শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

দেশের রাজনীতি কি দুর্বৃত্ত-কবলিত ?

দেশের রাজনীতি কি দুর্বৃত্ত-কবলিত ?

সংলাপ ॥ ‘দেশের রাজনীতি দুর্বৃত্ত-কবলিত হয়ে পড়ছে। অনেক আগেই কালো টাকা ও পেশী শক্তি ক্রয়ের সামর্থ নির্বাচনী মনোনয়ন কেনাবেচার বাজারে প্রধান নির্ধারক হয়ে গেছে। চাঁদাবাজি ও মস্তানি কোটিপতি হওয়ার সোজা পথ, আবার এদের সবারই গডফাদার কোন না কোনো রাজনীতিক। গত ২৫ বছরের প্রতিটি ক্ষমতাসীন দল বা জোট তাদের শাসনামলে বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের পছন্দমত সাজিয়েছে নিজেদের পক্ষে আনার উদ্দেশ্যে।
আগষ্ট মাস আমাদের আমাদের জন্য শোকাবহ মাস (যদিও বাংলা শ্রাবণ-ভাদ্র মাস হিসেবে এই মাসটিকে আমরা বাংলার ঐতিহ্যকে মূল্যায়িত করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি!)। বাঙালি জাতির জীবনে এবং পাশাপাশি বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে আগষ্টই হচ্ছে আত্মোপলব্ধি ও দৃঢ়প্রত্যয়ী হওয়ার মাস। এই মাসের ৩০-৩১ শ্রাবণ (১৫ আগষ্ট) সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যার ধারাবাহিকতায় কার্তিক মাসে (নভেম্বরে) হত্যা করা হয়েছিল জাতীয় চার নেতাকে। ইং ২০০৪ সালের ৪ ভাদ্র (২১ আগষ্ট) তারিখে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ সকল নেতৃত্বকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। ইং ২০০৫ সালের ৩২ শ্রাবণ (১৭ আগষ্ট) জেএমবির সদস্যরা সারা দেশে ৪৫০টি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। এই মাসেই মহাপ্রয়াণে চলে গিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি সাধক কাজী নজরুল ইসলাম। ২১ শ্রাবণ, আগষ্ট মাসের ৬ তারিখেই জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চালিয়েছিল সভ্যতার বর্বরতম পারমাণবিক বোমা হামলা।
প্রতি আগষ্ট মাসেই বঙ্গবন্ধুর ওপর স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ২০০৯ সালে স্মারক বক্তা ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ব্যারিষ্টার সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, ২০১১ সালে  স্মারক বক্তা ছিলেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংভাবে হত্যার পর তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। বাঙালি জাতি বিশ্বাস করে, বঙ্গন্ধুর নাম কখনই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। কারণ, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটেছে তার জন্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশের ৪৫ বছরের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির পরিবর্তিত ধারার উন্নয়নের পথে সবচেয়ে মারাত্মক বাধা দুর্নীতি। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি, ব্যবসায়িক দুর্নীতি, ঠিকাদারির দুর্নীতি সর্বোপরি মিথ্যা বলা ও মিথ্যাচার - সবই আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। দুর্র্নীতি দমন কমিশন তার বিশ্বাসযোগ্যতা আজও জাতির কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম বছরটি বাদ দিলে গত ৪৫ বছর সরকারগুলো আয়-বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখে চলেছে নিরন্তর। তাই, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য পর্বতপ্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকই তথ্য দিচ্ছে, বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ২৩ হাজার ২২৫ জনের উপরে। কালো টাকা, চোরাকারবারির টাকা, ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদের টাকা নিশ্চয়ই ওই হিসেবে আসেনি। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশের ১৬ লাখেরও কম মানুষ দেশের স্বাধীনতা-উত্তর ৪৫ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফসলটা কুক্ষিগত করে নিয়েছে।
দেশের ৯৯ শতাংশ জনগণ এই লুন্ঠনমূলক অর্থনীতির ন্যায্য সুফল থেকে বঞ্চিত থেকে গেছে। কোনো নির্বাচনেই পরাজিত দল নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেয়নি গত ২৫ বছরে এবং নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর থেকে আবারো ক্ষমতাসীন হওয়া পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনের নামে সরকারের বিরুদ্ধে সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াটাই এদেশের রাজনীতিকদের সংস্কৃতি হিসেবে চালু হয়ে যাচ্ছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে উৎপাটন করেছে ১৯৭৫-১৯৯০ পর্বে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাইকারী সামরিক জান্তা। পাকিস্তানী ধারায় সেনা ছাউনির রাজনীতি উৎপাটিত করার চেষ্টা করেছে বাঙালি জাতীয়তাবোধকে, জন্ম দেয়া হয়েছে মানচিত্র-ভিত্তিক, বিভেদকামী তথাকথিত ধর্মীয় জাতীয়তাবোধের কৃত্রিম ধারণা। সকল ধর্মের সম-মর্যাদা প্রদানকারী ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার প্রদানকারী সমাজতন্ত্রকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ শব্দগুচ্ছের আড়ালে নির্বাসনে পাঠিয়ে পরনির্ভরশীল মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের দর্শন ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিকে’ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে লালন করা হচ্ছে গত ৪১ বছর ধরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং বাঙালিত্ব। তাই রাষ্ট্রচরিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে জনগণের মালিকানাধীন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা, যে রাষ্ট্র শোষিত-বঞ্চিত শ্রমজীবী জনগণের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সুকঠিন সংগ্রামে শ্রমজীবী জনগণের পক্ষের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, যে রাষ্ট্র সমাজ পরিবর্তনকে তার মূল ব্রত হিসেবে বিবেচনা করবে। কিন্তু সামরিক স্বৈরশাসকগণের চক্রান্তে তা হয়নি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের কয়েকটি ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে গত কয়েক বছরে সামরিকজান্তাদের অবৈধ ও অ-সাংবিধানিক কাটা-ছেঁড়ার পর্ব পেরিয়ে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বিধৃত রাষ্ট্রীয় চার মৌল নীতি সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু, ২০১১ সালে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হলো, তাতে রাজনীতির সাম্প্রতিক বাস্তবতা তুলে ধরা হলেও সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এ দুটো নীতিকেই বহাল রাখা হয়েছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ, সন্ত্রাস এবং স্বরচিত তথাকথিত ইসলাম নিয়ে চলছে ক্ষমতাসীন হওয়ার তান্ডব। মোহাম্মদি ইসলাম ধারণকারীরা এই তান্ডবের মধ্যে পড়ে বাকরুদ্ধ!
ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, দিনে দিনে প্রমাণিত হচ্ছে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে পারেননি এবং প্রমাণের উপাত্তসমূহ উঠে আসছে তার জবরদখলকৃত পুরো শাসনামল হতে! সুপরিকল্পিতভাবে তিনি এবং তার সৃষ্ট রাজনীতিকরা একে একে জনগণের মানসপট থেকে মুছে দিতে চেয়েছেন ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও দু’লাখ মা-বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে অর্জিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি আদর্শ, অর্জন ও গৌরবগাঁথা। তার এই দেশোদ্রোহীতামূলক পাকি সত্তার সবচেয়ে প্রমাণটি উদ্ঘাটিত হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের নারকীয় হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাটি সম্পর্কে তার আগাগোড়া অবহিত থাকা। অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় তার সম্মতি প্রদানের বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে মূল ঘাতকদের জবানীতে জানাজানি হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, ওই ঐক্যবদ্ধ জাতিকে জিয়াউর রহমানই ধর্মীয় আবরণে আবার বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির কানাগলি দিয়ে প্রবিষ্ট করে গেছেন সুপরিকল্পিতভাবে যার কুফল আজও জাতি বহন করে চলেছে।

দেশের অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী বর্তমান সরকারের সাফল্যের পাল্লা ভারী।  বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশ, এর চলার পথে কোনরকম অসহযোগিতা করে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হলে তা বাঙালি জাতি প্রতিহত করার জন্য এখন দৃঢ়প্রত্যয়ী। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন