মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

দেশে দারিদ্র সীমার নীচে কয়েক কোটি মানুষ

দেশে দারিদ্র সীমার নীচে কয়েক কোটি মানুষ

শামসুর রহমান ॥ আমাদের চকচকে আধুনিকতা আর বিলাসিতার ছায়ার নীচে বাস করছে হত-দরিদ্র কয়েক কোটি ক্ষুধার্থ মানুষ। এমন কথা শুনলে যে কেউ আঁতকে উঠতে পারেন। সম্প্রতি এক নিরীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। ঢাকা শহরেই এ সংখ্যা প্রায় দেড়-কোটি আর শতাংশের হিসেবে প্রতি এক’শ জনে প্রায় ৩৩ জন। দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের তালিকায় পরের অবস্থান চট্টগ্রামের। এ বিভাগে প্রায় ৮৩ লাখ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করছে। অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে এ দুটো বিভাগের উন্নয়ন অবদান ঈর্ষা করার মতো। জিডিপিতে ঢাকা ৩৬ এবং চট্টগ্রামে ১১ শতাংশ যোগান দিচ্ছে। অথচ এ দুটো শহরেই দারিদ্রসীমার নীচের মানুষের বসবাস সবচেয়ে বেশি। ভরপেট খেতে পায় না প্রতিদিন, এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছেই। সম্প্রতি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), বিশ্ব-ব্যাংক এবং ডব্লিউ-এফ-পি’র এক যৌথ পরিসংখ্যানে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। এতে গড় দারিদ্র সীমার হার ২০১০ সালে গেল ২০০৪ সালের চেয়ে আশংকা জনক হারে বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
দারিদ্রসীমা মানচিত্রে এবার নিয়ে ২০০৪ হতে তৃতীয় দফায় প্রাকাশিত সূচকে দেখা গেছে, দেশে দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা মানুষের হার বেড়েছে। এতে আরও কয়েকটি বিষয় নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যেমন দারিদ্রসীমায় বাস করা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ ও এর প্রতিকার। সেই সাথে বিষয়গুলো অবস্থাগত উত্তোরণের পথ খুঁজতে সবচেয়ে জরুরী বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকগণ। বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসাইনের মতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে অর্থনীতি চাঙ্গা থাকায় হত-দরিদ্র মানুষের চাপ বেড়েছে। বিভাগীয় এ দুটো শহরে চাপ বেড়ে যাওয়ায় সূচকে এ হারও বেড়েছে। যদিও এটাই স্বাভাবিক, তারপরও বিষয়টি সমাধানে নতুন পথ বের করতে হবে বলে মনে করেন বিশ্ব-ব্যাংকের আবাসিক এ শীর্ষ অর্থনীতিবিদ। যথাযথ অর্থনৈতিক সুবিধা বঞ্চিত ও প্রকৃত পরিচর্যার অভাবে এই হার বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্রসীমার সূচক বেড়েই চলেছে। যৌথ-পরিসংখ্যান প্রকাশের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এসব কথা বলেন তিনি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মাইগ্রেশনের কারণে উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার আশংকা পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো উল্লেখ করা হয়, আন্ত-মাইগ্রেশনের হার কমিয়ে অর্থনৈতিক রূপরেখায় উন্নয়নসহ স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি সহ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার উত্তরণ ঘটিয়ে এ দারিদ্রসীমা  হ্রাস করা যেতে পারে। যেখানে আন্ত-শহুরে অভিবাসন চেতনাকে হ্রাস করা যেতে পারে। সুষ্ঠু অর্থব্যবস্থাপনাই এ হার কমিয়ে প্রায় নীচের দিকে নিয়ে যেতে কার্যকর ভূূমিকা রাখবে বলে পর্যবেক্ষণে বলা হয়। গেল দেড় দশকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসের হার কমিয়ে আনার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালে দারিদ্রসীমার হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশে। বর্তমানে সে হার কমিয়ে আনায় ৩১.৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে, ১৫.৬৪ কোটি লোক অনগ্রসর মাত্রার কাছাকাছি আছে। এ অনগ্রসর অর্থনৈতিক অবস্থা শুধু অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিস্তারের কারণেই ঘটেছে বলে পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়। দারিদ্রসীমা মানচিত্র ২০১০ অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলীয় বিভাগ রংপুর ও দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভাগ বরিশালে যথাক্রমে ৪২ এবং ৩৮.৯ শতাংশ বিরাজ করছে।  সেখানে চট্টগ্রামে ২৬.১ ও সিলেটে এ হার মাত্র ২৫.১ শতাংশে রয়েছে। পরিসংখ্যানে এ অঞ্চলের প্রতি এক’শ জনে দারিদ্রসীমা বিবেচনা করে তৈরি করা হয়। মানচিত্রে আরও দেখানো হয় যে, ঢাকা বিভাগীয় দশ উপজেলায় ৫৫ শতাংশ যা অন্য দশ উপজেলার তুলনায় ৪ শতাংশ কম মাত্রায় রয়েছে। এ বিভাগে ঢাকা জেলার সবচেয়ে কম দারিদ্র-সূচক যেখানে শরিয়তপুর সবচেয়ে বেশি মাত্রায় রয়েছে বলে পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫০ শতাংশ বা অতিমাত্রায় দারিদ্রসীমার হার পাওয়া গেছে ছ’টি উপজেলায়। বাকী সবগুলোয় এ হার প্রায় ৪ শতাংশ কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিক দিয়ে সবচেয়ে স্বচ্ছল সিলেট শহরের অবস্থান বেশ সু-সংহত। গোয়াইংহাট উপজেলায় মানুষ ৫০ শতাংশ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করছে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে খুলনা অঞ্চলের তিনটি উপজেলায় এ হার প্রায় ৫০ শতাংশ হারে রয়েছে বা তার চেয়ে কিছু বেশিও হতে পারে বলে পরিসংখ্যানে বিবেচিত হয়েছে।
রংপুর বিভাগে সাত উপজেলায় এ হার প্রায় দ্বিগুণ। সম্মিলিত ভাবে গড়ে ৩০.৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে রয়েছে। কুড়িগ্রামকে সবচেয়ে দরিদ্র জেলা হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয় এ এলাকার প্রতি একশ জনের ৬৩ জন দারিদ্রসীমার নীচে বাস করছে। অপরদিকে, কুষ্টিয়ায় ৯৬.৪ শতাংশ ধনবান লোক, যারা দারিদ্রসীমার উপরে রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের দারিদ্রসীমা হারে, সাতটি বিভাগের সর্বোচ্চ হার, ঢাকা বিভাগে ৩২.৩ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সিলেট বিভাগে ৫.৭ শতাংশ। অপর বিভাগ গুলোর মধ্যে বরিশাল ৭.৩ শতাংশ, খুলনা ১১.৪ শতাংশ, রাজশাহী ১১.৬ শতাংশ, রংপুর ১৫ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ১৬.৮ শতাংশ হারে দারিদ্রসীমার নিচে মানুষ বাস করছে। সমষ্টিগত ভাবে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গেছে।

সব মিলিয়ে  দেশের ৫’শ ৪৪ উপজেলার মধ্যে ৫১ উপজেলায় ৫০ শতাংশ বা তার কিছু বেশি এ সীমার উপরে বাস করছে, বাকী ৯৫ উপজেলায় এ হার মাত্র ১৫ শতাংশ বা তারচেয়েও কিছু কম বলে পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়। দারিদ্রসীমা চিহ্নের মানচিত্রে উচ্চমাত্রায় দুর্যোগপূর্ণ এলাকা নির্বাচিত করা হয় যমুনা নদী সংলগ্ন এলাকাকে। এ নদীকে যুক্ত রেখে আশ-পাশের জেলাগুলো সবথেকে বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থায় থাকছে। বন্যা ও খরার প্রভাবে এ এলাকা সংলগ্ন মানুষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মাত্রায় অনেক বেশি। এর উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ঘুর্নিঝড় লোনা-পানির প্রভাবে উন্নয়ণ ব্যহত হওয়ায় অর্থনৈতিক ভাবে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুক্ষীণ হয়। বিশ্ব ব্যাংকের অপর অর্থনীতিবিদ সালমান জায়িদী মনে করেন, বাংলাদেশ এ মানচিত্র অনুসারে হত দরিদ্র মানুষের সমস্যা আরও ভালকরে উপলব্ধি করতে পারবে। যা কিনা দেশের দারিদ্রসীমার হার কমিয়ে আনতে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব ব্যাংক সহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো এ পরিসংখ্যাণ ও মানচিত্রের উল্লিখিত হার পর্যবেক্ষণ করেই তৃণমূল পর্যায়ে শিশু ও নারীদের সাবলম্বী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাজ করেন। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ডাব্লিউএফপির আবাসিক প্রতিনিধি চিষ্টার রেডার মনে করেন, এমন পরিসংখ্যাণ একটা দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এতে করে তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্রপীড়িত অঞ্চলগুলোয় কাজের বিনিময়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায়, অগ্রণী ভুমিকা রাখতে সহজে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যায়। একই সাথে দারিদ্রসীমার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন