বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

অঙ্গে আমার বঙ্গ রক্ত বহে....

অঙ্গে আমার বঙ্গ রক্ত বহে....

শেখ উল্লাস ॥ বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য অন্যূন তিন হাজার বছরের। সেই ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে আজীবন ব্যাপৃত একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, অধ্যক্ষ শেখ আবু হামেদ-এঁর ভাষায়-'নবী নূহের কথা বলছি- চার ছেলে তাঁর- সাম, হাম, ইয়াফেস ও কেনান- অবুঝ অবাধ্য কেনান, প্লাবনে সেনান করে দিয়েছিল প্রাণ। আর সাম, হাম ও ইয়াফেসের বংশধর পৃথিবীতে আজও বেঁচে আছে। পৃথিবীর বুকে মানুষের দ্বিতীয় পত্তনে হামের অধস্তন হিন্দ যখন সিন্ধুর তীরে বসতি নামায় তারও কিছুকাল পরে- হামের অধস্তন আরেক পুরুষ বঙ্গ-হিন্দের সন্তান অথবা সন্তানের সন্তান গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে ছিল তারই আবাদী আবাস। পিতা বঙ্গের বংশধরেরা বৃদ্ধি পেয়ে গড়েছে সভ্যতা কালে কালে। পদ্মা-যমুনা-মেঘনার বাঁকে বাঁকে তাঁরই নামে আজ সাগরের নাম, তিনিই জনক বাঙালির। তাঁর গড়া রাষ্ট্রের নামই বঙ্গ। ব-দ্বীপের পললে পললে-পললের রন্ধ্রে রন্ধ্রে-সন্তান-সন্ততীর তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে আজও পিতা বঙ্গের সূত্র গাঁথা। যুগে যুগে তাই বিস্মিত বিশ্ব দেখে বঙ্গের সন্তানের কন্ঠে ধ্বনিত হয় সাহসী বারতা....অঙ্গে আমার বঙ্গ রক্ত বহে, আমরা যে ভাই নবী নূহের আদূরে তনয় সাহসী হামের কওম। বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা আমাদের রাজধানী আজ বাঙালি সভ্যতার ভিত। বঙ্গভবন হেথা পেয়েছে নতুন সাজ, এ যুগে জাতির নতুন স্থপতি বঙ্গবন্ধু ভবনও সেখানে আছে। ভূবন বঙ্গে আমরা অযুত বঙ্গ তনয় আজিকে সত্যি সাহসী নির্ভীক অকুতোভয়। পিতা বঙ্গ আমাদের রাষ্ট্রের জনকই শুধু নন-তিনিই করেছিলেন আমাদের একেশ্বরবাদী সংস্কৃতির গোড়াপত্তন।' অর্থাৎ, বাঙালি জাতির আদি পিতার নাম বঙ্গ এবং তিনি একেশ্বরবাদী ছিলেন। একেশ্বরবাদীরা স্বভাবতই সুন্দর ও শান্তির পূজারি। তারা মগ্ন থাকেন এক চিন্তায়, এক ধ্যানে, অনুসারী হন সরল ও সত্য পথের। প্রকৃতিই এখানকার মানুষকে সরল ও স্বাভাবিক জীবন দান করেছে। কালের বিবর্তনে তাই দেখা গেছে, শাসন ক্ষমতার মালিক হয়েও অনেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সূফী-দরবেশ হিসেবে। বাগেরহাটের সূফী সাধক খান জাহান আলী এঁদের একটি উদাহরণ। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে (১৪৯২-১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দ) শ্রী চৈতন্য বাংলায় প্রচার করেছিলেন বৈষ্ণব ধর্ম। বিভিন্ন সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে এ অঞ্চলের মানুষের সরল ও শান্তির পথ বিঘ্নিত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী মোগল, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানী শাসনামলের কুপ্রভাব হিসেবে এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষদের ওপর যে ধাক্কা লাগে তার পরিণতি আজও ভোগ করতে হচ্ছে এদেশের জনগণকে। বিশেষ করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একশ' বছরের শাসনের সময় (১৭৫৭-১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ) এদেশে ইংরেজদের তৈরি তল্পিবাহক অর্থাৎ, দালাল গোষ্ঠীটিই পার্থিব সব ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জন করে। নব্য জমিদার ও তাদের তল্পিবাহক নতুন নতুন গোষ্ঠী, পরিবার ও ব্যক্তির আধিপত্য কায়েম হয়। এ অঞ্চলের সূফীবাদী ও শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো ওইসব আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম  করেছে বিভিন্ন সময়ে। অপরদিকে, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ আমলে এ উপমহাদেশে শত শত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ধর্মশিক্ষার নামে মানুষকে ধর্মান্ধতার পথে ধাবিত করা হয়েছে। অথচ এদেশের মানুষকে শাসন ও শোষণ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় আজও এ অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে ধর্মভীরু ও ধর্মান্ধদের সংখ্যাটাই বেশি। সমাজে ধার্মিক মানুষের সংখ্যা সব সময়ই খুবই কম। এভাবে  সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তি ধর্মের নামে গান গেয়ে মানুষকে ঘুম পাতিয়ে রেখেছে। যখনই কেউ শাসন ও শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির কথা বলেছে তখনই শাসকবর্গ থেকে 'ধর্ম গেল' বলে জিগির তোলা হয়েছে। দেশের কথা, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা যখনই বলা হয়েছে, তখনই সেখানে ধর্ম প্রসঙ্গ আনা হয়েছে, দেশপ্রেমকে ধর্মবিরোধী কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এমনি করে মহাকালের বহু বাঁক অতিক্রম করে ১৯৭১'র ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন এবং তাঁরই ডাকে এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় এগিয়ে আসলেন, যে ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনী ২৫শে মার্চ বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে গণহত্যা চালালো তখনই সাম্রাজ্যবাদের সেই তল্পিবাহকদের প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হলো। এদেরই কেউ কেউ গিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানালো এবং অন্য কেউ গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলো এবং তাদের অনুগতদের দিয়েই সারা দেশে তৈরি হলো শান্তিকমিটি, রাজাকার-আলবদর-আলশামস্‌ যারা এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো ৯টি মাস ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতা চালিয়েছিল এদেশের মানুষদের ওপর, ঘৃণ্য সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে আজো তারা টিকিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও তারা ক্ষমা চায়নি তাদের বর্বর ভূমিকার জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, তারা বা তাদেরই বংশধর বা অনুচরেররা মিশে আছে এদেশেরই বিভিন্ন ক্ষেত্রে-রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, গণমাধ্যমসহ সর্বস্তরে। এদেরকে আজো সনাক্ত করা হয়নি যা দুভার্গ্যজনক বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।

এই অবস্থারই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত ১১ই সেপ্টেম্বর বৃহষ্পতিবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিহ্নিত রাজাকার-আল-বদর-আলশামস বাহিনী প্রধানদের দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে বিচারকার্য শুরু করা হবে। ভবিষ্যতে রাজাকার-আলবদর ও মানবতাবিরোদীদের উপজেলা ভিত্তিক তালিকা করার বিষয়েও মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় আরও বলেছেন, 'পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী মানব ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত করে বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল বধ্যভূমিতে। বাঙালি জাতি পাকিস্তানী বাহিনীর এই ঘৃণ্য বর্বরতাকে কখনও ভুলবেনা। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের এ জাতি মনে রাখবে আজীবন, স্মরণ করবে অনন্তকাল। আগত প্রজন্মের কাছে  মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি'। এদেশের শান্তিপ্রিয় বিবেকবান মানুষ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর এইসব কথায় আশাবাদী হয়ে থাকতে চায়। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে জালিয়াতির বিরুদ্ধে এই মন্ত্রীর নেয়া বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ইতোমধ্যে বিবেকবান মহলে প্রশংসা পেতে শুরু করেছে। অস্বীকার করার  কোনো উপায় নেই যে, রাজাকার-আলবদর-আলশামস ছাড়া এদেশের মানুষ সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য অবদান রেখেছিল এবং এই অর্থে সেই মানুষদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা, তবে যারা সেদিন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে  মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল, প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, সংসারধর্ম ছেড়ে দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিল, তারা এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, তারা মুজিবনগর কিংবা মুক্তিবাহিনীর লোক হিসেবে পাকিস্তানীদের কাছে তালিকাভুক্ত ছিলেন। দেশ স্বাধীন না হলে তারা কখনো স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারতেন না। এর বিপরীতে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন দিনগুলোতে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তা করেছিল, রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে ঘৃণ্য বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছিল তারা বাঙালি নামের কলঙ্ক, এক আল্লাহ্‌ বা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলে তারা কখনো নিজের জাতির সাথে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারতো না। তারা একেশ্বরবাদী বাঙালি চেতনারই শত্রু। সে কারণেই সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি রাজাকারদের তালিকা তৈরি এবং তা সর্বত্র প্রচার ও প্রকাশের ব্যবস্থা করাও আজ জরুরি। ভুলে গেলে চলবে না যে, হাজার হাজার রাজাকার ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র ও তার সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে টিকিয়ে রাখার জন্যই তারা শপথ নিয়েছিল। তারা তাদের শপথ থেকে এক বিন্দুও সরে গেছে বলে মনে করা এতদিন ভুল হয়েছে, সেই ভুলের খেসারত বাঙালি জাতি আর দিতে চায় না। উদারতা, সরলতা, শান্তি ও সত্যবাদিতার মধ্যেই প্রোথিত বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের শিকড়, এই ঐতিহ্যে কলঙ্ক লেপন করেছে রাজাকারেরা। সুতরাং এই রাজাকারদেরকে তালিকা করে নতুন প্রজন্মকে চিনিয়ে না দিলে সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাঙালি জাতির সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে পড়তে পারে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন