বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

অর্থপাচার বন্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে



*শপথ তাদের যারা ছুটে যায় হাঁপাতে হাঁপাতে-আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে, সকালে হামলায়, ধূলো উড়িয়ে ঢুকে পড়ে একসাথে। মানুষ তো তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। আর সে তো নিজেই তার স্বাক্ষী। আর ধন-সম্পদের প্রতি তার কি কঠিন প্রেম! সে কি জানে না যা কবরে আছে তা উঠানো হবে, আর অন্তরে যা আছে তা প্রকাশ করা হবে। আর সেদিন তাদের খবর তাদের প্রতিপালকের ভাল করেই জানা থাকবে। (আল কুরআন, সূরা আদিয়াত-আয়াত ১-১১)

শেখ উল্লাস ॥ যখন এ দেশের মানুষের এত অর্থ-সম্পদ, টাকা-পয়সা ছিল না তখন সমাজ-সচেতন মানুষদের পক্ষ থেকে বলা হতো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। এখন অনেক মানুষের হাতে, রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে অর্থ-সম্পদ হয়েছে। দেশের অর্থ-সম্পদ আজকাল ব্যাপকহারে বিদেশে পাচার হচ্ছে নানা পন্থায়, যা দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, অন্য সকল দুর্নীতির টাকা দেশের ভেতরে খরচ হলে, বিনিয়োগ হলে এর কিছু না কিছু অংশ কোন না কোন ভাবে দেশের মানুষের কাজে আসার সুযোগ থাকে, কিন্তু যে অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়, তা দেশের আর কোন কাজে আসে না। বিগত দুই তিন দশক ধরে এই অর্থপাচারই দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। বর্তমান সময়ের দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতি হচ্ছে, এদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী ও রাজনীতিজীবীদের একটি বিরাট অংশই এদেশের সকল সুবিধা-সুবিধা ভোগ করে তাদের আখের গোছাচ্ছে বিদেশে, বাড়ি করছে মালয়েশিয়া, আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়ায়; ছেলেমেয়েদেরকেও প্রতিষ্ঠিত করছে বিদেশে, টাকা জমাচ্ছে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে। নিজের জন্মভূমি, গ্রাম কিংবা মফস্বলের ছোট্ট শহরে তাদের আর ফিরে যাওয়া হচ্ছে না। দেশের প্রতি তাদের অনীহা, বিস্মৃতিপ্রবণতা ও অকৃতজ্ঞতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিজের জন্মভূমিকে তাদের এবং তাদের ছেলেমেয়েদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিতে পারছে না। ফলে নানা কৌশলে তারা বিদেশে অর্থ পাচার করছে এবং সেখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলছে। পরিণামে জীবনের শেষ দিনগুলো বিদেশের মাটিতে তারা কাটিয়ে দিচ্ছে ওইসব দেশের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। এই অবস্থায় একজন মানুষের নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলার অবস্থা তৈরি হয়েছে।
গত ১৩ জুন, ২০১৭, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪, তারিখ মঙ্গলবার দৈনিক কালের কন্ঠ লিখেছে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫১ কোটি টাকা পাচারকারী ৯ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থ পাচারকারী এই ৯ জনের আটজনই ব্যবসায়ী, অন্যজন সাবেক আমলা। তারা দেশের ব্যাংকিং চ্যানেল এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এই অর্থ পাচার করেছেন। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা পেতে যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি ’ল ফার্ম নিয়োগ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা এই ৪৫১ কোটি টাকাসহ দেশ থেকে পাচার হওয়া যেকোন অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যে এই তিনটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এই চুক্তি সম্পাদনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হওয়া যেকোন অর্থ ফেরত পেতে সব ধরনের আইনী কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করবে এই তিন মার্কিন প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে এনবিআর। প্রয়োজনে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেবে।
পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে আমদানী-রপ্তানীতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কোন কর্মকর্তা সহযোগিতা করেছেন কি-না তাও যাচাই করা হচ্ছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ সময়োচিত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমলে এদেশকে শোষণ করে ঔপনিবেশিক শাসকরা এদেশকে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দরিদ্র বানিয়ে এদেশেরই অর্থ লুন্ঠন ও পাচার করে নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিল। আজ আমাদেরই দেশের একশ্রেণীর প্রতারক, দুর্ণীতিবাজ ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিজীবি এদেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ব্রিটিশ-পাকিস্তানীদের লুটপাটের কারণে দরিদ্র হয়ে পড়া জনগণের আর্থিক স্বচ্ছলতা বর্তমানে বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার কমে আসলেও বিদেশে অর্থপাচারের মতো দুর্নীতি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশী নাগরিকদের পাচার ও জমা করা বিশাল অঙ্কের অর্থের খবর মাঝে মাঝেই প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। তবে এর প্রতিকার কিংবা অর্থ পাচাররোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপের খবর খুব কমই সাধারণ জনগণ জানতে পারে, যদিও এ সম্পদ দেশের সকল মানুষের। এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। নিজের জন্মভূমিকে বসবাসের অযোগ্য আখ্যায়িত করে যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে তারা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই তাদের সকলকে চিহ্নিত করে                   তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ও সর্বাত্মক  ব্যবস্থা গ্রহণ আজ সময়ের দাবি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন