বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫

বাংলার বুকে কোন্‌ ইসলাম চর্যা হবে???



বাংলার বুকে কোন্‌ ইসলাম চর্যা হবে???

শাহ্‌ সারফুল ইসলাম মাহমুদ ॥ ক্ষুধার্ত ভিখারী মসজিদে গিয়েছিল ‘শিন্নি’ (খাবার) পাওয়ার আশায়। ইমাম সাহেব তাকে জিজ্ঞেস  করেছিলেন ‘নামাজ পড়িস বেটা’। ভিখারী জবাবে না বলায় ইমাম সাহেব তাকে তাড়িয়ে দিয়ে ‘বন্ধ’ করে দিয়েছিলেন মসজিদের দরজা। ভিখারী ফিরে যেতে যেতে সখেদে বলেছিল আল্লাহর দরবারে - ‘আশিটা বছর কেটে গেল আমি ডাকিনি তোমায় প্রভু/ তাই বলে আমার ক্ষুধার অন্ন বন্ধ করনি কভু’। উপরের উদ্ধৃতি সাধক কবি নজরুলের কবিতার।
আল্লাহকে যে স্বীকার করছে, তাঁর বন্দনায় যে রত তাকে আল্লাহ যেমন লালন পালন করছেন, রক্ষা করছেন, যে আল্লাহর বন্দেগীতে নেই তাকেও তিনি অন্ন যোগাচ্ছেন। এমনকি যে আল্লাহকে স্বীকার করছে না, এই দুনিয়ায় তেমন কোটি কোটি মানুষ রয়েছে যাদের অন্নও তিনি বন্ধ করেননি! তাদেরও তিনি রক্ষা করছেন তার অনুগত বান্দাদের মতই একইভাবে!
জীবন্ত কুরআন আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা:) তাঁর বিরোধিতাকারী, এমনকি তাঁকে আক্রমণকারীদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ছিলেন না তিনি, হননকারীও ছিলেন না। তায়েফের ময়দানে বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা তাঁর জীবন সংশয় ঘটিয়েছিল তাদেরও তিনি ক্ষমা করে দিয়ে আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ক্ষমা ও করুণা প্রার্থনা করেছিলেন। এই ছিল আল্লাহর ধর্ম, এই ছিল নবী (সা:) পথ, এই হল কুরআনের শিক্ষা। এই ছিল, এই হল ইসলাম (শান্তি)। কিন্তু আজ বাংলাদেশে, ভারতবর্ষে, মধ্যপ্রাচ্যে, আফ্রিকায় বিশ্বের দেশে দেশে যা চর্চা হচ্ছে প্রশ্ন জাগে তা কোন - ইসলাম? পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান শহীদ হলেন গেল সপ্তাহে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার নিজ বাসভবনে। পীর হিসেবে পরিচিত খিজির খান সেখানে রহমতিয়া খানকা শরীফ পরিচালনা করতেন। তাঁকে জবাই করে হত্যার আভিযোগে গ্রেফতারকৃতরা পুলিশের কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে জানিয়েছে ‘ঈমান আকিদা’ পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকায় তারা খিজির খানকে খুন করেছে। জবাই করে খুন করলে সওয়াব বেশি তাই জবাই করে খুন করা। তারা এও বলেছে, যারাই পীরালি করবে তাদেরই তারা খুন করবে! কেবল খিজির খানই নয়, এর আগে আরো অনেককেই পীরালি বা মাজার দরবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় খুন হতে হয়েছে অতীতে। ওরসে মাজারে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটছে অনেক। দেশে, দেশ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ, রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত ছোট বড় লক্ষাধিক মাদ্রাসা। রয়েছেন পরিচিত-অপরিচিত ‘আলেম-ওলেমা খ্যাত’ নানান ডিগ্রী আর খেতাবধারী শত সহস্র ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। ধর্মের নামে এই নৃশংস খুন নিয়ে তাদের কোন বক্তব্য নেই! এ নিয়ে তারা নিশ্চুপ! অথচ কত না বিষয় নিয়ে রাজপথ কাঁপিয়ে, বক্তৃতা বিবৃতির ঝড় তুলে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করেন দেশবাসীর কাছে! প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় গণমাধ্যমের কল্যাণে তা নজরে আসে এমনকি বিশ্ববাসীরও! কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীদের খুন, ভিন্ন ভাবধারার মানুষের উপর পৈশাচিক আক্রমণ নিয়ে তাদের কোন বিবৃতি নেই! কাদিয়ানীদের অমুসলিম ফতোয়া দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গী জিহাদে পিছিয়ে নেই এরা। কিন্তু পাকিস্তানে, খোদ সৌদী আরবে শিয়া মুসলমানদের, এমনকি মসজিদের ভিতরে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনা ঘটে চললেও এদেশের কোন ইমাম, আলেম, ওলেমাদের এ নিয়ে কোন নিন্দা জ্ঞাপনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। প্রতিবাদ, মিছিল মিটিং তো দূরের কথা।
কিন্তু এর জবাব তো তাদের দিতে হবে এবং সরকারও এর দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারবে না যেহেতু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। দেশের ধর্মভীরু মুসলমানরা তো তাদের কাছে জবাব চাইবেই। তাদেরকে তো বলতেই হবে এই মানুষ খুন, পীর জবাই কোন্‌ ইসলামের মধ্যে পড়ে? পাকিস্তানী ইসলাম? সৌদি ইসলাম? পার্সিয়ান ইসলাম? তাদেরকে এও বলতে হবে মুহাম্মদী ইসলামে কোথায় বলা আছে পীরালি করলে জবাই করতে হবে? শিয়া, কাদিয়ানী, কুর্দি কিংবা সুন্নী এইসব মাজহাব কোন্‌ ইসলামের শিৰা? এই সব মাজহাব অনুসারীদের ভিন্নতার জন্য কতল করতে হবে কুরআনে কোথায় উল্লেখ আছে ?
প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসে আরও একটি প্রশ্ন। সেটি হচ্ছে, চাই বা না-চাই এই দেশটির রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আজ এরও ফায়সালা করার সময় এসেছে, রাষ্ট্রকে বেছে নেয়ার সময় এসেছে রাষ্ট্র তার ধর্ম হিসেবে বেছে নিবে কোন্‌ ইসলামকে? সৌদী ইসলাম? পাকিস্তানী ইসলাম? পার্সিয়ান ইসলাম? না মুহাম্মদী ইসলাম?
রাষ্ট্রের রয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়! এই মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে এ বিষয়টির নিষ্পত্তি করার। চাঁদ দেখা আর হজ্ব ব্যবস্থাপনা একটি মন্ত্রণালয়ের বড় কাজ হতে পারে না। রাষ্ট্রের ধর্ম সুস্পষ্ট করা, নাগরিকদের (মুসলিম  নাগরিক!) সেই ধর্মের পথে ধরে রাখা, সেই ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে সহযোগিতা দেয়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মৌল কর্তব্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। ধর্মের নামে রাষ্ট্রে খুনোখুনি চলবে, হানাহানি হবে; ধর্মের নামে জ্বালাও পোড়াও চলবে আর ধর্ম মন্ত্রণালয় নীরব দর্শক হয়ে রইবে তা শুধু অসাংবিধানিকই নয়, অধর্মও বটে।
ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠান চলবে, ধর্মের নাম করে জীবিকা চলবে অথচ ধর্ম কোন্‌টা, অধর্ম কোন্‌টা তার প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকা চলবে, এটাও ধর্মের মৌল চেতনার লঙ্ঘন কিনা এ প্রশ্ন উঠে আসবেই। অশান্তি সৃষ্টি করে, অশান্তি জিইয়ে রেখে, অশান্তি দশা দেখে শান্তি (ইসলাম) ধর্মের কথা বলা অনৈসলামিক কিনা সে প্রশ্নও উঠে আসার সময় এসেছে আজ।

বামপন্থী রাজনীতিকদের বোধোদয়!



সময়ের সাফ কথা....
বামপন্থী রাজনীতিকদের বোধোদয়!

সাগর সগীর ॥ ধর্মীয় মতাদর্শের বাইরে যে কয়েকটি মতাদর্শ পৃথিবীতে এসেছে তার মধ্যে পরীক্ষিত একটি হচ্ছে সাম্যবাদী মতাদর্শ। কমিউনিজম হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এই দর্শনটি মূলত ঊনবিংশ শতকে আবির্ভূত হলেও গোটা বিশ্বকে চিন্তায় ফেলেছিল বিশ শতকের গোড়ায়। দার্শনিক কার্লস মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস সূচিত এই মতাদর্শটি দুরদর্শী লেনিনের নেতৃত্বে বাস্তবায়নের পথে এগোয় রাশিয়ায়। গোটা বিশ শতক ধরে গোটা পৃথিবী জুড়ে ঝড় তোলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বলে পরিচিত এই মতাদর্শ। বাদ যায়নি ভারতবর্ষ, এই বাংলাদেশও। পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা তথা বৃহত্তর বঙ্গদেশ হয়ে ওঠে কমিউনিজমের উর্বর জমিন। তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে মেধাবী, সাহসী আর অগ্রসর অংশ ঝাঁকে ঝাঁকে সমবেত হয় বামপন্থী বলে পরিচিত কমিউনিজমের পতাকাতলে। কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে সঞ্চার করে আশা-ভরসা, জাগায় প্রত্যাশা আর বুনে যায় দেশ গড়ার স্বপ্নের বীজ।
সাম্যবাদী দর্শনের মূল কথা সাম্যের সমাজ, যা প্রতিষ্ঠিত হয় শোষণ বঞ্চনা বৈষম্যের অবসানের মধ্য দিয়ে; চূড়ান্তভাবে উৎপাদন যন্ত্রের, উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যক্তি মালিকানা বিলোপের মাধ্যমে। বিশের দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বহু সমাজতান্ত্রিক দেশ, সাধারণভাবে যা পরিচিত হয়ে উঠে ‘সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব’রূপে। শতাব্দীর গোড়াতে প্রতিষ্ঠিত এই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ঘটে শতাব্দীর শেষে এসে। একুশ শতকে এসে সেই বিশ্ব বাস্তবতা হচ্ছে অনেকটা ‘সেই রামও নেই, সেই অযোদ্ধাও নেই’! অর্থাৎ সেই পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নও নেই, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বও নেই! কিন্তু পৃথিবী থেকে কি শোষণ নেই? বঞ্চনা নেই? বৈষম্য নেই? সম্পদ বা উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিকানা নেই? উত্তর সবার জানা- এসবই আছে গোটা বিশ্ব জুড়ে; বরং আরো বেশি, আরো তীব্র, আরো প্রকট হয়ে! গোটা বিশ্বের মত এই উপমহাদেশে, এই বাংলাদেশেরও চিত্রও একই।
দূর রাশিয়ায়, দূর ইউরোপের কোন কোন দেশে কেন ভেঙে পড়লো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মুখ থুবড়ে কেন পড়ল ‘সাম্য যাত্রা’ তা গবেষকদের বিষয়, গভীর বিচার বিশ্লেষণ, বিপুল অর্থ আর সময় সাপেক্ষ ব্যাপার! অনেকটা ‘আদার ব্যাপারী-দশা থেকে জাহাজের খবর’ নেয়ার/দেয়ার মত। কিন্তু, এই উপমহাদেশে, বিশেষ করে এই বাংলাদেশে এত বৈষম্য, অত্যাচার অনাচার সত্ত্বেও এদেশের বামপন্থীরা কেন লাগাতার ব্যর্থতার চোরাবালিতে ডুবে রইলেন তা বুঝার জন্য গবেষক হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। প্রতীকীভাবে তা বুঝা যায় এদেশে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত একটি কথার সূত্র থেকে। বলা হতো এদেশের বামপন্থীরা ‘মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরেন’! অর্থাৎ, এদেশের বামপন্থীদের মগজ বন্ধক দেয়া ছিল মস্কো বা পিকিং (আজকের বেইজিং) এর নীতি নির্ধারকদের কাছে! সমালোচনাটির সত্যতা ধরা পড়লো যখন সোভিয়েতরাজের পতনের পর ধপাস করে নিভে গেল এদেশের বামপন্থীদের তেজ, টুকরো টুকরো হয়ে শক্তি হারালো বামশক্তি, বাম দলগুলো; দলবদল আর চরিত্র বদলের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে পড়লেন বাম নেতারা। দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ইউরোপ আর আমেরিকায় ঘোরাঘুরি করছেন নেতারা, আর কর্মীরা বিভিন্ন আন্দোলনের নামে রাজপথে নেমে গা গরম করছেন অহেতুক। হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্‌তি কর্মী - সংগঠক - সমর্থক শুভানুধ্যায়ী। অথচ শোষণ আজও অব্যাহত, লুণ্ঠন চলছে সমান তালে অথবা তার চেয়েও বেশি; বৈষম্য আরও প্রকট আরও বিকট - এদের মধ্যে বামেদের একাংশ বিদ্যমান ভোগে মোহাচ্ছন্নতায়! 
ফাঁকটা কোথায়? ফাঁকিটা কেন? ফাঁকি হচ্ছে আজকের বামপন্থী নেতারা নিজেরা যা বলেন নিজেরাই তা করেন না, বলায় আর করায় ফাঁকি। ফাঁক হচ্ছে এদেশের বামপন্থীরা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে, বাংলা আর বাঙালি চেনে না এমনকি বোঝেও না। যদিও বামপন্থী রাজনীতির আরেকটি পরিচয় ছিল ‘বস্তুবাদী দর্শন ভিত্তিক রাজনীতি’। এদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ আবেগ অনুভূতির বাইরে বাস্তবতা বিবর্জিত তাত্ত্বিক ঘোরের মধ্যে আবর্তিত তাদের চিন্তা ভাবনা, আচরণ-বিচরণ। এদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি সর্বোপরি এদেশবাসীর জীবন বাস্তবতার বাইরে বাম নেতা সংগঠকদের অবস্থা-অবস্থান। জনসম্পৃক্ততা নয় জনবিচ্ছিন্নতাই আজ বাম নেতা কর্মীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ত্যাগের নয় ভোগের স্রোতেই ভাসছেন তারা। ব্যতিক্রম হাতে গোণা যাও, পাওয়া যাবে তাদের ত্যাগও অবাস্তব জীবন যাপন আর রাষ্ট্র ও সমাজের মূল স্রোতধারার বাইরে সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ।
শোষণ বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন আজও সময়ের দাবি। সাম্যের প্রতিষ্ঠা কেবল নৈতিক বা মানবিক দাবিই নয়, সাংবিধানিক বাধ্য বাধকতাও বটে। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ সত্য প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত। এটাই বাস্তবতা এটাই সত্য। এদেশের বামপন্থী রাজনীতিকরা এই সত্য অনুধাবন করবেন কবে??

ধর্ম রাজনীতি কোন্‌ পথে??



ধর্ম রাজনীতি কোন্‌ পথে??


·        তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত রাখো। তুমি আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ করো যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। ৩০:৩০ - আল কুরআন।

·        ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই। ২:২৫৬ - আল কুরআন।

·        অবশ্য যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন কাজের  দায়িত্ব তোমার নেই, তাদের বিষয়ে আল্লাহর এখতিয়ার। আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদের জানিয়ে দেবেন। ৬:১৫৯ - আল কুরআন।
সংলাপ ॥ ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। ব্যক্তি জীবনে তার মতো করে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজে পায় মানুষ তার পছন্দের ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করে-নিজ নিজ ধর্মকে ব্যক্তি জীবনে ধারণ, লালন ও পালন করে। অপরদিকে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জীবনে কল্যাণ, তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার উপায় বাতলে দেয় যে নীতি তা-ই হচ্ছে রাজনীতি। ধর্ম ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে, রাজনীতি সমষ্টিকে ঘিরে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। ফলে দেখা গেছে ধর্ম যখনই রাজনীতির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে তখনই তা মুষ্টিমেয় নাগরিকের সংকীর্ণ স্বার্থের অনুকূলে গেছে, আর বিপক্ষে গেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্মীয় হানাহানিতে পৃথিবীটাতে যত মানুষের জীবন গেছে পৃথিবীর জায়গা দখলের যুদ্ধ বিগ্রহে প্রাণ হারিয়েছে তার চেয়ে অনেক কম মানুষ। এই ধর্মীয় হানাহানি যতটা না এক ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে অপর ধর্মের অনুসারীদের, তার চেয়ে বেশি হয়েছে একই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অন্তঃকলহে।  আর ইতিহাস এও বলে যে ধর্মের এই অ-ধর্মদশা তখনি দেখা গেছে যখন ধর্মব্যবসায়ী - মতলববাজরা ধর্মান্ধতার বিষাক্ত ধোঁয়ায় মানুষকে আচ্ছন্ন করে ধর্মকে টেনে এনেছে রাজনীতিতে - ধর্মকে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে নিছক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের প্রয়োজনে।
এই উপমহাদেশের-এমনকি এই দেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাস দেখলেই তা টের পাওয়া যায় হাড়ে হাড়ে। ধর্মের নামে, ইসলামের নামে ১৯৪৭ সালে ‘ঐতিহাসিক প্রতারণার’ মধ্যে দিয়ে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকরা সৃষ্টি করেছিল রাষ্ট্র ফাঁকিস্তান (কাগজে-পত্রে দলিলে যা পরিচিত ছিল পাকিস্তান বলে)। ধর্মের দোহাই দিয়েই ২৪ বছর পূর্ব বাংলার মানুষকে চরম শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছিল এই ফাঁকিস্তান রাষ্ট্রের মদ্যপ-মাতাল দুশ্চরিত্র পাকি জেনারেল আর শঠ রাজনীতিকরা। যার পরিণতিতে ঘটেছিল ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ; যে যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত লুন্ঠন করা হয়েছিল ইসলামের নামে, ঘৃণিত তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র ফাঁকিস্তান রক্ষার নামে।
যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে ঠকে এবং ঠেকে উচ্চমূল্যে কেনা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নীতি নির্ধারকরা তাই দেশের সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন যে নীতিটি তা প্রতিফলিত হয়েছিল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে। এতে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করা হয়, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। তবে শর্ত থাকে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা পক্ষানুযায়ী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করায় বা তার সদস্য হওয়ার বা অন্য কোন প্রকারে তার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকবে না।’
কিন্তু জাতির চরম দুর্ভাগ্য ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে ১৯৭৮ সালে সেনানায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানের এ-বিধানটি সংশোধন করে ধর্মের ভিত্তিতে সংগঠন করার অধিকার দেন। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, জিয়ার কেটে দেয়া এই খাল দিয়ে পাঁচ হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক এই বাংলার জনপদে ঢুকে পড়ে ধর্মান্ধতার ভয়াল সব কুমির, একে একে - যা অব্যাহত আছে আজও। এরই অনিবার্য পরিণতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে আচ্ছন্ন হতে হতে গোটা দেশ ধর্মান্ধতার বিষাক্ত নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হয় বাংলার সবুজ জমিন; ধর্মব্যবসায়ীদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র কবলিত হয়ে পড়েছে দেশের রাজনীতি, আর তারই উপজাত হিসাবে ঘুষ, দুর্নীতি, কালো টাকার স্রোতে ভাসছে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি।
সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি বন্ধে কমিশন ইতোমধ্যে যে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ নিয়ে এসেছে তার ৯০-সি (১/এ), ৯০ সি(১/বি), ও ৯০-সি (১/সি) ধারাসমূহ মুক্তিযুদ্ধের লুন্ঠিত চেতনা পুনরুদ্ধারে হয়ে উঠতে পারে মোক্ষম হাতিয়ার। এই গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ৯০-সি(১/এ) ধারায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্তে বলা হয়েছে যে, দলীয় গঠনতন্ত্রের উদ্দেশ্যসমূহ সংবিধানের পরিপন্থী হতে পারবে না। ৯০-সি (১/বি) ধারায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও লিঙ্গভেদে কোন বৈষম্য থাকতে পারবে না। ৯০-সি (১/সি) ধারায় বলা হয়েছে দলীয় নাম, পতাকা, চিহ্ন বা অন্য কোন কর্মকান্ড দ্বারা এমন কিছু করা যাবে না, যার মাধ্যমে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার কিংবা দেশকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যাবার আশংকা থাকে। উল্লেখ্য, ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলো এই অধ্যাদেশ-এর বিরুদ্ধে স্বাভাবিক কারণেই মারমুখি হয়ে উঠেছিলো, কিন্তু কোন ফল হয়নি। নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-এর যে উদ্যোগ নিয়েছে দেশবাসীর সামনে আজ তা এক বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও অপরাপর শক্তিসমূহকে এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে কোন রূপ ঝুঁকি না রেখেই। বিষয়টি কেবল প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তির কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না, দেশের সিংহভাগ ধর্মভীরু মুসলমানদের জন্য এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্মকে বার বার রাজনীতির প্রয়োজনে, ক্ষমতার স্বার্থে যে ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, টেনে আনা হয়েছে রাজনীতিতে, তা ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়, তাতে ধর্মই  কেবল বিতর্কিত হয়েছে। কলুষিত হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা; ধর্ম পরিচিত হয়ে পড়েছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের হাতিয়ার রূপে। আজ তাই সময় এসেছে ধর্মকে ধর্মের স্থানে, ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ধারণ-লালন ও পালনে আত্মিক উন্নতির বিষয় রূপে স্থান দিয়ে রাজনীতিকে ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্ত করার। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার পথ বন্ধ করার আজ তাই একটা মোক্ষম সময় এসেছে জাতির সামনে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় উপলব্ধি!



দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় উপলব্ধি!

সংলাপ ॥ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা জাতি উপলব্ধি করলেও দেশের পরিস্থিতি কেমন ছিলো এবং বর্তমানে কেমন আছে তা নিশ্চিত করেই পদক্ষেপ নিতে হবে রাজনীতিকদের।
অর্থনৈতিক দুর্নীতির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা। এখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এমন কোনো রাষ্ট্রীয় অঙ্গন পাওয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি নেই। মানুষের আত্মিক উৎকর্ষের জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা, সেখানেও প্রতিষ্ঠানের আপাদমস্তক বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।
রাজনীতিকদের এক বিরাট অংশের দুর্নীতি এখন আর গোপন নেই। রাষ্ট্রীয় টাকা খরচ করে দুর্নীতিবাজদের সাধুতে রূপান্তরিত করা যাবে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তাবিদরা চিন্তায় মগ্ন থাকতে পারেন। বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতিপরায়নতার কলঙ্ক নিয়ে আজও বিশ্বের বুকে একমাত্র সাহসী জাতি হিসেবে টিকে আছে বাঙালি।
এদেশে দুর্নীতির বিরোধী কাজ করার প্রভূত সুযোগ রয়েছে। প্রথমত মিথ্যা ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দুর্বার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। যেখানেই মিথ্যা ও মিথ্যাচার সেখানেই এলাকার সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে প্রতিরোধ করার জন্য। রাজনীতিকদের দুর্নীতির মূলোৎপাটন সম্ভব না হলেও এর বিপক্ষে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিরোধটা কিভাবে গড়ে তোলা সম্ভব এবং এ রোগের উৎপত্তি কোথায় ও কিভাবে এ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা-সমালোচনা অনেক করা যায়। কেউ কেউ বলেন, রাজনীতিই সমাজকে দুর্নীতিমগ্ন করেছে। আবার কারো কারো মতে আমলাতন্ত্র, আবার অনেকে দায়ী করেন শিক্ষাব্যবস্থাকে। আদর্শহীন শিক্ষিত লোকেরা সমাজের যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই চলছে চরম অনৈতিকতা। বাংলাদেশের সামাজিক বর্তমান অবস্থায় দুর্নীতি বা নীতিহীনতার প্রসার নানা দিক থেকেই ঘটে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আমলা নাকি রাজনৈতিক সমাজ বেশি দুর্নীতিবাজ-এর হিসাব বের করাও কঠিন। বাস্তবে দুর্নীতিবাজ আমলা এবং একই মনোবৃত্তির রাজনীতিক-এরা পরস্পর ভাই-ভাই। সরকারি আমলাদের সাহায্য ছাড়া ক্ষমতাবান রাজনীতিক দুর্নীতি করতে পারেন না। আবার ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের প্রশ্রয় কিংবা দুর্বলতা ছাড়া কোনো আমলার পক্ষে দুর্নীতি করে পার পাওয়া সম্ভবপর হতে পারে না। অপরদিকে আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যে আদর্শ ও নীতিভ্রষ্ট এবং দক্ষ মানুষ তৈরির মোটেও উপযোগী হয়ে উঠেনি সে কথা বিদেশে গিয়ে বাঙালিদের অবস্থা স্ব-চোক্ষে দেখলে উপলব্ধি করা যায়।
বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে বাজেট করতে হবে । নতুন প্রজন্মকে আদর্শিক শিক্ষায় ব্রতী করে গড়ে তোলার জন্য আদর্শিক শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীগণ যারা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত তাদের প্রতি সরকারের কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ব্যক্তির নৈতিক উৎকর্ষ সাধন। উপমহাদেশীয় পৌরাণিক শিক্ষাতত্ত্বে ন্যায়শাস্ত্রই শিক্ষার মূল বলে বিবেচনা করা হয়েছে। আর এই ন্যায়শাস্ত্র সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতার দিকটি এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। এ অবস্থায় নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে মোটাদাগে দায়ী করা যায়। মূলে দোষ শিক্ষা ব্যবস্থারই হোক আর আমলাতন্ত্রেরই হোক, রাজনীতিকদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। রাজনীতি এবং অর্থনীতির সাথে ন্যায়শাস্ত্রের নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। ইংরেজিতে পলিটিক্‌ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে বিচক্ষণ অর্থে। কাজেই যারা রাজনীতি করেন তাদের বিবেক ও প্রজ্ঞা-বিবর্জিত হওয়ার সুযোগ নেই। পৃথিবীর সব দেশেই রাজনীতি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের আমলাতন্ত্র কিভাবে চলবে, শিক্ষা ব্যবস্থা কি রকম হবে - রাজনৈতিক সমাজই তা নির্ধারণ করেন।
কাজেই রাজনীতি সংশোধিত হয়ে আদর্শিক না হলে, রাজনীতিকরা প্রজ্ঞাবান না হলে, কর্মে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারলে- একটি দেশ, একটি সমাজ কোনোমতেই সুগঠিত এবং সুন্দর হয়ে উঠতে পারে না। প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রতিটি সমাজের মধ্যে ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা দু’টোর প্রবণতাই বিদ্যমান। এটা প্রকৃতিরই নিয়ম। সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা সব সময়ই সত্য ও  নীতি-নৈতিকতায় দৃঢ়। পক্ষান্তরে কিছু লোক থাকে মিথ্যা ও অনৈতিক প্রবণতা যাদের প্রবল। এই বাস্তবতায় সমাজের আসল চেহারাটি কি রকম হবে, সেটা নির্ভর করে কারা সমাজের বা রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার ভার নিয়ে দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করছে। নীতিহীনরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা না বুঝে শুধুমাত্র নীতিবানদের মুখোশ পরে  শাসন করলে সমাজে অনৈতিকতার শক্তিই প্রবল হবে। পক্ষান্তরে নৈতিকশক্তিতে যারা বলীয়ান তারা সমাজ ব্যবস্থাপনায় দৃঢ় প্রত্যয়ী হলে দুর্নীতির শক্তি অবদমিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজে কোন শক্তি প্রবল হবে-সেটা অবশ্যই নির্ভর করে রাজনৈতিক সমাজের আদর্শ, নৈতিকতা ও সৎ সাহসের সঙ্গে দেশের আপামর জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ওপর। একই সঙ্গে প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। আইনের শাসন কায়েম, জবাবদিহিতা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্য প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কিছু রয়েছে সাংবিধানিক, কিছু প্রশাসনিক। বেসরকারি পর্যায়েও আছে অনেক প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক দলগুলো একেকটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের নিজ এখতিয়ারের মধ্যে নিয়মানুযায়ী দায়িত্ব পালনের পথে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে ফলে সমাজে অনৈতিকতার স্রোত প্রবল ও নির্বিঘ্ন।
বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক বিভাগ তথা প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে রাখার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে রাজনীতিকদের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশে বিগত সাড়ে তিন দশকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরাই হীনবল করে দিয়েছেন। তারাই শিক্ষা ব্যবস্থার মূলে আঘাত করেছেন ছাত্র এবং শিক্ষকদের দলীয় নীতিহীন রাজনীতিতে টেনে এনে। তারাই পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়ালে পরিণত করেছেন দলীয়করণের মাধ্যমে। তারা নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেননি। প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে ওঠেছিল ক্ষমতাসীন দলেরই বাড়তি অংশ যদিও এসব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নীতি নির্ধারণী সর্বোচ্চ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। দুঃখের বিষয়, ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশে এসব নীতি ও নৈতিকতার ধার ধারেন নাই। আমলাদের তারা ব্যবহার করেছেন ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে। তারাই সংসদকে পরিণত করেন নেতা বা নেত্রীর বন্দনা এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে অমার্জিত বাক্যবান নিক্ষেপের অবাধ কেন্দ্রে যেহেতু দেশাত্ববোধ ও দেশপ্রেম তাদের উপলব্ধিতে জায়গা পায়নি। তাই একটু একটু করে সমাজের সর্বত্র বাসা বেঁধেছে নিয়মের জায়গায় অনিয়ম। অনিয়মের প্রাবল্যে দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে স্থায়ী রূপ নেয়ার পথে। রাজনীতিকদেরই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলার সময় এসেছে যে রাজনৈতিক সমাজই কেবল পারে সকল পর্যায়ে দুর্নীতির পথ ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিতে। কাজেই রাজনীতির অঙ্গনকে মিথ্যা ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংস্কার-সংশোধন ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ বা কমানো যাবে এমন চিন্তা করা বা বলা হলে তা হবে শুভংকরের ফাঁকি।

নির্বাচন নয় অধিকার আদায়



নির্বাচন নয় অধিকার আদায়

আমি সত্য দিয়ে মিথ্যার ওপর আঘাত হানি; আমি মিথ্যাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেই আর তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দুর্ভোগ তোমাদের, তোমরা যা বলছ তার জন্য! ২১:১৮ - আল কুরআন।
সংলাপ ॥ নির্বাচন চাই না! কি হবে নির্বাচনে! কে নির্বাচন করবে? কাকে নির্বাচন করবে? সেই তো তারাই, বারবার ঘুরে ফিরে নাম, চেহারা বদল করে তারাই তো আসছে - গণতন্ত্রের নামে, ধর্মের নামে, জাতীয়তার নামে। সেই দুর্বৃত্তেরা, ঘুষখোর, মজুদদার, ঠিকাদার, দেশ লুটেরারা ও আধিপত্যবাদের দেশীয় এজেন্টরা। নির্বাচন মানেই তো তাদের ওঠানামা। তাদেরকে অবাধ লুটের আর একদফা লাইসেন্স দেয়া - নির্বাচন মানেই মিথ্যার বেসাতি করে সংসদ দখল করা। কাজেই নির্বাচন বাংলাদেশে আর কি প্রয়োজন আছে? ভোটের জন্য ভোটারদের আকুতির আর প্রয়োজন নেই। রাজনীতিক সমাজের সমস্ত কর্মকান্ডই জনতাকে ধোঁকা দেয়ার নাটক মাত্র। এখানে জনসাধারণের মতামত অর্থহীন।
আগামী নির্বাচনও তাইই হবে। আজ যারা নির্বাচনে না যাওয়ার বা অবিলম্বে নির্বাচনের জন্য হুমকি-ধামকি দিচ্ছে তাদের পেট মোড়ানী বেশি দিন চলবে বলে আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কারণ, প্রত্যেকেরই প্রভু আছে। তারা তাদের প্রভুভক্ত প্রভুদের আদেশ-নির্দেশ-উপদেশেই নির্বাচন করে। রাজনীতি কে করে? চোর, ডাকাত, খুনী, ধর্ষক, মিথ্যেবাদী, ভন্ড ও পাপিষ্ঠ রাজনীতিক ও অবসরপ্রাপ্ত আমলারাই রাজনীতির মাঠ দখল করে আছে। দুর্নীতিবাজ প্রশাসক, বর্বর, ধর্মধারীদের তাই গণতন্ত্রের মোড়কে রাজনীতিই প্রিয়। তারা দেশ চেনে না-মানুষ চেনে না-মানবতা চেনে না। তারা শুধু চেনে অর্থ, ভোগ এবং ক্ষমতা। যে আছে বা আসবে তাদের চেহারা যতই ভিন্ন হোক তাদের শতকরা নব্বই ভাগের তো একরৈখিক চরিত্র। ক্ষমতায় গিয়ে কয়জন এই দেশটিকে গণতন্ত্রের নামে গণ অর্থসম্পদ লুট করেনি! কয়জনের মধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে? ভালোবাসা আছে, শ্রদ্ধা আছে? আজকের নব্বই শতাংশ রাজনীতিকরা ক্ষমতার কামনা-বাসনার একদলভুক্ত। তাদের অন্য কোনো মানসিকতা নেই। তারা নিজেদের অস্তিত্বের বাইরে জনগণের অস্তিত্ব অনুভব করে না।
তাদের কোনো লিঙ্গ নেই, তারা পুরুষ কিংবা নারী হয় না, তাদের কোনো জাত নেই, শ্রেণী নেই, পেশা নেই। তাদের একটি মাত্র পরিচয় তারা ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিক। তাদের একটিমাত্র ভাষা, দুর্বৃত্তায়নের ভাষা ‘মিথ্যাচারিতা’ - দেশ-কাল-সময় তাদের জন্য বিবেচ্য নয়। ষড়যন্ত্র করে ধর্মের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে যে কোনো সময় তাদের বিস্তার ঘটাতে পারে। সাধারণ মানুষের প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রিত হয় বটে কিন্তু কখনোই তারা নিঃশেষ হয়ে যায় না। এখন সেই রাজনীতিকদের মিথ্যাচারিতার চূড়ান্ত বিস্তারময় সময়ের মধ্যে এই দেশের জনমানুষ ধুঁকছে।
মিথ্যার বিস্তার ঘটেছে-সর্বময় বিস্তার। বাথরুম থেকে বেডরুম। ফুটপাথ থেকে রাজপথ। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বনিম্ন বিচারালয় থেকে সর্বোচ্চ বিচারালয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে সাংসদ। ধর্মালয় থেকে জাতীয় সংস্কৃতি। খেলার মাঠ থেকে চিকিৎসালয়। সর্বত্রই মিথ্যাচার আর মিথ্যুকদের দাপট। মানুষ মূল্যহীন - মনুষত্ব অর্থহীন। জনমানুষের কোনো স্রষ্টা নেই!
আল্লাহ্‌ মিথ্যাবাদীদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না, তা তিনি পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেন কুরআনুল করিমে। যারা ন্যায়কে ধারণ করে না, সমস্ত অন্যায়, অমানবিকতা ও মিথ্যাচারের সাথে জীবন সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে তাদের ধর্মানুষ্ঠান দাড়ি-টুপি-জোব্বায় কিছু যায় আসে না! তাদের হজ্ব-যাকাত আর মসজিদের নামাজ পড়ার আনুষ্ঠানিকতায় বিভ্রান্ত হওয়াটা মূর্খতা। মূর্খের সাথেও আল্লাহ্‌ থাকেন না! স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সময় এসেছে।
সুতরাং কোনো নির্বাচন বা কি সংস্কার হলো তাতে জাতির কিছু যায় আসে না। চুয়াল্লিশ বছর ধরে অধিকাংশ ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকরা  প্রমাণ করেছে তারা কোন্‌ দলে। তারা দেশের জনমানুষের জন্য কেউ নয়, কখনো ছিলোও না। একাত্তরের যুদ্ধের ফাঁক দিয়েই এরা সৃষ্ট, আর আজ তাদের লক্ষ্য একটিই- ওই লুটপাটের রাজত্ব কায়েম রাখা। সুতরাং, নির্বাচনে বাংলার প্রতিটি জনপদে গর্তে লুকানো সাপেরা আবার বের হবে। ছোবল খাবে সাধারণ মানুষ। বিপন্ন হবে তাদের জীবন। নিপতিত হবে যন্ত্রণা-নির্যাতনের আর এক ঘনকালো অন্ধকার রাত্রিতে।
অতীত অভিজ্ঞতায় কি এটা প্রমাণিত নয় - নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কারা? নির্বাচিত হয় কারা? কাদের হাতে সমস্ত মানুষ বন্দি হয়ে পড়ে? কোন্‌ বিদেশী প্রভুদের সেবাদাস এরা? কারা এদেশের অর্থ-সম্পদ-মেধাকে পাচার করে? কারা নির্বাচন নামের নামের সুযোগ নিয়ে দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত করে দলীয় দুর্বৃত্তায়িত স্বৈরশাসনের বর্বরতা চাপিয়ে দেয় দেশবাসীর উপর? কাদের কালো টাকার দাপটে জনমানুষের জীবন প্রতিমুহূর্তে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হচ্ছে?
কাজেই নির্বাচন? না, অধিকার আদায়ের জন্য সামাজিক আন্দোলন! সবকিছু ভেঙ্গেচুরে সাজাবার আন্দোলন! জনমানুষের সকল অধিকার ফিরিয়ে আনবার আন্দোলন। একেবারে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল অব্দি জেগে উঠতে হবে সকল মানুষকে।  জেগে উঠতে হবে সারা দেশের  জনমানুষকে। আর ঘুমাবার সময় নেই। অনেক হয়েছে। অন্ধকার আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জ, শহরকে আজ জেগে উঠতে হবে। বাঙালির দু’টি হাত যে কোনো কামান বন্দুকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। জনমানুষকেই হিসেব নিতে হবে। দখলদার আর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও কর্মকর্তাদের বিচারের ভার তাদেরকেই নিতে হবে। অফিস আদালত থেকে টেনে বের করে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে আইন অমান্যকারী এবং রাজনীতির অসৎ সেবাদাসদেরকে।
এর কোনো ভিন্ন পথ খোলা নেই জাতির জন্য। নির্বাচন এখন আর কোনো পথ নয়। এর সমস্ত প্রক্রিয়াই ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের দখলে। সত্য, সুন্দর বাংলার যুগোপযোগী গণতন্ত্র মিথ্যাচারের কাছে অর্থহীন। সংস্কার! কোনো সংস্কারই এই দানবীয় স্রোতকে প্রতিরোধ করতে পারলো না। আর পারবে না। সময় এখন আর বাঙালির হাতে নেই। সর্বাত্মক আন্দোলনের পথেই যেতে হবে সত্যের ধ্বজা নিয়ে।