বাঙালির জীবনীশক্তিঃ জয় বাংলা
সংলাপ ॥ মুক্তিযুদ্ধের
সময় ‘জয়-বাংলা’ ধ্বনিটির জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়ে বাঙালির শক্তি হিসাবে সর্বজনীন হয়ে ওঠে।
এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা সবাই কোনো একটা বিশেষ দলের লোক ছিলেন না। আওয়ামী লীগ ছাড়াও
অন্যান্য অনেক দলের কর্মীরা এবং গণমানুষ এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ
দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিরাট অংশ ছিলেন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কহীন,
এ দেশের গণমানুষ। আমরা জানি, ‘জয়-বাংলা’ স্লোগান দিয়েই এদের সবাই দেশের জন্য প্রাণ দিতে এগিয়ে গিয়েছেন। এই জয়ধ্বনি
উচ্চারণ করে হুঙ্কার দিয়েই এরা যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানী নরপিশাচদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
বিজয়ের ক্ষণে বা পাকিস্তানী বাহিনী কিংবা রাজাকার, আল-বদর নামধারী এদেশী কাউকে পরাস্ত
করতে পারলে, আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধাই ‘জয়-বাংলা’ বলে চিৎকার করে তাদের উল্লাস প্রকাশ
করেছেন এবং এখনও করেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হবার পূর্ব মুহুর্তে জয়-বাংলা বলে চিৎকার
করে তারা তাদের জীবনের শেষ মুহুর্তে শেষ প্রত্যয়, শেষ আকাঙ্খা ব্যক্ত করে গিয়েছেন।
সে
সময় এ দেশের জনগণের মধ্যে যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেনি, তাদের মধ্যেও একমাত্র
রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও তাদের মদদদানকারী ছাড়া আপামর বাঙালির কাছে ‘জয়-বাংলা’ ধ্বনিটি
ছিল জীবনীশক্তি।
এই
ধ্বনিটি শুনলে সেই সময়কার ভীতি-বিহ্বল মুহুর্তগুলোতেও তাদের মনে সাহস ও আশার সঞ্চার
হতো এবং আজও হয়।
মুক্তিযুদ্ধের
সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে এই জয়ধ্বনিটি কি রকম জনপ্রিয় ও সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল তা বিশ্ববাসী
জানে।
মুক্তিযুদ্ধের
আগে থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত এই জয়ধ্বনিটির সর্বজনীনতাপ্রাপ্ত
হবার পর এটা আওয়ামী লীগের একচেটিয়া সম্পদ থাকেনি। এটা এ দেশের সকল মানুষের, এ দেশের
আপামর জনসাধারণের সম্পদ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল
বলে এটাকে আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা বলা যায় না, এটা হলো আমাদের বাঙালি জাতির স্বাধীনতা;
তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বজনীনতা প্রাপ্তির পর জয়-বাংলা ধ্বনিটিকে আওয়ামী লীগের
দলীয় সম্পদ বলা যাবে না, এটা সমগ্র বাংলা ও বাঙালি জাতির সম্পদ, এটা আপামর জনগণের শুধু
জয়ধ্বনি নয় জীবনীশক্তিও।
স্বাধীনতা
পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া যে সমস্ত রাজনৈতিক দল এদেশে সরকার গঠন ও পরিচালনা করেছেন
তাদের অনেক নেতা-কর্মীই এসেছেন আওয়ামী লীগ থেকে। তাই তারা যখন আওয়ামী লীগ থেকে সরে
এসে নতুন পার্টি গঠন করেছেন, তখন স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল যে এসব পার্টি তাদের পৃথক
অস্তিত্বের কারণ হিসেবে, তারা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ ও নীতিমালার দিক দিয়ে
আওয়ামী লীগের থেকে অন্যরকম, সেই কথাটাই জনগণের কাছে বড় করে তুলে ধরবেন এবং এর উপরেই
তারা বেশি জোর দিবেন। কিন্তু তা না করে তারা তাদের নেতা পৃথক, তাদের ধ্বনি পৃথক, তাদের
ভাষায়, বেতার সংস্থার নাম পৃথক ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর বেশি প্রাধান্য দিতে থাকেন এবং
এগুলোকেই তারা তাদের পৃথক অস্তিত্বের কারণ হিসেবে প্রতীয়মান করার চেষ্টা করতে থাকেন।
রাজনৈতিক
দলগুলো না হয় তাদের পৃথক অস্তিত্ব প্রমাণ করতে অন্য কোনো জোরালো যুক্তি দেখাতে না পেরে
এ দেশের বেতার ও টেলিভিশনে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়ে সেখানে একটা
বিকল্প ধ্বনি চালু করেছেন এবং তাদেরটা ভালো তা বোঝাবার জন্য করেছেন, কিন্ত তাই বলে
আমরা, যারা জনগণ, যারা কোনো দলের সদস্য নই, তাদের কি হয়েছে এতো সহজে শান্ত ছেলের মতো
বাংলা ভাষায় রচিত ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত আমাদের নিজস্ব জয়ধ্বনিটি বিসর্জন দিয়ে,
কোনোরূপ বিচার বিবেচনা না করে, যে পাকিস্তানের শোষণের অধীনে ছিলাম, যাদের অধীনতা থেকে
মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ নরনারীকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে, সেই
পাকিস্তানের নারা থেকে জিন্দাবাদ শব্দটি আমাদের বাংলাদেশের নামের সঙ্গে গ্রহণ করা এবং
সেই সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ধ্বনিটি যা বাঙালির জীবনীশক্তি তা বিসর্জন দেয়া!
পাকিস্তান-পছন্দ
দলগুলো জানতো এবং আজো জানে, যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত দেশবাসীর মন থেকে
‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি নির্বাসিত করা সহজ হবে না। তাই তারা জাতীয়তাবাদের যুক্তি বাদ দিয়ে
এ দেশের মানুষের ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, জয় শব্দটি ইসলামী
নয় - ওটা হিন্দুদের শব্দ, তাই ও শব্দটি বলা চলবে না, তার বদলে জিন্দাবাদ শব্দটি বলতে
হবে।
কি
চমৎকার! বাংলায় কথা বলবো, বাংলার মাটির ফসল খাবো, আমার মাকে আমি বাংলা ভাষায় ‘মা’ বলতে
পারবো। বাংলাদেশকে বাংলা ভাষায় ‘বাংলাদেশ’ বলতে পারবো। তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু
‘জয়-বাংলা’কে আমার মায়ের ভাষায় ‘জয়- বাংলা’ বলতে পারবো না। সেটা আমাকে বলতে হবে পাকিস্তানীদের
উর্দু ভাষায়, যারা এতোই বর্বর যে, আজও কোনো নারী যদি ধর্ষিত হবার ফলে অন্তঃসত্ত্বাও
হয় তাহলে তারা সেই নির্যাতিত নারীকেই উল্টো বেত্রাঘাত করে। বাঙালি জাতি কি সময়ের তালে
তালে ধর্মভীরুতার সংক্রামক ব্যধিতে ভুগে আত্মমর্যাদা শক্তি খোয়াতে বসেছে?
অদৃষ্টের
কি নির্মম পরিহাস। গত ৩০ মার্চ (১৯৯৬) তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের
দাবিতে জনগণের আন্দোলনের চাপে বিএনপি যখন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো, তখন তাদের নেত্রীকে
জনতার কাছে মুখ দেখাবার লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বলতে হয়েছিল জয় (বিজয়) ওদের
হয়নি, জয় হয়েছে আমাদের। জয় যদি এতোই হারাম (নিষিদ্ধ) শব্দ, তা হলে বলা দরকার ছিল জিন্দাবাদ
ওদের হয়নি, জিন্দাবাদ আমাদের হয়েছে।
আমাদের
মনে ‘জয়-বাংলা’ বাক্যটির প্রতি যে শক্তি ও আকর্ষণ আছে তাকে নিস্তেজ করে দেয়ার জন্য
উর্দু পছন্দ / পাকিস্তান পছন্দ দলগুলোও যথেষ্ট চেষ্টা করেছে এবং আজও করছে। এর থেকে
বোঝা যায় যে, আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা অংশের মধ্যে রাজনৈতিক
জারজ সন্তানদের মতো নিজ দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির চেয়ে অন্য একটা দেশ, জাতি, ভাষা
ও সংস্কৃতির প্রতি বেশি আকর্ষণ ও মমত্ববোধ রয়েছে। বাঙালি জাতি এখনও একটা মারাত্মক আত্মপরিচয়ের
ক্ষেত্রে সংক্রামক ব্যধিতে ভুগছে। এই ব্যধির হাত থেকে নিরাময় হতে একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক
বিপ্লব সময়ের দাবী।
আমাদের
তবুও একটা সৌভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ এখনো পর্যন্ত এই জয়ধ্বনিটিকে টিকিয়ে রেখেছে। যে সুরে
এই রণহুঙ্কারটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে এই রণহুঙ্কারটি
যে সুরে উচ্চারণ করে আমাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শেষ কামনা, তাদের শেষ প্রত্যয়
ব্যক্ত করে গিয়েছেন, সেই উচ্চারণের হুঙ্কার
‘জয়-বাংলা’ আমাদের প্রতিটি কর্মে ধরে রাখতে হবে। ধিক আমাদের বাঙালি রাজনীতি! ধিক আমাদের
ধর্ম ভীরুতায়! বাঙালি যে দলের, যে ধর্মের, যে বর্ণের লোকই হোক না কেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে
আমরা যে দলের সদস্যই হই, ‘জয়-বাংলা’ আমাদের সবার জন্যই জাতীয় জয়ধ্বনি। এই জীবনীশক্তিকে
আমাদের সর্বজনীন জয়ধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করা - নৈতিক দায়িত্ব,
কর্তব্য ও অধিকার।
জয়-বাংলা,
বাংলার জয়। জয় বাঙালি, বাঙালির জয়। আমরা সত্য ও শান্তির (ইসলাম) ধর্মাবলম্বীর প্রতীক
হই। ইদানিং এক ধর্মীয় উগ্রবাদী রাজনৈতিক ইসলামি দল জয়-বাংলা ধ্বনিতে আওয়াজ তুলে ধ্বংসাত্মক
ও হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে বর্তমান সরকারকে জনগণের কাছে হেয় করার জন্য। বাঙালিকে
প্রতিটি পদক্ষেপে আরো সাবধান হতে
হবে এবং তাদেরকে শনাক্ত করে প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে। বাঙালির সামনে সময় এসেছে
‘জয় বাংলা’ যে জীবনীশক্তি তার প্রমাণ দেয়ার।