বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

সময়ের সাফ কথা.... যাকাত-ছদকা-ফিতরা’র কথা


 অধ্যাপক মো. আক্তার হোসাইন ॥ মানবীয় আমিত্বের পরিপূর্ণ উৎসর্গের নাম যাকাত। মনের মধ্যে স্রষ্টার জন্য মহাশূন্য ভাব জেগে ওঠাই যাকাত। কোন দানকে কুরআনে যাকাত বলা হয়নি। ইসলাম এবং কুরআন নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা বলছেন যে যাকাত মালের সাথে সম্পর্কিত। অথচ কুরআন মাজিদ ঘোষণা করেছে যে, হযরত লুত, হযরত আদম, হযরত ইব্রাহীম এবং প্রত্যেক নবীই যাকাত দিয়েছেন। বিনিময় প্রথা চালু হলো সেদিনের কথা। শতকরা আড়াই টাকা তখনকার দিনে (১৪৫০ বছর আগে) কিভাবে যে দেয়া হতো তা তো সমাজকে বুঝানো যাবেনা। শতকরা আড়াই টাকাকে কুরআনে এমনকি হাদিসেও কোথাও যাকাত না বলে ছদকা বলা হয়েছে। যেখানেই সম্পদের উপর কর দানের প্রশ্ন সেখানেই ‘সাদকা’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। তাছাড়া প্রত্যেক নবীই যদি যাকাত দিয়ে থাকেন তবে হযরত আদম (আ.) কাকে যাকাত দিয়েছিলেন এ প্রশ্নটি এসে যায়? কুরআনে বলা হয়েছে ‘আল্লাজি নাহুম লিজ যাকাতে ফায়েলুন’ অর্থাৎ ‘তারা সদা সর্বদা যাকাতের জন্য কর্মতৎপর থাকেন।’ যাকাত যদি কর হতো তবে তার জন্য বিশ্বাসীরা এটা পরিশোধের জন্য সদা তৎপর না হয়ে বছরে একবার দিয়ে অন্য সময়টা এবাদতসহ নানাবিধ কর্মে নিয়োজিত থাকতেন। তাছাড়া সালাতের সাথে যাকাতের প্রসঙ্গ এসেছে। তাহলে সালাত আর যাকাত একসাথে। সমাজের কথামতো কি ধরে নিতে হবে যে সালাত সবার জন্য আর যাকাত বিত্তবানদের জন্য? অবশ্যই না। সালাতের সাথে যাকাতের কথা বারবার এসেছে এবং একটু তলিয়ে দেখতে গেলে মানুষ দেখতে পারবে যে স্রষ্টার সাথে সংযোগ সাধন ও আমিত্বের উৎসর্গের  বিষয় নানাভাবে নানা মহিমায় স্থান কাল পাত্রভেদে বিভিন্ন রকম দৃষ্টান্তে বলা হয়েছে। প্রশ্ন, তাহলে যাকাত কি? উত্তরটি হলো, মানুষ আল্লাহ্র নিকট থেকে যা কিছু যেমন ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি (চিত্তবৃত্তির সব ধরনের গুণাবলী সবই আল্লাহর দান), আল্লাহর এই দানকে নিজের নিকট না রেখে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করার নামই হলো যাকাত। মানবীয় আমিত্বের আবরণ ক্ষতিকর। মানুষের আমিত্বের আবরণ উন্মোচিত না হলে স্রষ্টার সাথে সংযোগ হবে না। কুরআনে বলা হয়েছে, সালাত কায়েম (সালাত পড়তে বলেনি) কর এবং যাকাত দাও। সালাতের মূল কাজ হলো স্রষ্টার সাথে সংযোগ প্রচেষ্টা। মানবীয় আমিত্বের আবরণ থাকলে সংযোগ হবে না। এগুলো বিসর্জন দিতে হয়। এ কারণে সালাত এবং যাকাত একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রের দরবারী আলেমগণ একে কর হিসাবে আদায়ে ফতোয়া দেয়াতেই বিষয়টি মূল বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা বোঝাতে চাচ্ছেন যে সম্পদ থেকে আড়াই ভাগ দান করলে সম্পদ বৈধ হয়। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি যে মৃত কিংবা জীবিত সকল লোকের সম্পদে গরীব, অভাবী, এতিম, ফকির, মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের হক রয়েছে তখন তা দেবেন কি করে? এরা তখন বলে গরীব মিছকিনকে আত্মীয়স্বজনসহ ডেকে কিছু খাইয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। কোথায় মালের ব্যাপার-অর্থের ব্যাপার আর কোথায় রুহানী তথা আধ্যাত্মিক ব্যাপার। কুরআনে বলা আছে, যে ব্যক্তি সম্পদ জমা করে রাখে তাকে হুতামা তথা জ্বলন্ত আগুনে চিরদিনই জ্বলতে হবে। ধন সম্পদ জমা করে রাখাটাই যেখানে অপরাধ সেখানে ধনের জন্য যাকাতের বিধান আসে কি করে? তাছাড়া এখানে একটা বিষয় কুরআনের আয়াত দ্বারা বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। কুরআনে বলা আছে, ‘আমি কাউকে বেহিসেবী তথা অফুরন্ত রেজেক দেই এবং কাউকে তার রিজিক নির্দিষ্ট করে রেখে দেই।’ এই বেহিসাবী রিজিক পার্থিব মাল বা ধন সম্পদ নয়। আল্লাহ্ যেখানে প্রত্যেকের ধনের পাই পাই করে হিসাব নেবেন বলে জানিয়েছেন সেখানে বেহিসাবী ধন সম্পদ দিয়ে আবার তার হিসাব চাওয়ার প্রশ্ন কেন? যদি বেহিসাবী সম্পদই ধরে নেয়া হয় তবে কেন বলা হলো যে যারা মাল জমা করে এবং গুণে গুণে রাখে তাদেরকে ওয়াইল নামক নরকে জ্বলতে হবে?
সমাজ আসলে কুরআনের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে একত্রে সমাবেশ করে দেখেনা এবং জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে পূর্বে যারা যা বলে গেছেন তাই মেনে নিয়ে কেবল অন্ধকারেই ডুবে আছে। দুনিয়ার সকল ধনীরই সম্পদের নিশ্চয়ই একটা হিসাব আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। তাহলে বেহিসাব কথাটা কাদের বেলায়,  কার জন্য প্রযোজ্য? আল্লাহর রিজিকের অর্থ যদি দুনিয়ার ধন সম্পদই হবে তাহলে আল্লাহ্ তার প্রিয়জনকে এই রিজিক নিশ্চয়ই প্রচুর দান করবেন কিন্তু আসলে তা হয়নি বরং আল্লাহ্ তার খাস বান্দাদেরকে এসব সম্পদ হতে এক রকম প্রায় বঞ্চিত করেই রেখেছেন। কোন্ নবী ধনে ধনী ছিলেন? নবীর কোন্ সঙ্গী সাথী ধনী ছিলেন? যারাও ছিলেন তারা তাদের ধন সম্পদ নবীর কাছে নিয়ে এসে আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে কি বিলিয়ে দেননি? সুরা মরিয়মের ১৩ নং আয়াতটিকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তবে এটা স্পষ্ট হবে যে, যাকাত বলতে কি বোঝায়। এ আয়াতে দু’টো শব্দ আছে একটি হলো ‘হানানান’ এবং অন্যটি হলো ‘জাকাতান’। হযরত ইয়াহিয়া (আ:) এর এমন কি সম্পদ ছিল যে, তাঁর প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যাকাতের প্রশ্ন উঠবে? ‘হানানান’ আসলে মনের গোলযোগ শুন্য একটি শান্ত ভাব। বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে কার্যকারণের কোন গোলযোগ নেই। সৃষ্টির প্রত্যেক স্থানে সবাই ঠিকভাবেই আছে। মনের এই গুণময় ভাবটির নাম হানানান। অতএব যার মাঝে এই হানানান চলে আসে তার মধ্যে কোমলতা প্রকাশ পায়। এই রূপে পরিপূর্ণ প্রশান্তির একটি মানসিক অবস্থার নাম হানানান।  হযরত ইয়াহিয়া (আ.) ছিলেন বৃদ্ধ এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন বন্ধ্যা। এসময় তাঁকে আল্লাহর তরফ থেকে একটি পুত্র সন্তানের খবর দেয়া হয় বলে হযরত ইয়াহিয়ার মন একরাশ প্রশান্তিতে, কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিলো।  হানানান অবস্থাপ্রাপ্ত হলে বিশ্ব প্রকৃতির স্বাভাবিক বিধানের সঙ্গে মনের পূর্ণ সমন্বয় সাধন ঘটে, আমিত্বের আবরণের পরিপূর্ণ একটি উৎসর্গ হয় অর্থাৎ যাকাত হয়ে যায়। সে ব্যক্তি তখন নিজেই তাকওয়ার মূর্ত প্রতীক। এস্থানে হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-এঁর কেবল শোকরানার ভাব, কৃতজ্ঞতার ভাব আল্লাহর রহমতে সিক্ত হবার ভাব। তার মাঝে কোন গর্ব নেই, আমিত্ব নেই আছে কেবল সেজদা আর কৃতজ্ঞতা। তাই, কুরআনের যাকাতকে যারা আয়কর বলেন তারা কিসের ভিত্তিতে বলেন তা বোধগম্য নয়। মানসিকভাবে জীবনের সামগ্রিক উৎসর্গই হলো যাকাত। এটা সাধকের জন্য সালাতের মতোই অবশ্য পালনীয় দেহ ও মনের একটি সার্বিক উৎসর্গ। পরিপূর্ণভাবে যাকাত দেয়া ব্যক্তি জান্নাতবাসী। সূরা তওবার ৬০ নং আয়াতে যে আট জনকে ছদকা দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা ভালো করে খেয়াল করলেই সব রহস্য বের হয়ে যাবে। এখানে হুবহু বাংলা অনুবাদ তুলে দেয়া হলো : ‘ছদকাসমূহ গরীব, মিসছিন, ছদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারী এবং অনুরাগী অন্তর বিশিষ্টদিগের জন্য এবং যারা গোলাম তাদেরকে মুক্ত করবে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্ত করা, আল্লাহর পথ ও পথিকের মধ্যে - এ হচ্ছে আল্লাহর বিধান। আল্লাহ্ বিজ্ঞানময় জ্ঞানী।’ বর্তমান মুসলমান সমাজের শতকরা আড়াই টাকা যদি যাকাত হিসেবে আদায় করা হয় তা খাবে কে?
যে আটজনের কথা বলা হলো তারা ছাড়া অন্য কেউ আছে কি যে অপরের সম্পদের হকদার? ছদকাকে আমরা কেন যাকাত বলে ধরে নিচ্ছি? যাকাত বলতে আমিত্বের আবরণ উন্মোচন, আত্মোৎসর্গ ব্যতীত অন্য আর কোন অর্থেই শব্দটি কুরআনে ব্যবহার হয় নাই। সুরা তওবায় ‘ছদকা’ শব্দটিই আছে যাকাত নেই। কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ছদকা নির্দিষ্ট আটটি খাতে ব্যয় করতে হবে। খাতগুলো হলো ১। অভাবগ্রস্ত প্রার্থীদের জন্য যারা অভাবের কারণে প্রার্থনা করে থাকেন, ২। অভাবীদের জন্য যারা কোন অবস্থাতেই প্রার্থনা করলো, ৩। যারা ছদকা আদায় এবং তা উপযুক্ত স্থানে বন্টন বিষয়ে কর্মচারীরূপে নিয়োজিত থাকবে, ৪। যারা বন্টন বিষয়ে কর্মচারীরূপে নিয়োজিত থাকবে। যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি প্রেমের অতিশয্যে অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থাপ্রাপ্ত হয়ে উপার্জনের কর্তব্য পালনে বিকল হয়ে পড়ে - তাদের জন্য, ৫। বন্দিকে মুক্ত করার জন্য, ৬। ঋণে আবদ্ধ সৎ কর্মশীল কোন ব্যক্তিকেও আর্থিক মুক্তি দেয়া যেতে পারে যদি তা কর্তৃপক্ষ দ্বারা ন্যায়সংগত হয়, ৭। ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রচার কাজে, ৮। পথিকের মধ্যে অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত পথিককে এ ছদকা দেয়া যাবে। এমতাবস্থায় যাকাত শব্দটিকে আমরা কখনো মালের মধ্যে বা অর্থের সাথে মিলাতে পারি না।

আমাদের দেশে ঈদের আগে ফেতরা ধরা হয়। এটা যে কোথা হতে কে আমদানি করলো তা এক বিস্ময়। প্রতিটি মানুষকে পৌনে দুই সের গমের সমপরিমাণ দামে ফেৎরা দিতে হয়। যাকাতও মাল, ছদকাও মাল, ফেতরাও মাল আর সবই যদি মাল আর কর হয় তবে তা তিন নামে আসার যে কোন যৌক্তিকতা থাকে না সেটা সাধারণ পাঠকও বুঝে যাবেন। মাল-অর্থ কামানোর এটা একটা শুভঙ্করের ফাঁকি। তাছাড়া এমনও দেখেছি  যে অনেক লোক স্বর্ণের যাকাত দিতে দিতে মূল স্বর্ণের দামের তিনগুণ বেশিও যাকাত দিয়েছেন।  পবিত্র কুরআন না বুঝে পড়ার খেসারত কতো কাল দিয়ে যাবে এই মুসলিম সমাজ? কুরবানীর মাংস কেন তিনভাগে ভাগ করা হয়? একভাগ নিজের, একভাগ আত্মীয়দের এবং একভাগ প্রার্থীদের জন্য? সম্পদের বেলায় এমনটি হলে অর্থাৎ যা কামাই করবো তার এক ভাগ আমার, একভাগ আত্মীয়দের এবং একভাগ প্রার্থীদের? কারণ, কুরআনে তো বলাই আছে  যে, তোমাদের সম্পদে রয়েছে আত্মীয়, গরীব, ফকির, মিসকিন ও এতিমদের হক। যার যার হক আদায় করে দিলেই তো হয়। সূরা আহ্যাবের ৩৩ নং আয়াতে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মনের কালিমা দূর করতে বলা হয়েছে। এভাবে যদি মানুষ চলতো আর কুরআন নির্দেশিত পথে ব্যবস্থা করতো তবে দুনিয়ার কোন মানুষ অনাহারে থাকতো না। কেউ দশ তলায় আবার কেউ গাছ তলায় থাকতো না। সূরা মুমিনে যাকাতের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করার চেষ্টা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা করছি কি তা? আমাদের ভেবে দেখা দরকার। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন