শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৫

জড়িয়ে গেছে জীবন সরু মোটা দুই তারে



সময়ের সাফ কথা....
জড়িয়ে গেছে জীবন সরু মোটা দুই তারে

সংলাপ ॥ অনেকে সরু-মোটা সমস্যাটির সমাধান করতে চান সরু তারটি ছিঁড়ে দিয়ে। কিন্তু সেটি সার্থক সমাধান নয়; মোটা তারটিকে সরু তারটির উপযুক্ত করে তোলাই সার্থক সমাধান। সমাজব্যবস্থাকে এমন সুশৃঙ্খল করা দরকার যেন তা সুকুমার জীবনের অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়। তাহলেই আমরা উপলব্ধি করব, ‘যোগ্যতমের উর্র্দ্ধতন’ - নীতি অতীত কালের মন্ত্র, আর পেছনে ফেলে আসা প্রাণীযুগের মন্ত্র আওড়িয়ে লাভ নেই, লাভ বর্তমান জীবনের মন্ত্র আওরিয়ে; আর তা হচ্ছেঃ সুন্দরের বিকাশ। সম্মুখের মন্ত্র আমাদের সম্মুখে টেনে নিক, অতীতের মন্ত্র অতীত হয়ে যাক।
প্রেম, সৌন্দর্য্য ও আনন্দই মানুষের মধ্যে মূল্যবান, তাই এদের জয় মনুষ্যত্বেরই জয়, আর এদের সঙ্গে যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন নীতির বৈরিভাব সুবিদিত। জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বাদ পেতে হলে এই সর্বনাশা নীতির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া চাই; নইলে তা মাধ্যাকর্ষণের মতোই আমাদের ইতর জীবনে আবদ্ধ করে রাখবে, উপরে উঠতে দেবে না।  সুন্দরের বিকাশ-এই মন্ত্র ঊর্ধ্বাকর্ষণের মন্ত্র - তা পঙ্কিল জীবন থেকে ঊর্ধ্বে টেনে নিয়ে আমাদের আত্মিক ক্রমবিকাশে সহায়তা করবে। এরই টানে বর্বরতামুক্ত হয়ে আমরা সভ্য হয়ে উঠব। আর এই সভ্যতায় শান্তি পাব যা মানুষের শ্রেষ্ঠ কাম্য।
সভ্যতার জন্য কল্যাণসৃষ্টি একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু তাই বলে কল্যাণই সভ্যতা নয়; তা সভ্যতার পাদপীঠ মাত্র। কল্যাণ প্রাণী-সত্তার ব্যাপার, আর রূপ-রস মানবসত্তার। তাই রূপ ও রসের দিকে দৃষ্টি না রেখে কল্যাণ সৃষ্টির সাধনা করলে শেষ পর্যন্ত তা অন্ধগলি হয়ে দাঁড়ায়। রূপ ও রসের সাধনাই মনুষ্যত্ব তথা সভ্যতার সাধনা। কল্যাণের সাধনা তার সহায়ক, তার বেশী কিছু নয়। রূপলোক ও রসলোকে আমাদের উন্নত করতে পারে শিক্ষা। তাই শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য, এবং সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য অন্তরের চোখ ও রসনা সৃষ্টি করা। যেখানে তা হয়নি সেখানে শিক্ষা ব্যর্থ। মনুষ্যত্বের সাধনা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনা, আর প্রেম-সৌন্দর্য্যের ও আনন্দের তাগিদেই আমরা লঘুভার হতে পারি। শিক্ষা আমাদের এই প্রেম, সৌন্দর্য্য ও আনন্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মনুষ্যত্বের সাধনায় তথা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনায় সহায়তা করে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর রূপ ও রসের জন্য কল্যাণ, কল্যাণের জন্য রূপ ও রস নয়, এই বোধ থাকে না বলে শিল্প সাহিত্যের এত অপব্যবহার ঘটে। শিক্ষার কাজ সেই মানুষটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া।
প্রাণীমানুষটির চেয়েও যে একটা বড় মানুষ আমাদের জীবনে রয়েছে, তাকে না জানলে মনুষ্যত্বকে জানা হয় না। শিক্ষা আমাদের এই সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে সচেতন রাখে, কিন্তু তাই বলে যে তা আমাদের একেবারে আলাদা করে রাখে, তা নয়। শিক্ষার ফলে আমরা জানি ঃ রস ও সৌন্দর্য্যের দরুণ আমরা প্রকৃতি-জগৎ তথা তরুলতা ও প্রাণীজগত থেকে আলাদা আবার রস সৌন্দর্য্যের তাগিদে তার সঙ্গে বাঁধা, কেননা প্রকৃতি-জগতের সঙ্গে আত্মীয়তা উপলব্ধি করতে না পারলে সৌন্দর্য্য ও আনন্দ লাভ করা যায় না। জীবন-বৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোটে, তাই মনুষ্যত্ব। বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালতে হবে এই ফুলের দিকে লক্ষ্য রেখে। শুধু শুধু মাটির রস টেনে গাছটা মোটা হয়ে উঠবে এই ভেবে কোন মালী গাছের গোড়ায় জল ঢালে না। সমাজব্যবস্থাকেও ঠিক করতে হবে মানুষকে খাইয়ে-দাইয়ে মোটা করে তোলবার জন্য নয়, মানুষের অন্তরে মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য্য, প্রেম  ও আনন্দ সম্বন্ধে চেতনা জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্য। যখন এই চেতনা মানুষের চিত্তে জাগে তখন এক আধ্যাত্মিক সুষমায় তার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, - এবং তারি প্রতিফলনে সমস্ত জগত আনন্দময় হয়ে দেখা দেয়। ফলে মানুষ ইতর জীবনের গুরুভার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে হালকা মনে করে।
যেখানে কামনা-প্রেমে প্রভেদ করা হয় না, সত্যে সত্যে প্রভেদ অস্বীকৃত থাকে; অর্থাৎ নিম্নস্তরের সত্য ও উঁচুস্তরের সত্য বলে কোন জিনিস থাকে না, যেখানে মুড়িমিছরির একদর, সেখানে সভ্যতার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। আর যেখানে এর বিপরীতটি ঘটে সেখানে তা মুক্ত, স্বাধীন অবাধগতি। তার চলার ভঙ্গীতে ঝলমল করে ওঠে মানুষের দেহমন, হালকা হয়ে যায় জীবনের গুরুভার। সত্যের স্তরভেদে সভ্যরা বিশ্বাসী; তারা জানে সমাজগঠনের নীতি সত্য, জীবনগঠনের নীতি সত্য এবং পরম সত্য তাই সমাজগঠনের নীতিকে যে মূল্য দেয়া উচিত তাই তারা দেয়, কিন্তু কখনো তাকে জীবনগঠনের নীতির মর্যাদা দেয় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন