্শনকে বিতর্কিত করার অধিকারতো আপনার আমার কারো নেই। এতটুকু মনে রাখলেই তাঁর সঠিক স্বরূপ অনুধাবন করে তাঁর দর্শন থেকে আমরা সবাই উপকৃত হতে পারবো সমষ্টিগতভাবে। ব্যক্তিগতভাবে তো যার যা পাওয়ার তা পেয়েছি এবং তা পেয়েই চলেছি। এবার দেখা যাক পুরুষোত্তমের আপন ভাষায় কি পরিচয় আমাদের দিচ্ছেনঃ
“আমার আল্লাহ্ পরম সুন্দর। আপনাদের আহ্বানে যখন কর্ম জগতের ভীড়ে নেমে আসি, তখন আমার পরম সুন্দরের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হই, আমার অন্তরে বাহিরে দুলে উঠে অসীম রোদন। সুন্দরের ধ্যান ও তাঁর স্তবই আমার ধর্ম। আমি তাঁর বিরহ এক মুহূর্তের জন্যও সইতে পারি না। আমার সর্ব অস্তিত্ব, জীবন-মরণ কর্ম, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ যে তাঁরই নামে শপথ করে তাঁকে নিবেদন করেছি। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, আমার ক্ষমা-সুন্দর প্রিয়তম আমার আমিত্বকে গ্রহণ করেছেন। যদি আর বাঁশি না বাজে আমায় ক্ষমা করবেন- আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। অসুন্দরকে ক্ষমা করতে - অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম - আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম- প্রেম পেতে এসেছিলাম সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতায় বেদনায় তাঁরই নির্গত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল। আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান-বেদনার গান গেয়ে যাব আমি, দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা। রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায় বলতেন, ‘দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটস্-এর মত খুব বড় একটা ট্রাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ!’ জীবনে সেই ট্রাজেডী দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারণে অন্যের জীবনে অশ্রূর বর্ষায় আছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমারই জীবনে রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত মেঘের উর্ধ্বে শূন্যের মত। কেবল হাসি! কেবল গান! কেবল বিদ্রোহ!
আমার বেশ মনে পড়ছে, একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা! আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়েছে-ঠিক সেই দিনই, সেই সময়ে আমার বাড়িতে হাস্না হেনা ফুঠেছে আমি প্রাণ ভরে সেই হাস্না-হেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম।
আমার কাব্য-আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে সৃষ্টি হয়েছে। যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা-কত কবিতা বেরুবে হয়তো আমার নামে। দেশ-প্রেমিক, বীর বিদ্রোহী-বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে। বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে, বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের একটি কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি।’
“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু
আর আমি জাগিব না-
কোলাহল করি সারা দিন মান
কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না।
নিশ্চল, নিশ্চুপ-

আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ!” 

চেতনায় নজরুল


চেতনায় নজরুল

সংলাপ ॥ ‘যারা আমার নামে অভিযোগ করেন তাদের মতো হলুম না বলে - তাদের অনুরোধ, আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে, গানের কবিকে তারা যেন সকলের করে দেখেন, আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের-সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব, আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ [১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর জবাবে, প্রতিভা ভাষণ] অথবা- ‘এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব গন্ডি কাটাইয়া সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’ [নবযুগ প্রবন্ধ]
কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীর রুলে অসংখ্য বৈশিষ্ট্য দীপ্যমান। তার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্যে নজরুল একক, অদ্বিতীয় ও তুলনা রহিত। যেটিকে কেউ পারেনি ছুঁতে। নজরুল আজও সে বৈশিষ্ট্যে অন্য অনেককে রেখেছেন দৌঁড়ের ওপর। বাংলার প্রধান দুই সমাজ হিন্দু-মুসলমান উভয়ের সংস্কৃতির পুরাণ ও ইতিহাসকে বেণীবদ্ধ করে কাব্যে রূপদান করেছেন। -
এই দু’টি সমাজের ওপর ভর রেখে নজরুল এমন এক সাহিত্য সৃষ্টি করলেন যা গোটা বাংলা সাহিত্যে একক ও অদ্বিতীয়। এ ক্ষেত্রে তিনি অন্যদের পেছনে ফেলে বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সত্যিকার শিল্পিত তীর্থ গড়ে দিয়েছেন। এ ধারায় দু’ধারি তলোয়ার ব্যবহার করেছিলেন নজরুল, যেখানে তার সমকক্ষ কেউ নেই। এখানে তার আগেও নাই কেউ, পরেও না। সেই পরিচয় নজরুল দিচ্ছেন। যে পরিচয়ে তিনি ব্যবহার করলেন হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত পুরাণ আর ইতিহাস। ‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্য করতলে/তাজি বোররাক আর উচ্চৈঃস্রবা বাহন আমার হিম্মত হ্রেষা হেঁকে চলে/’সত্যিই নজরুল হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই সতর্ক করে হাঁকছেন ‘ঘর সামলে নে এই বেলা তোরা ওরে ও হিন্দু-মুসলেমিন/আল্লাহ্ ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযোগ পালালে মেলা কঠিন/ধর্ম কলহ রাখ দু’দিন।’ পরধর্ম অসহিষ্ণুতার জন্য নজরুল আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে বিশ্বস্ত হয়ে আছেন। যে বিশ্বস্ততার বহুতল ভবন থেকে দাঁড়িয়ে তিনি তীব্র শ্লেষের মিশ্রণে বলতে পারেন- ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছো জুয়া/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে/ জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।’ প্রশ্ন করে সাথে সাথে সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারা এ তো কেবল এ স্বভাবজাত কবির পক্ষেই সম্ভব। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, জাত-পাতের মিথ্যে অহঙ্কার, হিন্দু-মুসলমানের বিদ্বেষ শেষ করার জন্য একটা সমাধান তিনি করতে চেয়েছেন। তাই প্রশ্নের উত্তরে এই ছোঁয়া-ছুঁয়ির প্রশ্নে তিনি হলেন আরো বেশি কঠোর   ও আপসহীন। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের কুটিরে কুঠারের আঘাত হেনে তছনছ করছেন এভাবে ‘হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,/ তাই তো বেকুব করলি তোরা এক জাতিকে একশ’ খান।’ তখন সাম্প্রদায়িকতা এত বেশি চেপে বসেছিল যে, যেখানে একজন হিন্দু, একজন মুসলমানের এক গ্লাস পানিতে ঠোঁট বসালেই যেন জাত চলে গেল। এখান থেকে বাঁচাতে সেই গ্লাসে একটি পাইপলাইনের সাহায্যে পানিটুকু পান করাতে নজরুলই এগিয়ে এসেছিলেন। ‘যে জাত ধর্ম ঠুনকো তত/আজ নয় কাল ভাঙবে সেত,/যাকনা সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া।’ এখানে কারো রক্তচুকে পরোয়াই করেননি তিনি। তার এই  স্ব-সৃষ্ট পথে তিনি একাকী হেঁটে গেছেন বহু দূর; যেখানে যদিও ছিল ভয়ানক আঁচড়ের ভয়, হিংস্রতার ভয়। এ ক্ষেত্রে তিনি অপেক্ষাও করেননি কারুর জন্য। দেশ ও দশের মঙ্গলের প্রদীপ তো তখন তারই হাতে। নজরুলের উচ্চকিত কণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে সেই ঘোষণা ‘যে যায় যাক সে। আমি আছি। আমি নতুন করে জগৎ সৃষ্টি করব। নতুন আলোর প্রাণস্পন্দনে সৃষ্টির আঙিনা তুলব ভরে।’ নজরুলের সেই নতুন জগৎটিই তো হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার চিত্তবৃত্তি।
তার এমন সব বলিষ্ঠ উক্তির পেছনে যে যুক্তি কাজ করেছে তা হলো  তার উদার, মুক্ত, স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন, কল্যাণী ও পবিত্র দৃষ্টি। যে দৃষ্টি সৃষ্টিকর্তা তার আপন মহিমায় ধারণ করে আছেন। বাংলা সাহিত্যের এই শ্রেষ্ঠ পুরুষ একমাত্র, শুধুমাত্র, কেবলমাত্র একটি জাতির একটি গোষ্ঠীর হয়ে যাবেন তা কেমন করে হয়! তাই তিনি হলেন না কোনো জাত-পাতের। তার বলার ঢংই যেন আলাদা ‘সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এ বিশ্বমায়ের বিশ্বঘর, /মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্মপর।’ আমাদের এই আত্মপরের ঘরে সুচ বিদ্ধ করেছেন কবি এভাবে  ‘বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত/কোন ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ/ নারায়ণের জাত যদি নাই/তোদের কেন জাতের বালাই’ এই বালাইয়ের দাওয়াই দিতে গিয়ে নজরুল যেন মিলে যান তুর্কি কবি আমির খসরুর সাথে। সেই মিলটা কাকতালীয় বা দৈবাৎই যেন। দু’জনই জাতের রোগের বিশেষজ্ঞ হয়ে চমৎকার ট্রিটমেন্ট করেছেন। তুর্কি কবি যেমন বলেন  ‘হিন্দু বাচ্চে বা বনিগর আজব দুসন ধরতো হ্যায়/দর আকতে সুমন গুফতন মুহজফুল করতো হ্যায়/গুফতম বিয়াকে বর লবেতু বুসে বগারম’-একটা হিন্দু ছেলেকে দেখো, কী আশ্চর্য সৌন্দর্যের অধিকারী। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে যেন ফুল ঝরে পড়ে। তাকে বললাম, কাছে এসো, তোমার ঠোঁটে চুমু খাব।
সে বলল, আরে রাম, তাহলে আমার ধর্ম নষ্ট হবে। এই ধর্ম থেকে জাত নামের বজ্জাত শব্দগুলো তুলে দিয়ে, মনুষ্যত্বের ওপর পশুত্বের দখলদারিত্বে ধিক্কার জানিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ঘটাচ্ছেন নজরুলও এভাবে  ‘মানুষ আজ পশুতে পরিচিত হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ল্যাজ গজিয়েছে ওদের মাথার ওপর, ওদের সারা মুখে। ওরা মারছে লুঙ্গিকে, মারছে নেঙটিকে। মারছে টিকিকে, মারছি দাড়িকে। বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মূর্খদের মারামারির কি অবসান নেই।’ অবসান হোক আর না হোক, নজরুল তার বলা থেকে কখনও অবসর নেননি। যে নজরুল ভাবগত আদর্শে দংশিত, মানবিক মূল্যবোধের জন্য মূল্যবান, ঐক্যের ঔদার্যে উদার, তিনিই তো ধর্মীয় বিবেকহীনতা ও হিন্দু-মুসলমানের এক কাতারে কাতারবদ্ধ হতে খোলাখুলি মত প্রকাশ করবেন।
দেখিলাম, ‘হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিলো না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদি চির কলঙ্কিত হইয়া রহিল।’
হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় গোঁড়ামিকে তীব্রভাবে কশাঘাতে জর্জরিত করার শক্তি নজরুল লাভ করেছিলেন মানুষের প্রতি স্বাভাবিক মমত্ব ও ধর্মীয় বহিরাবরণের অন্তঃসারশূন্যতা থেকে। এই শক্তিই তাকে জাতির মুক্তির পথে ধাবমান করেছিল। এখান থেকেই সাহস ও প্রেরণা নিয়ে সাম্যবাদের গান গাইলেন ‘মানুষেরে ঘৃণা করি/ও কা’রা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি/ ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে/ যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো/মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!’ মানব জীবনের মানুষের এক বৃত্তির প্রতিনিধিই যেন নজরুল। মানুষে মানুষে ভেদ নেই বলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই একটা বিশিষ্ট দিকের তুলনারহিত টাইপ বা প্রতিনিধি তিনি।
হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির ঐতিহ্য থেকে রূপক হিসেবে উদাহরণ গ্রহণ করার ফলে তিনি নিজেই একজন উদাহরণ। উভয়ের কাছে আজও তিনি প্রিয় প্রাঙ্গণ। এ ক্ষেত্রে অন্নদাশঙ্কর রায়ের মন্তব্যের সত্যতা স্বীকার্য। তিনি লিখেছিলেন- ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নি কো নজরুল।’ অন্য দিকে রবি ঠাকুরের একান্ত সচিব নজরুলকে একান্ত থাকতে দিলেন না। ১৩২৭ সালে মোসলেম-ভারত পত্রিকায় সেই সুধাকান্ত রায় চৌধুরী দু’টি কবিতা লিখেছিলেন। একটি মহাত্মা গান্ধীকে অন্যটি নজরুলকে নিয়ে।- ‘ছন্দে গানে বাজাও কবি বাজাও প্রাণের গান/মুগ্ধ করো বিশ্বজনে দাও গো নূতন প্রাণ।’ নজরুল কথা রেখেছেন। নূতন প্রাণও দিয়েছেন। গানের গানও গেয়েছেন। যে গানে ছিল কয়েক টন স্বর্ণ। যে প্রাণে ছিল লক্ষ কোটি প্রাণ। তাই বলে নজরুল নিজের ধর্ম ত্যাগ করেননি। অন্যের ধর্মকেও দেখেছেন উদারচিত্তে। হিন্দু পুরাণের গভীরে নিমগ্ন হওয়ার কারণও কিন্তু এটি। গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেল, জেন্দাবেস্তা, গ্রন্থসাহেব এবং মার্কস বাকুনিন বা রাসেল পড়ার পরও নজরুল লিখতে পেরেছিলেন, ‘শহীদী ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারি/হবে দুনিয়াতে আবার ইসলামি ফরমান জারি।’ অথবা, ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য তার নিজস্ব বক্তব্য- ‘ঐ ইসলাম ডুবে যায়।/ যত শয়তান/ সারা ময়দান/ জুড়ি খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়গান শোন গায়/ আজ শখ করে/জুতি টক্করে/তোড়ে শহীদের খুলি দুশমন পায় পায় -/ওরে আয়!/তোর জান যায় যাক পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায়।/ধর ঝঞ্ঝার ঝুঁটি দাপটিয়ে শুধু মুসলিম পাঞ্জায়।’ এসব চিন্তা কিন্তু ধর্ম ও দর্শনের ঊর্ধ্বে ইসলামকে স্থান না দিলে এমন কথা লেখা যেতো না। ইসলামই যে সমস্ত সৌন্দর্যের আকর। ইসলামের শিক্ষা তো এটি যে মায়ের পেটে যেমন তার কচি সন্তানটি সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ও নির্ভয়ের, তেমনি ভিন ধর্মের লোকেরাও ইসলামের অনুসারীদের কাছে তদ্রুপ নিরাপদ। তারপরও এখানে প্রশ্ন তোলা সম্ভব, তাহলে তিনি কেন বললেন, ‘আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। এই প্রশ্নের জবাব তার পূর্বোক্ত অভিভাষণ থেকে নেয়া যায়। তার উপলব্ধি সুন্দরের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন- ‘আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি। তার চোখে চোখভরা জলও দেখেছি।
শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাকে ক্ষুধাদীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি। ফাঁসির মঞ্চেও তাকে দেখেছি। আমার গান সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ করে দেখার স্তব- স্তুতি।’ এই ‘সুন্দর’ কিন্তু ইসলামের ভাবাদর্শ বা চিন্তাদর্শ থেকে দূরে ঠেলে দেয়ার পথ খোলা নেই। মোতাহার হোসেনকেও একই বক্তব্য প্রদান করেছেন চিঠির মাধ্যমে। ‘প্রিয় মোতাহার! আমার কেবলই মনে পড়ছে [বোধ হয় ব্রাউনিং] এর একটি লাইন- How sad and bad, and mad it was But than, was it was sweet!’- আমার মনে হচ্ছে ছোট্ট দু’টি কথা- সুন্দর ও বেদনা। এই দু’টি কথাতেই আমি সমস্ত বিশ্বকে উপলব্ধি করতে পারি।’ সুন্দর-অসুন্দরের একই বক্তব্য ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জুবিলী উৎসবের অভিভাষণ দিয়েছিলেন- ‘যিনি সকল কর্মের, ধর্মের, জাতির, দেশের, সকল জগতের একমাত্র পরম স্বামী পতিত্ব বা নেতৃত্ব করার একমাত্র অধিকার তাঁর। এ অধিকার মানুষেও পায় মানি। কিন্তু সে পাওয়া যদি তার কাছ থেকে না হয়, তারে বলে অহঙ্কার। এই অহঙ্কারকে আমি অসুন্দরের দূত মনে করি। এ উবারহব নয়, উবসড়হ।’ অহঙ্কার, অসুন্দর, কুসংস্কারকে নজরুল ভয়াবহ ভয় করতেন। তিনি তো অহঙ্কারকে আখ্যাও দিলেন অপদেবতা বলে। আসলে নজরুল ইসলাম মানবতার কথাই বলতে চেয়েছেন এবং তা করেছেনও। তিনি দৈত্যশক্তি বা পশুত্বকে বিনাশ বা উৎখাত করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। জালিম, অত্যাচার ক্ষত্রিয়কূলকে সমূলে উৎপাটন না করলে নতুন পৃথিবী নতুন সমাজ গঠন এবং সেখানে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তার লক্ষ্যও এক আজীব- ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না’। তখনই তিনি ‘রণক্লান্ত’ হয়ে শান্ত হতে পারেন। অথবা তার খুনঝরা লেখায় অশুভ শক্তির আসর কেটে শুভ শক্তির নদীতে আছড়ে পড়বেন এমনই- ‘প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।’ ভীতিহীন এসব সাহসী উক্তি শুধু মানবতার মুক্তির জন্য তিনিই কেবলমাত্র উচ্চারণ করেছেন। কাজেই অনুভূতির ক্ষেত্রে মুসলিম ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হলেও প্রকাশের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির উভয় ধারাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি। এখানেই নজরুলের মহত্ত্ব যে, হিন্দু ও মুসলমান এই দুই বাঙালি প্রধান, ধর্ম সম্প্রদায়কে গভীরে ধারণ করেই তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন অন্য লোকে।

সম্প্রদায়োর্ধ্ব বলেই বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, আরবি ও ফারসি যে সাতটি ভাষা জানতেন তা থেকে দুই হাতে পরিগ্রহ করেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার শ্রেষ্ঠপুঁরুষ হিসেবে নিজেকে উন্মোচিত করলেন। সম্প্রদায়োর্ধ্ব সমস্ত কাঁচামাল জমা করলেন হিমাগারে। আর হিমঘরে পাঠালেন জাত-পাতের সাম্প্রদায়িকতা নামের পরিত্যক্ত, উচ্ছিষ্ট বস্তুগুলো। যার কারণে নজরুলের আসনটি বাংলা সাহিত্যের আকাশ ছেদে ঝলমলে কম্পিত হলো। আর বাঙালি পেল সর্বকালের শ্রেণী নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব।