রবিবার, ২২ মে, ২০১৬

সবই যেন কানার হাট বাজার!



সবই যেন কানার হাট বাজার!
 
নজরুল ইশতিয়াক ॥ কোন্ বাস্তবতা - কোন্ অলংঘনীয় বিধান ও কোন্ সক্ষমতার জায়গা থেকে স্বাধীনতার চার দশক পরে এসে একাত্তরে মানবতা বিরোধী ঘাতকদের বিচার হচ্ছে। দায় মোচনের অনিবার্যতা কেন দেখা দেয় এবং ক্ষমতাধরেরাও শেষ পর্যন্ত কেন বিচারের মুখোমুখি হয়। এ সবই গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। ঘাতক খুনিরা যতই ডালপালা শেকড় বাকড় গেড়ে বসুক না কেন যতই কলা কৌশল অপকৌশল রপ্ত করুক না কেন প্রতিফল ভোগ করতেই হয়। পবিত্র কুরআন বিকৃত করে স্বরচিত মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে আপন বাসনা থেকে জাতি বিনাশী মানবতা বিরোধী কোন অপকর্ম যারা করেন এবং করবেন তাদেরকে জীবদ্দশায় তার প্রতিফল ফিরিয়ে দেখানো হয়। মহান করুনাময় স্রষ্টার এই বিধান লংঘিত হয় না। প্রকৃতপক্ষে সব অপরাধের বিচার হয় এবং অপরাধীরা বিচারের মুখোমুখি হবেই। সব অপরাধীর সব ঘাতকদের সব নষ্ট ভ্রষ্ট খুনি লুটেরা চক্রের শেকড় কাটা পড়ে। বস্তুত এদের শেকড় উপড়ে ফেলার এই ঘোষনা পবিত্র কুরআনের। পবিত্র কুরআন ঘোষনা করছে এদের শেকড় কাটা। বাইরে থেকে এদের শেকড় ডালাপালা যত বিস্তৃই দেখাক না কেন এরা বড়ই পরগাছা এদের শেকড় মাটির গভীরে পৌঁছায় না। মাটি, পানি, বাতাস এদেরকে স্থান দেয় না। এরা খড়কুটো পরগাছা। যতটুকু ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে তা কেবলই কোন মহাজনের দয়া-দাক্ষিন্যে আর তথাকথিত দেশপ্রেমিক ঈমানদারদের ধরি মাছ না ছুঁই পানি-র অবস্থানের কারণে। প্লাষ্টিকের বৃক্ষের মত এসব বৃক্ষের কোন শেকড় নেই, কোন সুগন্ধি বিলায় না। সৌন্দর্যহীন। পবিত্র কুরআন আরো ঘোষণা করেছে এরা মোনাফিক। এরা সরলের সাথে গরল মিশিয়ে দেয়। সত্যের সাথে মিথ্যা জড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে। এরা সুষ্পষ্টভাবে বিভাজন সৃষ্টিকারী বিভেদ ও অশান্তির উদগাতা। এরা কাফির। মূক, অন্ধ, বধির। এদেরকে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে, এরা দেখতে পায় না স্রষ্টার সৌন্দর্য। এদের সব অনুসরণকারী অনুকরণকারীরাও একই পথে চলছে। এদেরকেও একদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। সেই বিচার হবে দেশ ও জাতি হত্যার দায়ে, সেই বিচার হবে মানবিক মর্যাদাকে ভুলুন্ঠিত করার অভিযোগে, সেই বিচার হবে পবিত্র ইসলামের শান্তির আহ্বান আবেদনকে ভুল ব্যাখ্যা করার দায়ে। ধর্মকে পুঁজি করে ধান্দাবাজী করা, লুটপাট করা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা সহজ সরল মানুষকে প্রতারণা আর সব শুভ কল্যাণ প্রচেষ্টাকে বাধা দেয়ার জন্য বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিছুদিনের জন্য এদেরকে যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ দেয়া হয়েছে মাত্র।
ক্ষমতার জন্য পবিত্র ইসলাম কে ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহারকারী যেমন চরম অপমানিত হচ্ছে এবং হবে তেমনি যারা লুটপাটতন্ত্র কায়েম করে মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি করছে তারাও একদিন চরম অপমানিত হবে। যারা একই দেশে প্রবল বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে তাদেরও বিচার হবে বাংলার মাটিতে। বাংলার এই পবিত্র ভূমি লুটেরা ঘাতক খুনি ধর্মজীবি, ধর্ম ব্যবসায়ী কাউকেই যা ইচ্ছা তাই করার অনুমতি দেয় নি। যারা সাধারণ মানুষকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছে নানান কৌশলে তাদেরও চরম পরিনতির মুখোমুখি হতে হবেই। পালিয়ে বাঁচা যায় না। জনগণের টাকা লুট করে যারা অ্যামেরিকা কানাডা লন্ডন ম্যালেয়েশিয়ায় বিত্ত-বৈভবের জীবন যাপন করছে তারা কোনদিন বাংলার মাটিতে ঠাঁই পাবে না। বাংলা তাদের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এরা শরণার্থী জীবন বেছে নিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, প্রবল বৈষম্য জোর-জবরদস্তির শাসন-শোষণ কিছুদিন করা যায় অঞ্চল ও গণমনস্তাত্বিক অবস্থা ভেদে। কিন্তু তা টেকসই হয় না। বাঙালির এই ভূখন্ডে সাধারণ মানুষ রক্ত দিতে জানে, বিপুল বিস্ফোরণে দখলে নিতে পারে রাজপথ, দূর্গসমেত প্রাসাদ তার প্রমাণ রয়েছে। কাউকে ফাঁকি দিয়ে পিছনে ফেলে জোরজবরদস্তি করে যারা পার পেতে চায় তাদের জন্য প্রতিঘাত চরম হয়। দেশপ্রেম- মানবাধিকার, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা মিথ্যা চিৎকার করছে তাদের প্রত্যেককেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। যতটুকু সময়ক্ষেপণ তা কেবল বাঙালির অস্পৃশ্যতা মাত্র। কল্পনা বিলাস বাঙালির প্রধান অন্তরায়। গায়ের উপর এসে না পড়লে ঘুরে দাঁড়াতে চায় না।  ৪৪ বছরেও কেন এত নৈরাজ্য, কেন একটি জনগণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি করা গেল না সে দায় নিতে হবে রাজনীতিকদের। পার পাবার কোন সুযোগই নেই, কোন যুক্তি কোন জারিজুরি কোন ফাঁকিঝুকির সুযোগ নেই। চোখের সামনে এদেশের  হাজারো তথাকথিত দেশপ্রেমিকের গলায় কলঙ্কের তিলক অতীতে জুটেছে আরো জুটবে এতে কোন সন্দেহ নেই। দেখার চোখ থাকলে তথাকথিত এসব দেশপ্রেমিকের বিপর্যয় দৃশ্য দেখা যায়। প্রভাবশালী কত মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, সন্ত্রাসী মাফিয়াদের করুন কাহিনী অনুসন্ধানে ধরা পড়বে। জোর করে যারা নিজেকে নেতার চেয়ারে বসিয়েছেন, যারা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে এমপি- চেয়ারম্যান হয়েছেন, মন্ত্রী হয়ে জাতীয় পতাকা সম্বলিত গাড়ী হাঁকিয়েছেন আজ তারা কোথায়?
ষড়যন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়ে যারা বারবার চেয়ারে থেকেছেন তাদের দেহে-চিন্তায় কত অসুখ যে বাসা বেধেছে তা তারাই জানেন। মিথ্যাচারের রেকর্ড বাজিয়ে আজ যারা জনগণকে প্রতারিত করছেন তাদেরকে-ও একই ফল ভোগ করতে হবে। যেমন কর্ম তেমন ফল। বিশ্বাস ঘাতকেরা নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ার দৃশ্যায়ন প্রতিদিনই মঞ্চস্থ হয় আর পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে তা ধরা পড়ে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী আওয়ামীলীগ ও বামপন্থি দলগুলো। যদিও বহু বামপন্থিরা আগেই বেচাবিক্রির পাল্লায় দেদারসে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে। আর বাকিরা বক্তব্য বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে নিজেদের। তাদের জটিল মনস্তত্ব কতই না অনুৎপাদনশীল। যে দেশে বসে তারা সাম্য সমতার কথা বলে, যে দেশের জল, মাটি, বাতাস খেয়ে তারা বুলি আওড়ায়, তত্ত্ব দেয় সেই দেশকেই প্রকারান্তরে তারা অবজ্ঞা করে, অশ্রদ্ধা করে। এর পরিনাম তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, পাবে। বামপন্থি এবং দেশজ সংস্কৃতি অস্বীকারকারী জামায়াতী ও ওহাবী দর্শন মূলত একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। উভয়েই শেকড়হীন বৃক্ষ। রাজনীতিকদের স্মরণে রাখা উচিত সুরম্য প্রাসাদে বসে সাধারণ মানুষের ভালবাসা পাওয়া যায় না। স্বজন প্রীতির গহ্বর থেকে বের হতে না পারলে বেড়ায় ক্ষেত খায়। জনপ্রতিনিধি হবার পর জনগণের প্রতিনিধিই হতে হয়। ক্ষমতায় যেয়ে দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কঠিন না হতে পারলে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয়। লক্ষ্য পূরনে দৃঢ়তা দেখাতে না পারলে প্রত্যাঘাত পেতে হয়। লক্ষ্য পূরনের পথে যারা সাথী-সহযোগী বন্ধু তাদেরকে চিহ্নিত করা না গেলে, মূল্যায়ণ করতে ব্যর্থ হলে পরিণাম ভয়াবহ হয়। দলকানা বলেই অপরিহার্য-অনিবার্য নয় এটিই স্মরণে রাখতে হবে। বিশ্বাস ঘাতকেরা নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়েন। জীবনের অবসান হয়, দারুন এক দুঃস্বপ্নের যবানিকাতপাত ঘটে তবু কেন যেন অনুসন্ধান আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। প্রত্যেক শোষকের জানা থাকা ভাল যাদের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ছেন তারাই মুখ ফিরিয়ে নেয়। যে সমাজ যে পরিবার লালন পালন বেড়ে উঠার সুযোগ দেয় সেই সমাজকে শোষন নিপীড়ন করার ফল চরম অসম্মান।
প্রকাশ্যে সবার সামনে লুটপাটের মহাকর্মযজ্ঞে সিদ্ধহস্ত লোকেরা যখন জনগণের ভাগ্য পরির্তনের গল্প বলে তখনও কতটা নিরীহ হলে সহনশীল হলে সব জেনে বুঝে চুপচাপ থাকে বাঙালি। সহনশীল উদার বাঙালি যে কত ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ন তা সচেতন মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন।

সময়ের সাফ কথা.... বাঙালির বাংলা



সময়ের সাফ কথা....
বাঙালির বাংলা


বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে - ‘বাঙালির বাংলা’সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে। বাঙালির মতো জ্ঞান-শক্তি ও প্রেম-শক্তি (ব্রেন সেন্টার ও হার্ট-সেন্টার) এশিয়ায় কেন, বুঝি পৃথিবীতে কোন জাতির নেই। কিন্তু কর্ম-শক্তি একেবারে নেই বলেই তাদের এই দিব্যশক্তি তমসাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাদের কর্ম-বিমুখতা, জড়ত্ব, মৃত্যুভয়, আলস্য, তন্দ্রা, নিদ্রা, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিচ্ছার কারণ। তারা তামসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে চেতনা শক্তিকে হারিয়ে ফেলেছে। এই তম, এই তিমির, এই জড়ত্বই অবিদ্যা। অবিদ্যা কেবল অন্ধকার পথে ভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়; দিব্যশক্তিকে নিস্তেজ, মৃতপ্রায় করে রাখে। যারা যত সাত্বিক ভাবাপন্ন, এই অবিদ্যা তাদেরই তত বাধা দেয় বিঘ্ন আনে। এই জড়তা মানবকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যায়। কিছুতেই অমৃতের পানে আনন্দের পথে যেতে দেয় না। এই তমকে শাসন করতে পারে একমাত্র রজগুণ, অর্থাৎ ক্ষাত্র-শক্তি। এই ক্ষাত্রশক্তিকে না জাগালে মানুষের মাঝে যে বিশ্ব-বিজয়ী ব্রহ্মশক্তি আছে তা তাকে তমগুণের নরকে টেনে এনে প্রায় সংহার করে ফেলে। বাঙালি আজন্ম দিব্যশক্তিসম্পন্ন। তাদের ক্ষাত্রশক্তি জাগলো না বলে দিব্যশক্তি কোনো কাজে লাগলো না - বাঙালির চন্দ্রণাথের আগ্নেয়গিরি অগ্নি উদ্গিরণ করলো না। এই ক্ষাত্রশক্তিই দিব্য তেজ। প্রত্যেক মানুষেই ত্রিগুণান্বিত। সত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ। সত্বগুণ, ঐশীশক্তি অর্থাৎ সৎশক্তি সর্ব অসৎ শক্তিকে পরাজিত করে পূর্ণতার পথে নিয়ে যায়। এই সত্ব গুণের প্রধান শত্রু তম গুণকে প্রবল ক্ষাত্র শক্তি দমন করে। অর্থাৎ, আলস্য, কর্ম-বিমুখতা, পঙ্গুত্ব আসতে দেয় না। দেহ ও মনকে কর্মসুন্দর করে। জীবনশক্তিকে চির-জাগ্রত রাখে, যৌবনকে নিত্য তেজ-প্রদীপ্ত করে রাখে। নৈরাশ্য, অবিশ্বাস, জরা ও ক্লৈব্যকে আসতে দেয় না। বাঙালির মস্তিষ্ক ও হৃদয় ব্রহ্মময় কিন্তু দেহ ও মন পাষাণময়। কাজেই এই বাংলার অন্তরে-বাহিরে যে ঐশ্বর্য পরম দাতা আমাদের দিয়েছেন, আমরা তাকে অবহেলা করে ঋণে, ব্যাধিতে, অভাবে, দৈন্যে, দুর্দশায় জড়িয়ে পড়েছি। বাংলার শিয়রে প্রহরীর মতো জেগে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গিরি হিমালয়। এই হিমালয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুনি-ঋষি-যোগীরা সাধনা করছেন। এই হিমালয়কে তাঁরা সর্ব দৈব-শক্তির লীলা নিকেতন বলেছেন। এই হিমালয়ের গভীর হৃদ-গুহার অনন্ত স্নেহধারা বাংলার শত শত নদ-নদী রূপে আমাদের মাঠে-ঘাটে ঝরে পড়েছে। বাংলার সূর্য অতি তীব্র দহনে দাহন করে না। বাংলার চাঁদ নিত্য স্নিগ্ধ।
বাংলার আকাশ নিত্য প্রসন্ন, বাংলার বায়ুতে চিরবসন্ত ও শরতের নিত্য মাধুর্য ও শ্রী। বাংলার জল নিত্য প্রাচুর্যে ও শুদ্ধতায় পূর্ণ। বাংলার মাটি নিত্য-উর্বর। এই মাটিতে নিত্য সোনা ফলে। এত ধান আর কোনো দেশে ফলে না। পাট শুধু একা বাংলার। পৃথিবীর আর কোনো দেশে পাট উৎপন্ন হয় না। এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর, এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া আর কোথাও নেই। এত আনন্দ, এত হুল্লোড়, আত্মীয়তাবোধ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ - আল্লাহ্, ভগবানের উপাসনা, উপবাস-উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাংলার কয়লা অপরিমাণ, তা কখনো ফুরাবে না। বাংলার সুবর্ণ-রেখার বালিতে, পানিতে স্বর্ণরেণু। বাংলার অভাব কোথায়? বাংলার মাঠে মাঠে ধেনু, ছাগ, মহিষ। নদীতে ঝিলে বিলে পুকুরে ডোবায় প্রয়োজনের অধিক মাছ। আমাদের মাতৃ-ভূমি পৃথিবীর স্বর্গ, নিত্য সর্বৈশ্বর্যময়ী। আমাদের অভাব কোথায়। অতি প্রাচুর্য আমাদের বিলাসী, ভোগী করে শেষে অলস, কর্ম-বিমুখ জাতিতে পরিণত করেছে। আমাদের মাছ, ধান, পাট, আমাদের ঐশ্বর্য শত বিদেশী লুটে নিয়ে যায়, আমরা তার প্রতিবাদ তো করি না, উল্টো তাদের দাসত্ব করি; এ লুন্ঠনে তাদের সাহায্য করি।
বাঙালি শুধু লাঠি দিয়েই দেড়শত বছর আগেও তার স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখতে চেষ্টা করেছে। আজো বাংলার ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য যে আত্মদান করেছে, যে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, ইতিহাসে তা থাকবে স্বর্ণ-লিখায় লিখিত। বাংলা সর্ব ঐশীশক্তির পীঠস্থান। হেথায় লক্ষ লক্ষ যোগী-মুনি-ঋষি-তপস্বীর পীঠস্থান, সমাধি; সহস্র সহস্র ফকির-দরবেশ-ওলী-গাজীর দর্গা পরম পবিত্র। হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে শঙ্খ ঘন্টার ধ্বনি। এখানে যে শাসনকর্তা হয়ে এসেছে সেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলার আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতা-মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি। আমাদের বাংলা নিত্য মহিমাময়ী, নিত্য সুন্দর, নিত্য পবিত্র।
আজ আমাদের আলস্যের, কর্ম-বিমুখতার, পৌরুষের অভাবেই আমরা হয়ে আছি সকলের চেয়ে দীন। যে বাঙালি সারা পৃথিবীর লোককে দিনের পর দিন নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পারে তারাই আজ হচ্ছে সকলের দ্বারে ভিখারি। যারা ঘরের পাশে পাহাড়ের অজগর, বনের বাঘ নিয়ে বাস করে, তারা আজ নিরক্ষর বিদেশীর দাসত্ব করে। শুনে ভীষণ ক্রোধে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে, সারা দেহমনে আসে প্রলয়ের কম্পন, সারা বক্ষ মন্থন করে আসে অশ্রুজল।
যাদের মাথায় নিত্য স্নিগ্ধ মেঘ ছায়া হয়ে সঞ্চারণ করে ফিরে, ঐশী আশীর্বাদ অজস্র বৃষ্টিধারায় ঝরে পড়ে, শ্যামায়মান অরণ্য যাকে দেয় স্নিগ্ধ-শান্তশ্রী, বজ্রের বিদ্যুৎ দেখে যারা নেচে উঠে, ...হায় তারা এই অপমান এই দাসত্ব বিদেশী দস্যুদের এই উপদ্রব নির্যাতনকে কি করে সহ্য করে? ঐশী ঐশ্বর্য - যা আমাদের পথে ঘাটে মাঠে ছড়িয়ে পড়ে আছে তাকে বিসর্জন করে অর্জন করেছি এই দৈন্য, দারিদ্র্য, অভাব লাঞ্ছনা। বাঙালি সৈনিক হতে পারলো না। ক্ষাত্র শক্তিকে অবহেলা করলো বলে তার এই দুর্গতি তার অভিশপ্তের জীবন।
তার মাঠের ধান, পাট, রবি ফসল, তার সোনা তামা লোহা কয়লা - তার সর্ব ঐশ্বর্য বিদেশী দস্যু বাটপাড়ি করে ডাকাতি করে নিয়ে যায়, সে বসে বসে দেখে। বলতে পারে না ‘এ আমাদের ভগবানের দান, এ আমাদের মাতৃ-ঐশ্বর্য! খবরদার, যে রাক্ষস একে গ্রাস করতে আসবে, যে দস্যু এ  ঐশ্বর্য স্পর্শ করবে - তাকে ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’ দিয়ে বিনাশ করবো, সংহার করবো।’
বাঙালিকে, বাঙালির ছেলে-মেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাওঃ
‘এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির - আমাদের।
দিয়া ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’
তাড়াব আমরা, করি না ভয়
যত পরদেশী দস্যু ডাকাত
‘রামা’দের ‘গামা’দের।’
বাঙলা বাঙালির হোক ! বাঙলার জয় হোক ! বাঙালির জয় হোক।
 (সংগৃহীত)

ধর্ম নিয়ে রাজনীতি কোন পথে?



ধর্ম নিয়ে রাজনীতি কোন পথে?

শেখ উল্লাস ॥ ‘ধর্ম’-এ শব্দটি খাঁটি বাংলা শব্দ। বাংলা একাডেমীর সহজ বাংলা অভিধানে এই ধর্ম শব্দটির অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে, উপাসনা, জীবনাচরণের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও বিশ্বাস, স্বভাব, প্রকৃতি, গুণ, বিশেষত্ব (মানবধর্ম, আগুনের ধর্ম), সৎ কাজ, পূণ্যের কাজ, ভালো আচরণ, কর্তব্য, বিধি ইত্যাদি। ধর্মকর্ম, পূণ্যকর্ম, ধর্মের কাজ। আবার ধর্মগুরু অর্থ ধর্ম সম্পর্কে যিনি উপদেশ দেন, ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মপুস্তক অর্থ ধর্মের বই। ধর্মচর্চা অর্থ ধর্ম সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা, ধর্মাচরণ, ধর্মানুশীলন। ধর্মচিন্তা অর্থ ধর্মের তত্ত্ববিষয়ক চিন্তা বা ধ্যান, অধ্যাত্মবিষয়ক চিন্তা। ধর্মত অর্থ ধর্মানুসারে, ধর্ম অনুযায়ী, ন্যায়ত। ধর্মদ্রোহী অর্থ ধর্মবিরোধী। ধর্মনিষ্ঠ বা ধর্মপরায়ণ অর্থ ধার্মিক, যিনি ধর্মের নিয়ম নীতি ইত্যাদি মেনে চলেন। ধর্মপ্রচারক অর্থ কোনো ধর্মবিষয়ক মতামত প্রচারকারী। ধর্মপ্রাণ অর্থ ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী, নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মপালনকারী, ধর্মভীরু অর্থ ধর্মকে ভয় ও শ্রদ্ধা করেন যে জন। ধর্মান্ধ অর্থ নিজের ধর্মে অন্ধ বিশ্বাসী। ধর্মাবলম্বী অর্থ বিশেষ কোনো ধর্মের অনুসারী, ধর্মের সম্প্রদায়ভুক্ত (ইসলাম ধর্মাবলম্বী)। ধর্মোপদেশ অর্থ ধর্ম সংক্রান্ত উপদেশ বা শিক্ষা।
ধর্ম নিয়ে বাংলা ভাষায় এত যে শব্দ এর সবগুলোই মানুষের ধর্ম নিয়ে; যদিও জগতের অন্য সব প্রাণীরই ধর্ম আছে  যেখানে ধর্মের অর্থ শুধুই স্বভাব বা প্রকৃতি। পরম করুণাময়ের এই পৃথিবীতে এক একটি প্রাণী এক একটি স্বভাব বা প্রকৃতির অধিকারী হয়ে জন্মগ্রহণ করে সে ভাবেই সে জীবনাচরণ করে। এভাবে মানুষের সহজাত ধর্ম বা স্বভাব হচ্ছে, মানবতা বা মনুষ্যত্ব। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর অমর বাণী হচ্ছে, ‘মানুষ যদি হতে চাও তবে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত কর’। আমাদের সমাজে যার ভেতরে মিথ্যাচার বেশি, সব সময় যে অসৎ ও অন্যায় পথে চলে, যে কপট  মোনাফেক), যার ভেতরে মানুষের গুণাবলীর ঘাটতি রয়েছে বা এক দমই নেই তার জন্য একটি প্রচলিত বাক্য হচ্ছে - ‘লোকটির কোনো ধর্ম নেই’। অর্থাৎ, মনুষ্যত্ব গুণ যে হারিয়ে ফেলেছে সে তার ধর্মও হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রকৃত অর্থে সেই ধর্মদ্রোহিতার বা ধর্মবিরোধিতার পথে পা বাড়ায় । কিন্তু অন্য প্রাণী যত সহজে তার প্রকৃতি বা স্বভাবে বড় হয়ে উঠতে পারে, মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠে না। যেমন-একটি গরুর বাছুর প্রসবের পর পরই দৌঁড় দিতে পারে, অন্য সব প্রাণীও প্রকৃতিতে বড় হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু একটি মানুষকে জন্ম দেয়ার পর বড় করে তুলতে তার কতই যত্ন-আদর-সেবা-শুশ্রুষা করতে হয় তার মাকে। তারপর  তাকে সত্যিকারের যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সৃষ্টি করতে হয় কত রকমের পরিবেশ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ। মানুষকে সেই শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য যুগে যুগে এসেছেন কত নবী-রাসুল-অলি-আউলিয়া যাঁরা তাঁদের জীবনটাই ব্যয় করে গেছেন মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। একমাত্র মানুষের জন্য এত আয়োজন করতে হয় বলেই বাংলা প্রবাদে বলা হয়, ‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ’।
এই মানুষ মনুষ্যত্বের অধিকারী ধার্মিক হবেন, ধর্মনিষ্ঠ হবেন, সত্যনিষ্ঠ হবেন-এটাইতো কাম্য। মানুষ তার ধর্মকে অর্থাৎ তার প্রকৃত স্বভাব হারিয়ে ফেললে সে অধম হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু মানুষের এই ধর্মকে পুঁজি করে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে রাজনীতি যাকে বলে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। এই ভারত উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে এই রাজনীতি যারা করেছেন তারা নিজেরা কিন্তু কখনো ধর্মচর্চা করেননি। ১৯৪৭ সালে ধর্মের জিগির তুলে যারা ভারত ভাগ করেছে বিশেষ করে পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ কখনো ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মানেননি, বিলেতে ব্যারিষ্টার হওয়ার কারণে তিনি পুরোটাই ব্রিটিশ জীবনাচরণে (স্বভাবে) অভ্যস্ত ছিলেন। ব্রিটিশরা তাকে ব্যবহার করে যে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলো সেটা এদেশে টেকেনি। পাকিস্তান আমলের শুরুতেই ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয় এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বাদ দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম নিয়োজিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে দলটির নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব হয়। অপরদিকে, ধর্মের নামে রাজনীতি করে মুসলিম লীগের রাজনীতির পতনের যে সূচনা ১৯৫৪ সনে শুরু হয়, তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালে। আবার, ধর্মের নামে রাজনীতি করে এদেশে বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা জামাত কিছু সময়ের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ অর্জন করলেও এদেশের সাধারণ মানুষ ও প্রকৃতি যে তাদেরকে গ্রহণ করেনি তার সর্বশেষ প্রমাণ বর্তমানে সারা দেশে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে যে অনিয়ম, সহিংসতা ও মিথ্যাচার হয়েছে সেটাকেও এদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতিরই এক পরিণতি বলতে হবে। কারণ, এই দলগুলো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেছে, দুর্নীতি করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগত করেছে, ভোগ-বিলাস করেছে, কিন্তু মানুষকে ধার্মিক বানানোর কোনো পরিবেশ এরা তৈরি করে দেয়নি। সাধারণ মানুষকে ধর্মান্ধ, দরিদ্র, অশিক্ষিত, কৃশিক্ষিত বানিয়ে অন্ধকারে রেখে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ উদ্ধার করেছে। দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদেরকে উন্নত জীবনের পথ দেখানোর কোনো চেষ্টাই তারা কোনো দিন করেনি, করেছে শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি। এই রাজনীতির হর্তা-কর্তারা কোনোদিন তাদের ছেলেমেয়েদেরকে মাদ্রাসায় পড়ায়নি, পড়াবেও না। তাদের ছেলেমেয়েদেরকে ইংরেজি-মিডিয়ামে পড়িয়ে ভোগ-বিলাসের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা-শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলাই তাদের লক্ষ্য। রাজনীতিতে এরা চতুর বলেই এরা জানে যে, শুধু মাদ্রাসা পাস করে তাদের সন্তানরা পৃথিবীতে সম্মানের সাথে বাঁচার মতো যোগ্য মানুষ হতে পারবে না। মাদ্রাসায় পড়বে অতি দরিদ্রের সন্তানেরা যাদেরকে চিরদিনই দরিদ্র রেখে আরও শোষণ করা যাবে। এই রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা তারা পাচ্ছে আমেরিকা-সৌদি-ইহুদী-নাসারাদের কাছ থেকে-যাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, বাংলাদেশের সম্পদ লুন্ঠন করা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা, ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করা। মানুষ শান্তির ধর্ম (ইসলাম) পালন করুক, মানুষ ধার্মিক হোক, ধর্মনিষ্ঠ হোক,  নিজের দেশকে ভালোবাসুক, নিজেকে ভালোবাসুক, মানুষ সত্যনিষ্ঠ হোক-এ পরিবেশ এরা কখনো চায় না। এ প্রসঙ্গে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর আরেকটি অমর বাণী, ‘বিশ্বাসঘাতকেরাই নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ে’। দেশ, জাতি ও মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাকতার এই রাজনীতি যারা করেছেন, তাদের মুখোশ ইতিমধ্যে বাংলার মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। ৭১’এর রাজাকার ও রাজাকারদের উত্তারাধিকার হিসেবে এরা বাঙালির কাছে চিরকাল ঘৃণিত হয়ে থাকবে। মহাকালের কাছে এরা পরিগণিত হতে থাকবে দ্বি-চারী হিসেবে। পবিত্র  কুরআনে এদের পরিণতি সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।
তাই ধর্ম নিয়ে রাজনীতির মধ্যে যারা এখনো সুযোগ-সুবিধা খুঁজে বেড়ান, তাদেরকে সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। বর্তমান সরকারের মধ্যে, সরকারি দলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে যারা এখনো ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন, পরিবেশ ঘোলাটে করছেন তাদেরকে সরকার ও দল থেকে বের করে দেয়ার এখনই সময়। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে তারা শুধু দলের বা সরকারের নয়, তারা দেশ ও সমাজের শত্রু, তারা ধর্মেরও শত্রু।

ব্যাংকের লাভক্ষতি



ব্যাংকের লাভক্ষতি

মোঃ খলিলুর রহমান চৌধুরী ॥ আজকাল প্রায়ই বিভিন্ন ব্যাংকের লাভ-ক্ষতির অবস্থা পত্র পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় এবং বিভিন্নস্থানে রিপোর্টও করা হয়। প্রকৃতপক্ষে একটি ব্যাংকের লাভ বা ক্ষতি বলতে নীট লাভ বা ক্ষতিকেই বুঝায় এবং সকল সময়ে উক্ত নীট লাভ বা ক্ষতিকেই রিপোর্ট করা উচিৎ। উক্ত নীট লাভ বা ক্ষতি হলো মন্দ ঋণের বিপরীতে গড়া সঞ্চিতি উত্তর লাভ বা ক্ষতি। কিন্তু তা না করে অনেকেই সঞ্চিতি পূর্ব অপারেটিং লাভকে ঘোষনা করে থাকে যা খুবই বিভ্রান্তিকর। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খেলাপি ও মন্দ ঋণের ব্যাপকতার মধ্যে মন্দ ও কু-ঋণের সঞ্চিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বিষয়। হিসাববিজ্ঞানের নিয়মনীতিতে মন্দ ও সন্দেহজনক ঋণের সঞ্চিতি সৃষ্টি করা বাধ্যতামূলক। তাই নীট লাভ বা নীট ক্ষতির কালে উক্ত মন্দ ঋণের সঞ্চিতি বাদ দিয়েই নীট লাভ বা ক্ষতি নিরূপণ এবং তাই ঘোষনা করা উচিৎ।
০২। আজকাল এও শোনা যায় যে, একটি ব্যাংকের কিছু ব্রাঞ্চ লাভ করেছে কিছু ব্রাঞ্চ লোকসান করেছে। তার ভিত্তিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ঐ সমস্ত ব্রাঞ্চের নীট অপারেটিং লাভ বা ক্ষতিকেই ঘোষনা করে থাকে। এবং সেক্ষেত্রে উক্ত লাভ বা ক্ষতি মন্দ ও কুঋণ সঞ্চিতি উত্তর নীট লাভ বা ক্ষতি নয়। এক্ষেত্রেও জাতীয় পর্যায়ে খেলাপী ও মন্দ ঋণের ব্যাপকতার মধ্যে শাখা পর্যায়ে মন্দ ঋণের সঞ্চিতি সৃষ্টি করার পরেই শাখা পর্যায়ে নীট লাভ বা ক্ষতি নিরূপণ করা উচিৎ। এমনও হতে পারে যে, একটি শাখার সকল ঋণই খেলাপী এবং সকল ঋণের জন্য মন্দ ঋণের সঞ্চিতি করার প্রয়োজনীয়তা আছে। যদি তেমন হয়, তাহলে সঞ্চিতি সৃষ্টি করে নীট লাভ বা ক্ষতি নিরূপণ করার গুরুত্ব বলাই বাহুল্য।
০৩। খেলাপী ঋণ নিরূপণ ও তার বিপরীতে সঞ্চিতি সৃষ্টির সুস্পষ্ট নীতিমালা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারী করা আছে। যার ভিত্তিতে প্রতিটি শাখা অফিস উক্ত নীতিমালার প্রেক্ষিতে প্রতিটি শাখা পর্যায়ে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমান ও ক্যাটাগরী নিরূপণ করে তার বিপরীতে সঞ্চিতি সৃষ্টি করা কোন ব্যপার নয় এবং শাখা পর্যায়ে এই কাজটি করেই শাখার হিসাবের খাতাপত্রে প্রয়োজনীয় মন্দ ঋণের সঞ্চিতি সৃষ্টি করে শাখার নীট লাভ বা ক্ষতি নিরূপণপূর্বক স্টেটমেন্ট অব এ্যফেয়ারস একীভূতকরণের জন্য প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা উচিৎ। এটাই হিসাববিজ্ঞানের নিয়ম। প্রধান কার্যালয়ের কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগ কর্তৃক সকল শাখার স্টেটমেন্ট অব এ্যফেয়ারস একীভূত করে ব্যাংকের চূড়ান্ত হিসাব বিবরণী প্রস্তুত করা উচিৎ। উক্ত বিবরণী হতেই পুরো ব্যাংকের প্রভিশনের পরিমাণ জানা সম্ভব। কিন্ত তা না করে ব্যাংকগুলি কেন্দ্রীয়ভাবে মন্দ ঋণের সঞ্চিতি সৃষ্টি করে থাকে। যার কারণ বোধগম্য নয়।
০৪। পরিশেষে উল্লেখ্য যে, ব্যাংকের লাভ-ক্ষতি ঘোষনা করা, শাখা পর্যায়ের নীট লাভ-ক্ষতি নিরূপণ করা, ব্যাংকের লাভ-ক্ষতি ব্রাঞ্চ নিরূপণ করা, ঋণের সঞ্চিতি শাখা পর্যায়ে সৃষ্টি না করে কেন্দ্রীয় ভাবে সৃষ্টি করার প্রচলিত নিয়মগুলি হিসাববিজ্ঞানের নিয়মনীতিতে পর্যালোচনা করে দেখা আশু প্রয়োজন বলে হিসাববিজ্ঞানীদের অভিমত।