মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

নেতৃত্বের বেচা-কেনা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য

নেতৃত্বের বেচা-কেনা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য

বর্ষা ॥ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী এবং চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনাকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সম্পর্কে দেশের সাধারণ তথা সচেতন মহলের আগ্রহের শেষ নেই। কারণ, আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের ইতিহাসের পার্থক্য খুব সামান্যই। যদিও দেশ ও দলের চরম ক্রান্তিলগ্নে অর্থাৎ ৭৫-এর ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এত বড় একটা দলের ক'জন নেতা সেদিন খুনীদের বিরুদ্ধে  দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে রাজপথে নেমেছিলেন, আর কেনই বা পারেননি তা বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম ছিলেন জেলখানায় নিহত জাতীয় চার নেতা যারা নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তারা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু তথা দেশবাসীর সাথে কীভাবে এবং কতটুকু আত্মিক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। এক্ষেত্রে আরও ব্যতিক্রম হচ্ছে আওয়ামী লীগের সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত সমর্থক, সাধারণ কর্মী, শ্রমিক, কৃষকসহ খেটে খাওয়া এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক মানুষ  যারা শত-সহস্র প্রতিকূলতার মুখেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দিয়ে এসেছে, যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগের নেতারা সংসদ সদস্য-মন্ত্রী হতে পেরেছেন এবং সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হওয়ার লোভে কিংবা রাষ্ট্রীয় বড় বড় সুযোগ ও পদবী লাভের প্রত্যাশায় ব্যবসায়ী ও আমলাসহ তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের অনেকেই এখন দলটিতে এসে ভীড় করেছেন। বর্তমানে দলের অবস্থা এমনই যে, খোদ আওয়ামী লীগ প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনী মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন যা এদেশের প্রগতিশীল ও মানুষের মুক্তির আন্দোলনের ইতিহাসের জন্য দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। এমনি যখন এদেশ ও রাজনীতির চিত্র তখনই নিজ দলের নেতাদের নিয়ে আস্থাহীনতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৪ই সেপ্টেম্বর রোববার সংসদ অধিবেশন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের সব নেতাকে কেনা যায়।” এদিন সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের বিল নিয়ে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন হয়, যে উদ্যোগের সমালোচনা ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যেও। অধিবেশন শেষে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাছান মাহমুদ, দবিরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন খসরু, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে এগিয়ে বিচারপতিদের অপসারণ সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে কথা বলছিলেন।
একই সময় প্রধানমন্ত্রীর পেছনের আসনে থাকা প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সামনের সারিতে বসা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চান।
কয়েকজন সংসদ সদস্য সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের অবস্থান তুলে ধরে বিচারপতিদের সরানোর ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরানো নিয়ে বিভিন্ন জটিলতার কথা বলছিলেন।
শেখ হাসিনা তখন অধিবেশন কক্ষ থেকে বের হতে হতেই বলেন, “আওয়ামী লীগের সব নেতাকে কেনা যায়। এটাই সমস্যা। শেখ হাসিনা ছাড়া।” তার এই কথা সংসদের গ্যালারি থেকেও শোনা যাচ্ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য যে, ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন, 'বাংলার কৃষক ভাল, বাংলার শ্রমিক ভাল। যদি খারাপ হই-তবে আমরা এই তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। করাপশন বাংলার কৃষকরা করেনা, মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ-যারা ওদের টাকা দিয়েই লেখাপড়া শিখেছি'। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল এদেশের দুঃখী মানুষর মুখে হাসি ফুটানো। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও এদেশে যেখানে এখনো কোটি কোটি মানুষ বাস করে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে। দুর্নীতি, অন্যায়, শোষণ, মিথ্যাচার, ধর্ম ও শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য যখন এদেশে এখনো প্রাত্যহিক বিষয় সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা এবং শিক্ষিত সমাজ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর কন্যার বক্তব্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয় রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা দিয়ে কেনা গেলে অন্য দলের নেতাদের কাছ থেকে জাতি কী আশা করতে পারে? কারণ, টাকা তো আর সাধারণ মানুষের কাছে থাকেনা। এদেশের টাকা এখন চলে গেছে নব্য লুটেরা-ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ, ধর্মজীবী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে। সমাজের এই অপগোষ্ঠীর কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে গেলে সমাজ ও জাতির জন্য আরও অধপতন নেমে আসতে বাধ্য। তাই আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পর্কে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্য এক দিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, অন্য দিকে অনেক বেদনায়ক। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অনেক দুঃখ থেকে তাঁর দলের নেতাদের সম্পর্কে এইসব কথা বলেছেন। নেতাদের এই অবস্থা শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, অন্য যেকোনো বড় দলের অনেক নেতার সম্পর্কেই এই জাতীয় মন্তব্য উঠে আসবে গবেষণা করা হলে। তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পর্কে এই জাতীয় মূল্যায়ণ নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী আমলে বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এই দলটির অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রচার ও প্রসারের জন্য যেসব নেতা-কর্মী ও সংগঠক কাজ করে গেছেন তারা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন দেশ ও মানুষের প্রতি, কোনো স্বার্থ কিংবা টাকা-পয়সার কাছে তারা কখনো বিক্রি হয়ে যাননি। ওইসব নেতাদের অবদানেই এদেশের মানুষ আজ স্বাধীন দেশে বাস করছে। এই দলেরই অনেক নেতা বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি স্বার্থ কিংবা অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে দল, দেশ এমনকি বঙ্গবন্ধুর সাথে বেঈমানী করেছিল, আজ তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে আজকের দিনের আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আর না হলে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া নেতাদেরকে  দল থেকে বের করে দিতে হবে।

জাতির বিবেকের কাছে আজ প্রশ্ন উঠে এসেছে টাকার কাছে বিক্রি হওয়া নেতাদের দিয়ে দেশের উন্নতি কতটুকু সম্ভব? তাই দলে চালাতে হবে শুদ্ধি অভিযান। শুদ্ধ চিত্তের অধিকারী, ত্যাগী এবং গণমানুষের সাথে যাদের সম্পৃক্ততা আছে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান করে দিতে হবে। নচেৎ, সামনের দিনগুলোতে আরও ভয়ংকর পরিণতি জাতিকে এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বহন করতে হতে পারে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন