বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

পৌর নির্বাচনঃ গণতন্ত্র সমুন্নত


পৌর নির্বাচনঃ গণতন্ত্র সমুন্নত

শেখ উল্লাস ॥ সংবিধান অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দেশের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগুন, সন্ত্রাস ও হত্যা যেভাবে কয়েকমাস সারাদেশকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এক লোমহর্ষক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে আগুনে পোড়া শত শত অগ্নিদগ্ধ সাধারণ মানুষের আহাজারি যারা শুনেছে, দেখেছে এবং অনুভবের চেষ্টা করেছে তারা শুধুমাত্র অশ্রুসংবরণের মধ্য দিয়েই কর্তব্য সম্পাদন করেছে। ব্রিটিশ আমলে গান ছিল, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে’, ’৭১ সালে বলা হলো, ‘এক সাগরই রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা, আমরা তোমাদের ভুলবোনা’। ব্রিটিশ আর পাকিস্তানী আমলে ওইসব মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ হানাদার পাকিস্তানী শাসক-শোষকগোষ্ঠী। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে পেট্রোল বোমায় শত শত মানুষকে হত্যা বা আহত করার দায় কারা নেবে? নিশ্চয়ই এর দায়দায়িত্ব এক শ্রেণীর রাজনীতিকদেরই নিতে হবে- যারা শুধুমাত্র ওই নির্বাচনকে বানচাল করার কৌশল হিসেবে পেট্রোল বোমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা ও যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সহায়-সম্পত্তি ধবংসের পথ বেছে নিয়েছিল। এই রাজনীতিজীবীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোনো সরকার এবং কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার আন্দোলনের চেষ্টা চালায়, পরের বছর তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বের করা। সাধারণ মানুষের কষ্ট বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
গত ৩০শে ডিসেম্বর দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। সেই একই সরকার এবং  একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অংশ নিল বিএনপি এবং এই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে এই দলটির। কমিশনের হিসেবে, নির্বাচনের সর্বশেষ বেসরকারি ফলে দেখা গেল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ১৬৮টি পৌরসভার মেয়র পদে জয়লাভ করেছে, আর বিএনপি জয়লাভ করেছে মাত্র ১৯টি পৌরসভায়, ১টি পেয়েছে জাতীয় পার্টি এবং বাকী ২৬টিতে স্বতন্ত্রসহ অন্যান্য পরিচয়ের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। স্থগিত রয়েছে ২০টি পৌরসভার নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বাংলার মানুষের আরও বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো বিএনপি নির্বাচনে ভরাডুবির পরও ৩০ডিসেম্বরের নির্বাচনকে গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ‘সাফল্য’ বা ‘বিজয়’ হিসেবে দেখছে। এই ‘বিজয়’ ব্যাখ্যা করে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন পর দলের নেতাকর্মীরা প্রায় এক মাস ধরে মাঠপর্যায়ে সংগঠিত ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পেরেছেন। চরম বৈরি ও ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেও লড়াইয়ে থেকে নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই কমিশনের অধীনে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছে বিএনপি। এটাই আওয়ামী লীগের বড় অর্জন। এ নির্বাচনের আরও ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, সহিংসতার ভয়াবহতা এবার জাতিকে প্রত্যক্ষ করতে হয়নি।
বাংলা ভাষার একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘আমও গেল, ছালাও গেল’। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে জোরালো ও সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়ে এবং তাদেরই ইন্ধনে ২০১৪ সালের জানুয়ারীর নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপির মতো একটি বড় দল যে ভুল করেছে তার খেসারত তারা দিচ্ছে। কিন্তু তাদের কারণে নিরীহ শত শত মানুষকে যে আগুনে পুড়ে মরতে হল সে জবাব কে দিবে? শত প্রতিকূলতা এবং অসম্পূর্ণতার মধ্যেও নির্বাচনী ধারাবাহিকতা রক্ষার সফলতার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং তাঁর প্রশাসনকে অবশ্যই অভিনন্দন জানিয়েছে দেশবাসী ভোট দেয়ার মাধ্যমে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত প্রকাশ করছেন। দুই দলের প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষের নির্বাচনী যুদ্ধটি বহুদিন পরে আবারও গণমানুষের রাজনীতিতে নতুন একটি প্রাণের সঞ্চার করেছিল, নির্বাচনও ছিল মোটামুটিভাবে সহিংসতামুক্ত যা দেশের গণতন্ত্রের পথে এক নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে। নির্বাচনে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার জন্য এই দুটি দলের লোকদেরকে আরও অনেক অনেক বেশি সহিষ্ণু ও সত্যনিষ্ঠ হওয়া দরকার। রাজনীতিতে সততা ফিরিয়ে না আনলে দেশ পরিচালনা বা আমলাতন্ত্র, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কোনো কিছুতেই স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ সবই বোঝেন, তাই তাদের স্বার্থের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতা-কর্মীরা যত বেশি মনোযোগী হবেন ততই দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন