বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫

বাংলার বুকে কোন্‌ ইসলাম চর্যা হবে???



বাংলার বুকে কোন্‌ ইসলাম চর্যা হবে???

শাহ্‌ সারফুল ইসলাম মাহমুদ ॥ ক্ষুধার্ত ভিখারী মসজিদে গিয়েছিল ‘শিন্নি’ (খাবার) পাওয়ার আশায়। ইমাম সাহেব তাকে জিজ্ঞেস  করেছিলেন ‘নামাজ পড়িস বেটা’। ভিখারী জবাবে না বলায় ইমাম সাহেব তাকে তাড়িয়ে দিয়ে ‘বন্ধ’ করে দিয়েছিলেন মসজিদের দরজা। ভিখারী ফিরে যেতে যেতে সখেদে বলেছিল আল্লাহর দরবারে - ‘আশিটা বছর কেটে গেল আমি ডাকিনি তোমায় প্রভু/ তাই বলে আমার ক্ষুধার অন্ন বন্ধ করনি কভু’। উপরের উদ্ধৃতি সাধক কবি নজরুলের কবিতার।
আল্লাহকে যে স্বীকার করছে, তাঁর বন্দনায় যে রত তাকে আল্লাহ যেমন লালন পালন করছেন, রক্ষা করছেন, যে আল্লাহর বন্দেগীতে নেই তাকেও তিনি অন্ন যোগাচ্ছেন। এমনকি যে আল্লাহকে স্বীকার করছে না, এই দুনিয়ায় তেমন কোটি কোটি মানুষ রয়েছে যাদের অন্নও তিনি বন্ধ করেননি! তাদেরও তিনি রক্ষা করছেন তার অনুগত বান্দাদের মতই একইভাবে!
জীবন্ত কুরআন আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা:) তাঁর বিরোধিতাকারী, এমনকি তাঁকে আক্রমণকারীদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ছিলেন না তিনি, হননকারীও ছিলেন না। তায়েফের ময়দানে বিশ্বাসঘাতকতা করে যারা তাঁর জীবন সংশয় ঘটিয়েছিল তাদেরও তিনি ক্ষমা করে দিয়ে আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ক্ষমা ও করুণা প্রার্থনা করেছিলেন। এই ছিল আল্লাহর ধর্ম, এই ছিল নবী (সা:) পথ, এই হল কুরআনের শিক্ষা। এই ছিল, এই হল ইসলাম (শান্তি)। কিন্তু আজ বাংলাদেশে, ভারতবর্ষে, মধ্যপ্রাচ্যে, আফ্রিকায় বিশ্বের দেশে দেশে যা চর্চা হচ্ছে প্রশ্ন জাগে তা কোন - ইসলাম? পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান শহীদ হলেন গেল সপ্তাহে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার নিজ বাসভবনে। পীর হিসেবে পরিচিত খিজির খান সেখানে রহমতিয়া খানকা শরীফ পরিচালনা করতেন। তাঁকে জবাই করে হত্যার আভিযোগে গ্রেফতারকৃতরা পুলিশের কাছে প্রদত্ত জবানবন্দীতে জানিয়েছে ‘ঈমান আকিদা’ পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকায় তারা খিজির খানকে খুন করেছে। জবাই করে খুন করলে সওয়াব বেশি তাই জবাই করে খুন করা। তারা এও বলেছে, যারাই পীরালি করবে তাদেরই তারা খুন করবে! কেবল খিজির খানই নয়, এর আগে আরো অনেককেই পীরালি বা মাজার দরবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় খুন হতে হয়েছে অতীতে। ওরসে মাজারে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটছে অনেক। দেশে, দেশ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ, রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে পরিচিত ছোট বড় লক্ষাধিক মাদ্রাসা। রয়েছেন পরিচিত-অপরিচিত ‘আলেম-ওলেমা খ্যাত’ নানান ডিগ্রী আর খেতাবধারী শত সহস্র ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। ধর্মের নামে এই নৃশংস খুন নিয়ে তাদের কোন বক্তব্য নেই! এ নিয়ে তারা নিশ্চুপ! অথচ কত না বিষয় নিয়ে রাজপথ কাঁপিয়ে, বক্তৃতা বিবৃতির ঝড় তুলে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করেন দেশবাসীর কাছে! প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় গণমাধ্যমের কল্যাণে তা নজরে আসে এমনকি বিশ্ববাসীরও! কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীদের খুন, ভিন্ন ভাবধারার মানুষের উপর পৈশাচিক আক্রমণ নিয়ে তাদের কোন বিবৃতি নেই! কাদিয়ানীদের অমুসলিম ফতোয়া দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গী জিহাদে পিছিয়ে নেই এরা। কিন্তু পাকিস্তানে, খোদ সৌদী আরবে শিয়া মুসলমানদের, এমনকি মসজিদের ভিতরে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনা ঘটে চললেও এদেশের কোন ইমাম, আলেম, ওলেমাদের এ নিয়ে কোন নিন্দা জ্ঞাপনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। প্রতিবাদ, মিছিল মিটিং তো দূরের কথা।
কিন্তু এর জবাব তো তাদের দিতে হবে এবং সরকারও এর দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারবে না যেহেতু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। দেশের ধর্মভীরু মুসলমানরা তো তাদের কাছে জবাব চাইবেই। তাদেরকে তো বলতেই হবে এই মানুষ খুন, পীর জবাই কোন্‌ ইসলামের মধ্যে পড়ে? পাকিস্তানী ইসলাম? সৌদি ইসলাম? পার্সিয়ান ইসলাম? তাদেরকে এও বলতে হবে মুহাম্মদী ইসলামে কোথায় বলা আছে পীরালি করলে জবাই করতে হবে? শিয়া, কাদিয়ানী, কুর্দি কিংবা সুন্নী এইসব মাজহাব কোন্‌ ইসলামের শিৰা? এই সব মাজহাব অনুসারীদের ভিন্নতার জন্য কতল করতে হবে কুরআনে কোথায় উল্লেখ আছে ?
প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসে আরও একটি প্রশ্ন। সেটি হচ্ছে, চাই বা না-চাই এই দেশটির রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আজ এরও ফায়সালা করার সময় এসেছে, রাষ্ট্রকে বেছে নেয়ার সময় এসেছে রাষ্ট্র তার ধর্ম হিসেবে বেছে নিবে কোন্‌ ইসলামকে? সৌদী ইসলাম? পাকিস্তানী ইসলাম? পার্সিয়ান ইসলাম? না মুহাম্মদী ইসলাম?
রাষ্ট্রের রয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়! এই মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে এ বিষয়টির নিষ্পত্তি করার। চাঁদ দেখা আর হজ্ব ব্যবস্থাপনা একটি মন্ত্রণালয়ের বড় কাজ হতে পারে না। রাষ্ট্রের ধর্ম সুস্পষ্ট করা, নাগরিকদের (মুসলিম  নাগরিক!) সেই ধর্মের পথে ধরে রাখা, সেই ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে সহযোগিতা দেয়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মৌল কর্তব্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। ধর্মের নামে রাষ্ট্রে খুনোখুনি চলবে, হানাহানি হবে; ধর্মের নামে জ্বালাও পোড়াও চলবে আর ধর্ম মন্ত্রণালয় নীরব দর্শক হয়ে রইবে তা শুধু অসাংবিধানিকই নয়, অধর্মও বটে।
ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠান চলবে, ধর্মের নাম করে জীবিকা চলবে অথচ ধর্ম কোন্‌টা, অধর্ম কোন্‌টা তার প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকা চলবে, এটাও ধর্মের মৌল চেতনার লঙ্ঘন কিনা এ প্রশ্ন উঠে আসবেই। অশান্তি সৃষ্টি করে, অশান্তি জিইয়ে রেখে, অশান্তি দশা দেখে শান্তি (ইসলাম) ধর্মের কথা বলা অনৈসলামিক কিনা সে প্রশ্নও উঠে আসার সময় এসেছে আজ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন