ধর্ম
নিয়ে রাজনীতি কোন পথে?
শেখ উল্লাস ॥ ‘ধর্ম’-এ শব্দটি খাঁটি বাংলা
শব্দ। বাংলা একাডেমীর সহজ বাংলা অভিধানে এই ধর্ম শব্দটির অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে, উপাসনা,
জীবনাচরণের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও বিশ্বাস, স্বভাব, প্রকৃতি, গুণ, বিশেষত্ব (মানবধর্ম,
আগুনের ধর্ম), সৎ কাজ, পূণ্যের কাজ, ভালো আচরণ, কর্তব্য, বিধি ইত্যাদি। ধর্মকর্ম, পূণ্যকর্ম,
ধর্মের কাজ। আবার ধর্মগুরু অর্থ ধর্ম সম্পর্কে যিনি উপদেশ দেন, ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মপুস্তক
অর্থ ধর্মের বই। ধর্মচর্চা অর্থ ধর্ম সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা, ধর্মাচরণ, ধর্মানুশীলন।
ধর্মচিন্তা অর্থ ধর্মের তত্ত্ববিষয়ক চিন্তা বা ধ্যান, অধ্যাত্মবিষয়ক চিন্তা। ধর্মত
অর্থ ধর্মানুসারে, ধর্ম অনুযায়ী, ন্যায়ত। ধর্মদ্রোহী অর্থ ধর্মবিরোধী। ধর্মনিষ্ঠ বা
ধর্মপরায়ণ অর্থ ধার্মিক, যিনি ধর্মের নিয়ম নীতি ইত্যাদি মেনে চলেন। ধর্মপ্রচারক অর্থ
কোনো ধর্মবিষয়ক মতামত প্রচারকারী। ধর্মপ্রাণ অর্থ ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী, নিষ্ঠার
সঙ্গে ধর্মপালনকারী, ধর্মভীরু অর্থ ধর্মকে ভয় ও শ্রদ্ধা করেন যে জন। ধর্মান্ধ অর্থ
নিজের ধর্মে অন্ধ বিশ্বাসী। ধর্মাবলম্বী অর্থ বিশেষ কোনো ধর্মের অনুসারী, ধর্মের সম্প্রদায়ভুক্ত
(ইসলাম ধর্মাবলম্বী)। ধর্মোপদেশ অর্থ ধর্ম সংক্রান্ত উপদেশ বা শিক্ষা।
ধর্ম নিয়ে বাংলা ভাষায় এত যে শব্দ এর সবগুলোই
মানুষের ধর্ম নিয়ে; যদিও জগতের অন্য সব প্রাণীরই ধর্ম আছে যেখানে ধর্মের অর্থ শুধুই স্বভাব বা প্রকৃতি। পরম
করুণাময়ের এই পৃথিবীতে এক একটি প্রাণী এক একটি স্বভাব বা প্রকৃতির অধিকারী হয়ে জন্মগ্রহণ
করে সে ভাবেই সে জীবনাচরণ করে। এভাবে মানুষের সহজাত ধর্ম বা স্বভাব হচ্ছে, মানবতা বা
মনুষ্যত্ব। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর অমর বাণী হচ্ছে, ‘মানুষ যদি হতে চাও তবে মনুষ্যত্বকে
জাগ্রত কর’। আমাদের সমাজে যার ভেতরে মিথ্যাচার বেশি, সব সময় যে অসৎ ও অন্যায় পথে চলে,
যে কপট মোনাফেক), যার ভেতরে মানুষের গুণাবলীর
ঘাটতি রয়েছে বা এক দমই নেই তার জন্য একটি প্রচলিত বাক্য হচ্ছে - ‘লোকটির কোনো
ধর্ম নেই’। অর্থাৎ, মনুষ্যত্ব গুণ যে হারিয়ে ফেলেছে সে তার ধর্মও হারিয়ে ফেলেছে এবং
প্রকৃত অর্থে সেই ধর্মদ্রোহিতার বা ধর্মবিরোধিতার পথে পা বাড়ায় । কিন্তু অন্য প্রাণী
যত সহজে তার প্রকৃতি বা স্বভাবে বড় হয়ে উঠতে পারে, মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠে
না। যেমন-একটি গরুর বাছুর প্রসবের পর পরই দৌঁড় দিতে পারে, অন্য সব প্রাণীও প্রকৃতিতে
বড় হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু একটি মানুষকে জন্ম দেয়ার পর বড় করে তুলতে তার কতই
যত্ন-আদর-সেবা-শুশ্রুষা করতে হয় তার মাকে। তারপর
তাকে সত্যিকারের যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সৃষ্টি করতে হয় কত রকমের
পরিবেশ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ। মানুষকে সেই শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য যুগে যুগে এসেছেন
কত নবী-রাসুল-অলি-আউলিয়া যাঁরা তাঁদের জীবনটাই ব্যয় করে গেছেন মানুষকে সত্যিকারের মানুষ
হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। একমাত্র মানুষের জন্য এত আয়োজন করতে হয় বলেই বাংলা প্রবাদে
বলা হয়, ‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায়
তবে মানুষ’।
এই মানুষ মনুষ্যত্বের অধিকারী ধার্মিক
হবেন, ধর্মনিষ্ঠ হবেন, সত্যনিষ্ঠ হবেন-এটাইতো কাম্য। মানুষ তার ধর্মকে অর্থাৎ তার প্রকৃত
স্বভাব হারিয়ে ফেললে সে অধম হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু মানুষের এই ধর্মকে পুঁজি করে যুগ
যুগ ধরেই চলে আসছে রাজনীতি যাকে বলে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। এই ভারত উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে
এই রাজনীতি যারা করেছেন তারা নিজেরা কিন্তু কখনো ধর্মচর্চা করেননি। ১৯৪৭ সালে ধর্মের
জিগির তুলে যারা ভারত ভাগ করেছে বিশেষ করে পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী
জিন্নাহ্ কখনো ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মানেননি, বিলেতে ব্যারিষ্টার হওয়ার কারণে তিনি
পুরোটাই ব্রিটিশ জীবনাচরণে (স্বভাবে) অভ্যস্ত ছিলেন। ব্রিটিশরা তাকে ব্যবহার করে যে
পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলো সেটা এদেশে টেকেনি। পাকিস্তান আমলের শুরুতেই ১৯৫৫ সালে আওয়ামী
মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয় এবং ধর্মের রাজনৈতিক
ব্যবহার বাদ দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম নিয়োজিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে দলটির নেতৃত্বে
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব হয়। অপরদিকে,
ধর্মের নামে রাজনীতি করে মুসলিম লীগের রাজনীতির পতনের যে সূচনা ১৯৫৪ সনে শুরু হয়, তার
চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালে। আবার, ধর্মের নামে রাজনীতি করে এদেশে বিএনপি, জাতীয়
পার্টি বা জামাত কিছু সময়ের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ অর্জন করলেও এদেশের সাধারণ
মানুষ ও প্রকৃতি যে তাদেরকে গ্রহণ করেনি তার সর্বশেষ প্রমাণ বর্তমানে সারা দেশে চলমান
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে যে অনিয়ম, সহিংসতা ও মিথ্যাচার হয়েছে সেটাকেও এদেশে
ধর্ম নিয়ে রাজনীতিরই এক পরিণতি বলতে হবে। কারণ, এই দলগুলো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেছে,
দুর্নীতি করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগত করেছে, ভোগ-বিলাস করেছে, কিন্তু মানুষকে ধার্মিক
বানানোর কোনো পরিবেশ এরা তৈরি করে দেয়নি। সাধারণ মানুষকে ধর্মান্ধ, দরিদ্র, অশিক্ষিত,
কৃশিক্ষিত বানিয়ে অন্ধকারে রেখে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ উদ্ধার করেছে। দরিদ্র ও অশিক্ষিত
মানুষকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদেরকে উন্নত জীবনের পথ দেখানোর কোনো চেষ্টাই
তারা কোনো দিন করেনি, করেছে শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি। এই রাজনীতির হর্তা-কর্তারা
কোনোদিন তাদের ছেলেমেয়েদেরকে মাদ্রাসায় পড়ায়নি, পড়াবেও না। তাদের ছেলেমেয়েদেরকে ইংরেজি-মিডিয়ামে
পড়িয়ে ভোগ-বিলাসের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা-শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলাই তাদের লক্ষ্য।
রাজনীতিতে এরা চতুর বলেই এরা জানে যে, শুধু মাদ্রাসা পাস করে তাদের সন্তানরা পৃথিবীতে
সম্মানের সাথে বাঁচার মতো যোগ্য মানুষ হতে পারবে না। মাদ্রাসায় পড়বে অতি দরিদ্রের সন্তানেরা
যাদেরকে চিরদিনই দরিদ্র রেখে আরও শোষণ করা যাবে। এই রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা তারা পাচ্ছে
আমেরিকা-সৌদি-ইহুদী-নাসারাদের কাছ থেকে-যাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, বাংলাদেশের সম্পদ
লুন্ঠন করা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা, ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করা।
মানুষ শান্তির ধর্ম (ইসলাম) পালন করুক, মানুষ ধার্মিক হোক, ধর্মনিষ্ঠ হোক, নিজের দেশকে ভালোবাসুক, নিজেকে ভালোবাসুক, মানুষ
সত্যনিষ্ঠ হোক-এ পরিবেশ এরা কখনো চায় না। এ প্রসঙ্গে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর আরেকটি
অমর বাণী, ‘বিশ্বাসঘাতকেরাই নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ে’। দেশ, জাতি ও মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাকতার
এই রাজনীতি যারা করেছেন, তাদের মুখোশ ইতিমধ্যে বাংলার মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।
৭১’এর রাজাকার ও রাজাকারদের উত্তারাধিকার হিসেবে এরা বাঙালির কাছে চিরকাল ঘৃণিত হয়ে
থাকবে। মহাকালের কাছে এরা পরিগণিত হতে থাকবে দ্বি-চারী হিসেবে। পবিত্র কুরআনে এদের পরিণতি সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ
করা হয়েছে।
তাই ধর্ম নিয়ে রাজনীতির মধ্যে যারা এখনো
সুযোগ-সুবিধা খুঁজে বেড়ান, তাদেরকে সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। বর্তমান সরকারের মধ্যে,
সরকারি দলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে যারা এখনো ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন, পরিবেশ ঘোলাটে করছেন
তাদেরকে সরকার ও দল থেকে বের করে দেয়ার এখনই সময়। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে তারা
শুধু দলের বা সরকারের নয়, তারা দেশ ও সমাজের শত্রু, তারা ধর্মেরও শত্রু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন