বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

মানুষকে চেনাই শান্তি ধর্মের লক্ষ্য




সংলাপ ॥ কুরআন মতে, বিশ্বের সব মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। মানবজাতি আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়ার সন্তান। কালের প্রবাহে বংশবৃদ্ধির কারণে মানুষ বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হয়েছে। নবী করীম (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর কন্ঠে ঘোষিত হয়েছে শান্তিধর্মের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত - ‘হে মানবজাতি! তোমাদের  রব একজন, তোমাদের আদি পিতা একজন এবং তোমরা সকলেই আদমের সন্তান।’ সকল মানুষ একই উপাদানে, একই লক্ষ্যে সৃষ্ট। বিশ্বের সকল জাতি-সম্প্রদায় ও বর্ণের মানুষ আল্লাহ্ তায়ালার বৃহৎ পরিবারভুক্ত। তাই মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষই সমান মর্যাদা, সম্মান ও অধিকার পাবার যোগ্য। আল্লাহ্ তায়ালার নিকট সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা প্রিয় যে ব্যক্তি তার বৃহৎ পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক রাখে ও সদাচরণ করে। দ্বীনের নবী (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক) ঘোষণা দিয়েছেন - ‘আদম সন্তানেরা সবাই সমান। তাকওয়া ব্যতীত তাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই।’ মানুষে মানুষে পার্থক্য হয়, কে কি গুণ অর্জন করতে পেরেছে, কার মধ্যে মনুষ্যত্ব কতটা বিকশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে। জাতি-বর্ণ-ভাষা মানুষের মর্যাদার মানদ- নয়। রসুল (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক) ঘোষণা করেছিলেন - ‘আজ থেকে বংশগত কৌলীন্য বিলুপ্ত হলো। সে-ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে স্বীয় কর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। আরবদের ওপর অনারবদের, সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই’।
এ ঘোষণার মাধ্যমে তিনি (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক) জাতি, বর্ণ এবং বংশগত কৌলীন্য ভেঙ্গে বিশ্বনবী হলেন। বিশ্বনবী আবদ্ধ থাকতে পারেন না রক্ত, বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠী, ভাষা কিংবা রাষ্ট্রের প্রাচীরে। বিশ্বনবী আরবীয়, ভারতীয়, কিংবা মিসরীয়দের নবী নন, তিনি সমগ্র মানব জাতির নবী। যারা তাঁকে গোষ্ঠী, বর্ণ, দেশ ও জাতির ঊর্ধ্বে পথপ্রদর্শক হিসেবে মানে তারাই মুসলিম। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র, ভৌগোলিক সীমারেখা বা বংশ পূজারীরা কখনও আল্লাহর পূজারী  হতে পারে না।
কুরআন মতে আল্লাহ্ তায়ালা সকল মানুষের রব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানব জাতির পালনকর্তা তিনি। তাঁর পালনকর্মে কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। কোন দেশ, সম্প্রদায় বা জাতি দাবি করতে পারে না যে, আল্লাহ্ তায়ালা কেবল তাদের। তিনি সমানভাবে সকলের, সমগ্র সৃষ্টি জগতের। আল্লাহ্ তায়ালা বিশ্বজনীন তাই তাঁর নবী-রসুলগণও বিশ্বজনীন। নবী-রসুলগণের আগমন ঘটেছে বিভেদ তৈরির জন্য নয়, বিভেদের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য, বিচ্ছিন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। মহান সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি গোত্রের কাছে সমসাময়িক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে স্থানীয় ভাষায় পথপ্রদর্শকরূপে মনোনীত ব্যক্তিকে পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন ঐশী বাণী। সুরা ইব্রাহিমের ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে - ‘আর আমি প্রত্যেক রসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ এসব প্রত্যাদেশে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। সময়ের প্রয়োজনে প্রকাশভঙ্গিতে কিছু তারতম্য আছে মাত্র। আল্লাহ্ বলেছেন - ‘তোমাদের জন্য সেই বিধানই দেয়া হয়েছে, যা নূহকে দেয়া হয়েছিল এবং যা তোমাকে প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, তাই প্রত্যাদেশ করা হয়েছিল ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসাকে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করো, এবং তাতে কোন দ্বিমত সৃষ্টি  করো না’ (৪২ : ১৩)। সুরা আলে ইমরানের ৮৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে - ‘বলো আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ্তে আর যা আমাদের কাছে অবতীর্ণ হয়েছে, আর যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহিম, আর ইসমাইল আর ইসহাক আর ইয়াকুব আর গোত্রদের কাছে; আর যা দেয়া হয়েছিল মুসাকে আর ঈসাকে আর পয়গম্বরদের তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে, তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য আমরা করি না।’ পৃথিবীর সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি এই হচ্ছে কুরআনিক সিদ্ধান্ত। কুরআন কোন সাম্প্রদায়িক বিধান নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসৃতব্য বিধান। কুরআন মতে, সকল নবী রসুল একই ধর্ম প্রচার করেছেন। ১ লক্ষ ২৪ হাজার বার্তাবাহক তাঁদের সময়ের প্রতিনিধি। যখন কেউ কুরআন মেনে মুসলিম হয়, তখন সে আল্লাহ্ ও নবীর (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর প্রকৃতি অনুসরণ করে বিশ্বমানব হবার চেষ্টায় রত থাকে। তার আর কোন দেশ থাকে না, গোষ্ঠী থাকে না, জাতি থাকে না। বিশ্বমানব না হয়ে কেউ সত্যিকারের মুসলিম হতে পারে না।
কুরআন সমগ্র মানব জাতিকে শান্তিতে বসবাসের পথনির্দেশ দিয়েছে। কোন সম্প্রদায় বা ব্যক্তি মানুষের উপর অন্যায় আচরণ ও জুলুমকে ইসলাম সমর্থন করে না। মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ্ তায়ালা ইচ্ছা করলে সবাইকে একই ধর্মের অনুসারী বানাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নিজেই যেহেতু মানুষকে বিভিন্ন ধর্ম মতে বিভক্ত করেছেন তাই আমাদের কোন ধর্মের অনুসারীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা মোটেও ঠিক নয়। আমরা যদি সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করি এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালোবাসতে পারি তবেই পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হতে পারে। বাংলাদেশ ও বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধর্ম-বর্ণ-জাতি ইত্যাদি মনোভাবে বিচ্ছিন্ন মানবজাতি ঐক্যবদ্ধ হলেই শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন