বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

প্রকৃতির প্রতিঘাত নাকি আমাদের কর্মফল?

পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিল
প্রকৃতির প্রতিঘাত নাকি আমাদের কর্মফল?

·        ‘তিনিই জমিনের বুকে সুদৃঢ় পাহাড় সমূহ স্থাপন করেছেন, যাতে করে জমিন তোমাদের নিয়ে স্থির থাকতে পারে’। (সূরা আন-নাহল:আয়াত-১৫)।
·        ‘তিনিই নভোমন্ডলকে নির্মাণ করেছেন কোনো খুঁটি ছাড়া, যা তোমরা নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছ। তিনিই পৃথিবীতে পাহাড় সমূহ স্থাপন করেছেন ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে। তাতে সকল প্রকারের বিচরণশীল প্রাণীকুলের বিস্তারের ব্যবস্থা করেছেন’। (সূরা লুকমান: আয়াত-১০)।
·        ‘আমি জমিনকে বিছিয়ে দিয়েছি, আমি তার মধ্যে স্থাপন করেছি মজবুত পাহাড়সমূহ, আবার এ জমিনে আমি উদ্গত করেছি নানা ধরনের গাছপালা’। (সূরা ক্বাফ: আয়াত-৭)।
·        ‘তিনিই জমিনের ওপর থেকে পাহাড় সমুহ স্থাপন করেছেন ও তাতে বহুমূখী কল্যাণ রেখে দিয়েছেন এবং তাতে সকলের আহারের পরিমান নির্ধারণ করে দিয়েছেন’। (সূরা হামীম আস-সাজদাহ : আয়াত-১০)।

সংলাপ ॥ প্রকৃতি জগতের সবকিছুই সুমহান আল্লাহর নির্ধারিত বিধানে পরিচালিত হয়। প্রকৃতি জগতের স্বাভাবিক নিয়মে বাধা আসলে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব দেখা যায়। মানুষ প্রকৃতির উপর নিজেদের অস্বাভাবিক প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে প্রকৃতির যে ক্ষতি সাধন করে চলেছে তা পরিনামে নিজের দিকেই ফিরে আসছে। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে - ‘প্রত্যেকেই তার কর্মফল ভোগ করবে’। এটাই স্রষ্টার বিধান। প্রকৃতির উপর আঘাত করার কারণে প্রকৃতি প্রতিঘাত করবে এটাই স্বাভাবিক। সারাবিশ্ব জুড়েই প্রকৃতির এই প্রতিঘাত লক্ষণীয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে এই চিত্র যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পার্বত্য এলাকার মহা বিপর্যয় মানবসৃষ্ট অপকর্মের এক নিদারুন প্রতিঘাত। বাংলাদেশে পাহাড় ধ্বসের কারণে নানা সময়ে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য জেলা চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও বান্দরবানে প্রতি বছরই বর্ষার শুরুতে পাহাড় ধ্বস ও মাটি চাপায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে এবং মূল্যবান সম্পদ বিনষ্ট হয়। সতর্কতামূলক প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও পাহাড় ধ্বসে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে টানা দু’দিনের অবিরাম বৃষ্টির পর গত কয়েকদিনে তিন পার্বত্য জেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে রাঙামাটি জেলায়। এর আগেও ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ধ্বসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে। সে ঘটনায় সরকারী হিসেবে মারা গিয়েছিল ১২৭ মানব প্রাণ। ২০০৮ সালে ১৪ জন, ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ৩ জন, ২০১১ সালে ১৭ জন, ২০১২ সালে ৯৪ জন, ২০১৩ সালে ২ জন, ২০১৪ সালে ৩ জন, ২০১৫ সালে ১৯ জনের প্রাণহানি হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে গত ১০ বছরে ৪০১ জনেরও বেশি মানুষ পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রতিবছরই এভাবে লাশের ভারে পাহাড় কাঁদে। থরে থরে সাজানো লাশ দেখে স্বজনের কান্না আর অবিরাম বৃষ্টি যেন মিলেমিশে বেদনার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে পাহাড়ি এলাকায়। এবারের দুর্ঘটনায় অনেকে হারিয়েছেন স্ত্রী-সন্তান, কেউ হারিয়েছেন মা, কেউ বাবা, কেউবা ভাই-বোন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা ও দুই সৈনিক। কোনো কোনো পরিবারের এখন আর কেউই বেঁচে নেই। পাহাড় ধ্বসের পর উদ্ধার কাজের সময় মাটিচাপা পড়ে প্রাণ হারান তারা। কিন্তু কেন এখানে বার বার পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটে? প্রাণহানিও কেন এত বেশি? খোঁজা যাক তার উত্তর।
জানা গেছে, বান্দরবান জেলার ৭টি উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার পরিবার, রাঙামাটি জেলার ১০টি উপজেলায় প্রায় ৮০ হাজার পরিবার এবং খাগড়াছড়ি জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ৬০ হাজার পরিবারের বসতি রয়েছে। এরা উঁচু-নিচু পাহাড়, পাহাড় ঘেঁষে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে থাকেন। এসব পরিবার যুগ যুগ ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। কিন্তু জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বর্ষায় মাইকিং করে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা ছাড়া বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ নেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রায় ২৫ বছর ধরে তিন পার্বত্য জেলায় ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বন্ধ থাকায় ভূমিহারা বা ভূমিহীন হাজার হাজার পরিবার অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছে। এসব জেলায় একদিকে ভূমি বন্দোবস্ত বন্ধ রয়েছে, অপরদিকে পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিশেষ বিধিমতে ‘যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং জায়গা-জমি আছে, কেবল তারাই পার্বত্য অঞ্চলের জায়গা-জমি কিনতে পারবেন বা স্থায়ী বাসিন্দার অধিকার রাখেন’ বলে উল্লেখ রয়েছে। এ কারণেই বাঙালি জনগোষ্ঠী ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। এক খন্ড ভূমি কিনতে পারছে না বা ব্যবহারের সুযোগও নেই সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। ফলে বাধ্য হয়ে বৈধ-অবৈধ উপায়ে যে যার মতো পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে। এসব পরিবার খুবই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করে এলেও তাদেরকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। তাছাড়া ইউনিয়ন, উপজেলা বা পৌরসভাভিত্তিক পাহাড়ে ঝূঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসন করার কোনো সরকারি পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। গত কয়েক বছরে পার্বত্য জেলাগুলোয় পাহাড়ের নিচে দখল আর বসতি এত বেড়েছে, এ নিয়ে আর শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। যৎসামান্য তৎপরতা ছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবারো উদাসীন। কানে তুলা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমে বিভোর প্রশাসন। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দেশবাসীকে পাহাড় চাপাপড়া লাশের স্তুপ দেখতে হচ্ছে বারবার। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? চাইলেই ঠেকানো যায়; কিন্তু ঠেকানো হচ্ছে না। আর মানুষও অতি লোভে তা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে- বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ের মাটি অপেক্ষাকৃত নরম এবং মাটির ধরন হচ্ছে বেলে। তাই টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটিতে ব্যাপক ধ্বস নামে। এবার বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামে পাহাড়ের মাটি ধ্বসে যে পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছে, তা শুধু পাহাড়         কাটার কারণ নয়, অবাধে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে সৃজিত গাছপালা কর্তন এবং পাহাড় খোদাই করে নিষিদ্ধ বারুদ ব্যবহার করে বোল্ডার পাথর ভাঙন ও উত্তোলন করা। পাহাড়ের ওপর অত্যাচার হলে পাহাড় প্রতিঘাত করবেই।
পাহাড় ধ্বসের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের উপরের দিকের মাটিতে কঠিন শিলার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তাই বৃষ্টির কারণে এ ধরনের মাটি পানি শুষে ফুলতে থাকে। তাছাড়া কঠিন শিলা না থাকায় মাটিগুলো নরম ও পিচ্ছিল হয়ে যায়। ফলে ভারি বর্ষণের সাথে সাথে মাটি ভেঙ্গে পড়ে। তাছাড়া যারা পাহাড়ে থাকেন তারা ঘর নির্মাণের জন্য পাহাড়ের সবচেয়ে শক্ত মাটির স্তরও কেটে ফেলেন। এতে পাহাড় ধ্বসের শঙ্কা আরও তীব্র হয়।
জিও সায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পাহাড় ধ্বসের পেছনে প্রাকৃতিক কারণ এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। প্রাকৃতিক কারণ হলো পাহাড়ের ঢাল যদি এমন হয় যে ঢালের কোনো অংশে বেশি গর্ত থাকে, তখন অতিবৃষ্টিতে ভূমি ধ্বস হতে পারে। এছাড়া ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং পাহাড়ের পাদদেশের নদী ও সাগরের ঢেউ থেকেও পাহাড় ধ্বস হতে পারে। আর মনুষ্য সৃষ্ট কারণ হিসেবে গবেষণায় বলা হয়েছে, পাহাড়ের গাছ পালা কেটে ফেলা, মাটি কেটে ফেলা, পাহাড়ে প্রাকৃতিক খাল বা ঝর্ণার গতি পরিবর্তন, পাহাড়ের ঢালুতে অতিরিক্ত ভার দেয়া এবং খনি খননের কারণে পাহাড় ধ্বস হতে পারে। তবে আমাদের ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, বাংলাদেশে মূলত পাহাড়ের উপরের দিকে কঠিন শিলার অভাব, পাহাড়ের মাটি কেটে ফেলা এবং বড় গাছপালা কেটে ফেলার কারণেই পাহাড় ধ্বস হয়ে থাকে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড় ধ্বসের মূল কারণ হলো পাহাড় থেকে মাটি কাটা। পাহাড়গুলো ৩০ ডিগ্রির বেশি ঢালু হলে সে পাহাড়ের পাদদেশে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়। পার্বত্য জেলাগুলোয় রয়েছে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত অসংখ্য ঢালু পাহাড়। মাটির জমাট বাঁধা পাহাড় যখন কাটার মহোৎসব চলে তখন প্রবল বর্ষণ হলে মাটির ওপরের আবরণ না থাকায় যে প্রবল জলধারা নিচে ধাবিত হয় তার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ মাটি এসে পাহাড়ের পাদদেশে আছড়ে পড়ে। আর তখনই ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা।
২০০৭ সালে যখন পাহাড় ধ্বসে ব্যাপক প্রাণহানি হয় তখন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পাহাড়ি ভূমি ধ্বসের সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখসহ সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা পেশও করেছিল কমিটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এর অধিকাংশই মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি জরিপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে চিহ্নিত করার সুপারিশ ছিল, যা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তেমনিভাবে বাস্তবায়িত হয়নি পাহাড়ের পাদদেশে বিপদসঙ্কুল অবস্থায় বসবাসকারী বস্তিবাসীকে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনের কর্মসূচি। বাস্তবায়িত হয়নি পাহাড় কাটার আশঙ্কা কিংবা বন উজাড়ের ঘটনা। পাহাড় হন্তারকদের পাহাড় কাটা থেকে বিরত করা যায়নি। অন্যদিকে প্রশাসন, সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর লোভাতুর হাত গুটিয়ে না নেয়ায় অশিক্ষিত এ জনগোষ্ঠী টুপাইস দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস অব্যাহত রাখে। এক শ্রেণীর তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা জোরপূর্বক এসব পাহাড় দখল করে সেখানে টিনশেড ঘর তুলে তা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় ভাড়া দিচ্ছে। চট্টগ্রামের খুলশী ও রেলওয়ে সংলগ্ন একাধিক এলাকার পাহাড়ে এখন রমরমা পাহাড় বাণিজ্য চলছে। যেভাবে বসতি গড়া হচ্ছে তাতে আর পাহাড় থাকবে না। আগের ঘটনা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়নি বলেই তাদের এ করুণ পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে। পাহাড়ে এখন যারা বসবাস করছেন তারা দ্রুত অন্যত্র আশ্রয় না নিলে পাহাড়ের আক্রোশ থেকে রেহাই পাবে না।
একের পর এক পাহাড় চাপা পড়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় পাহাড় ব্যবস্থাপনায় আমাদের অক্ষমতাকেই প্রকাশ করছে। আপাতত এই দেড়শ’ প্রাণের চালানকে ‘নিয়তি’র পরিহাস বলে সবাই মেনে নিলেও মৃত্যুর এই অস্বাভাবিক মিছিলটির দীর্ঘায়ণের জন্য কেবলমাত্র ‘সৃষ্টিকর্তা’র উপর ছেড়ে দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। এগুলো এক প্রকারের হত্যাকান্ড। প্রতিদিন পত্রিকায় পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় কাটার খবর আসে। স্থানীয় প্রভাবশালীর দোহাই দিয়ে পাহাড় কেটে শিল্প-কলকারখানা তৈরি হচ্ছে, ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে। অপরিকল্পিত গর্ভধারণের মতো পাহাড়ের বুকে রাতারাতি বাড়ি তুলছে। এতো অরাজকতা চলার পরও এই দেশের সরকার চুপ মেরে বসে আছে। কারণ একটাই, যারা পাহাড় কাটছে কিংবা অবৈধ কারখানা পাহাড়ে বুকে তুলছে, তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক মেরুদন্ড শক্তপোক্ত। শুধুমাত্র সদিচ্ছা থাকলেই পাহাড়ে ভূমিধ্বস রোধ করা সম্ভব। সরকারের উচিত পাহাড়ে পরিকল্পিত বসতি কিংবা বসতির জন্য আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হওয়া। জাপানের মতো দেশে যেখানে বছরে সাড়ে চার হাজার ভূমিকম্প হয়েও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর হার এক শতাংশে নিয়ে এসেছে, সেখানে আমরা কেন পারি না? তারা তো প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পাহাড়কে শাসন করছে, আমরা কেন পাহাড়িদের দুঃখ লাঘবে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ  করছি না?

সময়ের দাবি সরকার শুধুমাত্র পাহাড়ের সুরক্ষায় বাস্তবমূখী পদক্ষেপ গ্রহন করুক। পাহাড়ে বসবাসরতদের উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে টেকশই বাড়ি-রাস্তাঘাট করে দিক। পাহাড়ি ভূমি-খেকোদের শাস্তির বিধান করে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করুক। অন্যরা পারলে আমরাও পারবো। আমরা মনে প্রাণে চাই, আর যেন পাহাড় ধসে কারো নির্মম মৃত্যু না হয়। আল্লাহর বিধান মেনে আমরা সবাই যেন পাহাড় রক্ষায় সচেতন হই। নয়তো আমাদের কর্মফল আমাদেরকেই ভোগ করতে হবে। 

সময়ের সাফ কথা.... যাকাত-ছদকা-ফিতরা’র কথা


 অধ্যাপক মো. আক্তার হোসাইন ॥ মানবীয় আমিত্বের পরিপূর্ণ উৎসর্গের নাম যাকাত। মনের মধ্যে স্রষ্টার জন্য মহাশূন্য ভাব জেগে ওঠাই যাকাত। কোন দানকে কুরআনে যাকাত বলা হয়নি। ইসলাম এবং কুরআন নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা বলছেন যে যাকাত মালের সাথে সম্পর্কিত। অথচ কুরআন মাজিদ ঘোষণা করেছে যে, হযরত লুত, হযরত আদম, হযরত ইব্রাহীম এবং প্রত্যেক নবীই যাকাত দিয়েছেন। বিনিময় প্রথা চালু হলো সেদিনের কথা। শতকরা আড়াই টাকা তখনকার দিনে (১৪৫০ বছর আগে) কিভাবে যে দেয়া হতো তা তো সমাজকে বুঝানো যাবেনা। শতকরা আড়াই টাকাকে কুরআনে এমনকি হাদিসেও কোথাও যাকাত না বলে ছদকা বলা হয়েছে। যেখানেই সম্পদের উপর কর দানের প্রশ্ন সেখানেই ‘সাদকা’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। তাছাড়া প্রত্যেক নবীই যদি যাকাত দিয়ে থাকেন তবে হযরত আদম (আ.) কাকে যাকাত দিয়েছিলেন এ প্রশ্নটি এসে যায়? কুরআনে বলা হয়েছে ‘আল্লাজি নাহুম লিজ যাকাতে ফায়েলুন’ অর্থাৎ ‘তারা সদা সর্বদা যাকাতের জন্য কর্মতৎপর থাকেন।’ যাকাত যদি কর হতো তবে তার জন্য বিশ্বাসীরা এটা পরিশোধের জন্য সদা তৎপর না হয়ে বছরে একবার দিয়ে অন্য সময়টা এবাদতসহ নানাবিধ কর্মে নিয়োজিত থাকতেন। তাছাড়া সালাতের সাথে যাকাতের প্রসঙ্গ এসেছে। তাহলে সালাত আর যাকাত একসাথে। সমাজের কথামতো কি ধরে নিতে হবে যে সালাত সবার জন্য আর যাকাত বিত্তবানদের জন্য? অবশ্যই না। সালাতের সাথে যাকাতের কথা বারবার এসেছে এবং একটু তলিয়ে দেখতে গেলে মানুষ দেখতে পারবে যে স্রষ্টার সাথে সংযোগ সাধন ও আমিত্বের উৎসর্গের  বিষয় নানাভাবে নানা মহিমায় স্থান কাল পাত্রভেদে বিভিন্ন রকম দৃষ্টান্তে বলা হয়েছে। প্রশ্ন, তাহলে যাকাত কি? উত্তরটি হলো, মানুষ আল্লাহ্র নিকট থেকে যা কিছু যেমন ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি (চিত্তবৃত্তির সব ধরনের গুণাবলী সবই আল্লাহর দান), আল্লাহর এই দানকে নিজের নিকট না রেখে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করার নামই হলো যাকাত। মানবীয় আমিত্বের আবরণ ক্ষতিকর। মানুষের আমিত্বের আবরণ উন্মোচিত না হলে স্রষ্টার সাথে সংযোগ হবে না। কুরআনে বলা হয়েছে, সালাত কায়েম (সালাত পড়তে বলেনি) কর এবং যাকাত দাও। সালাতের মূল কাজ হলো স্রষ্টার সাথে সংযোগ প্রচেষ্টা। মানবীয় আমিত্বের আবরণ থাকলে সংযোগ হবে না। এগুলো বিসর্জন দিতে হয়। এ কারণে সালাত এবং যাকাত একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রের দরবারী আলেমগণ একে কর হিসাবে আদায়ে ফতোয়া দেয়াতেই বিষয়টি মূল বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা বোঝাতে চাচ্ছেন যে সম্পদ থেকে আড়াই ভাগ দান করলে সম্পদ বৈধ হয়। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি যে মৃত কিংবা জীবিত সকল লোকের সম্পদে গরীব, অভাবী, এতিম, ফকির, মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের হক রয়েছে তখন তা দেবেন কি করে? এরা তখন বলে গরীব মিছকিনকে আত্মীয়স্বজনসহ ডেকে কিছু খাইয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। কোথায় মালের ব্যাপার-অর্থের ব্যাপার আর কোথায় রুহানী তথা আধ্যাত্মিক ব্যাপার। কুরআনে বলা আছে, যে ব্যক্তি সম্পদ জমা করে রাখে তাকে হুতামা তথা জ্বলন্ত আগুনে চিরদিনই জ্বলতে হবে। ধন সম্পদ জমা করে রাখাটাই যেখানে অপরাধ সেখানে ধনের জন্য যাকাতের বিধান আসে কি করে? তাছাড়া এখানে একটা বিষয় কুরআনের আয়াত দ্বারা বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। কুরআনে বলা আছে, ‘আমি কাউকে বেহিসেবী তথা অফুরন্ত রেজেক দেই এবং কাউকে তার রিজিক নির্দিষ্ট করে রেখে দেই।’ এই বেহিসাবী রিজিক পার্থিব মাল বা ধন সম্পদ নয়। আল্লাহ্ যেখানে প্রত্যেকের ধনের পাই পাই করে হিসাব নেবেন বলে জানিয়েছেন সেখানে বেহিসাবী ধন সম্পদ দিয়ে আবার তার হিসাব চাওয়ার প্রশ্ন কেন? যদি বেহিসাবী সম্পদই ধরে নেয়া হয় তবে কেন বলা হলো যে যারা মাল জমা করে এবং গুণে গুণে রাখে তাদেরকে ওয়াইল নামক নরকে জ্বলতে হবে?
সমাজ আসলে কুরআনের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে একত্রে সমাবেশ করে দেখেনা এবং জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে পূর্বে যারা যা বলে গেছেন তাই মেনে নিয়ে কেবল অন্ধকারেই ডুবে আছে। দুনিয়ার সকল ধনীরই সম্পদের নিশ্চয়ই একটা হিসাব আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। তাহলে বেহিসাব কথাটা কাদের বেলায়,  কার জন্য প্রযোজ্য? আল্লাহর রিজিকের অর্থ যদি দুনিয়ার ধন সম্পদই হবে তাহলে আল্লাহ্ তার প্রিয়জনকে এই রিজিক নিশ্চয়ই প্রচুর দান করবেন কিন্তু আসলে তা হয়নি বরং আল্লাহ্ তার খাস বান্দাদেরকে এসব সম্পদ হতে এক রকম প্রায় বঞ্চিত করেই রেখেছেন। কোন্ নবী ধনে ধনী ছিলেন? নবীর কোন্ সঙ্গী সাথী ধনী ছিলেন? যারাও ছিলেন তারা তাদের ধন সম্পদ নবীর কাছে নিয়ে এসে আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে কি বিলিয়ে দেননি? সুরা মরিয়মের ১৩ নং আয়াতটিকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তবে এটা স্পষ্ট হবে যে, যাকাত বলতে কি বোঝায়। এ আয়াতে দু’টো শব্দ আছে একটি হলো ‘হানানান’ এবং অন্যটি হলো ‘জাকাতান’। হযরত ইয়াহিয়া (আ:) এর এমন কি সম্পদ ছিল যে, তাঁর প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যাকাতের প্রশ্ন উঠবে? ‘হানানান’ আসলে মনের গোলযোগ শুন্য একটি শান্ত ভাব। বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে কার্যকারণের কোন গোলযোগ নেই। সৃষ্টির প্রত্যেক স্থানে সবাই ঠিকভাবেই আছে। মনের এই গুণময় ভাবটির নাম হানানান। অতএব যার মাঝে এই হানানান চলে আসে তার মধ্যে কোমলতা প্রকাশ পায়। এই রূপে পরিপূর্ণ প্রশান্তির একটি মানসিক অবস্থার নাম হানানান।  হযরত ইয়াহিয়া (আ.) ছিলেন বৃদ্ধ এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন বন্ধ্যা। এসময় তাঁকে আল্লাহর তরফ থেকে একটি পুত্র সন্তানের খবর দেয়া হয় বলে হযরত ইয়াহিয়ার মন একরাশ প্রশান্তিতে, কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিলো।  হানানান অবস্থাপ্রাপ্ত হলে বিশ্ব প্রকৃতির স্বাভাবিক বিধানের সঙ্গে মনের পূর্ণ সমন্বয় সাধন ঘটে, আমিত্বের আবরণের পরিপূর্ণ একটি উৎসর্গ হয় অর্থাৎ যাকাত হয়ে যায়। সে ব্যক্তি তখন নিজেই তাকওয়ার মূর্ত প্রতীক। এস্থানে হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-এঁর কেবল শোকরানার ভাব, কৃতজ্ঞতার ভাব আল্লাহর রহমতে সিক্ত হবার ভাব। তার মাঝে কোন গর্ব নেই, আমিত্ব নেই আছে কেবল সেজদা আর কৃতজ্ঞতা। তাই, কুরআনের যাকাতকে যারা আয়কর বলেন তারা কিসের ভিত্তিতে বলেন তা বোধগম্য নয়। মানসিকভাবে জীবনের সামগ্রিক উৎসর্গই হলো যাকাত। এটা সাধকের জন্য সালাতের মতোই অবশ্য পালনীয় দেহ ও মনের একটি সার্বিক উৎসর্গ। পরিপূর্ণভাবে যাকাত দেয়া ব্যক্তি জান্নাতবাসী। সূরা তওবার ৬০ নং আয়াতে যে আট জনকে ছদকা দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা ভালো করে খেয়াল করলেই সব রহস্য বের হয়ে যাবে। এখানে হুবহু বাংলা অনুবাদ তুলে দেয়া হলো : ‘ছদকাসমূহ গরীব, মিসছিন, ছদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারী এবং অনুরাগী অন্তর বিশিষ্টদিগের জন্য এবং যারা গোলাম তাদেরকে মুক্ত করবে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্ত করা, আল্লাহর পথ ও পথিকের মধ্যে - এ হচ্ছে আল্লাহর বিধান। আল্লাহ্ বিজ্ঞানময় জ্ঞানী।’ বর্তমান মুসলমান সমাজের শতকরা আড়াই টাকা যদি যাকাত হিসেবে আদায় করা হয় তা খাবে কে?
যে আটজনের কথা বলা হলো তারা ছাড়া অন্য কেউ আছে কি যে অপরের সম্পদের হকদার? ছদকাকে আমরা কেন যাকাত বলে ধরে নিচ্ছি? যাকাত বলতে আমিত্বের আবরণ উন্মোচন, আত্মোৎসর্গ ব্যতীত অন্য আর কোন অর্থেই শব্দটি কুরআনে ব্যবহার হয় নাই। সুরা তওবায় ‘ছদকা’ শব্দটিই আছে যাকাত নেই। কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ছদকা নির্দিষ্ট আটটি খাতে ব্যয় করতে হবে। খাতগুলো হলো ১। অভাবগ্রস্ত প্রার্থীদের জন্য যারা অভাবের কারণে প্রার্থনা করে থাকেন, ২। অভাবীদের জন্য যারা কোন অবস্থাতেই প্রার্থনা করলো, ৩। যারা ছদকা আদায় এবং তা উপযুক্ত স্থানে বন্টন বিষয়ে কর্মচারীরূপে নিয়োজিত থাকবে, ৪। যারা বন্টন বিষয়ে কর্মচারীরূপে নিয়োজিত থাকবে। যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি প্রেমের অতিশয্যে অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থাপ্রাপ্ত হয়ে উপার্জনের কর্তব্য পালনে বিকল হয়ে পড়ে - তাদের জন্য, ৫। বন্দিকে মুক্ত করার জন্য, ৬। ঋণে আবদ্ধ সৎ কর্মশীল কোন ব্যক্তিকেও আর্থিক মুক্তি দেয়া যেতে পারে যদি তা কর্তৃপক্ষ দ্বারা ন্যায়সংগত হয়, ৭। ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রচার কাজে, ৮। পথিকের মধ্যে অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত পথিককে এ ছদকা দেয়া যাবে। এমতাবস্থায় যাকাত শব্দটিকে আমরা কখনো মালের মধ্যে বা অর্থের সাথে মিলাতে পারি না।

আমাদের দেশে ঈদের আগে ফেতরা ধরা হয়। এটা যে কোথা হতে কে আমদানি করলো তা এক বিস্ময়। প্রতিটি মানুষকে পৌনে দুই সের গমের সমপরিমাণ দামে ফেৎরা দিতে হয়। যাকাতও মাল, ছদকাও মাল, ফেতরাও মাল আর সবই যদি মাল আর কর হয় তবে তা তিন নামে আসার যে কোন যৌক্তিকতা থাকে না সেটা সাধারণ পাঠকও বুঝে যাবেন। মাল-অর্থ কামানোর এটা একটা শুভঙ্করের ফাঁকি। তাছাড়া এমনও দেখেছি  যে অনেক লোক স্বর্ণের যাকাত দিতে দিতে মূল স্বর্ণের দামের তিনগুণ বেশিও যাকাত দিয়েছেন।  পবিত্র কুরআন না বুঝে পড়ার খেসারত কতো কাল দিয়ে যাবে এই মুসলিম সমাজ? কুরবানীর মাংস কেন তিনভাগে ভাগ করা হয়? একভাগ নিজের, একভাগ আত্মীয়দের এবং একভাগ প্রার্থীদের জন্য? সম্পদের বেলায় এমনটি হলে অর্থাৎ যা কামাই করবো তার এক ভাগ আমার, একভাগ আত্মীয়দের এবং একভাগ প্রার্থীদের? কারণ, কুরআনে তো বলাই আছে  যে, তোমাদের সম্পদে রয়েছে আত্মীয়, গরীব, ফকির, মিসকিন ও এতিমদের হক। যার যার হক আদায় করে দিলেই তো হয়। সূরা আহ্যাবের ৩৩ নং আয়াতে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মনের কালিমা দূর করতে বলা হয়েছে। এভাবে যদি মানুষ চলতো আর কুরআন নির্দেশিত পথে ব্যবস্থা করতো তবে দুনিয়ার কোন মানুষ অনাহারে থাকতো না। কেউ দশ তলায় আবার কেউ গাছ তলায় থাকতো না। সূরা মুমিনে যাকাতের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করার চেষ্টা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা করছি কি তা? আমাদের ভেবে দেখা দরকার। 

অর্থপাচার বন্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে



*শপথ তাদের যারা ছুটে যায় হাঁপাতে হাঁপাতে-আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে, সকালে হামলায়, ধূলো উড়িয়ে ঢুকে পড়ে একসাথে। মানুষ তো তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। আর সে তো নিজেই তার স্বাক্ষী। আর ধন-সম্পদের প্রতি তার কি কঠিন প্রেম! সে কি জানে না যা কবরে আছে তা উঠানো হবে, আর অন্তরে যা আছে তা প্রকাশ করা হবে। আর সেদিন তাদের খবর তাদের প্রতিপালকের ভাল করেই জানা থাকবে। (আল কুরআন, সূরা আদিয়াত-আয়াত ১-১১)

শেখ উল্লাস ॥ যখন এ দেশের মানুষের এত অর্থ-সম্পদ, টাকা-পয়সা ছিল না তখন সমাজ-সচেতন মানুষদের পক্ষ থেকে বলা হতো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। এখন অনেক মানুষের হাতে, রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে অর্থ-সম্পদ হয়েছে। দেশের অর্থ-সম্পদ আজকাল ব্যাপকহারে বিদেশে পাচার হচ্ছে নানা পন্থায়, যা দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, অন্য সকল দুর্নীতির টাকা দেশের ভেতরে খরচ হলে, বিনিয়োগ হলে এর কিছু না কিছু অংশ কোন না কোন ভাবে দেশের মানুষের কাজে আসার সুযোগ থাকে, কিন্তু যে অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়, তা দেশের আর কোন কাজে আসে না। বিগত দুই তিন দশক ধরে এই অর্থপাচারই দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। বর্তমান সময়ের দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতি হচ্ছে, এদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী ও রাজনীতিজীবীদের একটি বিরাট অংশই এদেশের সকল সুবিধা-সুবিধা ভোগ করে তাদের আখের গোছাচ্ছে বিদেশে, বাড়ি করছে মালয়েশিয়া, আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়ায়; ছেলেমেয়েদেরকেও প্রতিষ্ঠিত করছে বিদেশে, টাকা জমাচ্ছে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে। নিজের জন্মভূমি, গ্রাম কিংবা মফস্বলের ছোট্ট শহরে তাদের আর ফিরে যাওয়া হচ্ছে না। দেশের প্রতি তাদের অনীহা, বিস্মৃতিপ্রবণতা ও অকৃতজ্ঞতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিজের জন্মভূমিকে তাদের এবং তাদের ছেলেমেয়েদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিতে পারছে না। ফলে নানা কৌশলে তারা বিদেশে অর্থ পাচার করছে এবং সেখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলছে। পরিণামে জীবনের শেষ দিনগুলো বিদেশের মাটিতে তারা কাটিয়ে দিচ্ছে ওইসব দেশের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। এই অবস্থায় একজন মানুষের নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলার অবস্থা তৈরি হয়েছে।
গত ১৩ জুন, ২০১৭, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪, তারিখ মঙ্গলবার দৈনিক কালের কন্ঠ লিখেছে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫১ কোটি টাকা পাচারকারী ৯ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থ পাচারকারী এই ৯ জনের আটজনই ব্যবসায়ী, অন্যজন সাবেক আমলা। তারা দেশের ব্যাংকিং চ্যানেল এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এই অর্থ পাচার করেছেন। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা পেতে যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি ’ল ফার্ম নিয়োগ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা এই ৪৫১ কোটি টাকাসহ দেশ থেকে পাচার হওয়া যেকোন অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যে এই তিনটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এই চুক্তি সম্পাদনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হওয়া যেকোন অর্থ ফেরত পেতে সব ধরনের আইনী কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করবে এই তিন মার্কিন প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে এনবিআর। প্রয়োজনে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেবে।
পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে আমদানী-রপ্তানীতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কোন কর্মকর্তা সহযোগিতা করেছেন কি-না তাও যাচাই করা হচ্ছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ সময়োচিত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমলে এদেশকে শোষণ করে ঔপনিবেশিক শাসকরা এদেশকে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দরিদ্র বানিয়ে এদেশেরই অর্থ লুন্ঠন ও পাচার করে নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিল। আজ আমাদেরই দেশের একশ্রেণীর প্রতারক, দুর্ণীতিবাজ ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিজীবি এদেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ব্রিটিশ-পাকিস্তানীদের লুটপাটের কারণে দরিদ্র হয়ে পড়া জনগণের আর্থিক স্বচ্ছলতা বর্তমানে বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার কমে আসলেও বিদেশে অর্থপাচারের মতো দুর্নীতি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশী নাগরিকদের পাচার ও জমা করা বিশাল অঙ্কের অর্থের খবর মাঝে মাঝেই প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। তবে এর প্রতিকার কিংবা অর্থ পাচাররোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপের খবর খুব কমই সাধারণ জনগণ জানতে পারে, যদিও এ সম্পদ দেশের সকল মানুষের। এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। নিজের জন্মভূমিকে বসবাসের অযোগ্য আখ্যায়িত করে যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে তারা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই তাদের সকলকে চিহ্নিত করে                   তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ও সর্বাত্মক  ব্যবস্থা গ্রহণ আজ সময়ের দাবি। 

বৈষম্যহীন মিলনোৎসব ঈদ-উল-ফিতর


ফিরোজ আহমাদ ॥ আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্তির খুশি উদযাপনই হলো ঈদ। সিয়াম পালন করতে পারার বড় আনন্দে রোজাদার মাতোয়ারা হবেন এটিই স্বাভাবিক। যে প্রভুর সন্তুষ্টির জন্যে এতো আরাধনা, উপবাস, সেহরী, ইফতার, তাহাজ্জুদ, ইতেক্বাফ,  সে প্রভুর দেয়া পুরস্কার গ্রহণ করার সৌভাগ্যেই বা ক’জনের হয়। সেই পুরস্কার হলো ঈদ। এক মাস সিয়াম সাধনার পর পশ্চিমের আকাশে শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজাদারের ঘরে আনন্দের বন্যা বইতে থাকে। এছাড়া ঈদ-উল ফিতরের রাত দোয়া কবুলের রাত। সুনানে বায়হাকী শরীফের ৩/৩১৯ নং হাদিসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের যে পাঁচটি বিশেষ রাতের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। পাঁচটি রাতের প্রথমটি হলো জুমার রাত, ২য় হলো ঈদুল ফিতরের রাত, ৩য় হলো ঈদুল আযহার রাত, ৪র্থ হলো রজব মাসের চাঁদ উদয়ের প্রথম রাত, ৫ম হলো মাহে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত।
আইয়্যামে জাহেলীয়াতের যুগে আজকের মদীনায় তৎকালিন সময়ের ইয়াসরিবে কাফের মুশরেকরা ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে দু’টো আনন্দ উৎসব পালন করতো। ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ উৎসব দু’টো বিভিন্ন নাচ, গান, কৃষ্টি-আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হতো। আল্লাহ্ তায়ালা ঈমানদারদের খুশি উদ্যাপনের জন্য বরকতময় উপহার হিসেবে দিলেন ঈদ। ঈদ-উল ফিতর এর মধ্যে ইসলামের সুমহান আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, সহনশীলতা,  সহানুভূতি ও বিশেষ মূল্যবোধ রয়েছে। ঈদ-উল ফিতর উদ্যাপিত হয় ঈদের নামাজ আদায় করা, দোয়া দুরূদ পড়া, তাসবিহ তাহলীল পাঠ করা ও মিষ্টান্ন ও নানাবিধ রুচিসম্মত খাদ্য ও পানাহারের মাধ্যমে। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা ঈদ-উল ফিতরের দিন এতিম অসহায় দু:স্থদের ভালো খাবার ও নতুন জামা-কাপড় উপহার দেন। দেশের সকল এতিমখানা ও কারাগারগুলোতে বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। অসহায় দু:স্থদের মধ্যে ফিতরার টাকা বাড়তি আনন্দ প্রদান করে।
ঈদ-উল ফিতর মুসলমানদের বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক। সেদিন ধনী দরিদ্ররা ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর পরস্পরের সাথে  ভাব ও মত বিনিময় করার সুযোগ পান। করেন। ঈদের দিন মুসলমান অধ্যুষিত দেশের রাষ্ট্র প্রধানগণ তার দেশের সাধারণ জনতা ও  উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশেবিষয়গুলো এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। দেশের সবক’টি শিশু পার্ক, সমুদ্র সৈকত, চিড়িয়াখানা ও দর্শনীয় স্থান গুলোতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণী, পেশার মানুষের ঢল নামে। ঈদ উপলক্ষে সরকারী বেরসকারী অফিস আদালত শিল্প কারখানা গুলোতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। শহরে বসবাসরত চাকুরীজীবিরা বাবা-মা আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে বাড়ির দিকে ছুটে যান। রেল বাস, নৌ পথে বাড়তি ভোগান্তি উপেক্ষা করে যথা সময়ে প্রিয়জনের নিকট পৌঁছানোর লক্ষ্য থাকে। ঈদের দিন নতুন টাকা ছোটদের বাড়তি আনন্দ প্রদান করে।

ঈদ-উল ফিতরের আনন্দকে অর্থবহ করতে অশ্লীল নাচ গানের আসর বসানো, তাস খেলা, মদ জুয়ার আসর বসানো, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, ব্যাভিচার ও পরনিন্দার মতো অশ্লীল মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মিসওয়াক করা, ফজরের সালাত আদায় করা, বাবা-মাকে সালাম করা, আতর ব্যবহার করা, নীরবে তাকবীর বলতে বলতে ঈদ গাঁহে প্রবেশ করা উত্তম। ঈদের   নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধকে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ জীবনে কাজে লাগতে পারলে বাংলাদেশ একটি সুখী সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে।